হেনরিক ইবসেন

নরওয়েজীয় লেখক (1828–1906)

হেনরিক যোহান ইবসেন (জন্ম মার্চ ২০, ১৮২৮ – মে ২৩, ১৯০৬) একজন স্বনামধন্য নরওয়েজীয় নাট্যকার যিনি আধুনিক বাস্তবতাবাদী নাটকের সূত্রপাত করেছেন। তাকে সম্মান করে বলা হয় আধুনিক নাটকের জনক[] ইবসেন নরওয়ের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ লেখক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাট্যকার হিসেবে আসীন। তিনি নরওয়ের জাতীয় প্রতীকে পরিণত হয়েছেন বলা যায়।[]

হেনরিক ইবসেন
জন্মমার্চ ২০, ১৮২৮
সিয়েন, নরওয়ে
মৃত্যুমে ২৩, ১৯০৬
ক্রিস্টিয়ানিয়া
ছদ্মনামBrynjulf Bjarme (প্রাথমিক কাজ)
পেশানাট্যকার, কবি, মঞ্চনাটক পরিচালক
জাতীয়তানরওয়ে নরওয়েজীয়
ধরনসামাজিক বাস্তবতাবাদ
উল্লেখযোগ্য রচনাবলিপিয়ার গিন্ট (১৮৬৭)
আ ডলস হাউজ (১৮৭৯)
গোস্টস (১৮৮১)
দ্য ওয়াইল্ড ডাক (১৮৮৪)
হেড্ডা গ্যাবলার (১৮৯০)

তার যুগে তার নাটককে রুচিশীল ভাবা হত না, কেননা তখন পারিবারিক জীবন ছিল ভিক্টোরীয় আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং এ আদর্শের বাইরে কিছু করাকে ভাল চোখে দেখা হত না। ইবসেনের কর্ম মানবচরিত্রের বিভিন্ন বাস্তব দিক সম্পর্কে কথা বলে।

ইবসেন আধুনিক মঞ্চনাটক প্রতিষ্ঠা করেছেন সামাজিক মূল্যবোধের বিভিন্ন উপাদানকে সমালোচকের দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করে। ভিক্টোরীয় যুগে নাটকগুলো কেবল সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে কথা বলবে এমন ভাবা হত; যেখানে সত্য সর্বদাই কালো শক্তির বিরুদ্ধে জয়লাভ করবে এবং সব নাটকই তৎকালীন সামাজিক মূল্যবোধের গুণগান গেয়ে শেষ হবে। ইবসেন এই ধারার বিপক্ষে যেয়ে নাটকের সমাপ্তিতে বৈচিত্র্য আনেন এবং নতুন ধারার জন্ম দেন। শেক্সপিয়ারের মতো ইবসেনকেও ইউরোপীয় ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

পরিবার ও যৌবন

সম্পাদনা

নরওয়ের শিয়েন এলাকার সচ্ছল ব্যবসায়ী পরিবারে ইবসেনের জন্ম হয়। তার বাবা নুড ইবসেন ও মা ম্যারিচেন অ্যাটেনবার্গ। তাদের জাহাজে করে কাঠ পরিবহনের ব্যবসা ছিল। নরওয়ের প্রাচীন ও স্বনামধন্য পরিবারের একটি ছিল ইবসেনের পরিবার। জর্জ ব্র্যান্ডেসের কাছে লেখা এক চিঠিতে ইবসেন তার পরিবারের কথা প্রকাশ করেছেন। তার জন্মের কিছুদিন পরেই তার পরিবারের আর্থিক অবস্থার বেশ অবনতি ঘটে। তার মা দুঃখ থেকে বাঁচার আশায় ধর্মে মনোনিবেশ করেন। তার বাবা বিষন্নতার শিকার হন। একারণে তার রচিত চরিত্রগুলোর মাঝে তার বাবা-মায়ের ছায়া লক্ষ্য করা যায়। আর্থিক সঙ্কটের কারণে মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় তার নাটকের একটি প্রধান ভাব। এছাড়া মানুষের গোপন ঘটনার কারণে দ্বন্দ্ব্বও তার রচনার আরেকটি প্রধান বিষয়।

পনের বছর বয়সে ইবসেন ঘর ছাড়েন। ফার্মাসিস্ট হওয়ার মানসে তিনি ছোট্ট শহর গ্রিমস্টাডে আস্তানা গাড়েন এবং এখানেই তার নাটক লেখার সূত্রপাত হয়। ১৮৪৬ সালে তিনি এক গৃহ পরিচারিকার গর্ভে অবৈধ সন্তানের পিতা হন কিন্তু তার পিতৃত্ব তিনি অস্বীকার করেন। ইবসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির উদ্দেশ্যে তৎকালীন ক্রিস্টিয়ানিয়ায় (বর্তমান অসলো) যান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার চিন্তা বাদ দিয়ে (তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার প্রাথমিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, কেননা তিনি ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি) নাটক রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। তার প্রথম উপন্যাস ক্যাটিলিনা (১৮৫০) একটি বিয়োগান্তক উপন্যাস, যা তিনি Brynjulf Bjarme ছদ্মনামে প্রকাশ করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। তবে এই নাটক মঞ্চায়িত হয় নি। তার প্রথম মঞ্চস্থ নাটক হচ্ছে দ্য বুরিয়াল মন্ড (১৮৫০), যা খুব কমই নজর কেড়েছে। তবুও নাট্যকার হওয়ার রাস্তা থেকে ইবসেন পিছু হটেননি। এই নাটকগুলোর পর কয়েক বছরে ইবসেন কিছুই প্রকাশ করেননি।

জীবন ও সাহিত্য

সম্পাদনা

বার্গেনের একটি নরওয়েজীয় নাট্যগোষ্ঠীতে তিনি পরবর্তী কয়েক বছর চাকরি করেন। এখানে তিনি ১৪৫টিরও বেশি নাটকে নাট্যকার, পরিচালক এবং প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছেন। এ সময়ে তিনি তার নতুন কোন নাটক প্রকাশ করেননি। নাট্যকার হিসবে সাফল্য লাভে ব্যর্থ হলেও এই গোষ্ঠীতে তিনি অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চার করেছেন যা পরবর্তীকালে তার লেখার কাজে এসেছে।

ইবসেন ১৮৫৮ সালে ক্রিস্টিয়ানিয়াতে আসেন এবং ক্রিস্টিয়ানিয়ার জাতীয় থিয়েটারের সৃজন পরিচালক নিযুক্ত হন। তিনি সুজানা থোরেনসেন নামীয় ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করেন, যার গর্ভে তার একমাত্র সন্তান সিগার্ড ইবসেন জন্ম নেয়। এই দম্পতি খুবই অর্থকষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করেছেন এবং নরওয়ের জীবন নিয়ে ইবসেন খুব হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। ১৮৬৪ সালে তিনি ক্রিস্টানিয়া ত্যাগ স্বেচ্ছা নির্বাসনে ইতালি চলে যান। তিনি এর পরের ২৭ বছর আর স্বদেশে ফিরে আসেননি। যখন ২৭ বছর পর তিনি দেশে ফিরেন, ততদিনে তিনি নাট্যকার হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেছেন।

তার পরবর্তী নাটক ব্র্যান্ড (১৮৬৫) তাকে সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়, যেটির জন্য তিনি ছিলেন ক্ষুধার্থের মত অপেক্ষা করছিলেন। এটি তাকে আর্থিক সফলতাও এনে দেয়। ১৮৬৭ সালে তিনি প্রকাশ করেন পিয়ার গিন্ট, যেটির সুরারোপ করেছেন জনপ্রিয় সুরকার এডভার্ড গ্রেগ। যদিও ইবসেন আগেই ডেনীয় দার্শনিক কিয়েরকেগরের রচনার সাথে আগেই পরিচিত ছিলেন, তবুও তার ব্রান্ড নাটকের আগে তার প্রকাশ দেখা যায় নি। এরপর থেকে কিয়েরকেগরের আদর্শ নিয়ে তিনি গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেন। প্রথমে তার বন্ধু জর্জ ব্রান্ডেস ইবসেনের সাথে কিয়েরকেগরের তুলনা করলে ইবসেন বিরক্ত হয়েছিলেন। ইবসেন পরে কিয়েরকেগরের রচনায় আকৃষ্ট হন এবং Either/Orফিয়ার এন্ড ট্রেম্বলিং বই দুটি পড়েন। ইবসেনের পরবর্তী নাটক পিয়ার গিন্ট' কিয়েরকেগরের সচেতন নজরে এসেছিল।[][]

সাফল্যের সাথে সাথে ইবসেনের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তিনি নাটকে তার বিশ্বাস, বিচার ও চেতনার প্রকাশ ঘটাতে শুরু করেন। এই ধরনের নাটককে তিনি নাম দিয়েছেন "drama of ideas"। তার পরবর্তী নাটকের সিরিজকে ইবসেন নাটকের স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে, যেখানে তার ক্ষমতা, সৃজনীশক্তি ও প্রভাবের পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে। এই ধরনের নাটক তখন ইউরোপে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল।

 
১৮৭০ সালের দিকে ইবসেনের প্রতিকৃতি

১৮৬৮ সালে ইবসেন ইতালি ছেড়ে জার্মানির ড্রেসডেনে গমন করেন। এখানে তিনি তার প্রধান সাহিত্য কর্মগুলো রচনা করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে এমপেরর এন্ড গ্যালিলিয়ান (১৮৭৩), যা রোমান শাসক জুলিয়ান দ্য অ্যাপোস্টেট এর জীবন ও সময় নিয়ে নির্মিত হয়েছে। যদিও ইবসেনের মতে তার সমস্ত নাটকের মধ্যে এটিকেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতেন, তবুও অধিকাংশ সাহিত্যিকই তার সাথে দ্বিমত পোষণ করতেন। তার পরের সাহিত্যকর্মগুলো অনেক বেশি প্রশংসা কুড়িয়েছে। ১৮৭৫ সালে ইবসেন মিউনিখে চলে যান এবং এখান থেকে ১৮৭৯ সালে প্রকাশ করেন বিখ্যাত নাটক আ ডলস হাউস। এই নাটকে ভিক্টোরীয় যুগের বিয়েতে পুরুষ ও নারীর ভূমিকা তুলে ধরেন, যার জন্য তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন।

আ ডল'স হাউজ এর পর ইবসেন লেখেন গোস্টস (১৮৮১), যাতে ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতার ধারার উগ্র বর্ণনা ছিল। এখানে একজন বিধবা তার যাজকের কাছে প্রকাশ করেন যে, তিনি তার বিয়ের সময় তার খারাপ দিকগুলো গোপন করেছিলেন। যাজক পরামর্শ দেন তার তৎকালীন বাগদত্তাকে পরকীয়া সত্ত্বেও বিয়ে করার জন্য এবং মহিলা সে অনুযায়ী বিয়েও করেছিলেন এই আশায় যে তার ভালবাসায় তারা একত্রিত হতে পারবে। কিন্তু তিনি যা চেয়েছিলেন তা হয়নি। তার স্বামীর পরকীয়া তার মৃত্যু পর্যন্ত চালিয়েছেন এবং এরফলে তার সন্তান সিফিলিসগ্রস্থ হয়ে পরে। এই রোগের নাম শোনাও তখন কলঙ্ক হিসেবে বিবেচিত হত।

১৮৮২ সালে তিনি প্রকাশ করেন অ্যান এনিমি অফ দ্য পিপল। আগের নাটকগুলোতে বিতর্কিত বিষয়াদি গুরুত্বপূর্ণ থাকলেও তা ব্যক্তিগত অঙ্গনের ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। অ্যান এনিমি ইফ দ্য পিপল নাটকে বিতর্কই প্রধান আলোচ্য বিষয় এবং পুরো সমাজই ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী। যে প্রধান বার্তা এই নাটকটির মাধ্যমে দেয়া হয়েছে তা হল, কখনো কখনো একজন ব্যক্তির মতই সঠিক হতে পারে যদিও সাধারণ জনতা সকলেই ভিন্ন মত পোষন করে। সাধারণ জনতাকে এখানে মূর্খ ও ভেড়ার পালের মত তুলনা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে চলিত ভিক্টোরিয়ান বিশ্বাস, সমাজ একটি মহৎ প্রতিষ্ঠান এবং সর্বদা বিশ্বাসযোগ্য এই ধারণাকে হেয় করার চেষ্টা করা হয়েছে।

সাহিত্য কর্ম

সম্পাদনা

কাব্যগ্রন্থ

সম্পাদনা
  • ডিজিতে - একমাত্র কাব্যগ্রন্থ যাতে রয়েছে Terje Vigen

টুকিটাকি

সম্পাদনা
  • In May 2006 a biographical puppet production of Ibsen's life named 'The Death of Little Ibsen' debuted at New York City's Sanford Meisner Theater.
  • ইবসেনের একটিই পরিচিত ছবি আছে যাতে ইবসেনের হাসি দেখা যায়।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "Ibsen Celebration to Spotlight 'Father of Modern Drama'"। Bowdoin College। ২০০৭-০১-২৩। ২০১৩-১২-১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৩-২৭ 
  2. "Ibsen.net (English version)"। National Library of Oslo with funding from the Norwegian government। ২০০৭-০৭-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৩-২৭ 
  3. Shapiro, Bruce. Divine Madness and the Absurd Paradox. (1990) আইএসবিএন ৯৭৮-০-৩১৩-২৭২৯০-৫
  4. Downs, Brian. Ibsen: The Intellectual Background (1946)

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা