ব্যবহারকারী:Mahidihasanmyth/খেলাঘর
নাগুরা ফার্ম সম্পাদনা
নাগুরা ফার্ম উপমহাদেশের প্রথম গভীর পানির ধান গবেষণা কেন্দ্র। বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলায় ১৯৩৪ সালে নাগুরা ফার্ম প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের উৎপাদিত মোট ধানের এক-পঞ্চমাংশ আসে হাওরাঞ্চল থেকে। হাওর এলাকা এক সময় ধানের বৈচিত্র্যে অনন্য ছিল তাই এখানে গড়ে উঠেছিল উপমহাদেশের প্রথম গভীর পানির ধান গবেষণা কেন্দ্র। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি আঞ্চলিক কার্যালয়।
ইতিহাস সম্পাদনা
নাগুরা ফার্ম ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত ছিল ICAR (Imperial Council of Agricultural Research) এর সাহায্যপুষ্ট Coordinated Scheme of Rice Research, পরে আসাম সরকারের তদারকিতে এটা একটি স্থায়ী ইনস্টিটিউটের মর্যাদা পায়। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই প্রতিষ্ঠান তার স্থায়ী ইনস্টিটিউটের মর্যাদা হারিয়ে ঢাকা ফার্মের ইকোনমিক বোটানি (সিরিয়াল) এর অধীনস্ত একটি উপরিভাগে পরিণত হয়।
১৯৫৫ সালে ড. এ আলীম একটি স্বাধীন ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার বরাবরে একটি স্কীম জমা দেন। FAO, Ford foundation Ges IRRI এবং IRRI চেষ্টায় তা ১৯৬৫-৬৬ সালে East Pakistan Accelerated Rice Reasearch প্রকল্প নামে তা পাশ হয়। উক্ত প্রকল্প ১৯৭০ সালে ১ অক্টোবর আলাদা মর্যাদায় পূর্ব পাকিস্তান ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (East Pakistan Rice Research Institute/ EPRRI) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৭০ সালে নাগুরা ফার্ম EPRRI এর একটি আঞ্চলিক কার্যালয়ের পদমর্যাদা লাভ করে। এর আগ পর্যন্ত নাগুরা ফার্ম Deep Water Aman and Boro Paddy Research Station হিসেবে কৃষি গবেষণার একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিল।
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভের পর EPRRI পরিবর্তিত নাম হয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (Bangladesh Rice Research Institute/ BRRI/ ব্রি)। সারাদেশে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মোট ৯টি আঞ্চলিক কার্যালয় আছে। সিলেট অঞ্চলের আঞ্চলিক কার্যালয় করা হয় নাগুরা ফার্মকে। দাপ্তরিকভাবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, নাগুরা নামে অভিহিত হলেও সর্বসাধারণের কাছে নাগুরা ফার্ম নামেই সমধিক পরিচিত।
কার্যক্রম সম্পাদনা
নাগুরা ফার্ম বর্ষার পানির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠে এমন ধান নিয়ে গবেষণার জন্য প্রসিদ্ধ। এই ফার্মে উদ্ভাবিত আধুনিক জাতের ধানের মধ্যে রয়েছে বিআর১৭, বিআর১৮ এবং বিআর১৯। নতুন প্রজাতির ধান উদ্ভাবনের পাশাপাশি এখানে ধানের পরীক্ষামূলক চাষ করা হয় এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশ লোকপ্রশাসক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসহ দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাগণ তাদের প্রশিক্ষনের অংশ হিসেবে এই প্রতিষ্টানটি পরিদর্শন করতে আসেন।
দর্শনীয় স্থান সম্পাদনা
গবেষণাগারের সবুজ ক্যাম্পাসে নানা প্রজাতির হাজারো পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। পাখির কলকাকলি আর গবেষকদের সৃষ্টিশীলতায় এই ক্যাম্পাসে ইতোমধ্যে একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে পর্যটকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে।
অবস্থান সম্পাদনা
নাগুরা ফার্ম বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলা সদর হতে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে নাগুরা নামক স্থানে অবস্থিত।
তথ্যসূত্র-
১. ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস রচিত গ্রন্থ "ধান গবেষণাঃ শতবর্ষের কিছু কথা"
২. জাতীয় তথ্য বাতায়ন- বানিয়াচং উপজেলা ৩. বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI
চৌদ্দশাক সম্পাদনা
শুষনি, বথুয়া, কালকাসুন্দে, শর্ষে, গুলঞ্চ, পটোল বা পলতা, শেলুকা, নিম, জয়ন্তী, শালিঞ্চে বা শিঞ্চে, হিলমোচিকা বা হেলেঞ্চা, ভাঁট বা ঘেঁটু, ওল, কেঁউ—এই ১৪ পদের শাক একত্রে “চৌদ্দশাক” নামে পরিচিত। এ ১৪ পদের শাকের প্রতিটির আলাদা ভেষজ গুণ আছে।
চৌদ্দ রকমের শাক একত্রে মিশিয়ে রান্না করে খেলে শরীরে রোগ ব্যাধি হয় না বলে গ্রাম বাংলার মানুষ বিশ্বাস করে। ঋতু পরিবর্তনজনিত রোগব্যাধির হাত থেকে বাঁচার জন্যও চৌদ্দশাক খাওয়া হয়। ঋষিরা ধর্মের মোড়কে বেঁধে দিয়ে গেছেন চৌদ্দশাক খাবার প্রয়োজনীয়তাকে।
"ওলং কেমুকবাস্তুকং সার্ষপঞ্চ নিম্বং জয়াং।
শালিঞ্চিং হিলমোচিকাঞ্চ পটুকং শেলূকং গুড়ুচীন্তথা। ভন্টাকীং সুনিষণ্ণকং শিবদিনে যদন্তি যে মানবাঃ প্রেতত্বং ন চ যান্তি কার্তিকদিনে কৃষ্ণে চ ভূতে তিথৌ।"-কৃত্যকৃত্ত্ব /রঘুনন্দন।
শাস্ত্রে উল্লেখিত চৌদ্দশাক সম্পাদনা
১. ওল - Amorphophallus campalunatus (araceae)
২. কেঁউ - Cheilocostus speciosus (costaceae)
৩. বথুয়া Chenopodium album (chenopodiaceae)
৪. কালকাসুন্দে Senna Occidentalis (caesalpaneaceae)
৫. সরষে Brassica campestris (cruciferae)
৬. নিম Azadirachta indica ( meliaceae)
৭. জয়ন্তী Sesbania sesbans (fabaceae)
৮. শালিঞ্চে বা শিঞ্চে Alternanthera sessilis (amaranthaceae)
৯. গুলঞ্চ Tinospora cordifolia (menispermaceae )
১০. পটল বা পলতা Trichosanthes dioica (cucurbitaceae)
১১. শেলুকা Cordia dichotoma (boraginaceae)
১২. হিলমোচিকা বা হেলেঞ্চা Enhydra fluctuans ( asteraceae)
১৩. ভাঁট বা ঘেঁটু Clerodendrum splendens ( verbanaceae )
১৪. সুনিষণ্নক বা শুষনি Marsellia quadrifolia ( marsiliaceae )
বঙ্গের অন্যান্য অনাবাদী শাক সম্পাদনা
১৫. আমরুল Oxalis corniculata
১৬. কলমি Ipomoea aquatica
১৭. কুলেখাড়া Hygrophila auriculata
১৮. খারকোন বা ঘাটকোল Typhonium trilobatum
১৯. ব্রাহ্মী Bacopa monnieri
২০. ঢেঁকিশাক Diplazium esculentum
২১. নুনিয়া বা নুন খুড়িয়া Portulaca oleracea
২২. তেলাকুচা Coccinia grandis
২৩. দন্ডকলস Leucas aspera
২৪. গিমা Glinus oppositifolius
২৫. থানকুনি Centella asiatica Urban
২৬. কাঁটানটে বা খৈরাকাটা Amaranthus spinosus
২৭. কচু Colocasia esculenta
২৮. ঘাগরা বা হাগড়া (বিষাক্ত) Xanthium strumarium
২৯. মালঞ্চ Alternanthera philoxeroides
৩০. কালমেঘ বা আলুই Andrographis paniculata
৩১. বাসক Justicia adhatoda
৩২. চুকোর বা টক ভেন্ডি Hibiscus sabdariffa
৩৩. কস্তরী Abelmoschus moschatus
৩৪. মোরগফুল Celosia argentea var. cristata)
উপরে উল্লিখিত শাকের যে কোন চৌদ্দটি শাক কুড়িয়ে চৌদ্দশাক প্রথা পালন করা যায়।
চৌদ্দশাক রান্নার প্রণালী সম্পাদনা
চৌদ্দশাক রান্নার কোনও নির্দিষ্ট প্রস্তুত প্রণালী নেই। একেক জায়গায় একেক রকম ভাবে এই শাক রান্না করা হয়। আমিষ অথবা নিরামিষ যেকোনো ভাবেই এই শাক খাওয়ার রেওয়াজ আছে। এক্ষেত্রে কোথাও কালজিরে-কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে, কোথাও রসুন-শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে, আবার কোথাও শুধু পাঁচফোড়ন দিয়েও চৌদ্দশাক ভাজা খাওয়া হয়। কোথাও কোথাও চৌদ্দশাক শুধুই ভাজা খাওয়া হয়, অনেকক্ষেত্রে আলু বা বেগুন দিয়েও ভেজে খাওয়ার প্রচলন আছে।
ভূতচতু্র্দশীতে চৌদ্দশাক প্রথা সম্পাদনা
চৌদ্দশাক খেলে নাকি কার্তিকের টান থেকে রেহাই পাওয়া যায়, কারণ এই মাসে যমের বাড়ির ৮টি দরজা খোলা থাকে। দীপাবলির আগের দিন ভূতচতু্র্দশী। এই দিন বাঙালি গৃহস্থবাড়িতে ১৪ প্রদীপ জ্বালানো হয়। সঙ্গে নিয়ম রয়েছে খেতে হয় ১৪ রকম শাক বা চৌদ্দশাক।
ভূতচতু্র্দশীতে,১৪ প্রদীপ জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে এদিন দুপুরে ভাতের সঙ্গে খেতে হয় চৌদ্দশাক। কথিত আছে, শুভ শক্তিকে বিনাশ করতে এবং অতৃপ্ত আত্মাদের তুষ্ট করতে এই দিনে চৌদ্দশাক খাওয়া হয় এবং সন্ধ্যায় ১৪ টি প্রদীপ জ্বালানো হয়।
কালীপুজোর সঙ্গে চোদ্দো শাকের সম্পর্ক নিয়ে কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তবে সমাজবিজ্ঞানীদের মতে এই প্রথার সঙ্গে শস্যদায়িনী দেবী ভাবনার যোগাযোগ রয়েছে। ভেষজবিজ্ঞানীদের মতে ঋতু পরিবর্তনের সময়ে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসাবে এই শাকগুলি খাওয়া হত। বাংলার ঋতু প্রকোপ অন্য প্রদেশের থেকে বেশি হওয়ার জন্য আশ্বিন ও কার্ত্তিক মাস দুটিকে যমদংস্টা কাল বলা হত।
ঘোর অমাবস্যায় অন্ধকার দূর করতেই দীপ জ্বালানোর রেওয়াজ। আর চৌদ্দশাক খাওয়ার নিয়মটি এসেছে প্রধানত স্বাস্থ্যরক্ষার্থে। কারণ ঠান্ডার আমেজ এসে যায় এই সময়। মরসুম বদলের সময় প্রধানত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতেই চৌদ্দশাক ১৪টি শাক খাওয়া দরকার।
কৃষি সংস্কৃতিতে চৌদ্দশাক প্রথা সম্পাদনা
চৌদ্দশাক প্রথা পালনে গ্রামের নারীদের চৌদ্দ রকম শাক কুড়াতে হয়। আবাদী নয় অনাবাদী অর্থাৎ নিজে থেকে হয়ে ওঠা শাক। বাড়ীর আশপাশের পালান, খাল পুকুর ডোবার ধারে, রাস্তার ধারে, ক্ষেতের আইলে, চকে হতে আপনজালা শাক কুড়ানো হয়।
এক গবেষণায় (বইয়ের নামঃ “আমাদের কুড়িয়ে পাওয়া শাক”) দেখা গেছে চৌদ্দশাক কুড়াতে মেয়েরা ১ থেকে ২ কি.মি. পথ দূর থেকেও নিয়ে আসেন । তারা খুব খুশি হন যদি এই দুরত্বের মধ্যে অন্তত চৌদ্দ রকমের কুড়িয়ে নিয়ে আসতে পারলে।
নারীকে খবর নিতে হবে প্রকৃতির যে অংশ অনাবাদী - যে অংশ কৃষি সংস্কৃতির সংরক্ষণ করে রাখার কথা, নইলে প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ অসম্ভব - সেই অনাবাদী প্রকৃতি ঠিক আছে কিনা। যেসব গাছপালা, প্রাণ ও প্রাণী আবাদ করতে গিয়ে আবাদী জায়গায় কৃষক তাদের দমন করেছে, উঠতে দেয় নি, থাকতে দেয় নি, তারা সব কি ঠিকঠাক আছে?
চৌদ্দ রকম শাক খাওয়া তো আসলে সব রকম গাছপালা প্রাণ ও প্রাণীর হালহকিকতের খোঁজ নেওয়া। 'চৌদ্দ' সংখ্যাটা এই দিক থেকে প্রতীকী। নারীকে খবর নিতে হবে পুরুষ সারাবছর যে 'চাষ' করল তাতে অনাবাদি জাতি বা প্রজাতির হাল হকিকতের কি অবস্থা।
চাষ করার অর্থ আবাদী ফসলের দিকে মনোযোগ দেওয়া, কিন্তু অনাবাদি ফসলের বিশাল ক্ষেত্র যেন তাতে নষ্ট বা কৃষ্য ব্যবস্থায় গৌণ না হয়ে পড়ে তার জন্যই চৌদ্দ রকম শাক তোলা ও খাওয়ার রীতি চালু হয়েছে। চৌদ্দ রকম শাক পাওয়ার অর্থ হচ্ছে কৃষিকাজ পরিবেশসম্মত হয়েছে , কারণ কোন অনাবাদি শাক গৃহস্থের আলালন পালান থেকে হারিয়ে যায় নি।
এই রকমের খাদ্যের প্রাপ্তি ও প্রাচুর্যতার মধ্য দিয়েও নারীরা বুঝে নেন তাঁদের গ্রামটি খাদ্য স্বার্বভৌমত্ব ও খাদ্যের সমৃদ্বির দিক থেকে নিরাপদ। এসব শাক যেন হারিয়ে না যায় তার প্রতিও তারা খেয়াল রাখেন।
তথ্যসূত্র:
১. চিরঞ্জীব বনৌষধি - আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, ২. ভারতীয় বনৌষধি - ড.কালিদাস বিশ্বাস, ৩. বাংলাদেশ আগাছা পরিচিতি- বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ৪. পুষ্টি বাগান ও বাংলার শাক-সংস্কৃতি - ড. কল্যাণ চক্রবর্তী, ৬. উবিনীগ, ৭. বাঙলার শাক - ডিআরসিএসসি, ৮. প্রথম আলো