মুহাম্মদ জুনাগড়ী

ভারতীয় ইসলামি পণ্ডিত
(মাওলানা মুহাম্মদ জুনাগড়ী (রহ.) থেকে পুনর্নির্দেশিত)

মাওলানা মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহীম জুনাগড়ী ভারতীয় উপমহাদেশের একজন খ্যাতিমান আলেম, মুফাসসিরে কুরআন, মুহাদ্দিছ, ফক্বীহ, মুনাযির (তার্কিক), বাগ্মী, সাংবাদিক, বহু গ্রন্থ প্রণেতা ও সুদক্ষ অনুবাদক ছিলেন। তিনি মুহাম্মদ জুনাগড়ী নামে সর্বাধিক পরিচিত।

মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম জুনাগড়ী
উপাধিখতিবে হিন্দ
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম১৮৯০
মৃত্যু১৯৪১(1941-00-00) (বয়স ৫০–৫১)
ধর্মইসলাম
জাতিসত্তাব্রিটিশ ভারত
অঞ্চলভারত
আখ্যাআহলুল হাদিস
ধর্মীয় মতবিশ্বাসআছারী
প্রধান আগ্রহফিকহ, হাদিস
উল্লেখযোগ্য কাজতাফসীরে মুহাম্মাদী

জন্ম ও বাল্যকাল সম্পাদনা

মুহাম্মাদ জুনাগড়ী বর্তমান গুজরাত (সাবেক মুম্বাই) প্রদেশের জুনাগড় শহরে ১৮৯০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মুহাম্মাদ ইবরাহীম ধনাঢ্য ফল ব্যবসায়ী ছিলেন। মাতার নাম বিবি হাওয়া। পিতা-মাতা দু’জনই মায়মান (প্রচলিত মেমন) বংশোদ্ভূত ছিলেন।[১]

শিক্ষা জীবন সম্পাদনা

তিনি জুনাগড়ে আব্দুল্লাহ জুনাগড়ীর নিকট প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন।[২]

বাল্য শিক্ষক আব্দুল্লাহ জুনাগড়ীর নিকট থেকে দিল্লীতে উচ্চশিক্ষার বিবরণ শুনে পারিবারিক অসচ্ছলতা সত্ত্বেও তিনি সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ও বন্ধু আব্দুস সালামের[৩] সাথে ১৯১৩ সালে ২২ বছর বয়সে দিল্লি যান। সেখানে গিয়ে তিনি ‘মাদরাসা আমীনিয়া’তে ভর্তি হন। তবে নানা কারণে তাঁকে মাদরাসা থেকে বের করে দেয়া হয়।[৪]

পরে ফতেহপুরী মসজিদে এক আলাপচারিতায় তিনি মাওলানা আব্দুল ওয়াহ্হাব মুহাদ্দিছ দেহলভী (১৮৬৬-১৯৩৩) প্রতিষ্ঠিত দারুল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ মাদরাসার সন্ধান পান। পরে সেখানে ভর্তি হন ও নাহু, ছরফ, তাফসীর ও হাদীছের বিভিন্ন গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। পাশাপাশি দিল্লীর ফাটক হাবাশ খাঁ মাদরাসায় মিয়াঁ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভীর (১৮০৫-১৯০২) ছাত্র, মুহাদ্দিছ মাওলানা আব্দুর রহীম গযনভী অমৃতসরী (মৃঃ ১৩৪২ হিঃ) ও মাওলানা আব্দুর রশীদের কাছে হাদীছের কতিপয় গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। তাছাড়া দিল্লীর আলেম মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক দেহলভী মানতেকী এবং মাওলানা মুহাম্মাদ আইয়ূব পারেচার নিকট মানতেক, দর্শন, মুনাযারার মূলনীতি অধ্যয়ন করেন।[৫]

মাদরাসা প্রতিষ্ঠা সম্পাদনা

লেখাপড়া শেষ করার পর মাওলানা জুনাগড়ী দিল্লীর আজমিরী গেট সন্নিকটস্থ আহলে হাদীছ মসজিদে পাঠদান শুরু করেন। এখানে তিনি ‘মাদরাসা মুহাম্মাদিয়াহ’ প্রতিষ্ঠা করেন। আমৃত্যু ২৮ বছর যাবৎ তিনি এ প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের কুরআন ও হাদীছের দরস প্রদান করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর প্রিয় ছাত্র মাওলানা সাইয়িদ তাকরীয আহমাদ সাহসোয়ানী এবং মাওলানা আব্দুর রশীদ এখানে দরসের সিলসিলা অব্যাহত রাখেন।[৬]

সাংবাদিকতা সম্পাদনা

মাদরাসা মুহাম্মাদিয়ায় পাঠদানের পাশাপাশি মাওলানা জুনাগড়ী ‘গুলদাস্তায়ে মুহাম্মাদিয়া’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন। ১৯২১ সাল থেকে ‘আখবারে মুহাম্মাদী’ নামে প্রত্যেক আরবী মাসের ১৫ তারিখে পাক্ষিক হিসাবে প্রকাশিত হতে থাকে।

মাওলানা জুনাগড়ী আমৃত্যু এর সম্পাদক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর কারণে ১৯৪১ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী সংখ্যা বের হওয়ার পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৪১ সালের ১৫ই জুন থেকে তাঁর ছাত্র মাওলানা সাইয়িদ তাকরীয আহমাদ সাহসোয়ানীর সম্পাদনায় পুনরায় প্রকাশিত হতে শুরু করে। কাগজের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে ১৯৪৬ সালে আবার বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে চালু হয়। কয়েক মাস চালু থাকার পর চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।[৭]

জুনাগড়ীর বিরুদ্ধে মামলা সম্পাদনা

টিটাগড়-এর নিকটবর্তী ‘আঙ্গারা’ নামক গ্রামে একটি জালসায় তার বক্তব্য শুনে মুসলমানদের একটি গ্রুপ তার বিরুদ্ধে কলকাতা আদালতে ধর্ম অবমাননার মামলা দায়ের করে। এ মামলা দায়েরের অন্যতম একটা কারণ ছিল তার রচিত ‘দুর্রায়ে মুহাম্মাদী’ (মুহাম্মাদী চাবুক) নামক গ্রন্থটি। ইংরেজ সরকার গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করে। পরে মামলার রায় তাঁর পক্ষে যায়।[৮]

মৃত্যু সম্পাদনা

১৩৬০ হিজরীর ১লা ছফর মোতাবেক ২৮শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪১ সালে শুক্রবার রাত ১১-টার সময় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জুনাগড়ে তাঁকে দাফন করা হয়।[৯][১০]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. ইমাম খান নওশাহরাবী, তারাজিমে ওলামায়ে হাদীছ হিন্দ (পশ্চিম পাকিস্তান : মারকাযী জমঈয়তে ত্বলাবায়ে আহলেহাদীছ, ২য় সংস্করণ, ১৩৯১ হিঃ/১৯৮১ খৃঃ), পৃঃ ১৭৪; আব্দুর রশীদ ইরাকী, তাযকিরাতুল মুহাম্মাদিইয়ীন (সারগোদা : মাকতাবা ছানাইয়াহ, ২০১২), পৃঃ ৮৩; ড. মুহাম্মাদ মুজীবুর রহমান, মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ) : হায়াত ওয়া খিদমাত, উর্দূ অনুবাদ : আব্দুল্লাহ সালাফী মুর্শিদাবাদী (বেনারস : জামে‘আ সালাফিইয়াহ, ১৯৯৫), পৃঃ ১৬।
  2. তারাজিম, পৃঃ ১৭৫; মাওলানা মুহাম্মাদ মুক্তাদা আছারী উমারী, তাযকিরাতুল মুনাযিরীন (লাহোর : দারুন নাওয়াদির, ২০০৭), ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৭১।
  3. জুনাগড়ীর একমাত্র জীবিত পুত্র সেলিম মায়মান জুনাগড়ীর প্রদত্ত তথ্য মতে বিশ্ববরেণ্য আরবীবিদ আল্লামা আব্দুল আযীয মায়মানীর সাথে তিনি দিল্লী গিয়েছিলেন। তথ্য : মাওলানা সেলিম মায়মান জুনাগড়ী (৭৭), মির্জাপুর, বিনোদপুর, মতিহার, রাজশাহী। তাং ১৫.০৯.১৭ইং।
  4. তারাজিম, পৃঃ ১৭৪-৭৫; মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, পৃঃ ১৮-১৯।
  5. তারাজিম, পৃঃ ১৭৫; মাওলানা মুহাম্মাদ মুক্তাদা আছারী উমারী, তাযকিরাতুল মুনাযিরীন (লাহোর : দারুন নাওয়াদির, ২০০৭), ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৭১।
  6. মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক ভাট্টী, বার্রে ছাগীর মেঁ আহলেহাদীছ কী সারগুযাশত (লাহোর : আল-মাকতাবাতুস সালাফিইয়াহ, ১ম প্রকাশ, ২০১২), পৃঃ ২৭; আব্দুর রশীদ ইরাকী, চালীস ওলামায়ে আহলেহাদীছ (লাহোর : নু‘মানী কুতুবখানা, তাবি), পৃঃ ১৫৭; মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, পৃঃ ২৯।
  7. মাওলানা মুহাম্মাদ মুস্তাক্বীম সালাফী, জামা‘আতে আহলেহাদীছ কী ছিহাফাতী খিদমাত (বেনারস : আল-ইয্যাহ ইউনিভার্সাল, জানুয়ারী ২০১৪), পৃঃ ২৮-২৯; তারাজিম, পৃঃ ১৭৫; মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, পৃঃ ২৯-৩১।
  8. মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী, পৃঃ ৩৭-৩৯।
  9. চালীস ওলামায়ে আহলে হাদীস (উর্দু ভাষায়)। পৃষ্ঠা ১৫৯। 
  10. At-tahreek, Monthly। "মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ) (২য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম"মাসিক আত-তাহরীক । ধর্ম, সমাজ ও সাহিত্য বিষয়ক গবেষণা পত্রিকা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-০৪