রেশম প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক তন্তু। তন্তুর রানী রেশম। সারা বিশ্বে রেশমের ব্যবহার হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। এই রেশমের ইতিহাস জানা খুবই দরকার।

ইতিহাস

সম্পাদনা

জন্মের চার হাজার বছর পরেও রেশম শিল্প বা রেশম গুটির চাষ মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। ঐতিহাসিকেরা এব্যাপারে একমত যে প্রথমত চিনারাই আবিষ্কার করেছিল রেশমকে। বন জঙ্গল থেকে তসর বা রেশম মথের গুটি সংগ্রহ করে তা থেকে রেশম বার করানো হত। চৌ কিং এর লিখিত বিবরণ থেকে (২২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) জানা যায় প্রাচীনকালেও রেশমের ব্যবহার হত। বিশেষত কোন উৎসব বা অনুষ্ঠানে সম্রাটের সম্মানের প্রতীক হিসেবে রেশমের ব্যবহার প্রচলিত ছিল।

চিনের পর যে কোন দেশ রেশম চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল সে ব্যাপারে মত পার্থক্য আছে। অনেকের মতে জাপান, আবার কেউ কেউ বলেন কোরিয়া। তবে মোটামুটি জানা গেছে ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চিন থেকে জাপানে বা কোরিয়াতে এই শিল্পের প্রসার ঘটে।

প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে প্রমাণ মেলে, অতি প্রাচীন কালেও ভারতে অন্যতম শিল্প ছিল এই রেশম শিল্প। খ্রিস্টপূর্বাব্দ ১৪০ নাগাদ ভারতে প্রথম তুঁত গাছের চাষ হয়েছিল। পরে রেশম গুটি চাষের প্রাথমিক পদ্ধতি চিন থেকে তিব্বতের পথ দিয়ে ভারতে প্রসার লাভ করেছিল। তখন গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পারে ব্যাপকভাবে তুঁত চাষ ও পলুপালন শুরু হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য অনেকে বলেন, রেশমকীটকে ভারতে যারা প্রথম গৃহপালিত করতে পেরেছিলেন, তারা হলেন হিমালয়ের পাদদেশ অঞ্চলের অধিবাসী। সে যাই হোক রেশম শিল্প ভারতের বুকে মোটামুটি ভাবে প্রতিষ্ঠিত হল চতুর্থ শতাব্দীতে। মধ্য এশিয়ার অন্যান্য কয়েকটি দেশ এ ব্যাপারে চুপচাপ থাকল না। তারা শিল্প স্থাপনের কাজে ব্রতী হল। ওদিকে পারস্য, রোম ও অন্যান্য বহু দেশ রেশম ও রেশমজাত দ্রব্যাদি আমদানি করতে শুরু করল। রোমে রেশমের কদর ও চাহিদা এতই বেড়ে গেল যে প্রয়োজন অনুযায়ী সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছিল না। অবস্থা ও চাহিদার গুরুত্ব উপলব্ধি করে রোমের দুজন মনীষী তিব্বত থেকে রেশমগুটির চাষ পদ্ধতি হাতে কলমে শিখে নিলেন। অবশেষে তারা অক্লান্ত পরিশ্রমে কনসটানটিনোপলে এই রেশম শিল্প প্রতিষ্ঠিত করে এক বৃহৎ আলোড়ন জাগালেন। ধীরে ধীরে রোমানরা নিজের চেষ্টায় রেশম উৎপাদন করতে সক্ষম হল। ক্রমান্বয়ে এথেন্স ও করিয়নথে এই শিল্প গড়ে উঠল।

নবম শতাব্দীর শেষ ভাগে ভিনিসে রেশম শিল্পের প্রসার ঘটল। ক্রমে এর উন্নয়ন এতই ব্যাপক ভাবে হল যে ইউরোপের অনেকটা চাহিদা মেটানো গেল।

ইতালি থেকে রেশম শিল্পের প্রসার ঘটল ফ্রান্সে। রেশম মথের ডিম ও তুঁত গাছের বীজ নিয়ে এসে বহু সম্ভ্রান্ত বংশীয় মানুষ পলু পালনের কাজ আরম্ভ করলেন। ধীরে ধীরে এই শিল্প ফ্রান্সের বুকেও প্রতিষ্ঠিত হল অষ্টাদশ শতাব্দীতে। তারপর উনবিংশ শতাব্দীতে ফ্রান্সের বুকে নেমে এল এক অভিশাপ। এক মহামারী রোগ। ফ্রান্সের বেশম শিল্পকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলল পেবরিন নামে এক রোগ। সেই সময় লুই পাস্তুর রোগের কারণ আবিষ্কার করলেন। সেটা ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের কথা। রোগ প্রতিকারের কিছু কিছু পথ তিনি বলে দিলেন। তবুও কিন্তু ফ্রান্সে এই শিল্পকে প্রতিষ্ঠিত করা গেল না। কোন রকমে ধুঁকতে ধুঁকতে তা বেঁচে থাকল। এদিকে ব্রিটিশ ভারতে এসে সমৃদ্ধশালী রেশম শিল্প দেখে চমকে উঠল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এই শিল্পের ব্যাপক উন্নতির জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করল। পরে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে রেশম কেন্দ্র গড়ে তুলল। তারা বিদেশেও রেশম রপ্তানি করতে লাগল।

স্বাধীনতা লাভের পর কুটির শিল্পের অন্যতম প্রধান রেশম শিল্পের উপর গুরুত্ব বাড়ল। প্রতিটি পাঁচসালা পরিকল্পনাতেই এই শিল্পের উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থা রাখা হল।

অন্যান্য দেশেও এই শিল্পের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ব্যাপক উন্নতি সাধনে ব্যাপৃত হল। ফলে রেশম শিল্প একরকম দিগ্বিজয় করে বসল। উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশ জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়ন যান্ত্রিক ও কারিগরি বিদ্যার প্রয়োগে ও উপযুক্ত গবেষণার সাহায্যে এই শিল্পকে ব্যাপক আকার দিল। চিন, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া এ ব্যাপারে পাল্লা দিয়ে চলতে লাগল। ভারতের মতো বহু উন্নয়নশীল দেশেরই এখন গ্রামীণ শিল্পের অন্যতম বিষয় রেশম গুটির চাষ বা পলুপালন। রেশম অন্যদেশে বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য আনল চিন, জাপান ও ভারত। বিগত প্রায় সত্তর বছর ধরে জাপানের মোট বৈদেশিক মুদ্রার ৩০ থেকে ৫০ শতাংশই রেশম ও রেশমজাত দ্রব্য রপ্তানি করেই অর্জিত হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অসামান্য সাফল্যের দিকে দৃষ্টি রেখে অন্যান্য বহু দেশও উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে লাগল রেশম উৎপাদনের জন্য। ফলে সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত মোট তিরিশটি দেশে তুঁত চাষ ও পলু পালন করা হচ্ছে।[১]

রেশম উৎপাদন

সম্পাদনা

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে সারা বিশ্বে ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালে রেশম উৎপাদন ও চাহিদা উভয়ই ২-৫ শতাংশ হারে প্রতি বছরই বেড়েছে। রেশম হয়ে উঠেছে তন্তুর রাণী। ১৯৭০ সালে সারা বিশ্বে কাঁচা রেশমের মোট উৎপাদন হয়েছিল ৪০,২৫৪ মেট্রিক টন। কয়েকটি দেশের উৎপাদন নিম্নরূপ:

১৯৬৮ সাল

১৯৭০ সাল

(উৎপাদন মেট্রিক টন হিসেবে)

জাপান

২০,৭৫৫

২০,৭১৫

চিন

৮,৪৫০

১১.১২৪

সোভিয়েত ইউনিয়নঃ

২,৯৩০

২,৯৪০

ভারত ১,৭৪৫

২,২৫০ [২]


যে সমস্ত দেশ কাঁচা রেশম ও রেশমজাত দ্রব্য আমদানি করে, তাদের মধ্যে ইতালি, আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, জার্মান, থাইল্যান্ড ও হংকং উল্লেখযোগ্য।

বলা প্রয়োজন, উৎপন্ন রেশম মূলত গৃহপালিত রেশমকীট থেকেই পাওয়া যায়। এই রেশমকীট বা লার্ভার মূল খাদ্যই তুঁত পাতা। তাই রেশম শিল্প উৎপাদনের খরচের ৬০ শতাংশই ব্যয় করা হয় এই তুঁত চাষের জন্য। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এক আউন্স রেশম মথের ডিম থেকে যে লার্ভা হয় তাদের পালনের জন্য প্রায় এক মেট্রিক টন তুঁত পাতা লাগে। এ থেকে আর্ন্তজাতিক মানের ২৫ থেকে ৩০ কিলোগ্রাম গুটি বা কোকুন পাওয়া সম্ভব। এক হেক্টর উর্বর জমিতে ভালো ভাবে চাষ করলে বছরে প্রায় তিরিশ টন তুঁতপাতা পাওয়া যায়। ব্যাপক গবেষণার সাহায্যে এই সাফল্য বর্তমান যুগে আনা গেছে।

ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন এর এক হিসেবে দেখা যায় ১৯৮০ সালে বিশ্বে রেশমের চাহিদা হয়েছিল প্রায় ৪৮,০০০ মেট্রিক টন। আর্ন্তজাতিক বাজারে রেশমের উপযুক্ত চাহিদা বর্তমান; তা ছাড়া রেশম শিল্প বেকারি দূরীকরণ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে আগে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল এবং বর্তমানেও ভালোভাবে টিকে থাকবে বলে মনে হয়।[৩]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি=পরমপরশ
  2. টেমপ্লেট:বই উদ্ধৃতি= মাসিক বুলেটিন
  3. টেমপ্লেট:ভূমিলক্ষ্মী