ব্লু শার্ক

মাছের প্রজাতি

ব্লু শার্ক বা নীল হাঙ্গর (বৈজ্ঞানিক নাম: Prionace glauca) কার্কারিনিডি (Carcharhinidae) পরিবারের অন্তর্গত প্রিওনেস (Prionace) গণের এক প্রজাতির হাঙর। নীল হাঙ্গর সারা বিশ্বের নাতিশীতোষ্ণ এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মহাসাগরে দেখতে পাওয়া যায়। এদের ডাক নাম "'সমুদ্রের নেকড়ে'" (wolves of the sea)। এদের প্রধান খাদ্য মাছ এবং স্কুইড। সারা দুনিয়ায় এটাই একমাত্র হাঙ্গর যেটাকে মানুষ সরাসরি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এদের কেবল পাখনা নয়, পুরো শরীরই খাওয়া যায়।

নীল হাঙর
সময়গত পরিসীমা: Pliocene–Recent[১]
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস
জগৎ: Animalia
পর্ব: কর্ডাটা
শ্রেণী: Chondrichthyes
উপশ্রেণী: Elasmobranchii
বর্গ: Carcharhiniformes
পরিবার: Carcharhinidae
গণ: Prionace
Cantor, 1849
প্রজাতি: P. glauca
দ্বিপদী নাম
Prionace glauca
(Linnaeus, 1758)
নীল হাঙরের বিস্তৃতি

নীল হাঙ্গরের নামকরণ হয়েছে পিঠের নীলচে রঙের জন্য। এদের ওজন ৭০-১২০ পাউন্ডের মত হয়। মানুষের জন্য এরা কিছুটা বিপজ্জনক।

নামকরণ সম্পাদনা

 

১৭৫৮ সালে দ্বিপদ নামকরণের জনক ক্যারোলাস লিনিয়াস এদের নাম দেন Prionace glaucaPrionace glauca নামটি এসেছে গ্রিক "prion " এবং "akis" থেকে। প্রজাতিক নাম glauca উদ্ভূত হয়েছে ল্যাটিন শব্দ "glaucus" থেকে।

ইংরেজিতে এর অন্যান্য প্রচলিত নামগুলো হল: Blue shark, Blue dog এবং Blue whaler।

এছাড়া বিভিন্ন ভাষায় এর নাম নিচে দেওয়া হল:

আসুল (স্প্যানিশ), তিন্তোরেরা (স্প্যানিশ), বের্দেমার (স্প্যানিশ), ব্লাউই হাই (ডাচ), ব্লাঊহ্যায় (জার্মান), ব্লাউয়ার হ্যায় (জার্মান), Peau Bleue (ফরাসি), Sinihai (ফিনিশ), Blåhaj (সুইডিশ ড্যানিশ), Zarlacz Blekitny (পোলিশ), Pas Modrulj (সার্বো ক্রোট), গেলা আসুল (পর্তুগীজ), পাস মদ্রুলি (পর্তুগীজ), ভের্দেস্কা (ইতালীয়), স্কালো আজ্জুরো (ইতালীয়), Glucose (গ্রিক), কার্কারিয়াস (গ্রিক), Glafkcarcharias (গ্রিক ), Canavar Balik (তুর্কি), Pamuk Baligi (তুর্কি), Peshkagen (আলবেনিয়ান), Karish Kakhol (হিব্রু), ক্বলব আল বা'র (আরবি), Mouch Labhar (আরবি), Blouhaai (আফ্রিকান্স)।

বিচরণ সম্পাদনা

ব্লু শার্ক বিশ্বব্যাপী সব নাতিশীতোষ্ণ এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাগরে দেখা মেলে। এই প্রজাতি উপকূলের কাছাকাছি বিচরণ করে। মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং মহীসোপান কাছাকাছি উপকূলবর্তী এলাকাতেও এদের বিচরণ করতে দেখা যায়। আটলান্টিকাতে এদের নিউফাউন্ডল্যান্ড, কানাডা থেকে আর্জেন্টিনায় এবং নরওয়ে থেকে আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকাতেও পাওয়া যায়। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ইন্দোনেশিয়া এবং জাপান থেকে নিউজিল্যান্ড এমন কি ভারতও এদের বিচরণ সীমার ভেতর পড়ে। এরা খোলা সাগরে ১৪৮ ফুট (৩৫০ মিটার) গভীরে ঘুরে বেড়ায়। এরা শীতল জল পছন্দ করে। ৪৪.৬-৬০.৮° ফারেনহাইট (৭-১৬° সেলসিয়াস) উষ্ণ জল এরা খুবই ভালোবাসে। এরা ৬৯.৮° ফারেনহাইট (২১° সেলসিয়াস) তাপমাত্রা মানিয়ে নিতে পারে। এর বেশি হলে এদের জীবন সংকট দেখা দিতে পারে। ভারত সাগরে এদের ২৬২-৭২২ ফুট (৮০-২২০ মি) গভীরে দেখা গেছে এবং ৫৩.৬-৭৭° ফারেনহাইট (১২-২৫° সেলসিয়াস) উষ্ণ জলেও এদের দেখা মিলেছে।

জীববিদ্যা সম্পাদনা

 

নীল হাঙ্গর এর শরীর দেখতে বেশ সরু, মসৃণ ও সুদর্শন। এদের চোখ বেশ বড় কারণ এদের চোখ রাতে দেখার জন্য বিকশিত হয়। এদের মোচাকার তুণ্ড লম্বা এবং মুখের থেকে বেশি চওড়া। এদের সরু বক্ষীয় পাখনা ( pectoral fins) অত্যন্ত লম্বা এবং এদের তুণ্ড থেকে ফুল্কার দূরত্ব অনেক বেশি। এদের পৃষ্ঠদেশীয় পাখনা ঠিক পিঠের মাঝখানে থাকে এবং শরীরের পেছনে অবস্থান করে শ্রোণী পাখনা।

নীল হাঙ্গর নামটি এসেছে এদের পৃষ্ঠতল গাড় উজ্জ্বল নীল হওয়ার কারণে। তবে এটির নিচের দিক একদমই সাদা এবং বক্ষীয় পাখনার ডগায় কালো রং এর দাগ থাকে।

নীল হাঙ্গরের দাঁত ত্রিকোণাকার, বাঁকা এবং ক্রকচ হয়। এদের উপরের চোয়ালে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য মধ্যস্থিত দাঁত থাকে এবং এদের উভয় পাশে ১৪ টি দাঁত থাকে। নিচের চোয়ালে ১৫ থেকে ১৩ টি দাঁত খুবই সূক্ষ্ম ও ধারালো হয়। এদের নিচের দাঁত খাড়া ,ত্রিকোণ ও ধারালো হয়।

এদের পুরুষদের বয়স চার থেকে পাঁচ বছর এবং এরা ৬ ফুট (১৮২ সেমি) অথবা ৯.২ ফুট (২৮১ সেমি) এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ নীল হাঙ্গর হয়ে ওঠে। নারীদের সামান্য বয়স্ক হতে হয় পাঁচ থেকে ছয় বছর এবং ৭.৩-১০.৬ ফুট (২২১-৩২৩ সেমি) হয়ে গেলে এদের পূর্ণাঙ্গ নারী বলা যাবে। সব থেকে বড় নীল হাঙ্গর রেকর্ড করা হয়েছে ১২.৬ ফুট (৩৮৩ সেমি)। এরা কুড়ি বছরের মতো বাঁচে।

এদের খাবারের ভেতর আছে ছোট বোনি মাছ হেরিং এবং সার্ডিন। তাছাড়া এরা স্কুইড এবং অক্টোপাসও খায়। তবে এদের সহজ খাবারের ভিতর আছে স্কুইডের কিছু প্রজাতি। নীল হাঙ্গর ধীরেসুস্থে এবং অসন্দিগ্ধ ভাবে শিকার সংগ্রহ করে। এরা মৃত সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী খায়।

প্রজনন সম্পাদনা

নীল হাঙ্গর এর গর্ভকালীন সময়সীমা ৯ থেকে ১২ মাস। জন্ম হওয়ার পরপরই এদের দৈর্ঘ্য থাকে ১৬-২০ ইঞ্চি (৪১-৫০ সেমি)। নীল হাঙ্গরের জরায়ু হয় যার অর্থ এরা সরাসরি জন্ম দেয় ডিম দেয়না। বাচ্চা ফোটার পরে প্ল্যাসেন্টা কুসুম খেয়ে পরিপুষ্ট হয়। সম্পূর্ণরুপে বাড়ার পরে মায়ের শরীর থেকে আলাদা হয়ে বের হয়।

গুরুত্ব সম্পাদনা

সারা দুনিয়ায় এটাই একমাত্র হাঙ্গর যেটাকে মানুষ সরাসরি খাদ্য হিসেবে খায়। এর কেবল পাখনা নয়, পুরো শরীরই খাওয়া হয়। তাছাড়া জেলেদের কাছে এটি একটি মাজাদার গেমফিস হিসাবে বিবেচিত হয়। আর এই কারণে নীল হাঙ্গর সর্বাধিক বাণিজ্যিকভাবে ধরা হাঙ্গর। বছরে আনুমানিক ১০ থেকে ২০ মিলিয়ন নীল হাঙ্গর মারা হয়।

বিপদ সম্পাদনা

এরা মানুষ এবং নৌকা আক্রমণ করে বলে এদের বিপজ্জনক প্রজাতি বলে মনে করা হয়। আন্তর্জাতিক হাঙ্গর আক্রমণ ফাইলের হিসাবমতে এরা মানুষের উপোর ১২ টা এবং নৌকার উপর ৪ টা আক্রমণ করেছে। খোলা মহাসমুদ্রে ভাসমান নাবিকদের উপর আক্রমণের কথা বেশি শোনা যায়। তবে একথা ঠিক যে এদের হামলার পিছনে কোনো না কোনো ভাবেই মানুষের হাত ছিলো।

সংরক্ষণ সম্পাদনা

নীল হাঙ্গর IUCN এর কাছাকাছি হুমকির ভিতর থাকা হাঙ্গরের লাল তালিকায় ঢুকে গেছে। এর কারণ বেশি করে এটির শিকার হওয়া। যেহেতু মানুষ এটি খায় তাই এটির চাহিদা বেশি। আধুনিকালে ধারণা করা হয় এটির মাংস মানব শরীরে কিছু রোগ হওয়ার জন্য দায়ী। যদিও এর কোন সঠিক প্রমাণ নেই। যদি একথা প্রমাণিত হয় তাহলে নীল হাঙ্গর সংরক্ষণে অনেক বড় কাজে আসবে। তাছাড়া IUCN ,সরকারী সংস্থা এবং কিছু বেসরকারী সংস্থা এটি সংরক্ষণে সবসময়ই কাজ করছে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Sepkoski, Jack (২০০২)। "A compendium of fossil marine animal genera (Chondrichthyes entry)"Bulletins of American Paleontology364: 560। ২০১২-০৫-১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০১-০৯ 
  2. Stevens (২০০৫)। "Prionace glauca"বিপদগ্রস্ত প্রজাতির আইইউসিএন লাল তালিকা। সংস্করণ 2010.4প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১০, ২০১১