সাজিকাপাস

কীটপতঙ্গের প্রজাতি

সাজিকাপাস (বৈজ্ঞানিক নাম: Appias albina(Boisduval)) এক প্রজাতির মাঝারি আকারের প্রজাপতি। এরা পিয়েরিডি পরিবার এবং পিয়েরিনি উপগোত্র এবং অ্যাপিয়াস বর্গের অন্তর্ভুক্ত প্রজাতি।[] এই প্রজাতি ভারতের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন (Wild Life Protection Act, 1972) অনুসারে তফ্‌সিল ২ এর তালিকার অন্তর্ভুক্ত।

সাজিকাপাস
common albatross
ডানা বন্ধ অবস্থায়
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: Animalia
পর্ব: Arthropoda
শ্রেণী: Insecta
পরিবার: Pieridae
গণ: Appias
প্রজাতি: A. albina
দ্বিপদী নাম
Appias albina
(Boisduval, 1836)

সাজিকাপাস এর প্রসারিত অবস্থায় ডানার আকার ৬০-৭৫ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের হয়।[]

উপপ্রজাতি

সম্পাদনা

ভারতে প্রাপ্ত সাজিকাপাস এর উপপ্রজাতি হল-

  • Appias albina swinhoei (Moore, [1905]) – Sahyadri Common Albatross
  • Appias albina darada (C. & R. Felder, [1865]) – Sylhet Common Albatross

বিস্তার

সম্পাদনা

ভারত (ভারতীয় উপদ্বীপ, পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম এবং উত্তরপূর্ব ভারত, দক্ষিণ ভারতের পার্বত্য অঞ্চল, আন্দামান নিকোবর), বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার এবং অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এদের পাওয়া যায়।[]

বর্ণনা

সম্পাদনা

প্রজাপতির দেহাংশের পরিচয় বিষদ জানার জন্য প্রজাপতির দেহ এবং ডানার অংশের নির্দেশিকা দেখুন:-

আর্দ্র ঋতুরূপ

সম্পাদনা

পুরুষ প্রকারের ডানার উপরিতল সাদা বর্নের। সামনের ডানায় অ্যাপেক্স অথবা শীর্ষভাগ, টার্মেনের উপরিভাগ এবং কোস্টা কালো আঁশে ছাওয়া। বেসাল অথবা গোড়ার অংশ ইষদ কালচে, পিছনের ডানা পুরোপুরি সাদা বর্নের হয়। কোনো কোনো নমুনাতে কয়েকটি শিরার শেষপ্রান্ত টার্মিনাল অংশে কালো আঁশযুক্ত।

ডানার নিম্নতলে, সামনের ডানার শীর্ষ এবং পিছনের ডানার সমগ্র তল ফ্যাকাশে অনুজ্জ্বল হলদেটে আভাযুক্ত অথবা কখনো সখনো খুব হালকা গোলাপী আভাযুক্ত।[]

স্ত্রী

সম্পাদনা

ডানার উপরিতল : স্ত্রী প্রকারে ডানার উপরিতল সাদা। সামনের ডানায় কোস্টা, অ্যাপেক্স (চওড়াভাবে) এবং টার্মেন কালো, ৪ থেকে ৫টি এপিকাল সাদা ছোপ বর্তমান। টার্মিনাল কালো অংশ ২ নং শিরামধ্যে গভীরভাবে ভিতরের দিকে ঢোকা (inclined)। সেল এ কোনো ছোপ থাকে না। বেসাল অংশ অথবা ডানার গোড়ার দিকে হালকা ভাবে কালো আঁশে ছাওয়া। পিছনের ডানায় টার্মেন সরুভাবে এবং কোনো কোনো নমুনাতে অপেক্ষাকৃত চওড়াভাবে কালো এবং ভিতরের দিকে শিরায় শিরায় খাঁজযুক্ত (dentated)। বেসাল অংশ অথবা ডানার গোড়ার দিকে কোনো কালো আঁশের উপস্থিতি নেই।[]

ডানার নিম্নতল : ডানার নিম্নতলে, সামনের ডানায় শীর্ষভাগের নিচে কোস্টার সামান্য নীচ থেকে টার্মেন অবধি বিস্তৃত তীর্যক, বাঁকানো, আঁকাবাঁকা এবং মোটামুটি চওড়া একটি কালো বন্ধনী বিদ্যমান। উভয় ডানা নিম্নতলে দুটি ভিন্ন ভিন্ন রূপে সাদা অথবা ফ্যাকাশে হলুদ আভাযুক্ত এবং উজ্জ্বল হলুদ বর্নের।

শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ ভারতএ স্ত্রী প্রকারের দুটি রূপই ফ্লাভা (flava) এবং সেমিফ্লাভা (semiflava) বর্তমান।[]

ফ্লাভা রূপে, ডানার উভয়পৃষ্ঠ সাদার বদলে ফ্যাকাশে হলুদ হয়। সেমিফ্লাভা রূপে ডানার উপরিপৃষ্ঠ সাদা এবং নিম্নপৃষ্ঠে সামনের ডানার শীর্ষভাগ এবং সমগ্র পিছনের ডানা উজ্জ্বল হলুদ বর্নের।[]

শুষ্ক ঋতুরূপ

সম্পাদনা

স্ত্রী-পুরুষ উভয় এরই শুষ্ক ঋতুরূপ আর্দ্র ঋতুরূপের প্রায় অনুরূপ।

পুরুষ প্রকারে শুষ্ক রূপে ডানার উপরিতলে কালো আঁশের উপস্থিতি প্রায় বিলুপ্ত এবং কিছু কিছু নমুনাতে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতে দেখা যায়। ডানার নিম্নতলের ইষদ হলদে আভা আরও ফ্যাকাশে হয়ে যায়।

স্ত্রী

সম্পাদনা

স্ত্রী প্রকারে, শুষ্ক রূপে, ফ্লাভা এবং সেমিফ্লাভা উভয় রূপের খুবই সামান্য ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। ডানার উপরিপৃষ্ঠে সামনের ডানার কোস্টা, অ্যাপেক্স এবং টার্মেন জুড়ে থাকা কালো অংশ অপেক্ষাকৃত সীমিত হয়ে যায় অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত সরু হয়ে ওঠে। নিচের ডানার কালো টার্মেন এর অনুরূপ পরবর্তন হয়। ডানার নিম্নপৃষ্ঠে, সামনের ডানার কালো আঁকাবাঁকা বন্ধনীটি স্পষ্টতই সরু এবং খানিক অস্পষ্ট হয়ে যায়।[]

শুঙ্গ সাদায়-কালোয় ডোরাকাটা। মাথা এবং উদর উভয়পৃষ্ঠে সাদা এবং হালকা কালচে আঁশে ছাওয়া। বক্ষদেশ উপরিতলে ঘন কালচে নীল রোঁয়ায় আচ্ছাদিত।[]

চিরহরিৎ এবং প্রায়-চিরহরিৎ বনাঞ্চলে, প্রধানত ফাঁকা জায়গায়, জঙ্গলের রাস্তা এবং ঝর্ণা অথবা পাহাড়ি নদীর পাশে এই প্রজাতিকে দেখা যায়। স্থানীয়ভাবে এরা প্রতুল এবং সঠিক ঋতুতে এবং উপযুক্ত বাসভূমিতে এদের সংখ্যার আধিক্য চোখে পড়ে। স্ত্রী অপেক্ষা পুরুষদের অনেক অনেক বেশি সংখ্যায় বিচরন করতে লক্ষ্য করা যায়। গ্রীষ্ম এবং বর্ষার পরবর্তী মাসগুলোতে এদের সংখ্যাধিক্য নজরে আসে, তবে ঘন বর্ষার সময় এরা খুবই দুর্লভ দর্শন।[]

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা যে সাজিকাপাস এর নমুনা দেখি, তা পুরুষ প্রকার। স্ত্রী প্রকার খুবই দুর্লভ এবং তারা জঙ্গলের ঘন ঝোপঝাড়ের ভিতরে ছায়ায় অবস্থান করে। এই প্রজাতি মোটের উপর খুবই দ্রুত উড়ান সম্পন্ন। এরা নিচু, মাঝারি এবং উঁচু বিভিন্ন উচ্চতায় উড়তে পারে। কখনো নিচু ঔষধিগুল্মের ফুলে, কখনো লিয়ানাস (Liana) এর ফুলে অথবা সুউচ্চ গাছের চূড়ায় এদের অবস্থান করতে দেখা যায়। সাধারনত এরা একা একা উড়ে বেড়ায়, তবে জঙ্গলের কিনারে অথবা ঝর্ণার পাশে প্রিয় পরিবেশে প্রচুর নমুনা ঝাঁক বেঁধে বিরাজ করে।[] ফুলের মধুপান এই প্রজাতির অতি প্রিয় বিষয়। যখন ফুলের মধুপান করে, তখন এরা অন্যান্য প্রজাপতিদের থেকে খানিক ভিন্ন ভাবে ফুলে অবস্থান করে- ডানাগুলো সামান্য মেলে স্থির হয়ে থাকে। অন্যান্য প্রজাতিরা সাধারনত ডানা বন্ধ রেখে অথবা ডানা ছড়িয়ে অথবা ডানা ক্রমাগত ঝাপটাতে ঝাপটাতে মধু পান করে।[] গ্রীষ্মকালেও পুরুষ প্রকার এবং স্ত্রী প্রকার কদাচিৎ ভিজে মাটিতে অথবা ভিজে বালিতে অথবা ভিজে ছোপে বসে একা অথবা দলবদ্ধভাবে মাডপাডেল করে। গাছের পাতায় এবং ডালে প্রধানত ডানাবন্ধ এবং কখনো কখনো ডানামেলা অবস্থানে এদের প্রায়শই রোদ পোহাতে দেখা যায়। দক্ষিণ ভারতে অনুকূল পরিবেশে এবং ঋতুতে (বর্ষার পরে) অগণিত নমুনাকে একত্রে মাডপাডল করতে লক্ষ্য করা যায়।

খুব গরমের দিনে, এদের পাতা অথবা ঝোপঝাড়ের ছায়ায় এবং পাতার নিচে বিশ্রাম নিতে দেখা যায়। বিশ্রামাবস্থায় এরা এদের সামনের ডানা জোড়া প্রায় পুরোপুরিভাবে পিছনের ডানার মধ্যে ঢুকিয়ে নেয়, শুধুমাত্র সামনের ডানার শীর্ষভাগ সামান্য দৃশ্যমান হয়, সাজিকাপাস খুব শক্তিশালী পরিযায়ী-এরা দলবদ্ধভাবে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ীতা করে। পরিযায়ীর ঝাঁকে সদস্য সংখ্যা কখনো কয়েক ডজন থেকে কখনো কয়েক হাজারও হয়। পাহাড়ী জঙ্গলে ৯০০ থেকে ১২০০ মিটার উচ্চতার মধ্যে এদের বিচরন লক্ষ্য করা যায়। সিকিম এ ১২০০ মিটার (৪০০০ ফুট) উচ্চতা পর্যন্ত এদের দর্শন মেলে।[]

বৈশিষ্ট্য

সম্পাদনা

এরা সাধারনত ডিম পাড়ে ছোট ছোট থোকায় (small batches)। ডিম ইষদ হলুদ বর্নের এবং বোতল এর আকৃতি যুক্ত।[]

শূককীট

সম্পাদনা

নবজাত শূককীট ইষদ হলদেটে এবং পাতার শিরার সাথে সহজেই মিশে থাকে; হুট্‌ করে চোখে পড়ে না। পরবর্তীকালে, শূককীট আকারে বেড়ে উঠলে তার বর্ন হয় উজ্জ্বল নীলচে-সবুজ (cerulean blue) এবং দেখতে খুব আকর্ষনীয় লাগে। তবে সমগ্র শূককীট দশায় মাথা হলুদই থেকে যায়। মাথা এবং দেহত্বক অসংখ্য ছোট বড় ঘন কালো শঙ্কু আকৃতি গুটিতে পরিপূর্ণ যে গুটিগুলির ডগায় সুক্ষ, সরু রোয়াযুক্ত। দেহের নিম্নতল হালকা সবজে হলুদ (lemon yellow) এবং দেহের প্বার্শভাগে ওই হালকা সবজে হলুদ রঙের একটি রেখা মাথার পিছন থেকে সম্পূর্ণ দেহজুড়ে বিস্তৃত। হলদে-সাদা একটি স্পাইরাকুলার বন্ধনী চোখে পড়ে ২ ও ৩ নং দেহখন্ড থেকে ১২ তম দেহখন্ড পর্যন্ত। মাথা গোলাকার, চক্‌চকে্ হলুদ।

শূককীট আহার্য উদ্ভিদের কচি পাতা এবং কুড়ি খায়, তবে শক্ত এবং পুরনো পাতাকে এড়িয়ে যায়। পাতার নিচের পিঠে এরা বিশ্রাম নেয়, তবে নিজেদের লুকিয়ে রাখার কোন চেষ্টা করে না। এদের উজ্জ্বল বর্নের জন্য বেড়ে ওঠা শূককীটকে সহজেই স্পষ্টভাবে দেখা যায় পাতার মধ্যে।[]

আহার্য উদ্ভিদ

সম্পাদনা

এই শূককীট Putranjivaceae পরিবারের উদ্ভিদ Drypetes oblongifolia, Drypetes venusta এবং Drypetes roxburghii গাছের কচি পাতা এবং কুঁড়ির রসালো অংশ আহার করে।[]

মূককীট

সম্পাদনা

মূককীটের দেহের বর্ন উপরিপৃষ্ঠে খুব হালকা সবজে- হলুদ এবং নিম্নপৃষ্ঠ ময়লাটে সাদা। ৪ থেকে ১৪ তম দেহখন্ডে গোলাপী আভাযুক্ত। মাথার অগ্রভাগে বাঁকানো শিং এর মত অভিক্ষিপ্ত (projected) যেটি সাদাটে বর্নের এবং উপরি এবং নিম্নপৃষ্ঠে লম্বা কালো এবং প্বার্শতল চাপা। মূককীটের দেহের নিম্নপৃষ্ঠের প্বার্শদেশ খুব হালকাভাবে করাতের মত খাঁজকাঁটা (serrated); ২ নং দেহখন্ডের সামনের দিকে প্বার্শরেখা সামান্য অভিক্ষিপ্ত হয়ে ছোট দাঁতের মত অংশের সৃষ্টি করেছে। দেহের নিম্নপৃষ্ঠের প্বার্শরেখা (dorsal line) উপরিপৃষ্ঠ অপেক্ষা বেশি মাত্রায় করাতের মত খাঁজকাঁটা। বক্ষদেশ বলিষ্ঠভাবে খাঁজযুক্ত ৬, ৭ এবং ৮ নং দেহখন্ডের প্বার্শ দাঁত ৩টি প্রায় একই আকারের এবং খুব তীক্ষ্ণ।[]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Isaac, Kehimkar (২০০৮)। The book of Indian Butterflies (ইংরেজি ভাষায়) (1st সংস্করণ)। নতুন দিল্লি: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। পৃষ্ঠা ১৭৬। আইএসবিএন 978 019569620 2 
  2. R.K., Varshney; Smetacek, Peter (২০১৫)। A Synoptic Catalogue of the Butterflies of India। New Delhi: Butterfly Research Centre, Bhimtal & Indinov Publishing, New Delhi। পৃষ্ঠা 77। আইএসবিএন 978-81-929826-4-9ডিওআই:10.13140/RG.2.1.3966.2164 
  3. Wynter-Blyth, M.A. (1957) Butterflies of the Indian Region, pg ৪২৯.
  4. Swinhoe, Charles (১৯০৫–১৯১০)। Lepidoptera Indica. Vol. VII। London: Lovell Reeve and Co.। পৃষ্ঠা 11–12। 
  5. Bingham, C.T. (১৯০৭)। The Fauna of British India, Including Ceylon and BurmaII (1st সংস্করণ)। London: Taylor and Francis, Ltd.। পৃষ্ঠা 212–213। 
  6. Kunte, Krushnamegh (২০১৩)। Butterflies of The Garo Hills। Dehradun: Samrakshan Trust, Titli Trust and Indian Foundation of Butterflies। পৃষ্ঠা ১৫৫। 
  7. Peter, Smetacek (২০১৮)। A Naturalist's Guide to the Butterflies of India Pakistan, Nepal, Bhutan, Bangladesh and Sri Lanka (ইংরেজি ভাষায়) (1st সংস্করণ)। New Delhi: Prakash Books India Pvt. Ltd.। পৃষ্ঠা ৫০। আইএসবিএন 978 81 7599 406 5 
  8. Kunte. Krushnamegh (2000) India-a Lifescape: Butterflies of Peninsular India, pg 100.
  9. Kunte, K. 2006. Additions to known larval host plants of Indian butterflies. Journal of the Bombay Natural History Society 103(1):119-120

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা