যন্ত্র প্রকৌশল, যন্ত্র নির্মাণ ও স্মৃতিবিজ্ঞানের আলোচনায় যন্ত্রকৌশল বলতে কোনও যন্ত্র, যন্ত্রের অংশবিশেষ কিংবা যান্ত্রিক ব্যবস্থার ভেতরে অবস্থিত একাধিক অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর, দৃঢ় ও বিকৃতিরোধী গতিশীল যন্ত্রাংশ নিয়ে গঠিত সমবায়কে বোঝায়, যা যন্ত্রের ভেতরে গতি সঞ্চার, নিয়ন্ত্রণ বা সীমাবদ্ধ করে কোনও বিশেষ ক্রিয়া সম্পাদন করে।[] একে ইংরেজি পরিভাষায় মেকানিজম (Mechanism) বলে। যন্ত্রকৌশলে গতিশীল যন্ত্রাংশগুলি এমনভাবে সুবিন্যস্ত ও পরস্পরের সাথে সংযুক্ত থাকে, যাতে সেগুলি যন্ত্রকৌশলটির এক প্রান্তে প্রবিষ্ট বল ও গতিকে পূর্বনির্ধারিত উপায়ে রূপান্তরিত করে অপর প্রান্তে উদ্দীষ্ট বল ও গতি উৎপাদন করা হয়। একটি যন্ত্রকৌশল এক ধরনের স্মৃতিশৃঙ্খল (Kinematic chain) যাতে অন্তত একটি সংযোগকারী বস্তু (link) প্রসঙ্গকাঠামোর সাপেক্ষে স্থির থাকে। যন্ত্রকৌশলে প্রতিটি যন্ত্রাংশকে এমনভাবে বিন্যস্ত করা থাকে যাতে এগুলির আপেক্ষিক গতি সুনির্দিষ্ট ও সীমায়িত থাকে, অর্থাৎ যন্ত্রাংশগুলি একে অপরের সাপেক্ষে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু উপায়ে নড়াচড়া করতে পারে।[] কোনও যন্ত্রের যন্ত্রকৌশলগুলিকে আপাতদৃষ্টিতে জটিল মনে হলেও এগুলিকে সর্বদা অপেক্ষাকৃত সরলতর কতগুলি মৌলিক যন্ত্রকৌশলের একটি সমবায় হিসেবে বিশ্লেষণ করা যায়। এরূপ প্রতিটি মৌলিক যন্ত্রকৌশলের সদস্য অংশগুলি একটি সংযোগকারী বস্তু (link) থেকে আরেকটিতে গতি সঞ্চার করে। পদার্থবিজ্ঞানে ক্ষমতা হল বল ও গতির সমন্বিত বহিঃপ্রকাশ। যন্ত্রকৌশলের কাজ হল ক্ষমতার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি অভীষ্ট গতি ও বল অর্জন করা।

Bonsack's machine
জেমস আলবার্ট বনসাক ১৮৮০ সালে প্রথম সিগারেট রোলিং মেশিন তৈরি করেন।

একটি যন্ত্রকৌশল সাধারণত বেশ কিছু গতিশীল যন্ত্রাংশ নিয়ে গঠিত, যেমন:

যন্ত্রকৌশল সাধারণত একটি বৃহত্তর যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ, যাকে যান্ত্রিক ব্যবস্থা বা যন্ত্র বলে। যেমন একটি মোটরগাড়ির দিকনিয়ন্ত্রক যন্ত্রকৌশল (স্টিয়ারিং মেকানিজম Steering mechanism) বা কোনও হাতঘড়ির দম দেওয়ার যন্ত্রকৌশল (ওয়াইন্ডিং মেকানিজম Winding mechanism)। সাধারণত অনেকগুলি যন্ত্রকৌশলের সমবায়কেই যন্ত্র বলে। যন্ত্রের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হল সরবরাহকৃত শক্তিকে কোনও অভীষ্ট কাজে রূপান্তরিত করা। যন্ত্রের ভেতরে অবস্থিত বিভিন্ন যন্ত্রকৌশলের উদ্দেশ্য হল বিভিন্ন ধরনের বল ও গতির সমবায় সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কোনও যন্ত্রকে সেটির চূড়ান্ত উদ্দেশ্য পালনে অর্থাৎ অভীষ্ট কাজ সম্পাদনে সাহায্য করা।

উদাহরণ: বাইসাইকেলের সম্মুখচালনা যন্ত্রকৌশল

সম্পাদনা

বাইসাইকেল বা দ্বিচক্রযান একটি পরিবহন যন্ত্র যার উদ্দেশ্য মানুষের দৈহিক শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিকে রূপান্তরিত করা এবং মানুষের পা দ্বারা প্রযুক্ত বলে নিহিত যান্ত্রিক শক্তিকে কাজে রূপান্তরিত করে কোনও নির্দিষ্ট দূরত্বের পথ অতিক্রম করা। একটি সরল বাইসাইকেল যন্ত্র তিনটি যন্ত্রকৌশলের সমষ্টি: সম্মুখচালনা যন্ত্রকৌশল (Driving mechanism ড্রাইভিং মেকানিজম), গতিরোধক যন্ত্রকৌশল (Braking mechanism ব্রেকিং মেকানিজম) ও দিকনির্দেশক যন্ত্রকৌশল (steering mechanism স্টিয়ারিং মেকানিজম)।

বাইসাইকেলের সম্মুখচালনা যন্ত্রকৌশলটি বাইসাইকেলকে সড়কের উপরে পথ অতিক্রমের কাজে সাহায্য করে। বাইসাইকেলের আরোহী প্রথমে সাইকেলটির পাদানিতে (Pedal পেডাল) বল প্রয়োগ করেন। পাদানিতে প্রযুক্ত বল একটি সংযোগদণ্ডের (Crank ক্র্যাংক) মাধ্যমে (যাকে একটি ভারোত্তলক-দণ্ড বা লিভার নামক সরল যন্ত্র হিসেবে কল্পনা করা যায়) সাইকেলের সম্মুখভাগের বড় (অর্থাৎ অধিকসংখ্যক দাঁতবিশিষ্ট) দাঁতালো চাকায় (Gear বড় গিয়ার বা Sprocket বড় স্প্রকেট) স্থানান্তরিত হয় ও সেটিকে একটি অক্ষদণ্ডের চারদিকে ঘোরায়। এভাবে পায়ের শক্তি দাঁতালো চাকা ও শিকল ব্যবস্থায় (chain and sprocket) স্থানান্তরিত হয়। বড় দাঁতালো চাকাটি একটি চক্রাকার শিকলের (Chain চেইন) মাধ্যমে সাইকেলের পেছনের অংশে অপেক্ষাকৃত ছোট (অর্থাৎ কম সংখ্যক দাঁতবিশিষ্ট) একটি দাঁতালো চাকার (ছোট গিয়ার বা ছোট স্প্রকেট) সাথে যুক্ত থাকে। এই দাঁতালো চাকা ও শিকল ব্যবস্থাটিকে একটি কপিকল (এক ধরনের সরল যন্ত্র) হিসেবে কল্পনা করা যায়। শিকল দিয়ে সংযুক্ত থাকার কারণে বড় দাঁতালো চাকা যে দিকে ঘোরে, ছোট দাঁতালো চাকাটিও সেই দিকেই ঘোরে। বড় দাঁতালো চাকাটির তুলনায় ছোট দাঁতালো চাকাটি বেশি দ্রুত ঘোরে; কত বেশি দ্রুত ঘুরবে, তা দুই দাঁতালো চাকার দাঁতের অনুপাতের উপর নির্ভর করে। বড় দাঁতালো চাকাতে যদি ছোটটির তুলনায় দ্বিগুণ দাঁত থাকে (যেমন বড়টিতে ৫৪টি দাঁত ও ছোটটিতে ১৭টি দাঁত), তাহলে বড়টি একবার ঘুরলে একই সময়ে ছোটটি দুইবার ঘুরবে। এখন পেছনের ছোট দাঁতালো চাকাটি বা ছোট গিয়ারটি সাইকেলের পেছনের চাকার অক্ষদণ্ডটিকে (Rear axle রিয়ার অ্যাক্সল) ঘোরায়। অক্ষদণ্ডটি পেছনের চাকার চক্রনাভিকে (Hub হাব) ঘোরায় এবং চক্রনাভি থেকে অনেকগুলি শিকের (Spoke স্পোক) মাধ্যমে এই ঘূর্ণন গতিটি চক্রবেড়ে (Rim রিম) স্থানান্তরিত হয়, ফলে সাইকেলের পেছনের চাকাটির সড়ক স্পর্শকারী অংশটি ছোট দাঁতালো চাকার সমান গতিতে ঘূর্ণন সম্পন্ন করে। এভাবে ২:১ অনুপাতের সম্মুখ-পশ্চাৎ দাঁতালো চাকাবিশিষ্ট যন্ত্রকৌশলে সামনের পাদানি সম্পূর্ণ একবার ঘুরিয়ে পেছনের চাকাটি সম্পূর্ণ দুইবার ঘোরানো সম্ভব। চাকার শিকগুলি ভারোত্তোলক দণ্ড বা লিভারের (lever) মতো কাজ করে; চক্রবেড়ের ব্যাসার্ধ (R) ও অক্ষদণ্ডের ব্যাসার্ধের (r) অনুপাত যত বড় হবে, চাকাটির আদর্শ যান্ত্রিক সুবিধা (Ideal Mechanical Advantage) তত বেশি হবে এবং চাকাটির বেড় রাস্তার উপরে গড়িয়ে গড়িয়ে ততই বেশি সরলরৈখিক দূরত্ব অতিক্রম করবে। এভাবে পায়ের শক্তি পাদানি থেকে দাঁতালো চাকা ও শিকল ব্যবস্থা হয়ে পেছনের চাকা ঘূর্ণনের কাজে এবং শেষ বিচারে সমতল পথে দূরত্ব অতিক্রমের কাজে রূপান্তরিত হয়।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Hunt, K. H. (১৯৭৮), Kinematic Geometry of Mechanisms, New York: Oxford University Press 
  2. Ham, C. W.; Crank E. J.; Rogers W. L. (১৯৫৮), Mechanics of Machinery, McGraw-Hill