শিবের বিয়ে

বাঙালি হিন্দু লোকোৎসব

শিবের বিয়ে নবদ্বীপের একটি আঞ্চলিক উৎসব। বাংলার শৈব সংস্কৃতি মেনে অনেক উৎসব প্রচলিত। তাদের মধ্যে নবদ্বীপের শিবের বিয়ে একক ও স্বতন্ত্র ধারা বহন করে চলছে। চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজোর শেষ দিন অর্থাৎ দশমীর পরদিন ভোররাতে শিবের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।[১]

শিবের বিয়ে
শিবের বিয়েতে বুড়োশিবকে চতুর্দলায় সাজানো হয়েছে
পালনকারীবাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়
উদযাপনপ্রথানুসারে বাসন্তী পুজোর পর দশমীর দিন ভোর রাতে
তারিখচৈত্র শুক্লপক্ষ
সংঘটনবার্ষিক
সম্পর্কিতগাজন, চরক

চোখ ধাঁধানো শোভাযাত্রার মাধ্যমে নানা রাস্তা ঘুরে শিবপার্বতীকে চতুর্দলায় সাজিয়ে পোড়ামাতলায় নিয়ে আসা হয়। এই অনুষ্ঠানটিকে বিশেষজ্ঞগণ সমাজের উচ্চ শ্রেণী ও নিম্ন শ্রেণীর মিলন বলে মনে করেন। শিব এখানে নিম্ন শ্রেণী ও পার্বতী উচ্চ বংশীয় কন্যা। এবং এই বিয়ে সামাজিক মিলনের বহিঃপ্রকাশ।[২]

প্রাচীনত্ব সম্পাদনা

বাংলায় শৈব ধর্মের শিকড় অনেক গভীরে। সামান্য কিছু বৈদিক প্রভাব ছাড়া বাংলার সংস্কৃতি মূলত বৈদিক পূর্ববর্তী সংস্কৃতিতে সম্পৃক্ত। তেমনই শৈব ধর্ম একটি অবৈদিক বা বেদ পূর্ববর্তী যুগের সংস্কৃতি। বঙ্গদেশে প্রচলিত শৈব ধর্মীয় অনুষ্ঠান গুলির মধ্যে গাজন, চরক, শিবের বিয়ে, শিবরাত্রি বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এদের মধ্যে শিবের বিয়ে একটি বিশেষ উৎসব। নবদ্বীপের এই উৎসবের প্রাচীনত্ব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞগণ এটিকে অন্তত ৫০০ থেকে ৬০০ বছরের প্রাচীন উৎসব বলে মনে করেন। তবে নবদ্বীপ খুবই বন্যা প্রবণ একটি অঞ্চল হওয়ায় অত পুরোনো পুঁথিপত্রের মাধ্যমে সঠিক বয়স নির্ণয় করা সম্ভব হয় নি। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে বিশেষকগণ এটিকে সাড়ে তিনশ বছরের প্রাচীন উৎসব[২] বলে চিহ্নিত করেছেন।

বাসন্তী পূজা ও শিবের বিয়ে সম্পাদনা

সমগ্র বঙ্গদেশের ন্যায় নবদ্বীপেও বাংলা দিনপঞ্জি অনুযায়ী চৈত্র মাসের শুক্ল ষষ্ঠি,সপ্তমী,অষ্টমী, নবমী ও বিজয়া দশমী তিথি মেনে সাড়ম্বরে পাঁচদিন বাসন্তী দুর্গা পুজো অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু, নবদ্বীপের বাসন্তী পুজোয় অতিরিক্ত সংযোজন হলো এই শিবের বিয়ের অনুষ্ঠান। বাসন্তী পুজোর শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয় শিবের বিয়ের অনুষ্ঠানটি। বাসন্তী পুজো সমাপ্ত হলে, পাঁচ দিন ধরে অনুষ্ঠিত হওয়া বাসন্তী পুজোর সুসজ্জিত মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমার সাথে নবদ্বীপের মন্দিরে অধিষ্ঠিত শিবের বিবাহ সম্পন্ন হয়। বাসন্তী পুজোর ভোরে শিবের মুখোশ তৈরি করে সেটিকে চতুর্দলায় সাজিয়ে নিয়ে বর সাজানো হয়। অন্যদিকে দুর্গা ঠাকুরকে (বাসন্তী ঠাকুরকে) দোলায় সাজিয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে অবশেষে পোড়ামা তলায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে বাঙালি হিন্দু বিবাহ রীতি মেনে শিব ও মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার বিয়ে দেওয়া হয়। সাতপাকে ঘোরা থেকে শুরু করে মালা বদল জলসাজ সবই হয়। এর পর আতশবাজির বাজির প্রদর্শনীর অনুষ্ঠান করা হয়।[২]

বিয়ের যৌতুক সম্পাদনা

এই বিয়েতে নানা উপহারের ব্যবস্থাও করা হয়। শহরের বিশিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানের শ্রেষ্ঠ সামগ্ৰী এই বিয়ের যৌতুক হিসাবের দেন। খাট বিছানা আলমারী থেকে শুরু করে সাইকেল বাইক সবই দেওয়া হয়।[২]

সংস্কৃত গবেষক শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্ত বলেন,

বিয়ের ভোজন সম্পাদনা

নবদ্বীপ শহরের বিশিষ্ঠ ব্যক্তিরা বিয়ের পর আগত দর্শনার্থীদের জন্য খাওয়ানোর ব্যবস্থাও করেন। লুচি-আলুদম, মিষ্টি, খিচুড়ি ইত্যাদি খাওয়ানো হয়। আজও এই প্রাচীন ধারা একই ভাবে পালিত হচ্ছে।[২]

কয়েকটি বিশেষ বিয়ের আয়োজন সম্পাদনা

নবদ্বীপের সাতটি নোরাকৃতি বৌদ্ধ ধারার শিবের মধ্যেই এই বিয়ের প্রচলন আছে। তারা হলো বুড়োশিব, যোগনাথ, বালকনাথ, দন্ডপাণি শিব,নন্দী পাড়ার পলকেশ্বর, দেয়াড়াপাড়ার আলোকনাথ, বৌবাজারের বানেশ্বর। আগে বাসন্তীপুজোর দশমীর ভোরে বুড়োশিব আর যোগনাথ শিবের জোড়া বিয়ের আয়োজন হতো। সত্তরের দশক থেকে উৎসবে কিছুটা ভাঁটা পড়ে। জাঁকজমক কমে, বুড়োশিব ছাড়া অনেক শিবেরই বিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। তবে আবার এই উৎসব চেনা আঙ্গিকে ফিরেছে। পুরাতত্ত্ব পরিষদের শান্তিরঞ্জন দেব বলেন,

লোকসংস্কৃতি ও মৃৎশিল্প সম্পাদনা

 
নবদ্বীপের শিবের মুখোশ

শিবের মুখোশ নবদ্বীপের এই লৌকিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ।[৩] চৈত্র মাসে শিবপার্বতীর বিয়ের সময় এই মুখোশ তৈরি করা হয়। লৌকিক শৈব সংস্কৃতির সাথে এই মুখোশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটিকে মুখোশ বলা হলেও আসলে এটি মাটি দিয়ে তৈরি মূর্তি। বহুবর্ণশোভিত এই মুখোসটি লৌকিক শিল্পের অন্যতম নিদর্শন। শিল্পী নারায়ণ পাল এখনও এই ধরনের মূর্তি তৈরি করেন।[৩][৪]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "আনন্দবাজার পত্রিকা - মুর্শিদাবাদ ও নদিয়া"। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৩-২৯ 
  2. "আজ শিবের বিয়ে নিয়ে মাতোয়ারা হতে প্রস্তুত নবদ্বীপবাসী"bartamanpatrika.com। ২০১৯-০৪-১৪। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-০৭ 
  3. বিশ্ব বাংলা। বাংলার পুতুল (পিডিএফ)। বিশ্ব বাংলা। [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  4. সাঁতরা, তারাপদ (২০০০)। "পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পী সমাজ"search.iisg.amsterdam। কলকাতা: লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার। পৃষ্ঠা ৪২। আইএসবিএন 8187360224। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-০৭