র‍্যনে জিরার

ফরাসি ইতিহাসবিদ, সাহিত্য সমালোচক, সমাজতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক দার্শনিক এবং অনুকরণমূলক অভিলাষ

র‍্যনে নয়েল তেওফিল জিরার[ক][খ] (ফরাসি: René Noël Théophile Girard, ফরাসি উচ্চারণ: ​[ʁəne ʒiʁaʁ]; ২৫শে ডিসেম্বর ১৯২৩ – ৪ঠা নভেম্বর ২০১৫) ছিলেন একজন ফরাসি ঐতিহাসিক, সাহিত্য সমালোচকসামাজিক বিজ্ঞানের দার্শনিক। তাঁর কাজ দার্শনিক নৃবিজ্ঞান ঐতিহ্যের অন্তর্গত। জিরার বহু আকাদেমীয় পরিমণ্ডলব্যাপী বিস্তৃত প্রায় তিরিশটি বইয়ের লেখক ছিলেন। তাঁর কাজ বিংশ ও একবিংশ শতকের সাহিত্য সমালোচনা, সমালোচনামূলক তত্ত্ব, নৃবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, পুরাণতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, অর্থশাস্ত্র, সাংস্কৃতিক গবেষণাদর্শনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

র‍্যনে জিরার
René Girard
Girard in 2007
জন্ম
র‍্যনে নয়েল তেওফিল জিরার
René Noël Théophile Girard

(১৯২৩-১২-২৫)২৫ ডিসেম্বর ১৯২৩
আভিনিওঁ, ফ্রান্স
মৃত্যু৪ নভেম্বর ২০১৫(2015-11-04) (বয়স ৯১)
জাতীয়তাফরাসি
শিক্ষাএকল নাসিওনাল দে শার্ত (স্নাতক)
ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় ব্লুমিংটন (পিএইচডি)
পরিচিতির কারণবুনিয়াদি নৃবিজ্ঞান
অনুকরণমূলক তত্ত্ব
অনুকরণমূলক আকাঙ্ক্ষা
অনুকরণমুলক যুগ্ম দ্বিবাঁধাই
কুরবানির উৎপত্তি ও মানব সংস্কৃতির ভিত্তি হিসেবে বলির পাঁঠায়ন পদ্ধতি
দলীয় সংঘাত তত্ত্ব
দাম্পত্য সঙ্গীমার্তা জিরার[১]
সন্তান
পুরস্কারইম্মর্তেল দ্য লাকাদেমি ফ্রঁসেজ (আসন ৩৭)
শ্যভালিয়ে দ্য লা লেজিওঁ দনর
কমঁদঁ দ্য লর্দ্র দেজ আর এ দে লেত্র
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
প্রতিষ্ঠানসমূহডিউক বিশ্ববিদ্যালয়
ব্রিন মার কলেজ,
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়
বাফেলো বিশ্ববিদ্যালয়
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়
ডক্টরেট শিক্ষার্থীস্যান্ডর গুডহার্ট
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থীঅ্যান্ড্রু ফিনবার্গ
স্বাক্ষর

দর্শনশাস্ত্রে (এবং এর সূত্র ধরে অন্যান্য উচ্চশিক্ষায়তনিক ক্ষেত্রগুলিতে) জিরারের মূল অবদান ছিল অভিলাষের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও নৈতিক ব্যবস্থাসমূহ-সংক্রান্ত উপক্ষেত্রে তাঁর গবেষণা। জিরার বিশ্বাস করতেন যে প্রাথমিকভাবে একটি পর্যবেক্ষণভিত্তিক অনুকরণমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের বিকাশ ঘটে। একটি শিশু প্রাপ্তবয়স্কদের আচরণ নকল করা শেখার মাধ্যমে ঐ শিশুর মধ্যে অভিলাষের বিকাশ ঘটে। শিশু তথা ভবিষ্যৎ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে পরিচিতি, জ্ঞান ও বস্তুগত সম্পদ অর্জনের যে অভিলাষ কাজ করে, জিরারের মতে তার মূল ভিত্তি হল অন্যকে অনুকরণ করা অর্থাৎ অন্যের যা আছে, তা নিজের কাছেও থাকার অভিলাষ।

মানবসমাজে যত প্রতিযোগিতা, দ্বন্দ্ব বা সংঘাত আছে, জিরারের মতে এর সবকিছুর মূলে আছে এই অনুকরণমূলক অভিলাষ। ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে বা গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে এই অভিলাষজনিত দ্বন্দ্ব-সংঘাত শেষ পর্যন্ত যখন বিপজ্জনক এক ধ্বংসাত্মক ধাপে গিয়ে পৌঁছায়, তখন এই সংঘাতকে হালকা বা লঘু করার জন্য অন্য কোনও ব্যক্তি বা বস্তুকে বলির পাঁঠা বানানো হয়, জিরার যার নাম দিয়েছেন বলির পাঁঠায়ন কর্মপদ্ধতি। মানুষ সাধারণত সংঘাতের কারণ হিসেবে তার নিজের অবদান বা অংশীদারত্বের দায়িত্ব নিতে চায় না কিংবা এ নিয়ে আত্ম-সমালোচনা করতে নারাজ থাকে। এর পরিবর্তে মানুষেরা দলমত নির্বিশেষে একত্রিত হয় এবং সংঘাতে যার সবচেয়ে কম জনসমর্থন আছে (যেমন: কোনও অজনপ্রিয় রাজা বা শাসক, কোনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, কোনও বিদেশী ব্যক্তি বা দল, ইত্যাদি), সেই ব্যক্তি বা দলকে হত্যা করে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লঘু করার প্রচেষ্টা চালায়। এভাবে কাউকে হত্যার পরে তারা নিজেদেরকে বলে যে তাদের মধ্যে সংঘাতজনিত উত্তেজনা অনেক হ্রাস পেয়েছে এবং তারপরে নিহত রাজা বা ব্যক্তিকে মানুষ দেবতা, দেবতাতুল্য মানব, বা সাধুর আসনে অধিষ্ঠিত করে। অথবা তারা নিজেদের মধ্যে সংঘাতের কারণ হিসেবে সম্পূর্ণ নিরপরাধ তৃতীয় কোনও পক্ষকে অভিযুক্ত করে, যে তৃতীয় পক্ষকে হত্যা করার প্রক্রিয়াটি একটি সাধারণ একত্রীকরণমূলক পৌরাণিক ভিত্তিস্তর হিসেবে একটি মানব সংস্কৃতির জন্ম দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে কাজ করে।

জিরারের মতে এ কারণেই ধর্ম ও পুরাণের উৎপত্তি মানব সমাজ, সভ্যতা ও ইতিহাসের বিবর্তনের অপরিহার্য ধাপ ছিল। অনুকরণমূলক দ্বন্দ্ব ও অভীষ্ট বস্তুসমূহের অসম বিতরণ থেকে স্বাভাবিকভাবেই যে হিংস্রতার সৃষ্টি হয়, তাকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যেই পুরাণ ও ধর্মের উৎপত্তি। ধর্ম কাউকে বলির পাঁঠা বানানোর প্রবৃত্তিকে কাল্পনিক ধারণার দিকে ধাবিত করে; যেমন অন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়, বরং অশুভ অপদেবতা বা শয়তানকে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের জন্য দায়ী করা হয়। তাই যদি ধর্ম না থাকতো, তাহলে জিরারেত মতে মানুষে মানুষে সংঘাত অনেক বেশি বৃদ্ধি পেত। জিরারের এই চিন্তাধারা ছিল বিংশ শতাব্দীতে তাঁর জীবদ্দশাতে বহুল প্রচলিত উত্তর-আধুনিকতাবাদের ঘোর বিরোধী। মানব প্রকৃতি নিয়ে মূলধারায় প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিগুলির তুলনায় জিরারের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অনেক বেশি নিরাশাবাদী। তিনি মনে করতেন ধর্ম ও ধর্মীয় রচনাবলির মূল উদ্দেশ্য হল সংঘাত নিরসনের লক্ষ্যে কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বলির পাঁঠা বানিয়ে যেন হত্যা না করা হয়, তা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে তাঁর চিন্তাধারাতে ফ্রিডরিখ নিচের চিন্তাধারার প্রভাব ও সম্প্রসারণ লক্ষ্য করা যায়।

জিরার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত এবং এর পরে ১৯৮২ সাল থেকে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত আরেক খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। সারা জীবনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৫ সালের ১৭ই মার্চ তারিখে তাঁকে ফ্রান্সের মর্যাদাবাহী উচ্চশিক্ষায়তনিক প্রতিষ্ঠান আকাদেমি ফ্রঁসেজ তাঁকে ৪০ জন “অমর” (লেজ ইম্মর্তেল, Les immortels) সদস্যের একজন হিসেবে মনোনীত করে। দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পরে জিরার ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড শহরে তার নিজস্ব বাসভবনে ৯১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[১]

পুরস্কার ও সম্মাননা

সম্পাদনা

গ্রন্থতালিকা

সম্পাদনা

আরও দেখুন

সম্পাদনা

পাদটীকা

সম্পাদনা
  1. এই ফরাসি ব্যক্তিনামটির বাংলা প্রতিবর্ণীকরণে উইকিপিডিয়া:বাংলা ভাষায় ফরাসি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণে ব্যাখ্যাকৃত নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে।
  2. /ʒɪəˈrɑːrd/;[২]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Haven, Cynthia (নভেম্বর ৪, ২০১৫)। "Stanford professor and eminent French theorist René Girard, member of the Académie Française, dies at 91"Stanford University। মার্চ ২৩, ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ৪, ২০১৫ 
  2. "René Girard CBC interview part 1 of 5 (audio only)"

অধিকতর পাঠ

সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা