সুরেশ বিশ্বাস
সুরেশ বিশ্বাস (১৮৬১ ― ২২ সেপ্টেম্বর ১৯০৫) একজন নদিয়া জেলার বাসিন্দা তথা ভারতীয় অভিযাত্রী যিনি ব্রাজিলের গৃহযুদ্ধে লড়েছিলেন।
সুরেশ বিশ্বাস | |
---|---|
জন্ম | ১৮৬১ |
মৃত্যু | ২২ সেপ্টেম্বর ১৯০৫ (৪৪ বছর) |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
পেশা | পশু প্রশিক্ষক, সৈনিক |
পিতা-মাতা | গিরিশচন্দ্র বিশ্বাস |
প্রারম্ভিক জীবন
সম্পাদনা১৮৬১ সালে বঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের নাথপুরে এক মাহিষ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা গিরিশচন্দ্র বিশ্বাস এর প্রথম পুত্র তিনি। শোনা যায় তার পূর্ব পুরুষেরা নীল বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন।[১][২] সুরেশের জন্ম দিন ও মাস পাওয়া যায় না। বয়সকালে তিনি এই তথ্য জানার জন্য পিতৃব্যকে চিঠি লিখেছিলেন, কিন্তু তার পিতৃব্য কি উত্তর দিয়েছিলেন তা জানা যায় না। সুরেশের জন্মস্থান নাথপুর গ্রামটি কৃষ্ণনগর থেকে ২৩ কিলোমিটার পশ্চিমে ইছামতীর তীরে অবস্থিত। তার পিতা গিরিশচন্দ্র সরকারি দপ্তরে সামান্য বেতনের চাকরি করতেন। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সুরেশ ছিলেন জ্যেষ্ঠ। তার পরিবার ছিল গৌরাঙ্গের উপাসক।
শৈশব থেকে সুরেশ ছিলেন দুরন্ত ও দুঃসাহসী। যখন তার বয়স মাত্র দুই, তিনি একবার অনায়াসে একটি ২০ ফুট উঁচু মইয়ে উঠে পড়েন। আর একবার একটি বিড়ালের মুখে থেকে একটি কাঠবিড়ালীকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। বিড়ালটি তাকে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিলে তাকে কয়েকমাস শয্যাশায়ী থাকতে হয়।
সুরেশের আর একটু বড় হতে তার পিতা গিরিশবাবু কলকাতার বালিগঞ্জে একটি বাড়ি কিনে সপরিবারে কলকাতায় চলে আসেন। সুরেশকে তিনি ভবানীপুরের লন্ডন মিশন কলেজে ভর্তি করে দেন।
কর্মজীবন
সম্পাদনাভারত
সম্পাদনাগৃহত্যাগের পর সুরেশ চাকরির সন্ধান করতে লাগলেন। কিন্তু তার শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় তিনি কোথাও কোন চাকরি পেলেন না। অবশেষে তিনি যখন হতাশ হয়ে পড়েছেন তখন তিনি স্পেন্সেস হোটেলে একটি ট্যুরিস্ট গাইডের চাকরি পেলেন। গাইডের কাজে জাহাজ ঘাটে ঘন ঘন যাতায়াতের ফলে তার বিলেত যাওয়ার বাসনা হল। তিনি বিলেত যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু ফলপ্রসূ হল না। অবশেষে তিনি আপাততঃ বিলেতযাত্রার বাসনা স্থগিত রেখে সমুদ্রযাত্রা করে বিদেশভ্রমণের পরিকল্পনা করলেন। জাহাজে করে প্রথমে তিনি রেঙ্গুনে গিয়ে উঠলেন। সেখানে চাকরির চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর রেঙ্গুনের পাট চুকিয়ে তিনি চেন্নাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। সেখানে অতি সস্তায় একটি বাড়ি ভাড়া করে চাকরির সন্ধান করতে লাগলেন। যে কোন কাজের জন্য চেন্নাইয়ে খ্রীষ্টানদের দোরে দোরে জন্য ঘুরলেন, কিন্তু কোন কাজ জুটল না। অবশেষে প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় এক ফিরিঙ্গির কাছে বাড়ির পরিচারকের কাজ পেলেন। সেখানে মাসকতক থাকার পর কলকাতায় ফিরে আসেন।
কলকাতায় সুরেশের খাদ্য বাসস্থানের সমস্যা ছিল না। লন্ডন মিশন কলেজের অধ্যক্ষ আসটন তাকে কলেজের বোর্ডিংয়ে আগের মতই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এর মধ্যে তিনি অকদিন পিতা ও পিতৃব্যের অনুপস্থিতিতে মায়ের সাথে দেখা করে আসেন। এদিকে তার কোন স্থায়ে চাকরি জুটল না। তিনি গঙ্গার জেটিতে জেটিতে ঘুরতেন ও জাহাজের ক্যাপ্টেনদের সাথে মেলামেশা করতেন। একদিন তার বি এস এন কোংরের ক্যাপ্টেনের সাথে আলাপ হল। বহু অনুনয় বিনয়ের পর ক্যাপ্টেন সুরেশকে ফেরার সময় বিলেতে নিয়ে যেতে রাজি হলেন। ১৮৭৮ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে সুরেশ বি এন এস কোংরের সহকারী স্টুয়ার্ডের পদে যোগ দিয়ে বিলেতযাত্রা করেন।
ইউরোপ
সম্পাদনাজাহাজ লন্ডনে নোঙর করলে সুরেশ প্র্থমে তিন সপ্তাহ শহরটা ঘুরে দেখলেন। অবশেষে জাহাজ ছাড়বার সময় হলে সুরেশ বিলেতে থেকে যাওয়া মনস্থির করলেন। জাহাজের এক সহকর্মী বোসেনের সহায়তায় লন্ডনের ইষ্ট এন্ডে বসবাসের জন্য সস্তায় একটি ঘর ঠিক করলেন। চাকরি জোটানো দূরস্থান, সুরেশ তার বিলেত জীবনের প্রথম কয়েকদিনেই তার অর্জিত সমস্ত অর্থ মদ ও নারীসঙ্গে উড়িয়ে দিলেন। কপর্দকশূন্য অবস্থায় সংবাদপত্র বিক্রেতার কাজে যোগ দিলেন। তারপর কিছু দিন মুটের কাজ করলেন। তারপর ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চলে ফেরিওয়ালার কাজ করলেন। এই সময় তিনি স্বচেষ্টায় লেখাপড়া শুরু করে প্রথাগত শিক্ষার অভাব কিছুটা মেটাতে শুরু করলেন।
এই সময়ে কেন্টে অবস্থানকালে দৈবাৎ এক সার্কাস দলের সাথে সুরেশের যোগাযোগ হয়। তিনি সার্কাসে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে সার্কাসের ম্যানেজার তাকে পরীক্ষা করতে চান। সুরেশ সার্কাসের সব চেয়ে বলশালী ব্যক্তিকে কুস্তিতে পরাজিত করে সার্কাসে চাকরি পান। বেতন থাকা খাওয়া বাবদ সপ্তাহে ১৫ সিলিং। সাসেক্সে সার্কাস দল তাঁবু ফেললে সুরেশ সার্কাসে খেলা দেখান এবং প্রথম দিন থেকেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ক্রমে তিনি বন্য পশু বিশেষতঃ সিংহকে বশ করার খেলায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ১৮৮০ সালে সার্কাস দলের সাথে ইংল্যান্ড ভ্রমণকালে প্রসিদ্ধ হিংস্র পশু বশকারী প্রফেসর জামবাখের সাথে তার পরিচয় ঘটে। জামবাখ ছিলেন তৎকালীন ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পশু বশকারী। জামবাখের প্রস্তাবে সুরেশ সার্কাসের চাকরি ছেড়ে তার নিজস্ব পশুশালায় সহকারীরূপে যোগ দেন। সেখানে বছর দুয়েক কাজ করার পর পুনরায় সার্কাসে যোগ দেন। ১৮৮২ সালে লন্ডনের এক প্রদর্শনীতে বাঘ ও সিংহের খেলা দেখিয়ে জগৎজোড়া খ্যাতি লাভ করেন। তিনি সার্কাস দলের সঙ্গে ইউরোপ যাত্রাকালে জার্মানির হামবুর্গে বিশিষ্ট পশু প্রশিক্ষক গাজেনবাখের সাথে পরিচিত হন এবং সার্কাসের চাকরি ছেড়ে অধিক বেতনে গাজেনবাখের পশুশালার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর তিনি অধিকতর বেতনে জো কার্ল নামক জনৈক ব্যক্তির পশুশালার দায়িত্ব নেন। কিয়ৎকাল পশু প্রশিক্ষকের কাজ করার পর পুনরায় সার্কাসে যোগ দেন।
১৮৮৫ সালে জার্মানিতে অবস্থানকালে পুর্বের সেই জার্মান যুবতীর সাথে তার দেখা হয় এবং প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের সম্পর্কের কথা যুবতীর আত্মীয়গণ জানতে পারলে তারা সুরেশের প্রাণ সংহার করার জন্য উদ্যত হন। সুরেশ জার্মানি পরিত্যাগ করলে তারা ইউরোপের নগরে নগরে লোক লাগিয়ে সুরেশের অনুসন্ধান করতে থাকেন। সুরেশ ওয়েল নামক জনৈক হিংস্র পশু প্রদর্শনকারীর দলে চাকরি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পলায়ন করেন। সার্কাস দলের সঙ্গে তিনি মেক্সিকো হয়ে ব্রাজিলের রাজধানী রিও দি জেনেরিও-তে উপনীত হন।
ব্রাজিল
সম্পাদনাব্রাজিলে সার্কাসে হিংস্র পশুর খেলা দেখানোর পাশাপাশি সুরেশ অঙ্ক, দর্শন ও রসায়নের বিভিন্ন বিষয়ের উপর বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। কিছুকাল পরে ব্রাজিলের রাজকীয় পশুশালার প্রশিক্ষক ও রক্ষকের পদ শূন্য হলে সুরেশ সার্কাসের চাকরি ছেড়ে সেখানে যোগদান করেন। এই সময় সুরেশের সাথে স্থানীয় এক চিকিৎসকের কন্যার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একদিন তার প্রেমিকা তাকে বলেন যে তাকে সৈনিক বেশে বড় সুন্দর দেখাবে। ২৫ বছরের তাজা যুবক সুরেশ তার প্রণয়িণীর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রাজিল সম্রাটের অধীনে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং কঠোর অনুশীলন আরম্ভ করেন। পরের বছর তিনি কর্পোরাল পদে উন্নীত হয়ে একটি ছোট সৈন্যদলের অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়ে সান্তাক্রুজে চলে যান। তারপর রিও দি জেনেরিও-র হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়্কের দায়িত্ব পান। হাসপাতালে থাকাকালীন তিনি অস্ত্রপচার শিক্ষা করেন এবং তাতে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন।
১৮৮৯ সালে তার সেনাবাহিনীতে তিন বছরের বাধ্যতামূলক মেয়াদ ফুরোলেও সুরেশ সেনাবাহিনীতেই থেকে যান। তিনি অশ্বারোহী থেকে পদাতিক শ্রেণীতে পরিবর্তন করে বন্দুক চালনা শিক্ষা করেন। এই সময়ে তিনি উক্ত চিকিৎসক কন্যাকে বিবাহ করেন। কর্পোরাল থেকে তিনি ক্রমে প্রথম সার্জেন্টের পদে উন্নীত হন। ১৮৯২ সালে তার প্রথম পুত্রের জন্ম হয়। ১৮৯৩ সালে তিনি প্রথম লেফ্টানেন্টের পদে উন্নীত হন।
১৮৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ব্রাজিলে এক ভয়ানক রাষ্ট্রবিপ্লবের সূচনা হয়। সাধারণতন্ত্রের নৌবাহিনী রাজধানী রিও দি জেনেরিও-কে ঘিরে তুমুল গোলাবর্ষণ করতে থাকে। সুরেশ স্থলাবাহিনীর সেনাপতির অধীনে থেকে স্থলস্থ দুর্গগুলি রক্ষা করতে থাকেন। স্থলবাহিনী দুর্গ রক্ষায় সাহসিকতার পরিচয় পেয়ে বিদ্রোহী নৌবাহিনী সরাসরি রাজধানী অধিকার এক প্রকার অসম্ভব বিবেচনা করে রিও দি জেনেরিও-র শহরতলি নিথেরয় আক্রমণ করল। উপর্যুপরি গোলাবর্ষণ করে নিথেরয় সম্পূর্ণ বিদ্ধস্ত করে নৌসেনাগণ তীরে অবতরণ করে নিথেরয় অধিকার করতে উদ্যত হলেন। তখন রাত্রিকাল। ঘোর অন্ধকারের মধ্যে বিদ্রোহী সেনাগণ নিথেরয়ে উত্তর দিক থেকে প্রবেশ করলে শহরের রক্ষার দায়িত্ব থাকা স্থল সেনাগণের সাথে তুমুল যুদ্ধ বাধল। উভয়পক্ষে বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও বিদ্রোহী নৌসেনাগণ নিথরয়ের দখল নিতে উদ্যত হল। এমত অবস্থায় স্থলবাহিনীর সেনাপতির আহ্বানে মাত্র ৫০ জন সৈন্য নিয়ে নিথেরয় রক্ষার জন্য এগিয়ে এলেন সুরেশ। শেষ রাতে শত্রু ঘাঁটিতে সুরেশ ও তার সঙ্গীরা আক্রমণ করেন এবং সুরেশের দৃঢ় সংকল্প ও অসামান্য সামারিক পারদর্শিতার জোরে শত্রুপক্ষকে ধ্বংস করেন নিথেরয়ের যুদ্ধে জয়লাভ করেন। নৌবিদ্রোহ দমন হয়। কালে সুরেশ সেনাবাহিনীতে থেকে কর্ণেল পদে উন্নীত হন।
শেষ জীবন
সম্পাদনাসুরেশ রিও দি জেনেরিও-র এক সম্ভান্ত ও সম্মানীয় ব্যক্তির মর্যাদা পান। তার একটি কন্যা সন্তানও জন্মায়। তিনি সেখানে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে থাকেন। পিতৃব্যর সাথে পত্র দ্বারা যোগাযোগ রাখতেন সুরেশ। তার কীর্তি কাহিনীর কথা স্বদেশে পৌঁছোয় ও তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। ১৯০৫ সালে তার মৃত্যু হয়।
পাদটীকা
সম্পাদনা- ↑ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৯, পৃ. ২০
- ↑ Kling, Blair B. (২০১৬-১১-১১)। The Blue Mutiny: The Indigo Disturbances in Bengal, 1859-1862 (ইংরেজি ভাষায়)। University of Pennsylvania Press। পৃষ্ঠা 84। আইএসবিএন 978-1-5128-0350-1।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা
|