লোহিত সরণ
লোহিত সরণ বলতে একটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তু কর্তৃক নিঃসরিত তড়িচ্চৌম্বক বিকিরণের (সাধারণত দৃশ্যমান আলো) তড়িচ্চৌম্বক বর্ণালির লাল প্রান্তের (অপেক্ষাকৃত দুর্বল) দিকে সরে যাওয়াকে বোঝায়। পদার্থবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কোন উৎস থেকে আগত তড়িচ্চৌম্বক বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য গ্রাহক প্রান্তে এসে বেড়ে যাওয়ার ঘটনাটিকেই সাধারণভাবে লাল সরণ বলা হয়। তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এই বৃদ্ধির কারণে এর কম্পাঙ্ক হ্রাস পায়। বিপরীতক্রমে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের হ্রাস পাওয়ার ঘটনাকে নীল সরণ বলা হয়। যেকোন ধরনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বৃদ্ধির ঘটনাকেই লাল সরণ নামে আখ্যায়িত করা হয়, উক্ত তরঙ্গটি আলোকীয় না হলেও তথা দৃশ্যমান আলোক সীমার মধ্যে না থাকলেও। যেমন, সাধারণ আলোক তরঙ্গ না হয়ে এটি এক্স-রশ্মি, গামা রশ্মি বা অতিবেগুনি রশ্মি-ও হতে পারে। এক্ষেত্রে নামকরণটি অদ্ভুত মনে হতে পারে। কারণ লাল আলোর চেয়ে বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্য যাদের (যেমন অবলোহিত, ক্ষু্দ্র-তরঙ্গ অথবা বেতার তরঙ্গ) তাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আরও বৃদ্ধি ঘটলে নিঃসন্দেহে তা হবে লাল আলোর সীমার অনেক বাইরে। তথাপি সে ঘটনাকেও লাল সরণই বলতে হবে। মোট কথা লাল সরণ বিকিরণকে লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়।
মোট তিনটি কারণের উপর ভিত্তি করে লোহিত সরণের প্রকারভেদ করা যায়। সাধারণ ডপলার ক্রিয়া, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ এবং মহাকর্ষীয় প্রভাবের অধীনে কাল দীর্ঘায়ন সেই তিনটি কারণ। একটি আলোক-উৎস যখন পর্যবেক্ষক থেকে দূরে সরে যায় তখন পর্যবেক্ষকের কাছে উৎস থেকে আগত তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের যে পরিবর্তন হয় তাকেই ডপলার সরণ বা ডপলার লোহিত সরণ বলা হয়। মহাবিশ্ব প্রসারিত হওয়ার কারণে মহাজাগতিক লাল সরণ ঘটে থাকে। দূরবর্তী ছায়াপথ, কোয়াসার এবং আন্তঃছায়াপথীয় গ্যাস মেঘের লোহিত সরণ পৃথিবী থেকে তাদের দূরত্বের সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়। এই বলবিজ্ঞানটিকে কাজে লাগেই আধুনিক বিশ্বতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মহা বিস্ফোরণ মতবাদের ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হয়েছে। পর্যবেক্ষক যদি উৎসের তুলনায় উচ্চ মহাকর্ষীয় বিভবে অবস্থান করে তাহলে মহাকর্ষীয় লাল সরণ ঘটে। ব্যাপক অপেক্ষবাদ অনুসারে সুবৃহৎ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তুর নিকটে যে কাল দীর্ঘায়ন ঘটে তা-ই এই লোহিত সরণের কারণ। এই নিবন্ধে বর্ণিত কাঠামো রুপান্তরের নীতির মাধ্যমে এই তিনটি বিষয়েরই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। লোহিত সরণ ছাড়াও তড়িচ্চৌম্বক বিকিরণে অন্য কোন ধরনের সরণ আনয়নের জন্য অসংখ্য ভৌত ও গাণিতিক প্রক্রিয়া রয়েছে। সেগুলোকে লোহিত সরণের সাথে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবেনা।
ইতিহাস
সম্পাদনাঊনবিংশ শতাব্দীতে তরঙ্গ বলবিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং ডপলার ক্রিয়া সংক্রান্ত মৌলিক গবেষণা ও অনুসন্ধানের প্রসারকেই লোহিত সরণ আবিষ্কারের সূচনা হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৮৪২ সালে ক্রিস্টিয়ান আনড্রেয়াস ডপলার সর্বপ্রথম এ ধরনের ঘটনার ভৌত ব্যাখ্যা প্রদান করেন।[১] এরপর ওলন্দাজ আবহাওয়াবিদ ক্রিস্টফ হেন্ড্রিক ডিডেরিক বাইস বালেট ১৮৪৫ সালে শব্দ তরঙ্গের ক্ষেত্রে ডপলারের প্রকল্পটি বাস্তব পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করেন।[২] এই প্রকল্প যে সকল ধরনের তরঙ্গের জন্য প্রযোজ্য হবে সে সম্বন্ধে ডপলারের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছিল। ডপলার আরও বলেছিলেন, তারার বর্ণ পরিবর্তনের কারণও এটি হতে পারে। পরে জানা গেছে তারার বর্ণ পরিবর্তনের কারণ তাদের অভ্যন্তরস্থ তাপমাত্রা, ডপলার ক্রিয়া নয়। কিন্তু, ডপলার ক্রিয়ার অব্যাহত সাফল্যের ফলে পরিশেষে লোহিত সরণ আবিষ্কার তাকে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী আর্মান্ড হিপ্পোলাইট লুই ফিজো ১৮৪৮ সালে সর্বপ্রথম ডপলার লোহিত সরণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি তারার বর্ণালি রেখায় সরণের কারণ হিসেবে ডপলার ক্রিয়াকে উল্লেখ করেছিলেন। নির্দিষ্ট এই ক্রিয়াটিকে তাই অনেক সময় "ডপলার-ফিজো ক্রিয়া" বলা হয়ে থাকে। ১৮৬৮ সালে ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়াম হাগিন্স এই ক্রিয়া ব্যবহার করে প্রথম পৃথিবী থেকে অপসৃয়মাণ তারার বেগ নির্ণয় করেন।[৩]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Doppler, Christian (১৮৪৬)। Beiträge zur fixsternenkunde। 69। Prague: G. Haase Söhne। বিবকোড:1846befi.book.....D।
- ↑ Maulik, Dev (২০০৫)। "Doppler Sonography: A Brief History"। Maulik, Dev; Zalud, Ivica। Doppler Ultrasound in Obstetrics And Gynecology। Springer। আইএসবিএন 978-3-540-23088-5।
- ↑ Huggins, William (১৮৬৮)। "Further Observations on the Spectra of Some of the Stars and Nebulae, with an Attempt to Determine Therefrom Whether These Bodies are Moving towards or from the Earth, Also Observations on the Spectra of the Sun and of Comet II"। Philosophical Transactions of the Royal Society of London। 158: 529–564। ডিওআই:10.1098/rstl.1868.0022। বিবকোড:1868RSPT..158..529H।