সংবাদপত্র
সংবাদপত্র বা খবরের কাগজ হল একটি লিখিত প্রকাশনা যার মধ্যে থাকে বর্তমান ঘটনা, তথ্যপূর্ণ নিবন্ধ, সম্পাদকীয়, বিভিন্ন ফিচার এবং বিজ্ঞাপন। এটি সাধারণত সাধারণত স্বল্প-মূল্যের কাগজে মুদ্রণ করা হয় যেমন নিউজপ্রিন্ট। পৃথিবীর আধুনিক বিপ্লব ও সংগ্রামের ইতিহাসে সংবাদপত্রের ভূমিকা অনেক । ২০০৭ অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী দৈনিক খবরের কাগজের সংখ্যা ছিল ৬,৫৮০টি যারা একদিনে প্রায় ৩৯৫ মিলিয়নের বেশি কপি বিক্রি করত। বর্তমানে বেশীরভাগ সংবাদপত্রই তাদের অনলাইন সংস্করণ বের করে থাকে।
বর্তমানে বিভিন্ন প্রকার সংবাদপত্র আমাদের চোখে পরে।যেমন: দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক পত্রিকা, পাক্ষিক, মাসিক পত্রিকা, বিষয়ভিত্তিক পত্রিকা।
সংজ্ঞা
সম্পাদনাএকটি সংবাদপত্র সাধারণত চারটি মানদণ্ড পূরণ করে:[১][২]
- প্রচার: এর বিষয়বস্তু জনসাধারণের জন্য যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রবেশযোগ্য।
- পর্যায়বৃত্তি: এটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়।
- প্রচলন: এটির তথ্য প্রকাশনার সময়সূচী হিসেবে হালনাগাদকৃত থাকবে।
- সার্বজনীনতা: বিষয়ের একটি পরিসীমা এটি কভার করবে।
ইতিহাস
সম্পাদনাপ্রাচীন রোমে, অ্যাক্টা দিউরমা বা সরকারের ঘোষণা পত্র প্রকাশ করা হত। সেটা ধাতু বা পাথরে খোদাই করে জনসমাগম হয়, এমন জায়গায় টাঙ্গিয়ে দেওয়া হত। চায়নায়, ৮ম শতাব্দীর দিকে কাইয়ুয়ান ঝা বাও নামে এক রাজকীয় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের অস্তিত্ত পাওয়া যায়। মুসলমান রাজত্বকালে ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের প্রচলন ছিল। অবশ্য তখন সংবাদপত্র মুদ্রিত হত না, সমস্ত রাজনৈতিক বিষয়ক সংবাদ হাতে লেখা হত এবং তা দেশের রাজকর্মচারীর নিকট প্রেরিত হত। সমস্ত বিভিন্ন বিভিন্ন প্রদেশের সংবাদ একত্র করে সম্রাটের কাছে যেত। এরূপ সংবাদ- সংগ্রহের জন্য আলাদা বিভাগ ছিল।
- ভারতে
মুসলমান রাজত্বকালে, মধ্যযুগীয় ভারতে সংবাদপত্রের প্রচলন ছিল।অবশ্য তখন সংবাদপত্র মুদ্রিত হত না, সমস্ত রাজনৈতিক বিষয়ক সংবাদ হাতে লেখা হত এবং তা দেশের প্রধান প্রধান রাজকর্মচারীর নিকট প্রেরিত হত।সমস্ত বিভিন্ন বিভিন্ন প্রদেশের সংবাদ একত্র করে সম্রাটের কাছে যেত। এরূপ সংবাদ- সংগ্রহের জন্য আলাদা বিভাগ ছিল। কানুন এ-জং নামক প্রাচীন পারস্য গ্রন্থে লেখা আছে যে, পানিপথের প্রথম যুদ্ধে (১৫২৬ খ্রী:) বাবর শাহ শিবিরে বসে সংবাদপত্র পাঠ করছিলেন এমন সময়ে হিন্দু রাজারা এসে সন্ধির প্রস্তাব করেন। আবুল ফজল আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে লিখেছেন, সম্রাট আকবরের সময় প্রতি মাসে গভর্নমেন্ট গেজেটের মত রাজকীয় সমাচারপত্র প্রচলিত ছিল। শাজাহান আগ্রার মহরম দরবারে বলেছিলেন, "এলাহাবাদের হিন্দু রাজাদের বিদ্রোহের কথা সমাচার পত্রে পাঠ করে বিস্মিত ও বিষাদিত হলাম।" সম্রাট আওরঙ্গজেব ঔরঙ্গাবাদ নামক স্থানে জীবনলীলা সংবরণ করেন, তার পীড়ার সমাচার ও বিবরণ দিল্লির 'পয়গম-এ-হিন্দ্' নামক ফারসি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।[৩]
বাংলায় সংবাদপত্র
সম্পাদনাইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের আগে এই উপমহাদেশে সংবাদপত্র প্রকাশের কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে না। ১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকি স্থানীয় ইংরেজদের জন্য বেঙ্গল গেজেট বা ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভার্টাইজার নামে দুই পাতার একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেন। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস, তার পত্নী ও ইংরেজ বিচারকদের সম্পর্কে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশের দরুন এটিও দ্রুত বাজেয়াপ্ত হয়।১৮১৮ সালের গোড়ার দিকে রাজা রামমোহন রায়ের সহায়তায় শিক্ষক ও সংস্কারক গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ করেন। অতঃপর ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের উদ্যোগে শ্রীরামপুর থেকে বাংলা মাসিক পত্রিকা দিগদর্শন প্রকাশিত হয়। ১৮১৮ সালের ২৩ মে বেঙ্গল গেজেট’ প্রকাশের এক সপ্তাহ পর সমাচার দর্পণ প্রকাশিত হয়।
রাজা রামমোহন রায় বাংলা সংবাদ কৌমুদী, ইংরেজি ব্রাহ্মিনিক্যাল ম্যাগাজিন ও ফার্সিতে মিরাত-উল-আকবর প্রকাশ করেন এবং তার নেতৃত্বে ভারতীয় ও ইউরোপীয় সম্পাদকদের ঐক্যবদ্ধ চাপে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক বিদ্যমান সংবাদপত্র আইন শিথিল করতে বাধ্য হন। ১৮৫৮ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা সাপ্তাহিক সোমপ্রকাশ প্রকাশ করেন। ১৮৫৯ সালে ঢাকায় বাংলাযন্ত্র নামে প্রথম বাংলা মুদ্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখান থেকে ১৮৬১ সালে ঢাকা প্রকাশ প্রকাশিত হয়। এ বছরেই দি জন বুল ইন দি ইস্ট (পরবর্তী নামকরণ দি ইংলিশম্যান) ইউরোপীয়দের ও ভারতে নীলকরদের শক্তিশালী মুখপত্র হয়ে ওঠে। ১৮৬৫ সালে এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত পাইওনিয়র পূর্ণাঙ্গ সংবাদ পরিবেশনের জন্য খ্যাতি অর্জন করে। ১৮৬৮ সালে ঘোষ ভ্রাতৃগণ (শিশির কুমার ঘোষ ও মতিলাল ঘোষ) যশোরের ক্ষুদ্র গ্রাম ফুলুয়া-মাগুরা থেকে বাংলা সাপ্তাহিক অমৃতবাজার পত্রিকা প্রকাশ করেন (পরবর্তীকালে কলকাতায় স্থানান্তরিত)। ১৮৮১ সালে যোগেন্দ্র নাথ বসু বঙ্গবাসী প্রকাশ করেন। ১৮৭২ সালে প্রকাশিত বাংলা নীল দর্পণ নাটক ইউরোপীয় নীলচাষীদের নির্মম অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরলে সরকারি মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং ফলত সরকার ১৮৭৬ সালে নীলকরদের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করে। অমৃতবাজার পত্রিকা (যশোর) সহ আরও কতিপয় স্থানীয় পত্রিকা নীলচাষীদের পক্ষাবলম্বন করে।[৪]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Werner Faulstich: "Grundwissen Medien", 4th ed.,ya UTB, 2000, আইএসবিএন ৯৭৮-৩-৮২৫২-৮১৬৯-৪, chapter 4
- ↑ Margarete Rehm। "Margarete Rehm: Information und Kommunikaegenwart. Das 17. Jh"। Ib.hu-berlin.de। ২০১২-০২-০৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০২-২১।
- ↑ বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস, দুর্গাচন্দ্র সান্যাল, মডেল পাবলিসিং হাউস, ISBN 81-7616-067-9
- ↑ "সংবাদপত্র ও রাজনীতি"। বাংলাপিডিয়া। সংগ্রহের তারিখ ১৩ মে ২০১৭।
- বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস- দুর্গাচন্দ্র সান্যাল।