শ্রিভপোর্ট, লুইজিয়ানা

শ্রিভপোর্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের একটি শহর। এটি শ্রিভপোর্ট-বসিয়ার মেট্রোপলিটন এলাকার সবচেয়ে জনবহুল শহর। জনসংখ্যার দিক দিয়ে নিউ অর্লিন্সব্যাটন রুজের পর এর অবস্থান। এর অধিকাংশ এলাকাই কাড্ডো প্যারিশ এর অন্তর্ভুক্ত। রেড নদীর পশ্চিম তীর থেকে শুরু করে বসিয়ার প্যারিশ পর্যন্ত এর সম্প্রসারণ ঘটেছে। ২০১০ এর আদমশুমারি অনুযায়ী শ্রিভপোর্টের জনসংখ্যা ১,৯৯,৩১১। [১] ২০১৯ সালে এর জনসংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১,৮৭,১১২।[২]

শহরের বিভিন্ন অবকাঠামো
পতাকা
মানচিত্রে মোট এলাকা

১৮৩৬ সালে শ্রিভ টাউন কোম্পানি রেড নদী ও টেক্সাস ট্রেইলের (ট্রেইল হলো ভ্রমণের উদ্দেশ্যে নির্মিত বালু বা পাথর নির্মিত বিশেষ এক ধরনের পথ) সংযোগস্থলে নতুন একটি শহর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শ্রিভপোর্ট শহর গড়ে তুলে।[৩] বিংশ শতকে লুইজিয়ানায় তেলশিল্পের বিকাশ ঘটলে এখানে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল ও ইউনাইটেড গ্যাস কোম্পানির মত তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যালয় স্থাপিত হয়। তেলশিল্পের পতন ঘটলে এখানে কর্মসংস্থান হ্রাস পায়। পরবর্তীতে গাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জেনারেল মোটরসের শ্রিভপোর্ট শাখা বন্ধ হয়ে গেলে বেকারত্বের হার আরো বেড়ে যায়। সেড্রিক গোভার শহরের মেয়র নির্বাচিত হলে অপরাধ[৪], অর্থনৈতিক সংকট[৫] ও জনসংখ্যা হ্রাসের[৬] মত সমস্যা দূরীকরণে উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

শ্রিভপোর্ট আর্কানসাস, লুইজিয়ানাটেক্সাস অঙ্গরাজ্যের মিলনস্থল আর্ক-লা-টেক্সাসের কেন্দ্র। এখানে লুইজিয়ানা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, লুইজিয়ানা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা অবস্থিত। রিজিয়নস ফিন্যান্সিয়াল কর্পোরেশন, জেপি মর্গান চেজ, এটি অ্যান্ড টি, হানিওয়েল ইউওপি[৭] ও ইউনাইটেড পার্সেল সার্ভিসের মত প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় এখানে অবস্থিত।

ইতিহাস সম্পাদনা

ক্যাপ্টেন হেনরি মিলার শ্রিভস রেড নদীকে নৌ-চলাচলের উপযোগী করে তুলেন। হেলিওপোলিস নামক বিশেষ এক ধরনের নৌযান ব্যবহার করে তিনি নদীর উপরস্থ ১৮০ মাইল দীর্ঘ কাঠ-সৃষ্ট জট দূর করেন। তার নামানুসারে শহরটির নাম হয় শ্রিভপোর্ট।

১৮৩৫ সালে কাড্ডো আদিবাসীরা শ্রিভটাউন কোম্পানির কাছে যে ভূমি বিক্রয় করে, শ্রিভটাউন তারই অংশ ছিল। ১৮৩৮ সালে কাড্ডো প্যারিশ সৃষ্টি করা হলে শ্রিভপোর্ট এর সদর দপ্তর হয়। ১৮৩৯ সালের ২০ মার্চ একে স্থানীয় শাসনের আওতাভুক্ত করা হয়।

এখানে প্রচুর পরিমাণে বাষ্পীয় ইঞ্জিনচালিত নৌকা বিক্রি করা হত। এছাড়াও শহরটি দাসব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ১৮৬০ সালে শ্রিভপোর্ট শহরে ২,২০০ জন স্বাধীন মানুষ ও ১,৩০০ জন ক্রীতদাস ছিল।

গৃহযুদ্ধ ও পুনর্গঠন সম্পাদনা

ইউনিয়ন বাহিনী ব্যাটন রুজ ও ওফেলেসাস দখল করে নেওয়ার পর ১৮৬৩-১৮৬৫ সালে শ্রিভপোর্ট লুইজিয়ানার রাজধানী ছিল। কনফেডারেট বাহিনীর ট্রান্স-মিসিসিপি দপ্তর এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শহরে উত্তর-পশ্চিম শৈলশিরায় আলবার্ট সিডনি জনসন দুর্গ প্রতিষ্ঠিত হয়।

শ্রিভপোর্টের নারীরা গৃহযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। ঐতিহাসিক জন ডি উইন্টারস তার ১৯৬৩ সালের "লুইজিয়ানায় গৃহযুদ্ধ" বইয়ে এর বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। যোদ্ধাদের জন্য কাপড় সেলাই, চাদর দান, অর্থ সংগ্রহ-সহ বিভিন্ন উপায়ে তারা যোদ্ধাদের সাহায্য করেন।

১৮৬২ সালের ডিসেম্বরে কনফেডারেট সৈন্যদের জন্য অর্থ সংগ্রহে শ্রিভপোর্টে আনন্দানুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ১৮৬৩ সালের ৬ এপ্রিল শ্রিভপোর্ট নারী সমিতি একই উদ্দেশ্যে বলনাচের আয়োজন করে। একই মাসে শহরের ম্যানসফিল্ড মহিলা কলেজে কনফেডারেটদের সম্মানে কনসার্ট আয়োজিত হয়।

১৮৭৩ সালে শ্রিভপোর্টে পীতজ্বর মহামারী দেখা যায়, যাতে ৭৫৯ জন অধিবাসী মারা যান। পরবর্তীতে আরো ৪০০ জন পীতজ্বরে মারা যান। [৮]

১৮৯৫ সালে ফ্রেঞ্চ অভিবাসী জাস্টিন ভিনসেন্ট গ্রাস (১৮৬৮-১৯৫৯) শ্রিভপোর্ট শহরের সবচেয়ে বড় মুদি দোকান ও পানশালা খুলেন। তিনি ও তার স্ত্রী ইউজিন লুইজিয়ানার অন্যতম মানবদরদি ব্যক্তি ছিলেন। "কমিউনিটি ফাউন্ডেশন অব নর্থ লুইজিয়ানা" নামক সমাজকল্যাণ সংস্থায় তারা ২.৩ মিলিয়ন ডলার অর্থ দান করেন।

এ শহরে জন্ম নেওয়া অনেক আফ্রো-আমেরিকান সংগীতজ্ঞ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এদের মধ্যে রয়েছেন-হাড্ডি উইলিয়াম লেডবেটার( যিনি লেড বেলি নামে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছিলেন),জেসি থমাস, ডেভ আলেক্সান্ডার ও কেনি ওয়েইন শেফার্ড।

১৯১৪ সালের দিকে রেড নদী পুনরায় নৌ-চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ১৯৯৪ সালে আমেরিকান সেনাবাহিনীর উদ্যোগে এটি পুনরায় নৌ-চলাচলের উপযোগী হয়।

১৯২৪ সালে শ্রিভপোর্টের নাগরিকরা সামরিক বিমানঘাঁটি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। ১৯২৬ সালে তারা জানতে পারে, টেক্সাসের ক্রকেট দুর্গে অবস্থিত সেনাবাহিনীর তৃতীয় আক্রমণ উইং ৫০০% সম্প্রসারণ করা হবে, এবং এজন্য তাদের ৮১ বর্গকিলোমিটার এলাকার প্রয়োজন। ১৯২৭ সালে স্থানীয় নাগরিক নেতা অ্যান্ড্রু কোয়ের্বেস ও জন ডি এউইংয়ের নেতৃত্বে এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কমিটি গঠন করা হয়। তাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা খারিজ হয়ে গেলেও ১৯২৮ সালে ক্যাপ্টেন হ্যারল্ড রস হ্যারিস-কে বিমানঘাঁটির জন্য শ্রিভপোর্টে উপযুক্ত জায়গা নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

ক্যাপ্টেন হ্যারিস বার্কসডেল ফিল্ডের নিকটে একটি তুলা আবাদক্ষেত্রকে জায়গা নির্বাচন করেন। স্থানীয় কমিটি সর্বসম্মতভাবে এর অনুমোদন প্রদান করে। ১৯২৮ সালের ৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রিভপোর্ট বিমানঘাঁটি নির্মাণের জায়গা হিসেবে নির্বাচিত হয়। এজন্য শহরটি ৮০-টি প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে। ৮০০-জন ভূমিমালিককে ১৫,০০,০০০ ডলারের বন্ড প্রদানের মাধ্যমে সরকার জায়গার মালিকানা লাভ করে। ১৯২৯ সালে শ্রিভপোর্টের ভোটাররা এর অনুমোদন প্রদান করেন। ১৯৫৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর বন্ডের মেয়াদ শেষ হয়।

১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বরে জর্জ এস প্যাটন শ্রিভপোর্টে সামরিক মহড়ার আয়োজন করেন।[৯]

শ্রিভপোর্ট শহর থেকেই লুইজিয়ানা হেরাইড রেডিও কার্যক্রম পরিচালনা করত। হ্যাঙ্ক উইলিয়ামসএলভিস প্রিসলির মত খ্যাতনামা শিল্পী এখানে সংগীত পরিবেশন করেছেন।

১৯৬০ এর দশকে শ্রিভপোর্টে নাগরিক অধিকার আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। এখানকার বাসিন্দা ড.সি ও সিম্পসন মার্টিন লুথার কিং এর সঙ্গে কাজ করার দরুন তার বাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়।[১০]

আফ্রিকান আমেরিকান সংগীতজ্ঞ স্যাম কুক ও তার দল শ্রিভপোর্টের একটি সরাইখানায় প্রবেশের চেষ্টা করেন, যেখানে শ্বেতাঙ্গরাই শুধু প্রবেশ করতে পারত। এ কারণে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ প্রেক্ষাপটে তিনি "এ চেঞ্জ ইজ গনা কাম"( পরিবর্তন আসতে চলেছে) গানটি রচনা করেছেন।

১৯৯০ এর দশকে শ্রিভপোর্ট শহরে নৌ-জুয়া জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৫৩,১৯৭৯ ও ১৯৯৯ সালে শহরটি "অল আমেরিকান সিটি" পুরস্কার লাভ করে।[১১]

১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর জর্জ ডব্লিউ বুশ এখানে বার্কসডেল বিমানঘাঁটি পরিদর্শন করেন। ২০০৫ সালের ১১ই মার্চ তিনি শ্রিভপোর্ট শহরে বক্তৃতা দেন।

ভূগোল সম্পাদনা

শ্রিভপোর্ট উত্তর-পশ্চিম লুইজিয়ানার অংশ। এটি ডালাস থেকে ১৮৮ মাইল, টাইলার থেকে ৯৮ মাইল, টেক্সাসের মার্শাল শহর থেকে ৪১ মাইল, লিটল রক থেকে ২১৫ মাইল, আর্কানসাসের টেক্সারকানা থেকে ৭৩ মাইল, ব্যাটন রুজ হতে ২৫০ মাইল, মনরো থেকে ৯৯ মাইল, রুস্টন থেকে ৬৯ মাইল ও মিনডেন থেকে ৩০ মাইল দূরে অবস্থিত।

পশ্চিম ও দক্ষিণ শ্রিভপোর্ট সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ২৫৩ ফুট উপরে অবস্থিত।[১২] শহরের আয়তন ১২২.৩৫ বর্গমাইল, এর ১০৭.১৪ বর্গমাইল স্থল ও ১৫.২১ বর্গমাইল জল। [১৩]

শ্রিভপোর্টের জলবায়ু আর্দ্র উপক্রান্তীয় ধরনের। এখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৫১ ইঞ্চি। বছরে গড়ে ৩৫ দিন হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা বিরাজ করে।

জনমিতি সম্পাদনা

২০১৮ এর সম্প্রদায়গত সমীক্ষা অনুযায়ী শ্রিভপোর্টের জনসংখ্যা ১,৮৯,১৪৯।[১৪] ২০১৯ সালে জনসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১,৮৭,১১২। বাসিন্দাদের ৫৬.৩% আফ্রিকান আমেরিকান, ৩৭.৩% অ-হিস্পানিক শ্বেতাঙ্গ, ০.৬% আদিবাসী আমেরিকান, ১.৯% এশীয় ও ২.২% হিস্পানিক অথবা লাতিনো।

২০১০ এর আদমশুমারি অনুযায়ী, শহরের পরিবারগুলোর গড় আয় ৩৭,১২৬ মার্কিন ডলার। পুরুষদের গড় আয় ৩১,২৭৮ ডলার ও নারীদের গড় আয় ২১,৬৫৯ ডলার। ১৮.৭% পরিবার ও ২২.৮% বাসিন্দা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এদের ৩৩.৩% এর বয়স ১৮ এর নিচে ও ১৬.৩% এর বয়স ৬৫ এর সমান বা বেশি।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "American FactFinder - Results"archive.vn। ২০২০-০২-১২। ২০২০-০২-১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৪ 
  2. Bureau, US Census। "Population and Housing Unit Estimates Tables"The United States Census Bureau (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৪ 
  3. "Greater Shreveport Chamber of Commerce"web.archive.org। ২০০৮-০২-১৯। Archived from the original on ২০০৮-০২-১৯। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৪ 
  4. "Crime down in Shreveport, police say"web.archive.org। ২০১৮-০৬-১৩। Archived from the original on ২০১৮-০৬-১৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৪ 
  5. "Forecast for economic growth in Shreveport is bright"ksla (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৪ 
  6. May, Gerry। "Future of fast internet pops up in Shreveport"KTBS (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-২৪ 
  7. https://www.honeywell.com/newsroom/pressreleases/2016/06/honeywell-uop-opens-new-catalyst-production-line-at-shreveport-la-facility
  8. http://ldh.la.gov/assets/oph/Center-PHCH/Center-CH/infectious-epi/Annuals/LaIDAnnual_YellowFever.pdf
  9. "The Louisiana Maneuvers"The National WWII Museum - New Orleans। সংগ্রহের তারিখ ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ 
  10. "Beyond Galilee"web.archive.org। ২০ আগস্ট ২০১৮। Archived from the original on ২০ আগস্ট ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ 
  11. "All-America City: Past Winners"web.archive.org। ৭ জুলাই ২০১০। ২৬ জুন ২০০২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ 
  12. "Map Shreveport - Louisiana Longitude, Altitude - Sunset"www.usclimatedata.com। সংগ্রহের তারিখ ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ 
  13. "American FactFinder - Results"archive.vn। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০। ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ 
  14. https://data.census.gov/cedsci/table?q=Shreveport%20city,%20Louisiana&g=1600000US2270000&hidePreview=false&tid=ACSDP1Y2018.DP05&vintage=2018&layer=place&cid=DP05_0001E