খেলার ফলাফলে কারসাজি
এই নিবন্ধটিতে কোনো উৎস বা তথ্যসূত্র উদ্ধৃত করা হয়নি। |
খেলার ফলাফলে কারসাজি বা ইংরেজি পরিভাষায় ম্যাচ ফিক্সিং হলো কোনো ম্যাচের ফল বা ম্যাচের নির্দিষ্ট অংশের ফল আগেই নির্ধারণ করে খেলা। কোনো নির্দিষ্ট খেলার নিয়ম ও নীতি লঙ্ঘনের মাধ্যমে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের মতো ঘটনা ঘটানো হয়। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রধান কারণ হলো জুয়াড়িদের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবানা হওয়ার সম্ভাবনা। কখনো কখনো খেলোয়াড়রা ইচ্ছে করেও ম্যাচ ফিক্সিং করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কারণ থাকে, তুলনামূলক ভালো ড্রাফট সুবিধা পাওয়া বা কোনো আসরের নকআউট পর্বে দুর্বল প্রতিপক্ষ পাওয়ার সম্ভাবনা। কখনো আবার কোনো দলের খেলোয়াড় অন্য দলের সুবিধা করে দেয়ার জন্যও ম্যাচ ফিক্সিং করতে পারেন।
যখন জুয়াড়িদের মাধ্যমে ম্যাচ ফিক্সিং হয়, তখন খেলোয়াড়, দলীয় কর্মকর্তা, এবং/অথবা রেফারিদের সঙ্গে জুয়াড়িরা যোগাযোগ করে (এবং সাধারণত অর্থ লেনদেন করে)। তাদের মধ্যকার যোগাযোগ বা অর্থ লেনদেন কখনো কখনো চিহ্নিত হতে পারে এবং তাদের বিরুদ্ধে আদালত বা নির্দিষ্ট খেলার আয়োজক গোষ্ঠি আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে। আবার, ভবিষ্যত সুবিধার জন্য কখনো কখনো পুরো দল ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকে। যা প্রমাণ করা খুব কঠিন। এই ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো দলের কোচ দলের পারফর্ম্যান্স যাতে খারাপ হয়, তা নিশ্চিত করতে খেলোয়াড় বদল করেন (যেমন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে বসিয়ে রাখা, সাধারণ বা ইচ্ছাকৃত ইনজুরির অজুহাত দেয়া)। খেলোয়াড়দের খারাপ খেলার কথা সরাসরি না বলে এ ধরনের কাজ করা হয়ে থাকে। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের বিভিন্ন ঘটনায় এ ধরনের বিষয় উঠে এসেছে।
সাধারণত ম্যাচ ফিক্সিং বলতে চূড়ান্ত ফলাফল আগেই নির্ধারণ করে দেয়াকে বোঝায়। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের আরো একটা অংশ হলো স্পট ফিক্সিং, যা ম্যাচের ছোট কোনো অংশে করা হয় এবং যা ম্যাচের চূড়ান্ত ফলাফলকে খুব বেশি প্রভাবিত করতে পারে না।
ম্যাচ ফিক্সিংকে গেম ফিক্সিং, রেস ফিক্সিং, স্পোর্টস ফিক্সিং, অথবা হিপোডরমিংও বলে। ইচ্ছেকৃতভাবে ম্যাচ হারাকে ম্যাচ ছেড়ে দেয়া হলেও অভিহিত করা হয়। একই সাথে, যখন কোনো দল ইচ্ছেকৃতভাবে হারে বা তারা যতোটা ভালো খেলতে পারতো, ততোটা না খেলে, তখন ওই দলকে ‘ট্যাংকড’ বলে অভিহিত করার রেওয়াজ আছে।
প্ররোচক ও কারণ
সম্পাদনাম্যাচ ফিক্সিংয়ের সবচেয়ে বড় কারণ হলো জুয়াবাজি ও ভবিষ্যতে দলীয় সুবিধা পাওয়া।
জুয়াড়িদের সাথে চুক্তি
সম্পাদনাম্যাচ ফিক্সিংয়ের উদ্দেশ্যে জুয়াড়িদের সঙ্গে চুক্তি করলে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভবানা থাকে। এই বিষয়ের সবচেয়ে কুখ্যাত উদাহরণ হলো ১৯১৯ সালে হওয়া উত্তর আমেরিকার ‘ব্ল্যাক সক্স কলঙ্ক’। যেখানে সিকাগো হোয়াইট সক্স দলের কয়েকজন সদস্য জুয়াড়িদের সাথে ষড়যন্ত্র করে ওয়ার্ল্ড সিরিজে ফিক্সিং করেছিলো।
জুয়াবাজির মাধ্যমে রেস ফিক্সিং করার অন্যতম পরিচিত ঘটনাটি ঘটেছিলো ১৯৩৩ সালের ট্রিপলি গ্রান্ড প্রিক্সে। যেখানে বিজয়ী লটারির নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছিলো রেসে বিজয়ী গাড়ির সংখ্যায়। একজন লটারি ক্রেতা ওই রেসের ড্রাইভার একিলে ভার্সির গাড়ির নম্বরের সঙ্গে মেলানো লটারি কিনেছিলো এবং তার সঙ্গে যোগাযোগ করে চুক্তি করিলো যে, ভার্সি যদি রেস জিতেন তাহলে লটারি জিতবেন ওই ক্রেতা এবং লটারি জেতার অর্থ তিনি ভার্সিকেও দিবেন। পরে ভার্সি অন্য ড্রাইভারদের সঙ্গে তার অর্থের ভাগ দেয়ার চুক্তি করেন। ওই রেসে বাজে শুরুর পরও ভার্সি জিতে যান এবং অন্য ড্রাইভাররা পুরো রেসে ইচ্ছে করেই বাজে পারফর্ম করেন।
স্পোর্টট্রেডার নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা বিভিন্ন ফেডারেশনের হয়ে খেলার বিশুদ্ধতা নিশ্চিতে নজর রাখে। তাদের দাবি, তারা যে সব ম্যাচে নজরদারি করেন, তার মধ্যে অন্তত একভাগ ম্যাচে ফিক্সিং হয়।
এ ধরনের অপকর্ম ঠেকানো
সম্পাদনাম্যাচের আগে জুয়াড়িদের বাজারে নজরদারি করে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের পরিকল্পনা চিহ্নিত করা সম্ভব। একই সাথে ম্যাচের সময় জুয়াড়িদের যে বাজার থাকে, সেখানে নজরদারি করেও ম্যাচ বিকৃত করার বিষয়ে সুনিশ্চিত ধারণা পাওয়া যেতে পারে। বিশ্বে অনেক ফেডারেশন আছে যারা ম্যাচ ফিক্সিং ধরার জন্য লোক নিয়োগ করে। ২০১৬ সালের ম্যাজর বেসবল লিগ (এমবিএল) জিনিয়াস স্পোর্টস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়, যারা ম্যাচের সততা নির্ধারণে বিশেষজ্ঞ। যারা এমবিএলের সব ম্যাচের জুয়া বা ফিক্সিংয়ে নজরদারি করেছে।
এ ছাড়া, বিশ্বের অনেক ফেডারেশন ম্যাচ ফিক্সিং প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে খেলোয়াড় এবং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়। তাতে তাদেরকে শেখানো হয় ফিক্সিং কেনো এবং তারা কীভাবে এ ধরনের গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকবে।
তুলনামূলক ভালো নকআউট পর্ব পাওয়ার আশা
সম্পাদনাঅনেক খেলার বিভিন্ন টুর্নামেন্টে একাধিক রাউন্ড থাকে। যেখানে প্রথম রাউন্ডের ফলাফলের উপর নির্ভর করে পরের রাউন্ডে একেকটা দলের প্রতিপক্ষ কারা হবে। এর ফলে, কখনো এমন হয়— প্রথম রাউন্ডে একটা ম্যাচ হেরে গেলে পরের রাউন্ডে তুলনামূলক সহজ প্রতিপক্ষ পাওয়া যায়, যাদের বিপক্ষে জেতার বেশি সম্ভাবনা থাকে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড ম্যাচ ছেড়ে দেয়ার মতো গর্হিত হলেও আমেরিকান খেলাধুলার জগতে এটিকে তেমন একটা খারাপ চোখে দেখা হয় না।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় বাস্কেট বল অ্যাসোসিয়েশনে এমন অভিযোগ জমা পড়ে যে, কোনো দল পয়েন্ট টেবিলে পঞ্চম না হয়ে ষষ্ট হওয়ার জন্য চেষ্টা করে। এর ফলে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থাকা দলের বিপক্ষে খেলার সম্ভাবনা কমে যায়। কারণ শীর্ষ দলের সঙ্গে খেললে হারের ঝুঁকি বেশি থাকে। এ ছাড়া অন্য সুবিধার জন্যও কোনো দল এমন করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে এনবিএর কথা বলা যায়। এনবিএ হলো যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম চতুর্থ বৃহৎ পেশাদার প্রতিযোগিতা। যেখানে প্লে অফে দলগুলো হোমে খেলার সুবিধা পেতে চেষ্টা করে। এর কারণে ২০০৫-৬ মৌসুমে লস অ্যাঞ্জেলেস ক্লিপার্সের বিপক্ষে ইচ্ছে করে পয়েন্ট টেবিলে ষষ্ট হওয়ার অভিযোগ আসে। যদিও সেটি প্রমাণিত হয়নি। ওই আসরে পঞ্চম হলে নিজেদের মাঠে খেলার সুযোগ হারাতো তারা। পরিস্থিতি এ রকম দেখে ইচ্ছে করে হেরে ষষ্ট হয় তারা। ওই মৌসুমের পর এনবিএ কর্তৃপক্ষ প্লে অফে কিছু পরিবর্তন আনে।
এ ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ফুটবল লিগের একটি দলের বিপক্ষেও প্লে অফে পছন্দের দল ‘বেছে নিতে’ লিগ পর্বের ম্যাচে ইচ্ছে করে হারার অভিযোগ আছে।
এ ধরনের ফিক্সিংয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ সম্ভবত সান ফ্রান্সিসকো ফোরটি-নাইনার্স ও লস অ্যাঞ্জেলেস র্যামসের মধ্যকার ম্যাচটি। ১৯৮৮ সালে সান ফ্র্যান্সিসকো ফোরটি-নাইনার্স প্লে অফ নিশ্চিত করেছিলো এবং লিগ পর্বে তারা লস অ্যাঞ্জেলসের কাছে হেরেছিলো। ওই সান ফ্র্যান্সিসকোর এই জয়ে পোস্টসেশন থেকে নিউ ইয়র্ক জায়ান্টস বাদ পড়ে যায়। পরে জায়ান্টসের কোয়ার্টারব্যাক ফিল সিমস রেগেমেগে ফোরটি-নাইনার্সের উদ্দেশ্যে বলেন, তারা ‘কুকুরের মতো শুয়ে পড়েছিলো’।
কানাডিয়ান ফুটবল লিগে ক্রস-ওভার-রুল নিয়ম প্রবর্তনের পর পশ্চিমাঞ্চলের দলগুলোর উপর অভিযোগ আছে যে, তারা মৌসুমের শেষ দিকে গিয়ে ইচ্ছে করে হেরেছে। এতে তারা পয়েন্ট টেবিলে কিছুটা নেমে গেছে বটে, তবে প্লে অফ ও পরবর্তী রাউন্ডে সহজ প্রতিপক্ষও নিশ্চিত হয়েছে। এই অভিযোগ অবশ্য প্রমাণিত নয়। ইদানীং কানাডিয়ান ফুটবল লিগে পূর্বাঞ্চলের দলগুলোকে দুর্বল মনে করা হয়।
২০০৬ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের আইস হকি প্রতিযোগিতায়ও ইচ্ছে করে ম্যাচ হারের একটি সম্ভাব্য উদাহরণ আছে। যেখানে পুল বি’র শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিলো সুইডেন ও স্লোভাকিয়া। দুই দলের জন্যই ওই ম্যাচটি ছিলো গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচ। ম্যাচের পর সুইডেনের কোচ বেনগট্যাক গুসটাফসন জনসম্মুখেই স্লোভাকিয়ার বিপক্ষে হারের কারণ বলেছিলেন। ওই ম্যাচটি জিতলে কোয়ার্টার ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ হতো কানাডা, যারা ২০০২ সালে সোনাজয়ী, অথবা চেক প্রজাতন্ত্র, যারা ১৯৯৮ সালের সোনাজয়ী। সুইডের কোচ এই দলের একটিকে কলেরা অন্যটিকে গ্লাগ রোগের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তার এমন মন্তব্যই প্রমাণ করে যে স্লোভাকিয়ার বিপক্ষে ইচ্ছে করেই হেরেছিলো সুইডেন। মজার ব্যাপার হলো পুল বি’র শেষ ম্যাচে হারের পরও পরে সুইডেনই ২০০৬ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের আইস হকিতে সোনা জিতে।
১৯৯৮ সালের টাইগার কাপে, যা একটি আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট, যেখানে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ খেলেছে, যেখানে একটি ম্যাচে দুই দলকেই হারার চেষ্টা করতে দেখা গেছে। টুর্নামেন্টটি আয়োজন করেছিলো ভিয়েতনাম। আট দেশের টুর্নামেন্টটিতে দুইভাগে চারটি করে দল খেলে। সেখানে প্রতিটি গ্রুপের শীর্ষ দুই দলের সেমিফাইনালে যাওয়ার নিয়ম ছিলো। সেমিফাইনালে এক গ্রুপের চ্যাম্পিয়নের খেলার কথা ছিলো অন্য গ্রুপের রানার্স আপের বিপক্ষে। প্রথম গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয় সিঙ্গাপুর আর দ্বিতীয় হয় ভিয়েতনাম। অর্থাৎ দ্বিতীয় গ্রুপের চ্যাম্পিয়নকে স্বাগতিক ভিয়েতনামের বিপক্ষে খেলার জন্য ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানোইয়ে আসার প্রয়োজন পড়ে। ম্যাচটি হওয়ার কথা ছিলো ভিয়েতনামের জাতীয় দিবসে। আর দ্বিতীয় গ্রুপের রানার্স আপের খেলার কথা ছিলো হো চি মিন সিটিতে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে। এই যখন পরিস্থিতি, দ্বিতীয় গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হতে চাইছিলো না থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া। ফলে সেমিফাইনাল নিশ্চিতের পর গ্রুপের শেষ ম্যাচে দুই পরস্পরের বিপক্ষে হারের চিন্তা নিয়ে মাঠে নামে। খেলা শুরুর পর কোনো দলই গোল করার কোনো চেষ্টা করেনি। এক পর্যায়ে ইন্দোনেশিয়ার ডিফেন্ডার মোর্শিদ ইফেন্দি আত্মঘাতী গোল করে দেন। মজার ব্যাপার হলো, এ সময় তাকে ঠেকাতে চেষ্টা করে থাইল্যান্ডের খেলোয়াড়রা। এই ম্যাচের জন্য দুই দলকেই ৪০ হাজার ডলার করে জরিমানা করা হয় এবং মোর্শিদ ইফেন্দিকে সারা জীবনের জন্য আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিষিদ্ধ করা হয়।
২০১২ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে এ ধরনের প্রকৃত বা সম্ভাব্য দুটি প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়।