জগজ্জীবনপুর তাম্রশাসন সম্পাদনা

জগজ্জীবনপুর তাম্রশাসন নবম শতাব্দীর পালবংশীয় রাজা মহেন্দ্রপালের তাম্রশাসন, যা দিয়ে এই রাজার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় এবং দেবপাল-পরবর্তী পাল রাজাদের ক্রম ও বংশলতা নির্ণয়ের প্রমাদগুলি দূর করা যায়।

আবিষ্কার সম্পাদনা

মালদা জেলার সদর মহকুমার হাবিবপুর থানার অন্তর্গত জগজ্জীবনপুর মৌজার দাগ নং ৬৩৯-এ তুলাভিটা বা সলাইডাঙা নামে একটি সওয়া-পাঁচ মিটার উঁচু ঢিপিতে ১৯৮৭ সালের ১৩ই মার্চ এটি আবিষ্কৃত হয়। এই জায়গাটি মালদা শহর থেকে প্রায় ৩৬ কি.মি. পূর্বে। জগদীশচন্দ্র গাঁই নামে স্থানীয় কৃষক তাঁর জমি কোপানোর সময় এটি আবিষ্কার করেন।[১] বর্তমানে এই তাম্রশাসনটি মালদা জেলা জাদুঘরে রাখা আছে। এই আবিষ্কারের পর প্রথমে সুধীন দে ও পরে অমল রায়ের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরাতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিকরণের গবেষকরা তুলাভিটা ও সন্নিহিত অঞ্চলে খননকার্য চালান, ফলে একটি বৌদ্ধ বিহারের (নন্দদীর্ঘিকা-উদ্রঙ্গ মহাবিহার) ধ্বংসাবশেষ ও অন্যান্য পুরাকীর্তি পাওয়া যায়।

বিবরণ সম্পাদনা

তামার পাতটি আয়তাকার, ৩৮ সে.মি. লম্বা এবং ৫২.৫ সে.মি. চওড়া। ওপরে পালবংশীয় রাজচক্র ঢালাই করে লাগানো, রাজচক্রের নিচে লেখা শ্রীমহেন্দ্রপালদেবঃ। রাজচক্রটি ২০ সে.মি. লম্বা এবং ২২ সে.মি. চওড়া। তামার পাতের সামনের দিকে ৪০ পংক্তি এবং পেছনের দিকে ৩৩ পংক্তি লেখা আছে। ভাষা পদ্য-গদ্যাত্মক সংস্কৃত। লিপি তৎকালীন সিদ্ধমাতৃকা[২]। এই লিপি সিদ্ধং লিপি থেকে বিকশিত এবং বর্তমান বাংলা লিপির পূর্বসূরী।

ছন্দ: শ্লোক ১৭-১৯, ২১, ২৩: অনুষ্টুভ্; শ্লোক ২৪: ইন্দ্রবজ্রা; শ্লোক ২, ২৫, ২৯: মালিনী; শ্লোক ৩৪: মন্দাক্রান্তা; শ্লোক ২০: পুষ্পিতাগ্রা; শ্লোক ১, ৪, ৮, ১০, ১৪-১৫, ২৬, ৩১: শার্দূল-বিক্রীড়িত; শ্লোক ৫, ২৭, ৩২: স্রগ্ধরা; শ্লোক ৩, ৬-৭, ১২-১৩, ১৬, ২২, ৩৩: বসন্ততিলক; শ্লোক ৯, ১১, ২৮, ৩০: উপজাতি।

তাম্রশাসনটি মহেন্দ্রপালের রাজত্বের সপ্তম বছরে উৎকীর্ণ এবং এতে মহেন্দ্রপাল কর্তৃক পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির কুণ্ডলখাটক বিষয়ে নন্দদীর্ঘিকা শহরে পূর্বপ্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ বিহারের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সমগ্র নন্দদীর্ঘিকা শহরটি দান করা হয়েছে।

১৯৯১ সালে কমলাকান্ত গুপ্তের পাঠোদ্ধার প্রকাশিত হয় ঢাকার ইতিহাস পরিষৎ পত্রিকায় এবং পরের বছর কোলুবেল ব্যাসরায় রমেশ ও এস. সুব্রহ্মণ্য আয়ারের পাঠোদ্ধার ও ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা ৪২তম খন্ডে।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পাদনা

আগে ঐতিহাসিকরা মনে করতেন যে দেবপালের পর রাজা হন তাঁর খুড়তুতো ভাইয়ের ছেলে প্রথম বিগ্রহপাল। বিভিন্ন সমকালীন অভিলেখে শূরপাল ও মহেন্দ্রপাল নামে আরও দুই রাজার নাম পাওয়া যায়। মনে করা হত শূরপাল বিগ্রহপালেরই অপর নাম এবং মহেন্দ্রপালকে ধরা হত গুর্জর-প্রতিহার রাজা প্রথম মহেন্দ্রপাল। ১৯৭০ সালে শূরপালের মির্জ়াপুর তাম্রশাসন (বর্তমানে লখনউ জাদুঘরে রক্ষিত) আবিষ্কারের পর এই রাজার আলাদা অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় এবং এই রাজাকে প্রথম শূরপাল ধরে নিয়ে দীনেশচন্দ্র সরকার ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত তাঁর পাল-সেন যুগের বংশানুচরিত গ্রন্থে পাল রাজাদের ক্রম ও বংশলতা পুনর্গঠন করেন। জগজ্জীবনপুর তাম্রশাসন থেকে পালবংশীয় রাজা হিসেবে মহেন্দ্রপালের অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়, জানা যায় যে মহেন্দ্রপাল ও শূরপাল ছিলেন দেবপাল ও মাহটা দেবীর দুই পুত্র এবং দেবপালের পর রাজা হন মহেন্দ্রপাল। ফলে পালবংশের ক্রম আবার পুনর্গঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯৮৮ সালে গৌরীশ্বর ভট্টাচার্য South Asian Studies পত্রিকায় The New Pāla Ruler Mahendrapāla: Discovery of a Valuable Charter নিবন্ধে এবং ১৯৯৪ সালে দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর Ancient India: History and Archaeology বইতে এই পুনর্গঠন করেন। গঙ্গোপাধ্যায় মহেন্দ্রপালের রাজত্বকাল নির্ধারণ করেন ৮৪৫-৮৬০ খ্রিস্টাব্দ। ১৯৯৫ সালে এক মার্কিন সংগ্রাহকের ব্যক্তিগত সংগ্রহে পালযুগের দুইটি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়, যা প্রথম শূরপাল ও মাণিক্যদেবীর পুত্র গোপাল নামে রাজার চতুর্থ বর্ষে উৎকীর্ণ।[৩] ফলে পাল-বংশলতা আবার পরিবর্তিত হয়েছে।[৪]

এর আগে বিহার ও বাংলায় বিভিন্ন মূর্তির পাদদেশে উৎকীর্ণ মহেন্দ্রপালের নয়টি ক্ষুদ্র অভিলেখ পাওয়া গিয়েছিল, যা থেকে মনে করা হত প্রতিহার রাজা মহেন্দ্রপাল পাল সাম্রাজ্যের বিরাট অংশ দখল করে নিয়েছিলেন। জগজ্জীবনপুর তাম্রশাসন থেকে এখন এটা প্রতিষ্ঠিত যে আগের অভিলেখগুলি ছিল পালবংশীয় মহেন্দ্রপালের এবং তাঁর সময়ে পাল সাম্রাজ্যের সীমানা অক্ষুণ্ণ ছিল।

মূল পাঠ সম্পাদনা

ওঁ[৫] স্বস্তি। শ্রীমন্-মানিত-শাসনো নিজব-
লৈরধ্যাসিতো বীর্যবান্ অত্যানন্দ-সুভূ-
তি-নন্দিত-মহাদানপ্রিয়ঃ ক্ষান্তিমান্। ভা-
স্বদ্-বংশভবঃ প্রজাহিতকরো নিঃশেষ-ভূমীশ্বরঃ সিদ্ধার্থো ভুবনানি পাতু সুগতঃ পাতা চ ধর্ম্মস্থিতেঃ॥॥ নৃপতিরিব বভূব ধ্ব-
স্ত-দোষান্ধকারো রবিরিব পট-ধাম্নান্-ধাম গোপাল নামা। অগণিত-গুণ-রত্নং যং সমাসাদ্য জাতা হরি-বসতি-সুখেভ্যো
দত্ত-তোয়াঞ্জলিঃ শ্রীঃ॥॥ অত্যুদ্ধত-দ্বিষদনেক-জয়ার্জ্জিত-শ্রীঃ শ্রীধর্ম্মপাল ইতি তস্য সুতো বভূব। প্রক্ষালিতানি কলি-স-
ন্তমসাবিলানি যস্যেন্দ্রদেব-যশসা ককুভাং মুখানি॥॥ দুর্ব্বারান্দ্বিষতো বিজিত্য সমরে তানিন্দ্ররাজাদিকান্ সিন্ধুনামধিপ-
ম্প্রমথ্য রভসাদুন্মীলিত-ক্ষ্মাভৃতা। দত্তা যেন মহী মহোদয়বতী বিক্রান্তি-ভাজে নিজং নির্ব্যাজং নতি বামনায় বলিনা চক্রা-
য়ুধায়ার্থিনে॥॥ রেণূন্ যস্য অঙ্গণেভ্যো হত-রিপু-মহিষী-শ্বাস-বাতা হরন্তি সিঞ্চত্যেতানি মাদ্যৎ-করি-করট-গলদ্দান-তোয়প্রবাহাঃ।
১০ রাজ্ঞাং সেবাপরাণা ম্প্রণত-নিজ-শিরোরত্ন-পুষ্প-প্রতানৈ র্দ্দোর্দ্দর্প্পানীত-লক্ষ্মী-কর-কমল-ধৃতঃ পূজিতঃ পাদপদ্মঃ॥॥ নীতের্বিলাস-ভ-
১১ বনম্প্রিয়-বিক্রমায়ঃ শ্রীদেবপাল ইতি তত্তনয়ো বভূব। যঃ কৌতুকাদিব জগৎপদবীন্ দিদৃক্ষু শ্চংক্রম্যতে স্ম ভবনাঙ্গণ-লীলয়েব॥॥ দ-
১২ ণ্ডোপনীত-কনকৈ র্ব্বসুধাধিপানাং রাজা মহাসমর-নাটক-সূত্রধারঃ। যো নির্ম্মমে সুগত-সদ্ম-গৃহঞ্চ গৌর্য যৎকৌতুকাঞ্চ তিল-
১৩ কঞ্চ জগৎ ত্রয়েঽপি॥॥ দুর্ব্বারাস্ত্র-নিপাত-ভীষণ-রণৎসন্নাহ-লব্ধোদয়ম্। সাক্ষীকৃত্য বিভাবসুং রণশিরোবেদী-মহামণ্ডপে। খ-
১৪ ড়্গাবর্জ্জিত-বৈরি-বারণ-ঘটা-কুম্ভাশৃগম্ভ-প্লুতো যো জগ্রাহ করং ক্ষিতীশ্বর-বরো নিঃশেষ-ভূভৃদ্-ভুবাম্॥॥ যং যোধয়ামা সুররাতয়স্তে যে-
১৫ ষাং রিরংসা সুর-সুন্দরীভিঃ। তথা বিবস্বদ্-ভ্রমণাবধীনি যৈঃ ক্রেতুং ইষ্টান্যসুভি র্যশাংসি॥॥ ধর্ম্মস্য প্রসবেন যেন বিপুলাম্ভুতিঞ্চি-
১৬ রম্বিভ্রতা ভ্রূলীতাহুত-কামরূপ-বিভবেনারোহৎ আদ্যম্ভৃশম্। দুর্গ্গায়শ্চ হিমালয়াচলভুবঃ শ্লাঘ্য ঙ্কর ঙ্গৃহ্ণতা সম্যক্ত্ব ম্প-
১৭ রমেশ্বরত্বমপর ন্দেবেন সন্দর্শিতম্॥১০॥ স চাহমানান্বয়-বারিধীন্দোঃ সাধ্বীং সুতাং দুর্ল্লভরাজ-নাম্নঃ শ্রীমাহটাং ধর্ম্মপরাং নরেন্দ্রস্ত্র-
১৮ য়ীমিবোদ্বাহ সলক্ষণাঙ্গীম্॥১১॥ সা দেবকীব নরদেব-সহস্র-বন্দ্যং সৌকর্যতো বসুমতী-ভরমুদ্বহন্তম্। লক্ষ্ম্যাঃ স্বয়ম্বরপতি ম্পুরুষো-
১৯ ত্তমঞ্চ দেবং সুতোত্তমমসূত মহেন্দ্রপালম্১২॥ যস্যাশা-বিজয়-প্রয়াণ-রজসাং সান্দ্রে সমুৎসর্প্পতি ব্যূহে নির্ভর-পূরিতাম্ব-
২০ রতয়া সম্পাদিতোর্ব্বী-দ্রুমে। স্পৃষ্টে পাদতলৈ রকাণ্ড-পতনাশঙ্কা-চমৎকারিণো বিদ্যামুৎপতনৈক-হেতুমজয় ন্বিদ্যাধরাণাং গ-
২১ ণাঃ॥১৩॥ আপ্রালেয়-গিরে র্বৃষাঙ্ক-বৃষভ-ক্ষুণ্ণাগ্র-রত্নস্থলাদ্ আসিন্ধো র্দ্দশকন্ধরারি-বিশিখ-ব্যালোড়িতান্তর্জ্জলাৎ। আপূর্ব্বা-
২২ পর-দিঙ্মুখৈক-তিলকাৎ শৈল-দ্বয়াৎভূভুজো নির্ব্যাজং নিপতন্তি যস্য চরণে দূরান্তরৈ র্ম্মৌলিভিঃ॥১৪॥ খড়্গোৎখাতা-মহেভ-কুম্ভ-বি-
২৩ গলৎ-কীলাল-ধারাজলে জাতো বৈরি-বধূ-বিলোচন-বমদ্-বাষ্পাম্বুভি র্ব্বর্ধিতঃ। সন্তীর্যাধিপতীনপাং প্রতিদিশং যাতঃ সহস্রৈ র্ম্মুখৈ-
২৪ শ্চিত্রং [পাব]কহরণৈ র্বিলাসিতো যস্য প্রতাপানলাঃ॥১৫॥ ত্বং সর্ব্বদা নৃপতি-চন্দ্র-জয়-শ্রিয়ার্থী স্বপ্নেঽপি ন প্রণয়িণী ভবতোঽহম্ আ-
২৫ সম্। ইথম্ভিয়া কুপিতয়েব রিপুং ভজন্ত্যা ব্যাজৃম্ভিরে সমর-কেলি-সুখানি যস্য॥১৬॥ স খলু ভাগীরথী-পথ-প্রবর্ত্তমান নানা-
২৬ বিধ[৬]-নৌবাটক-সম্পাদিত-সেতুবন্ধ-নিহিত-শৈলশিখর-শ্রেণী-বিভ্রমাৎ। নিরতিশয়-ঘন-ঘনাঘন-ঘটা-শ্যামায়মান-
২৭ বাসরলক্ষ্মী-সমারব্ধ-সন্তত-জলদসময়-সন্দেহাৎ উদীচীনানেক-নরপতি-প্রাভৃতীকৃতাপ্রমেয়-হয়বাহিনী-ধারখুরোৎখাত[৭]-
২৮ ধূলীপ্রসরিত[৮]-দিগন্তরালাৎ পরমেশ্বর-সেবাসমায়াতাশেষ-জম্বুদ্বীপ-ভূপাল-পাদানাভর[৯]-নমদবনেঃ। ঔদ্দালকখাতক-সমা-
২৯ বাসিত-শ্রীমজ্জয়স্কন্ধাবারাৎ পরমসৌগত-পরমেশ্বর-পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ-শ্রীদেবপালদেব-পাদানুধ্যাতঃ
৩০ পরমসৌগতঃ পরমেশ্বরঃ পরমভট্টারকো মহারাজাধিরাজঃ শ্রীমান্ মহেন্দ্রপালদেবঃ কুশলী॥ শ্রীপুণ্ড্রবর্ধন-
৩১ ভুক্তৌ কুণ্ড[ল]খাতক-বিষয়ে নন্দদীর্ঘিকোদ্রঙ্গে সীমা। তত্র পূর্ব্বেণ টঙ্গিলনদ্যার্ধস্রোতঃ পরিচ্ছিন্ন দক্ষিণেনাপি কুব্জ-ঘ-
৩২ টিকার্দ্ধ-স্রোতিকয়া কাসিঞ্জর-বম্মক-মধ্যেন নারায়ণ-বাসীয়-পূর্ব্বসীমাবধিঃ। পশ্চিমেনাপি গোলটী-নির্জ্ঝরে-
৩৩ ণাজ[গ]র-বাসকাবখাতেন বল্মীকস্তূপে নাশ্বত্থবৃক্ষেণ বিজ্জগবন্ধা-
৩৪ কং পশ্চিম-ষণ্ডালান্ত রামলকী-বৃক্ষ-পর্যন্তঃ উত্তরেণাপ্যতঃ পূর্ব্বমুখোত্তরকুণ্ড দক্ষিণেন নন্দসুরাল্পা
৩৫ টঙ্গিল-অর্দ্ধস্রোতোঽবধিঃ এবন্নিয়মিতসীম্নি সমুপগতান্ সর্ব্বানেব রাজনক-রাজপুত্র-কুমারামাত্য-ভুক্তিপ-
৩৬ তি-বিষয়পতি। সেনাপত্যুপরিক-তদায়ুক্তক। বিনিয়ুক্তক-দাণ্ডিক-দাণ্ডপাশিক। চৌরোদ্ধরণিক। দৌঃসাধ্যসাধ-
৩৭ নিক-[খো]ল-দূত-গমাগমিকাভিত্বরমাণ-হস্ত্যশ্বোষ্ট্র-নৌবল-ব্যাপৃতক-গোমহিষ্যাজাবিক-বাড়বাধ্যক্ষাদি-রাজপাদোপজীবি-
৩৮ নোঽন্যাংশ্চাচাট-ভট-জাতীয়ান্। যথাকালাধ্যাসী-বিষয়ব্যবহারিণঃ সকরণান্ ব্রাহ্মণ-মাননা-পূর্ব্বকং প্রতিবাসি-
৩৯ নঃ ক্ষেত্রকরাংশ্চ যথার্হং মানয়তি বোধয়তি সমাদিশতি চ মতমস্তু ভবতাং। মহাসেনাপতি-শ্রীবজ্রদেবেন দূতক-মু-
৪০ খেন বয়ং বিজ্ঞাপিতাঃ। যথা মাতাপিত্রোরাত্মনঃ সকলস্য চ সত্বরাশেঃ পুণ্যাভিবৃদ্ধয়ে নন্দদীর্ঘিকোদ্রঙ্গে ময়া বি-
৪১ হারঃ কারিতঃ তত্র যথোপরিলিখিত-নন্দদীর্ঘিকোদ্রঙ্গো ভগবতো বুদ্ধ-ভট্টারকস্য প্রজ্ঞাপারমিতাদি-সকল-
৪২ ধর্ম্ম-নেত্ত্রীস্থানস্য আর্যাবৈবর্ত্তিকা-বোধিসত্ব-গণ স্যাষ্ট-মহাপুরুষ-পুদ্গল-আর্যভিক্ষু-সংঘস্য যথার্হং পূজন-লেপ-
৪৩ নাদ্যার্থে চীবর-পিণ্ডপাত-শয়নাসন-গ্লান-প্রত্যায়-ভৈষজ্য-পরিষ্কারাদ্যর্থং খণ্ড-স্ফুটিত-সমাধানাদ্যর্থ মন্যে-
৪৪ ষামপি মমাভিমতানা ম্মৎ-পরিকল্পিত-বিভাগে নানবদ্য-ভোগার্থং শ্রীমদ্-ভট্টারকপাদাঃ দদাত্বিতি অতোঽস্মাভি-
৪৫ স্তদীয়-বিজ্ঞপ্ত্যা অয়ং যথোপরিলিখিত উদ্রঙ্গঃ স্বসংবদ্ধ-ভূমিসমেত শ্চতুঃসীমা-পর্যন্তঃ সতলঃ সোদ্দেশঃ সোপ-
৪৬ রিকরঃ সপট্ট-তরোপেতঃ সদশাপচারঃ[১০] সচৌরোদ্ধরণঃ পরিহৃত-সর্ব্বপীড়ঃ আচাট-ভট-প্রবেশাকিঞ্চিৎ-প্রগ্রাহ্যঃ।
৪৭ রাজকুলাভব্য-সর্ব্বপ্রত্যায়-সমেতো ভূমিচ্ছিদ্র-ন্যায়ে নাচন্দ্রার্ক্ক-ক্ষিতি-সমকালং তথৈব প্রদত্তঃ যথাভবদ্ভিঃ সর্ব্বৈরেব দান-
৪৮ মিদমনুমোদনীয়ং প্রতিবাসিভিঃ। ক্ষেত্রকরৈ শ্চাজ্ঞাশ্রবণবিধেয়ৈ র্ভূত্বা সমুচিত-করপিণ্ডাদি প্রত্যায়োপনয়ঃ কার্যঃ[।]
৪৯ ভাবিভিরপি ভূপতিভির্ভূমে র্দ্দানফল-গৌরবাদপহরণে মহান্নরক-পাতক-ভয়াচ্চ দানমিদমনুমোদ্য পরিপালনীয়মি-
৫০ তি। সংবৎ ৭ বৈশাখদিনে ২ তথা চ ধর্ম্মানুশংসন-শ্লোকাঃ। বহুভি র্ব্বসুধা দত্তা রাজভিঃ সগরাদিভিঃ[।] যস্য যস্য য-
৫১ দা ভূমিস্তস্য তস্য তদা ফলম্॥১৭॥ ষষ্টির্ব্বর্ষসহস্রাণি স্বর্গ্গে মোদতি ভূমিদঃ। আক্ষেপ্তা চানুমন্তা চ তান্যেব নরকে বসেৎ॥১৮
৫২ স্বদত্তা ম্পরদত্তাম্বা যো হরেত বসুন্ধরাম্। স বিষ্ঠায়াং কৃমির্ভূত্বা পিতৃভিঃ সহ পচ্যতে॥১৯॥ ইতি কমলদলাম্বু-বিন্দুলোলাং
৫৩ শ্রিয়মনুচিন্ত্য মনুষ্য-জীবিতঞ্চ। সকলমিদমুদাহৃতঞ্চ বুধ্বা ন হি পুরুষৈঃ পরকীর্ত্তয়ো বিলোপ্যাঃ॥২০॥ শ্রীমৎ-সংগ্রামত-
৫৪ রেণ কৃতঃ সুকৃত-কর্ম্মাণি। সৌমিত্রিরিব রামেন শূরপালোঽত্র দূতকঃ॥২১॥ শ্রীমান্ কুলে মহতি দেবরদেব নামা শ্লা-
৫৫ ঘ্যো বভূব ধরণীতল-গীতকীর্ত্তিঃ। অদ্যাপি সদ্‌গুণ-কথাশ্রয় এক এব সংকীর্ত্তয়তে প্রথমমেব জনৈর্ম্মহদ্ভিঃ॥২২॥ অন্যো-
৫৬ ন্য-স্পর্ধয়া বৃদ্ধমনন্যজনগোচরম্। ত্যাগঃ সত্যঞ্চ শৌর্যঞ্চ যস্য চৈতদ্ গুণত্রয়ম্॥২৩॥ তস্যাত্মজোঽভূৎ কমলানিবাসঃ
৫৭ শ্রীমান্ স নারায়ণদেব নামা। ধর্ম্মপ্রিয়ঃ প্রাণসমান-সত্যো বলেন যুক্তো গুরুণা মহীয়ান্॥২৪॥ অমলিনতর-বারিস্ফার-
৫৮ ধারা-নিপাতৈঃ। প্লুত-বপুরারিবৃন্দম্ ম্লানয়ন্তি সামন্তাৎ। অপি করিবর-ভেদোদ্ভূত-রক্তানুলিপ্তা দিশি দিশি সিতিমানং
৫৯ যস্য কীর্ত্তিস্ততান॥২৫॥ ত্যাগো নির্ভর-পূরিতার্থ-হৃদয়ঃ শৌর্যং জিতারাতিকাং সত্যন্নির্ম্মিত-নাকধাম-ধিষণা বিজ্ঞা-
৬০ ত-বস্তুস্থিতিঃ। কুর্বন্নেত্র-বিনোদদান-চতুরং শীলং জনানন্দকৃৎ কীর্ত্তির্দ্দিক্-সরসীষু কৈরব-বনচ্ছায়েব যস্যাভবৎ॥২৬
৬১ বহ্নির্ব্বৈরীন্ধনানাং নৃপশত-মুকুটোদ্ঘৃষ্ট-পাদারবিন্দঃ লোকস্থিতিনাং প্রণয়িজন-সরোজাকরার্কায়মাণঃ। যঃ পৃ-
৬২ থ্ব্যামেকনাথঃ প্রথিত-নিজগুণ-শ্লাঘয়া বর্জ্জিতাত্মা চক্রে শ্রীধর্ম্মপালো নৃপতিরধিপতি ম্মণ্ডলে দর্দ্দরণ্যাম্॥২৭॥ বভূব
৬৩ লক্ষ্মীরিব তস্য জায়া বপুস্ত্রিলোকী তিলকং বহন্তি। সিদ্ধিস্ত্রিবর্গ্গস্য বপুষ্মতীব কল্যাণদেবীতি যথাত্থনামা॥২৮॥ কুলকম-
৬৪ লিনী-লীনা-লক্ষ্মীরুতালয়-দেবতা স্বপতি-হৃদয়-গ্রাহিণ্যেষা সতী কিমরুন্ধতী। কিমুত বসুন্ধরেয়ং বিত্তপ্রসাধিত-মন্দিরা
৬৫ ইতি মনসি যা বিষ্টা লোকাংশ্চকার বিতর্কিতান্॥২৯॥ দিবীব তস্যাং রবিণেব তেন রামেব সম্যগ্-বিদিতোগুণাদি। সত্বোপকারৈক-র-
৬৬ তঃ প্রতাপী শ্রীবজ্রদেবো বিমল-স্বভাবঃ॥৩০॥ যো লক্ষ্মীং কুলজান্দয়ৎ-প্রণয়িণীং বীর্যোদয়াল্লীলয়া খড়্গাবর্জ্জিত-দন্তিকুম্ভ-বি-
৬৭ গলদ্-রক্তাম্বুভিঃ প্লাবিতঃ। হুত্বা শাস্ত্র-হুতাশনে রিপুহবির্মন্ত্রান্বিতো দুর্ল্লভাং সংগ্রামে বিজয়শ্রিয়ং পরিণয়ং লোকে বরত্বং গতঃ॥৩১
৬৮ ত্যাগো দুর্ব্বোধ-সত্যে সদসি পটুগিরো নাপবাদে পরস্তাৎ। প্রজ্ঞাশাস্ত্রে নানার্থ ব্যপগত-তমসো বঞ্চনেঽপি প্রজার্কঃ। ক্ষান্তির্দিনে ন ভূয়ো
৬৯ দ্বিষতি রণবরে সম্মুখে শস্ত্রপাণৌ। মৈত্রী ত্যাগে স্থিরেভুন্ন তু চলবনিতা সম্প্রয়োগেঽপি যস্য॥৩২॥ আর্যেষু জহ্নুতনয়া-স-
৭০ লিলাভিষেকো দিক্-কামিনীষু ঘন-চন্দন-পঙ্ক-লেপঃ। দুর্ব্বার-বৈরি-বনিতা-বদনাম্বুজেষু যস্যেন্দ্রধাম-কলিতো যশসাং বিতানঃ॥৩৩
৭১ ভব্যস্যৈতাঃ প্রকৃতি-পটবো যাবদ্দেবেহ গাবঃ। তত্বালোকং বিহত-তমসঃ তন্বতে সর্ব্বদিক্কং। যাবৎ পৃ-
৭২ থ্বী-বলয়-বহনাশ্চর্য-কর্ম্মাচ কূর্ম্মঃ। তাবৎ-তস্য ব্রজতু কৃতিনঃ কীর্ত্তিরেষা প্রতিষ্ঠাম্॥৩৪
৭৩ উৎকীর্ণ্ণমিদং শাসনং সামন্ত-শ্রীমাহড়েন॥

বঙ্গানুবাদ সম্পাদনা

শ্লোক ১: ওঁ স্বস্তি। শ্রীমান্ সিদ্ধার্থ, যাঁর শাসন (সর্ব)মান্য, যিনি নিজ (অধ্যাত্ম)বলে অধ্যাসনে (= উচ্চ আসনে) আসীন, বীর্যবান্, আনন্দ-সুভূতি-ক্ষান্তি-ময়, ভাস্বর (= সৌর) বংশে যাঁর জন্ম, যিনি প্রজাহিতকারী ও সমগ্র ভুবনের ভূমীশ্বর, সেই ধর্মকে স্থিতিদানকারী সুগত আমাদের রক্ষা করুন।

শ্লোক ২: গোপাল নামে এক নৃপতির জন্ম হয়েছিল, যিনি সূর্যের মত দোষান্ধকার (= মাৎস্য-ন্যায়)কে ধ্বংস করেছিলেন। তাঁর দেহপট ছিল উজ্জ্বল, অগণিত গুণরত্নের আধার সেই রাজাকে দেখে শ্রী (= লক্ষ্মী) তাঁর হরিভবনে (= বৈকুণ্ঠে) সুখে থাকাকে তোয়াঞ্জলি (= জলাঞ্জলি) দিয়েছিলেন (অর্থাৎ সেই রাজার রাজলক্ষ্মী হয়েছিলেন)।

শ্লোক ৩: ধর্মপাল নামে তাঁর (= গোপালের) ছেলে ছিলেন, যিনি বহু অতি-উদ্ধত রাজাকে জয় করে শ্রী (= খ্যাতি) লাভ করেছিলেন। ইন্দ্রের মত তাঁর যশ কলি-কলুষিত সব দিকের মুখ-প্রক্ষালন (= পবিত্র) করেছিল।

শ্লোক ৪: দুর্বার শত্রু ইন্দ্ররাজকে তিনি যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। সিন্ধুদেশের রাজাকে তিনি রভসে (= রঙ্গভরে, অনায়াসে) (যুদ্ধে) বিধ্বস্ত করেছিলেন। বলিরাজা যেমন বামন (অবতার)কে নির্ব্যাজ (= অকপট)ভাবে সমগ্র পৃথিবী দান করেছিলেন, সেভাবে তিনি অর্থী (= শরণাগত) চক্রায়ুধকে মহোদয় (= কনৌজ)-এর রাজত্ব দিয়েছিলেন।

শ্লোক ৫: যাঁর (প্রাসাদের) অঙ্গণের রেণু (= ধূলি) নিহত শত্রু (রাজা)দের মহিষীদের শ্বাসবায়ু উড়িয়ে নিয়ে যেত, হাতিদের গলগণ্ড-নিঃসৃত মদস্রাব-প্রবাহ (যাঁর অঙ্গণকে) সিঞ্চিত করত, সেবাপরায়ণ (সামন্ত) রাজাদের মুকুটের রত্নগুলি যাঁর পাদপদ্মে পূজায় অর্পিত ফুলের মত লাগত, দুর্দান্ত শক্তিতে আনীত লক্ষ্মী যাঁর করকমলে ধৃত ছিলেন।

শ্লোক ৬: নীতির বিলাসভবন (= অত্যন্ত নীতিনিষ্ঠ) ও বিক্রমশীল[১১] দেবপাল নামে তাঁর পুত্র জন্মেছিলেন, যাঁর শৈশব-ক্রীড়াতেই প্রাসাদাঙ্গণ জুড়ে বিক্রম প্রকাশ পেত।

শ্লোক ৭: মহাসমর নাটকের সূত্রধার হয়ে বহু রাজার কনক-ভাণ্ডার তিনি দণ্ড হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন। সুগত ও গৌরীর এমন দুটি মন্দির তিনি নির্মাণ করিয়েছিলেন, যা ছিল ত্রিজগতের তিলক-প্রতিম।

শ্লোক ৮: তাঁর দুর্বার অস্ত্রের ভীষণ রণটঙ্কারে ভোর হত, সূর্যদেব সাক্ষী থাকতেন তাঁর রণমণ্ডপে। শত্রুহাতিদের কুম্ভসদৃশ মাথা থেকে নিঃসৃত রক্তে খড়্গ ভিজিয়ে তিনি পার্বত্য রাজ্যগুলি থেকে কর আদায় করে এনেছিলেন।

শ্লোক ৯: তাঁর শত্রু যোদ্ধাদেরও সুরসুন্দরীদের প্রতি রিরংসা ছিল (অর্থাৎ স্বর্গে পৌঁছাবার আকাঙ্ক্ষা ছিল) এবং প্রাণ দিয়ে যশ ক্রয় করতেও তারা পেছপা ছিল না।

শ্লোক ১০: তিনি ধর্ম-প্রসূত (ধর্মের অনুসরণে, অথবা, ধর্মপালের রেখে যাওয়া) বিপুল মহিমার অধিকারী হয়েছিলেন, ভ্রূভঙ্গিতে দহন করেছিলেন কামরূপের (= কামরূপ রাজ্যের) বৈভব (শিব যেমন তৃতীয় নয়ন-বহ্নিতে দহন করেছিলেন কামদেবকে), হিমালয়-অঞ্চলের রাজ্যগুলি থেকে শ্লাঘনীয় কর আদায় করে (শিব যেভাবে হিমালয়ের কাছ থেকে পার্বতীর করগ্রহণ করেছিলেন) সত্যিই তিনি পরমেশ্বর (= শিব) প্রতিম হয়েছিলেন।

শ্লোক ১১: তিনি বিয়ে করেছিলেন চাহমান জাতির চন্দ্র মাহটা দেবীকে, যিনি ছিলেন দুর্লভরাজের সাধ্বী, সুন্দরী, ধর্মপরায়ণা কন্যা।

শ্লোক ১২: তিনি (= মাহটা) দেবকীর মত সহস্র লোকের বন্দিত, অক্লেশে বসুমতীর (শাসন)ভার বহনকারী, লক্ষ্মীর স্বয়ম্বরপ্রাপ্ত মহেন্দ্রপালকে জন্ম দিয়েছিলেন। (দ্বৈত অর্থে কৃষ্ণ ও বিষ্ণুর সঙ্গে এখানে মহেন্দ্রপালের তুলনা আছে।)

শ্লোক ১৩: অম্বর-আচ্ছন্নকারী তাঁর বিজয়-অভিযানের ধূলি ঘনায়িত হয়ে পৃথিবীকে বৃক্ষরূপ দিয়েছিল। পদস্পর্শে বৃক্ষ প্রস্ফুটনের আশঙ্কায় বিদ্যাধররা বিদ্যা ছাড়াই উপরে উঠে গিয়েছিলেন।

শ্লোক ১৪: হিমালয়ে শিবের বৃষভের খুরে উত্থিত রত্নখচিত অঞ্চলগুলিতে, দশানন-বিজয়ীর বাণক্ষেপে আলোড়িত সমুদ্রতীরে, দিঙ্মুখ-তিলক শৈলদ্বয়ে, রাজারা নিজেদের মুকুট দূরে রেখে অকপটভাবে তাঁর চরণে প্রণতি জানান।

শ্লোক ১৫: সহস্রমুখ আগুনের মত তাঁর প্রতাপানলে রাজারা জলের দিকে ধেয়ে যান, কিন্তু সেই জলের স্তর ক্রমেই বাড়তে থাকে খড়্গে ছিন্ন হাতিদের মস্তক-স্রাব আর বৈরিবধূদের অশ্রুধারায়।

শ্লোক ১৬: এই চন্দ্রসম রাজা বিজয়লক্ষ্মীর কাম্য হয়েও স্বপ্নেও তাঁকে প্রণয়িণী করেন নি; তাই কুপিত হয়ে তিনি শত্রু রাজার ভজনা করায় সেটা এই রাজার সমরকেলির সুখ বাড়িয়েছে।[১২]

গদ্যাংশ: যেখানে ভাগীরথী-পথে পরিক্রমণশীল নানাবিধ রণতরণী[১৩] [সুবিখ্যাত] সেতুবন্ধনিহিত শৈলশিখরশ্রেণীরূপে [লোকের মনে] বিভ্রমের উৎপাদন করে থাকে,—যেখানে নিরতিশয় ঘনসন্নিবিষ্ট [ঘনাঘন-নামক] রণকুঞ্জর-নিকর [জলদজালবৎ প্রতিভাত হয়ে] দিনশোভাকে শ্যামায়মান করে, [লোকের মনে] নিরবচ্ছিন্ন জলদসময় (মেঘের সময় = বর্ষাকাল)-সমাগম-সন্দেহের উৎপাদন করে থাকে,—যেখানে উত্তরাঞ্চলাগত অগণ্য [মিত্র] রাজন্য-কর্তৃক [প্রাভৃতীকৃত] উপঢৌকনীকৃত অসংখ্য অশ্বসেনার প্রখর-খুরোৎক্ষিপ্ত-ধূলিপটল-সমাবেশে দিঙ্মণ্ডলের অন্তরাল নিরন্তর ধূসরিত হয়ে থাকে,—যেখানে রাজরাজেশ্বর-সেবার্থ-সমাগত সমস্ত জম্বুদ্বীপাধিপতিগণের পদাতি-পদভরে বসুন্ধরা অবনত হয়ে থাকে,—সেই ঔদ্দালকখাতক-সমাবাসিত-শ্রীমজ্জয়স্কন্ধাবার থেকে, পরম সুগত-[বুদ্ধ]-মতাবলম্বী পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ শ্রীদেবপালদেবের পাদানুধ্যান-পরায়ণ, পরমসৌগত পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ শ্রীমান্ মহেন্দ্রপালদেব কুশলে আছেন। শ্রীপুণ্ড্রবর্ধন-ভুক্তির কুণ্ডলখাতক বিষয়ে নন্দদীর্ঘিকা উদ্রঙ্গের (ছোট শহর, যেখানে কর-আদায়ের পরিকাঠামো আছে[১]) সীমা। এর পূর্বে টঙ্গিল নদীর অর্ধস্রোত (নালা), কুব্জঘটিকা নালার দক্ষিণ দিক থেকে কাসিঞ্জর ও বম্মক মধ্যবর্তী নারায়ণবাসীয় (?বিষ্ণুমন্দির) পর্যন্ত। পশ্চিমে গোলটী ঝর্ণা থেকে অজগর-বাসক অবখাত, উইঢিপি, অশ্বত্থ বৃক্ষ, বিজ্জগ বাঁধ হয়ে ষণ্ডালের পশ্চিম সীমায় আমলকী গাছ পর্যন্ত। উত্তরে উত্তরকুণ্ডের পূর্ব মুখ থেকে দক্ষিণে টঙ্গিল নালা পর্যন্ত নন্দসুরাল্পা। এই সীমায় কার্যরত সমস্ত রাজনক, রাজপুত্র, কুমারামাত্য, ভুক্তিপতি, বিষয়পতি, সেনাপতি, উপরিক, তদায়ুক্তক, বিনিয়ুক্তক, দাণ্ডিক, দাণ্ডপাশিক, চৌরোদ্ধরণিক, দৌঃসাধ্যসাধনিক, খোল, দূত, গমাগমিক, অভিত্বরমাণ, হস্তী-অশ্ব-উষ্ট্র-নৌবল-ব্যাপৃতক, গোমহিষ্যাজাবিক, বাড়বাধ্যক্ষ ইত্যাদি রাজকর্মচারী,[১৪] চাট-ভট-জাতীয় অন্যান্য ব্যক্তি, যথাকাল-বাস্তব্য বিষয়ব্যবহারী এবং করণ ও প্রতিবাসী ক্ষেত্রকরসকল, এঁদের ব্রাহ্মণসম্মানপূর্বক [অর্থাৎ আগে ব্ৰাহ্মণের সম্মান করে, পরে এঁদেরকে যথাযোগ্যভাবে সম্মান করে,] জানাচ্ছেন ও আজ্ঞা করছেন যে,—আপনাদের সম্মতি হোক,—মহাসেনাপতি শ্রীবজ্রদেব দূতক দ্বারা আমাদেরকে জানিয়েছেন যে,—“মাতাপিতার, নিজের ও সকলের সত্বরাশিতে পুণ্যাভিবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আমরা নন্দদীর্ঘিকোদ্রঙ্গে বিহার নির্মাণ করিয়েছি, সেই ভগবান্ বুদ্ধভট্টারকের সংঘের প্রজ্ঞাপারমিতাদি সকল ধর্মনেত্রীদের স্থানের, আর্যাবৈবর্তিকা ও বোধিসত্বগণের, অষ্ট মহাপুরুষ, পুদ্গল, আর্যভিক্ষুর এবং আমার মনোনীত অন্যদের যথার্থ পূজন-লেপনাদি, বস্ত্র-খাদ্য-শয্যা-ধ্যান-চিকিৎসা-পরিষ্কারাদি, বিভিন্ন মেরামতি ও আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী অন্যান্য সুবিধার জন্য, সেই নন্দদীর্ঘিকোদ্রঙ্গ, যেমনটি উপরে লিখিত আছে, আপনি দান করুন।” তদনন্তর আমি, তদীয় বিজ্ঞপ্তি অনুসারে উপরি লিখিত উদ্রঙ্গ স্বসংবদ্ধ-ভূমিসমেত স্বসীমা পর্যন্ত, যাবতীয় কর আদায়ের অধিকার-সমেত, যথা, ভূতল, ভূতলের উপরদেশ, উপরিকর, জল-সংলগ্ন ভূমি, দশাপচার, চৌরোদ্ধরণ, চাট-ভটদের প্রবেশকর, এবং সকল কর থেকে মুক্ত (পরিহৃত-সর্বপীড়া) ও সকল দায় থেকে মুক্ত (অকিঞ্চিৎ-প্রগ্রাহ্য) অবস্থায়, রাজকুলের প্রাপ্য যাবতীয় প্রত্যায়-করের অধিকার-সমেত, ভূমিচ্ছিদ্র-ন্যায়ানুসারে (প্রথম চাষের অধিকার) চন্দ্ৰ, সূর্য ও পৃথিবীর অবস্থানকাল পর্যন্ত [বজ্রদেব যেরূপভাবে প্ৰাৰ্থনা করেছিলেন] সেইরূপেই প্ৰতিষ্ঠাপন করলাম। আপনারা সকলেই ভূমির দানফলগৌরব ও তদপহরণে মহানরকপাতাদি ভয় [স্মরণ করে] এই দান অনুমোদন করে পরিপালন করবেন। প্ৰতিবাসী ক্ষেত্ৰকর সকল [এই রাজ] আজ্ঞা শ্রবণ করে, সমুচিত করপিণ্ডকাদি সমস্ত প্ৰদেয় বস্তু [পূর্বোক্ত দেবসেবাৰ্থ] প্ৰদান করুক। সংবৎ ৭, বৈশাখের দ্বিতীয় দিন। ধর্মের অনুশাসন পালনের শ্লোকসমূহ (নিচে দেওয়া হল)।

শ্লোক ১৭: সগর প্রভৃতি বহু রাজগণ ভূমিদান করে গিয়েছেন; যখন যে রাজা ভূমির অধিপতি হন, তখন তাঁরই ফল হয়।

শ্লোক ১৮: ভূমিদানকারী ষাট হাজার বছর স্বৰ্গভোগ করেন। দত্তভূমির হরণকারী ও হরণ বিষয়ের অনুমোদনকারী তৎ[পরিমিত]কাল পৰ্যন্ত নরকভোগ করেন।

শ্লোক ১৯: যিনি স্বদত্ত অথবা পরদত্ত ভূমি হরণ করেন, তিনি পিতৃগণের সহিত, বিষ্ঠার কৃমি হয়ে, নরকযন্ত্ৰণা ভোগ করেন।

শ্লোক ২০: লক্ষ্মী ও মনুষ্যজীবন পদ্ম (কমল) পত্রস্থিত জলবিন্দুর ন্যায় চঞ্চল;—এটি এবং আগের বাক্যগুলি স্মরণ করে, পরকীর্তির বিলোপসাধন করা কোন পুরুষেরই কর্তব্য নয়।

শ্লোক ২১: মহাযোদ্ধা ও সুকার্যকারী, রামের ভাই লক্ষ্মণ-সদৃশ শ্রীমান্ শূরপাল (এই দানপত্রের) দূতক (রাজপ্রতিভূ হিসেবে সম্পাদনকারী)।

শ্লোক ২২: মহৎ কুলে শ্লাঘনীয় দেবরদেবের জন্ম হয়েছিল, দেশ জুড়ে যিনি গীতকীর্তি ছিলেন, এখনও মহৎ লোকেরা তাঁর সদ্‌গুণগুলির চর্চা করে থাকেন।

শ্লোক ২৩: ত্যাগ, সত্য, শৌর্য—এই পরস্পর বিরোধী গুণত্রয়ের তিনি আকর ছিলেন, যা লোকে বুঝতে পারত না।

শ্লোক ২৪: তাঁর পুত্র নারায়ণদেব ছিলেন লক্ষ্মীর নিবাস-স্থল, ধর্মপ্রিয়, সত্য ছিল তাঁর প্রাণ-সমান, বল ও গৌরবে তিনি ছিলেন মহীয়ান্।

শ্লোক ২৫: জলপ্রপাতের স্ফটিক-বারিধারার মত অমলিন তাঁর কীর্তি [যুদ্ধে] আহত হাতিদের রক্তলিপ্ত দিক্‌সমূহের মুখ পরিষ্কার করে দিত।

শ্লোক ২৬: তিনি ছিলেন ত্যাগশীল ও সন্তুষ্টচিত্ত, শৌর্যে জিতেছিলেন শত্রুদের, সত্যই তাঁর আকাশ-দেদীপ্য ধীশক্তি বস্তুর প্রকৃত রূপ জানতে পেরেছিল। চোখের ইঙ্গিতে তিনি দান করতে পারতেন, তাঁর কীর্তিসূর্য দিকে দিকে সরোবরের শ্বেতপদ্মের বনকে ছায়ায় ঢেকে দিত।

শ্লোক ২৭: বৈরিশিবিরে তিনি ছিলেন আগুনের ইন্ধন, তাঁর পাদপদ্ম রাজাদের মুকুট ঘর্ষণ করত, তিনি ছিলেন লোকস্থিতিকারী (দেশরক্ষক), কমলিনীদের কাছে সূর্যপ্রতিম, নিজগুণের প্রশংসায় আত্মবর্জিত, দেশের একমাত্র নাথ, ধর্মপাল রাজা তাঁকে দর্দরণ্য মণ্ডলের অধিপতি করেছিলেন।

শ্লোক ২৮: তাঁর স্ত্রী কল্যাণদেবী ছিলেন ত্রিলোকের তিলকসমা, ত্রিবর্গের সিদ্ধির (ধর্ম, অর্থ, কাম) মূর্তিমতী রূপ।

শ্লোক ২৯: তিনি কি ছিলেন কুলকমলিনী লীলাময়ী লক্ষ্মী, নাকি স্বামীর হৃদয়-গ্রাহিণী সতী অরুন্ধতী? কোন মন্দিরের দেবী নাকি বিত্ত-প্রসাধিতা স্বয়ং পৃথিবী? লোকের মনে এসব বিতর্ক জাগত।

শ্লোক ৩০: আকাশ ও সূর্যের মত এই দুজনের রাম-সদৃশ পুত্র বজ্রদেব, যিনি সকলের উপকার-রত, প্রতাপশীল ও বিমল-স্বভাব।

শ্লোক ৩১: বিজয়লক্ষ্মীর প্রণয়প্রা্প্ত তাঁর খড়্গে শত্রুপক্ষীয় হাতিরা বীর্য ও লীলাভরে ছিন্নমুণ্ড হয়ে তাঁকে রক্তস্নাত করে, যুদ্ধ-যজ্ঞের পবিত্র আগুনে মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে শত্রুরা হয় আহুতি-প্রাপ্ত।

শ্লোক ৩২: দুর্বোধ-সত্যের বিতর্কসভায় তিনি পটুত্ব দেখিয়েছেন, প্রজ্ঞাশাস্ত্রে সূর্যের মত দূর করেছেন অন্ধকার, শান্তির সময় শত্রুদের প্রতি তিনি বন্ধুভাবাপন্ন, চঞ্চলা লক্ষ্মী সঙ্গে থাকুন বা না থাকুন, তিনি মৈত্রীপূর্ণ, ত্যাগশীল, স্থিরমতি।

শ্লোক ৩৩: ঋষিদের কাছে জাহ্নবী-সলিলে অভিষেকের মত, দিক্-কামিনীদের কাছে ঘন-চন্দন-পঙ্ক-লেপনের মত, দুর্বার শত্রুদের রমণীদের মুখপদ্মের কাছে ইন্দ্রধাম-তুল্য তাঁর যশ-বিতান।

শ্লোক ৩৪: যতদিন কূর্মাবতার পৃথিবীর ভার বহন করবেন, ততদিন সূর্যরশ্মির মত আপনার কীর্তির এই আলেখ্য সবদিকের তমসা দূর করুক।

এই শাসন সামন্ত শ্রীমাহড় কর্তৃক উৎকীর্ণ হল।

টীকা ও সূত্র সম্পাদনা

  1. Interpreting a Stone and a Bronze Image of Malda Museum in West Bengal, গোপাল দাস, The Journal of Social Science Researcher, Vol III, No. 3, July 2014, pp. 34-40.
  2. প্রাক্-বাংলা লিপির এই নামটি দিয়েছিলেন প্রসিদ্ধ অভিলেখবিদ্ দীনেশচন্দ্র সরকার, আলবেরুণীর লেখা অনুসরণে। বর্তমানে ঐতিহাসিক মহলে এই নামই চালু।
  3. The New Pāla Ruler, Gopāla (II), Son of Śūrapāla (I), গৌরীশ্বর ভট্টাচার্য, Facets of Indian Culture, 1998, pp. 177-181.
  4. পাল বংশলতার সর্বশেষ সংস্করণের জন্য দেখুন: The Royal Charters of King Madanapāla and the Chronology of the Pāla Kings of Bengal and Bihar, S. C. Mukherji, Journal of Bengal Art, Vol. 4, 1999.
  5. এখানে ওঁ-স্থলে একটা চিহ্ন আছে। সমস্ত পাল তাম্রশাসনই এই চিহ্ন দিয়ে শুরু হয়, এখানে দেখুন। অনেকটা বাংলা ৎ-এর মত দেখতে এই চিহ্নটাকে সিদ্ধং চিহ্ন বলে।
  6. রমেশ ও আয়ারের পাঠোদ্ধারে নানাবিধ-স্থলে নানাধিপ আছে, যা পাঠোদ্ধার-প্রমাদ হওয়ারই সম্ভাবনা। অন্যান্য পাল তাম্রশাসনেও এই অংশটি অবিকল পাওয়া যায় এবং তাতে নানাবিধই আছে। উদাহরণ-স্বরূপ, ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসনের ২৫ নং পংক্তি, দেবপালের মুঙ্গের তাম্রশাসনের ২৪ নং পংক্তি এবং নারায়ণপালের ভাগলপুর তাম্রশাসনের ২৫ নং পংক্তি দেখুন।
  7. অন্যান্য তাম্রশাসনে খরখুরোৎখাত আছে।
  8. অন্যান্য তাম্রশাসনে ধূলীধূসরিত আছে।
  9. অন্যান্য তাম্রশাসনে পাদাতভর আছে।
  10. রমেশ ও আয়ার এটিকে শুদ্ধ করে সদশাপরাধঃ পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন, কিন্তু খালিমপুর ও ভাগলপুর তাম্রশাসনেও এই পাঠ আছে।
  11. কমলাকান্ত গুপ্ত ও রমেশ-আয়ারের পাঠোদ্ধারে এই শ্লোকের ব্যাখ্যায় দেবপালের মায়ের নাম বিক্রমা বলা হয়েছে। এটা ভুল ব্যাখ্যা, কারণ দেবপালের মুঙ্গেরনালন্দা তাম্রশাসনে পরিষ্কার বলা আছে যে দেবপালের মায়ের নাম ছিল রণ্ণাদেবী। এ ব্যাপারে আলোচনা দেখুন: The Myth of Vikramādevī — Mother of Devapāla?, গৌরীশ্বর ভট্টাচার্য, প্রত্ন সমীক্ষা, Vol. 6-8 (1997-1999), 2001, pp. 84-87.
  12. সম্ভবত মহেন্দ্রপালের কোন পরাজয়ের ইঙ্গিতবাহী।
  13. নানাবিধ নৌবাটক মানে নানারকম নৌকা নয়। পালরাজাদের জয়স্কন্ধাবারে অন্যান্য সামরিক উপকরণের সঙ্গে নৌবাহিনীও থাকত। এখানে নৌবাটক শব্দে তাই বোঝানো হয়েছে। গৌড়লেখমালায় খালিমপুর তাম্রশাসন প্রসঙ্গে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
  14. এই সব রাজকর্মচারীর বিস্তৃত বিবরণের জন্য দেখুন: পাল-সাম্রাজ্যের শাসন-প্রণালী, রাধাগোবিন্দ বসাক, প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড), ১৯৩৬, পৃ. ৮৮১।

পাল সাম্রাজ্য সম্পাদনা

 
৮০০ খ্রিস্টাব্দের এশিয়া, যাতে পাল সাম্রাজ্য দেখা যাচ্ছে

পাল সাম্রাজ্য ছিল অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে বাংলার পাল রাজবংশের সাম্রাজ্য, যা তুঙ্গাবস্থায় সমগ্র উত্তর ভারত, এবং বর্তমান পাকিস্তানের পূর্বাংশ, অসম, বাংলাদেশ, নেপাল, উড়িষ্যা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। এই রাজবংশ ছিল মহাযান ও তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী।

মাৎস্যন্যায় ও গোপাল সম্পাদনা

গৌড়রাজ শশাঙ্কের মৃত্যুর পর এক শতাব্দীর ওপর বাংলায় অরাজকতা চলে, ছোট মাছের ওপর বড় মাছের অত্যাচারের মত। সেই সুযোগে বারবার হয় বিদেশি আক্রমণ, যার মধ্যে উল্লেখ্য কনৌজের যশোবর্মা ও অসমের হর্ষদেবের বঙ্গ-অধিকার। এই মাৎস্য-ন্যায় থেকে বাঁচতে ৭৫০ খৃষ্টাব্দে গোপালকে রাজা নির্বাচন করা হয়। ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসন অনুযায়ী, গোপালকে "মাৎস্যন্যায়ম্-অপোহিতুং প্রকৃতিভির্-লক্ষ্ম্যাঃ করং-গ্রাহিতঃ"[১][২] করা হয়েছিল অর্থাৎ মাৎস্যন্যায় দূর করতে প্রকৃতি (জনসাধারণ) তাঁকে রাজলক্ষ্মীর করগ্রহণ করিয়েছিল।

 
খালিমপুর তাম্রপত্র
 
খালিমপুর তাম্রলেখ, ১-৩৩ পংক্তি
 
খালিমপুর তাম্রলেখ, ৩৪-৬২ পংক্তি

তবে প্রশস্তি করে "প্রকৃতিভিঃ" নির্বাচিত বলা হলেও আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে[৩][৪] এটা এখনকার সাধারণ নির্বাচনের মত ছিল না, বরং সামন্তরাজগণ ও অন্যান্য প্রভাবশালী লোকেরাই এই নির্বাচনটি করে থাকবেন। কাঞ্চীর বৈকুণ্ঠপেরুমাল মন্দিরলেখে বর্ণিত পল্লবরাজ নন্দিবর্মার[৫] এবং রাজতরঙ্গিণী (৫৷৪৫৭) বর্ণিত কাশ্মীররাজ যশস্করের নির্বাচনের ধরণ থেকে এটা বোঝা যায়।

রাজা হয়ে গোপাল সমগ্র গৌড় তথা বাংলা নিজের অধিকারে আনতে যত্নশীল হন। এরপর তিনি নজর দেন পশ্চিম দিকে। তিব্বতী লামা তারানাথের ভারতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস (১৬০৮) অনুযায়ী গোপাল মগধ অধিকার করেছিলেন। রমাপ্রসাদ চন্দের মতে তিনি তীরভুক্তি বা মিথিলাও অধিকার করেন।[৬]

পালদের বংশপরিচয় সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। পরবর্তী যুগে পালরা নিজেদের সূর্যবংশীয়, বরুণবংশীয় ইত্যাদি দাবি করলেও খালিমপুর লেখ অনুযায়ী গোপালের পিতা বপ্যট খণ্ডিতারাতি (শত্রুদমনকারী) এবং পিতামহ দয়িতবিষ্ণু সর্ববিদ্যাবদাত (উচ্চশিক্ষিত) বলে বর্ণিত হয়েছেন, বংশপরিচয় নিয়ে আর কোন বাগাড়ম্বর নেই, যা থেকে মনে হয় বংশমর্যাদা আহামরি কিছু ছিল না।

ধর্মপাল সম্পাদনা

গোপাল-পুত্র ধর্মপালকে বলা যেতে পারে পাল বংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি। বাংলা ও বিহার অঞ্চল তাঁর সরাসরি শাসনাধীন ছিল, আর কনৌজের সিংহাসনে তিনি বসিয়েছিলেন চক্রায়ুধ নামে এক সামন্ত রাজাকে। এই উপলক্ষ্যে কনৌজে তিনি এক দরবার আহ্বান করেন এবং সেখানে, খালিমপুর তাম্রশাসন অনুযায়ী "তিনি [ধর্মপাল] মনোহর ভ্রূভঙ্গি-বিকাশে (ইঙ্গিতমাত্রে) ভোজ, মৎস্য, মদ্র, কুরু, যদু, যবন, অবন্তি, গন্ধার, কীর প্রভৃতি বিভিন্ন জনপদের নরপালগণকে প্ৰণতিপরায়ণ চঞ্চলাবনত মস্তকে সাধু সাধু বলিয়া কীর্তন করাইতে করাইতে, হৃষ্টচিত্ত পঞ্চালবৃদ্ধ কর্তৃক মস্তকোপরি আত্মাভিষেকের স্বর্ণকলস উদ্ধৃত করাইয়া, কান্যকুব্জরাজকে রাজশ্ৰী প্রদান করিয়াছিলেন।"[৭] এত সব রাজা ধর্মপালের বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন বলেই সোড্‌ঢলের উদয়সুন্দরীকথায় (১০৩০) তাঁকে উত্তরাপথস্বামী বলা হয়েছে।[৮][৪]

কনৌজ ত্রিকোণ সম্পাদনা

 
কনৌজ ত্রিকোণ

এই সময় মহোদয় বা কনৌজের দখল নিয়ে পাল, প্রতীহার ও রাষ্ট্রকূট রাজ্যের ত্রিকোণ সংঘর্ষ দেখা দেয়, যাকে বলে কনৌজ ত্রিকোণ। প্রতীহাররাজ বৎসরাজ ধর্মপালকে পরাজিত করে তাঁর "শরদিন্দুপাদ-ধবল" রাজছত্রদ্বয় ছিনিয়ে নিয়ে যান, এরপর রাষ্ট্রকূটরাজ ধ্রুব উত্তরে অভিযান চালিয়ে বৎসরাজকে পরাজিত করে মরুভূমিতে বিতাড়িত করেন এবং গৌড় ও বঙ্গের রাজছত্রদুটি দখল করেন। ধ্রুব বিজয়গর্বে দক্ষিণে ফিরে গেলে ধর্মপাল উত্তরের সার্বভৌমত্ব লাভ করেন এবং কনৌজের সিংহাসনে চক্রায়ুধকে প্রতিষ্ঠিত করেন। পরের অধ্যায়ে বৎসরাজের পুত্র দ্বিতীয় নাগভট চক্রায়ুধ ও ধর্মপাল উভয়কেই পরাজিত করেন এবং কনৌজ অধিকার করে সেখানে নিজের রাজধানী স্থাপন করেন। এই পরিস্থিতিতে ধর্মপাল ও চক্রায়ুধ ধ্রুবের পুত্র এবং পরবর্তী রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দের শরণাপন্ন হন। পরিণামে তৃতীয় গোবিন্দ উত্তরে বিজয় অভিযান চালান এবং নাগভটকে বিতাড়িত করে নিজ ভ্রাতুষ্পুত্র কর্করাজকে গুজরাটের মহাসামন্ত হিসেবে নিয়োগ করেন। কর্করাজের বরোদা তাম্রশাসন অনুযায়ী গুর্জরদের আটকে রাখার জন্য তাঁর এক হাত ছিল দিগর্গল (দরজার আগল)। মহাসামন্ত এতই দক্ষ দিগর্গল হয়েছিলেন যে প্রায় দুই প্রজন্ম ধরে গুর্জর প্রতীহাররা রাজপুতানার মরুভূমি থেকে বেরোতে পারে নি।[৯] বিজয় অভিযান শেষে তৃতীয় গোবিন্দ দাক্ষিণাত্যে ফিরে গেলে ধর্মপাল আবার উত্তরাপথের পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ হন। গুজরাটের মহাসামন্তের "দিগর্গল"-ভূমিকার অন্তে নাগভট-পৌত্র মিহিরভোজ আবার পাল-সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন, কিন্তু দেবপালের হাতে পরাজিত হয়ে প্রত্যাবর্তনে বাধ্য হন।

দেবপাল সম্পাদনা

 
বাদল স্তম্ভলিপি

ধর্মপাল প্রৌঢ় বয়সে বিয়ে করেন গুজরাটের রাষ্ট্রকূট মহাসামন্ত কর্করাজের পৌত্রী রণ্ণাদেবীকে, এঁদের পুত্র দেবপাল অল্প বয়সে সিংহাসনে বসেন এবং প্রায় চল্লিশ বছর রাজত্ব করেন। তিনিই ছিলেন পাল বংশের, এবং সম্ভবত বাংলার সমগ্র ইতিহাসের, সবচেয়ে দিগ্বিজয়ী সম্রাট। তাঁর সেনাপতি ছিলেন খুড়তুতো ভাই জয়পাল এবং মন্ত্রী ছিলেন দর্ভপাণি ও পরে তাঁর পৌত্র কেদারমিশ্র। এঁদের সৈনাপত্য ও মন্ত্রণাবলে তিনি চতুর্দিকে বিজয় অভিযান পাঠান। নারায়ণপালের ভাগলপুর তাম্রশাসন অনুযায়ী, "জয়পাল ভ্রাতা দেবপালের আজ্ঞায় দিগ্বিজয়ার্থ বহির্গত হইলে, উৎকলপতি দূর হইতে নাম শুনিয়াই, ভয়বিহ্বলচিত্তে স্বীয় রাজধানী ত্যাগ করিয়াছিলেন; এবং বন্ধুপরিবেষ্টিত প্রাগ্‌জ্যোতিষপতি, তাঁহার আজ্ঞা শিরোধার্য করিয়া, যুদ্ধ হইতে বিরত হইয়া, শান্তিলাভ করিয়াছিলেন।"[১০] এইভাবে অসম ও উড়িষ্যা পাল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। কেদারমিশ্রের পুত্র গুড়বমিশ্রের বাদল স্তম্ভলিপি অনুযায়ী মন্ত্রীদের "নীতিকৌশলে শ্রীদেবপালনৃপ হস্তীর মদজলসিক্ত-শিলাসংহতি-পূর্ণ নর্মদার জনক বিন্ধ্যপর্বত হইতে আরম্ভ করিয়া, মহেশ-ললাট-শোভিত-ইন্দুকিরণে উদ্ভাসিত হিমাচল পর্যন্ত, এবং সূর্যের উদয়াস্তকালে অরুণরাগরঞ্জিত জলরাশির আধার পূর্ব সমুদ্র এবং পশ্চিম সমুদ্রের মধ্যবর্তী সমগ্র ভূভাগ করপ্রদ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন" এবং "উৎকলকুল উন্মূলিত করিয়া, হূণ-গর্ব হরণ করিয়া, দ্রবিড়রাজ এবং গুর্জররাজের দৰ্প খর্ব করিয়া, দীর্ঘকাল সাগরাম্বরা বসুন্ধরা সম্ভোগ করিয়াছিলেন"।[১১] দেবপালের মুঙ্গের তাম্রশাসন অনুযায়ী তাঁর বাহু বিন্ধ্য ও কাম্বোজ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।[১২] এই কাম্বোজের পরিচয় নিয়ে সংশয় আছে। সেকালে তিব্বতকে কাম্বোজ বলত এবং তিব্বতীয় সূত্রে তিব্বতের রাজা কর্তৃক ধর্মপালের পরাজয়ের বিবরণ আছে। হতে পারে দেবপাল এই কাম্বোজকে হারিয়েছিলেন। উত্তরবঙ্গের কোচ উপজাতির নাম এই কাম্বোজ থেকে এসেছে।[৪] আবার অতি প্রাচীন যুগে আর এক কাম্বোজ ছিল বর্তমান পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমায়। এদের ঘোড়া ছিল বিখ্যাত। প্রতীহার এবং পাল সেনাবাহিনী কাম্বোজ ঘোড়া ব্যবহার করত। দেবপাল বীরদেব নামে এক পণ্ডিতকে নালন্দা মহাবিহারের অধ্যক্ষ নিয়োগ করেছিলেন, তিনি মূলে ছিলেন এই আফগান কাম্বোজের বাসিন্দা। হতে পারে এই কাম্বোজে যুদ্ধাভিযানকালে দেবপালের সঙ্গে বীরদেবের পরিচয় ঘটে। সব মিলিয়ে দেবপালের আমল ছিল পাল সাম্রাজ্যের তুঙ্গ যুগ।

পতনের প্রথম ধাপ সম্পাদনা

দেবপালের পর তাঁর দুই পুত্র মহেন্দ্রপাল ও প্রথম শূরপাল পর পর রাজা হন। এরপর সিংহাসনে বসেন জয়পালের পুত্র প্রথম বিগ্রহপাল। তিনি সন্ন্যাসী হয়ে গেলে রাজত্ব পান তাঁর ছেলে নারায়ণপাল। নারায়ণপালের সুদীর্ঘ পঞ্চান্ন বছরের বেশি রাজত্বকালে পাল বংশের পতনের শুরু। প্রতীহার ও রাষ্ট্রকূট আক্রমণে তিনি পরাজিত হন। অসম ও উড়িষ্যাও স্বাধীন হয়ে যায়। পূর্ববঙ্গে চন্দ্র রাজবংশ হরিকেল রাজ্য স্থাপন করে। এরপর রাজা হন যথাক্রমে রাজ্যপাল ও দ্বিতীয় গোপাল। এসময় হয় চন্দেল্ল ও কলচুরি আক্রমণ। পালদের কাম্বোজ অশ্ববাহিনী বিদ্রোহ করে গৌড় তথা উত্তরবঙ্গ দখল করে কাম্বোজান্বয় পাল রাজবংশ স্থাপন করে। পরবর্তী রাজা দ্বিতীয় বিগ্রহপালের সময় হাতে থাকে শুধু বিহার। চন্দ্র রাজা হরিকেল থেকে গৌড়ের কাম্বোজ পাল বংশকে আক্রমণ করেন এবং কামরূপ দখল করেন। মূল পাল বংশ পরিণত হয় মগধের রাজবংশে।

প্রথম মহীপাল সম্পাদনা

মহীপালের সময় পালরাজ্যের আবার সম্প্রসারণ ঘটে। তিনি কাম্বোজ পালবংশকে হারিয়ে পিতৃরাজ্য উদ্ধার করেন, পশ্চিমে বারাণসী পর্যন্ত অধিকার সম্প্রসারণ করেন। চোলসম্রাট রাজেন্দ্রচোল এ সময় উড়িষ্যা হয়ে বাংলা আক্রমণ করেন। দণ্ডভুক্তিতে কাম্বোজ পালবংশের শেষ রাজা ধর্মপাল রাজেন্দ্রচোলের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন, দক্ষিণ রাঢ়ে পরাজিত হন রণশূর, বঙ্গালদেশে (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা, তথা বাখরগঞ্জ অঞ্চল) চন্দ্রবংশীয় রাজা গোবিন্দচন্দ্র রণহস্তী থেকে নেমে পলায়ন করেন। অবশেষে রাজেন্দ্রচোল কর্ণভূষণ, চর্মপাদুকা এবং বলয় বিভূষিত মহীপালকে ভীষণ সমরক্ষেত্র থেকে পলায়ন করতে বাধ্য করে, তাঁর অদ্ভুত বলশালী করিসমূহ এবং রত্নোপমা রমণীগণকে হস্তগত করেছিলেন।[১৩] রাজেন্দ্রচোল লুণ্ঠিত দ্রব্যাদি নিয়ে ফিরে গেলে মহীপাল আবার আগের ক্ষমতায় ফিরে আসেন এবং রাজ্যের সম্প্রসারণ করেন। বারাণসীর অধিকার নিয়েও তাঁর সঙ্গে চেদীর কলচুরিাজ গাঙ্গেয়দেবের যুদ্ধ হয়। মহীপালের রাজত্বকালেই গজনীর সুলতান মাহমুদ ভারত আক্রমণ করে মথুরা, সোমনাথ ইত্যাদি বিধ্বস্ত করেন। বারাণসী সম্ভবত মহীপালের অধিকারে থাকাতেই রক্ষা পেয়েছিল।

নয়পাল ও অন্যান্য সম্পাদনা

মহীপালপুত্র নয়পাল চেদীরাজ লক্ষ্মীকর্ণকে দীর্ঘ যুদ্ধের পর পরাজিত করেন। পরে প্রাচীন যুগের সর্বপ্রসিদ্ধ বাঙালি পণ্ডিত ও বিক্রমশীলা মহাবিহারের অধ্যক্ষ অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের মধ্যস্থতায় উভয়ের সন্ধি হয়। এরপর অতীশ নেপাল হয়ে তিব্বত যান এবং বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক বিস্তার ঘটান। নেপাল থেকে তিনি নয়পালকে একটি ধ্রুপদী চিঠি লেখেন, বিমলরত্ন-লেখনামা নামে, তাতে রাজধর্ম সম্বন্ধে আছে বহু অমূল্য উপদেশ।[১৪] নয়পালের পুত্র তৃতীয় বিগ্রহপালের সঙ্গে লক্ষ্মীকর্ণের পুনর্বার যুদ্ধ ও পরাজয় হয়, শেষে সন্ধি হিসেবে লক্ষ্মীকর্ণের কন্যা যৌবনশ্রীর সঙ্গে বিগ্রহপালের বিবাহ হয়। এই বিষয়ের ওপর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তুমি সন্ধ্যার মেঘ নামে উপন্যাস লিখেছিলেন। পরবর্তীকালে বিগ্রহপাল বহিঃশত্রুর আক্রমণে বারবার বিপর্যস্ত হন এবং পাল সাম্রাজ্যের পতন দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকে। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত খ্যাত রামপালের সময় সাময়িক উত্থান হলেও এরপর ক্রমে পালবংশ লোপ পায় এবং বাংলা সেনবংশের অধীনে আসে।

প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পাদনা

পাল প্রশাসন ছিল রাজন্যকেন্দ্রিক, একই পরিবার বংশানুক্রমে তাঁদের প্রধানমন্ত্রী থাকত। সাম্রাজ্য ভুক্তি, বিষয়, মণ্ডল ও ক্ষুদ্রতর বিভাগে ভাগ হয়ে শাসিত হত। পাল তাম্রশাসনগুলিতে বহুরকম রাজকর্মচারীর নাম পাওয়া যায়।

ধর্ম ও সাহিত্য সম্পাদনা

চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু প্রসিদ্ধ বই পাল আমলের লেখা। যথা চক্রদত্ত, দ্রব্যগুণসংগ্রহ, শব্দচন্দ্রিকা ইত্যাদির লেখক চক্রপাণিদত্তের পিতা নারায়ণ ছিলেন নয়পালের রন্ধন বিভাগের প্রধান। রামপালের চিকিৎসক ভদ্রেশ্বরের পুত্র সুরেশ্বর শব্দপ্রদীপ নামে ভেষজ-অভিধান এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে লোহার ব্যবহারের ওপর লোহপদ্ধতি নামে গ্রন্থ লেখেন। জ্যোতির্বিদ্যার বিভিন্ন গ্রন্থলেখক মল্লিকার্জুন সুরীও পালযুগের। সন্ধ্যাকরনন্দীর রামচরিত ছিল দ্বৈত অর্থের বই, এক দিকে রামের সীতা উদ্ধার, অন্য দিকে কৈবর্ত ভীমের হাত থেকে রামপালের বরেন্দ্র উদ্ধার। দায়ভাগ ও অন্যান্য আইনের বই রচয়িতা জীমূতবাহন পালযুগের লেখক।

পাল রাজত্ব শুরু হওয়ার আগে থেকেই বিহার ও বাংলায় বৌদ্ধ ধর্ম বহুপ্রচলিত ছিল। গোপালের রাজত্বের প্রথমদিকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ছিলেন শান্তরক্ষিত, সেখান থেকে তিব্বত গিয়ে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন। ধর্মপালের সময় হরিভদ্র, টঙ্কদাস প্রভৃতি লেখকরা বৌদ্ধগ্রন্থ লেখেন। সহজিয়া ও তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম-প্রাণিত প্রাচীনতম বাংলা সাহিত্য চর্যাপদ এ যুগেই লেখা হয়। লুইপা, তিলোপা ও অন্যান্য তান্ত্রিক বৌদ্ধসাধক, বৌদ্ধ মহাপণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর ও অন্য বহু বৌদ্ধ পণ্ডিত ও লেখকের আবির্ভাব পাল যুগে। পাল রাজারা অনেক বৌদ্ধ মঠ ও বিহার স্থাপন করেন, যেমন গোপাল স্থাপন করেন ওদন্তপুরী মহাবিহার, ধর্মপাল স্থাপন করেন বিক্রমশীলা ও সোমপুরী মহাবিহার, রামপাল জগদ্দল বিহার।

কথাসাহিত্যে পাল রাজবংশ সম্পাদনা

  • রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ধর্মপাল (১৯১৫)
  • শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস তুমি সন্ধ্যার মেঘ (১৯৫৮)

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Khalimpur Plate of Dharmapaladeva, Lorenz Franz Kielhorn, Epigraphia Indica, Vol 4, 1897, p. 243.
  2. On a New Copper-plate Grant of Dharmapāla, উমেশচন্দ্র বটব্যাল, Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol. LXIII, Part I, 1894, p. 39.
  3. Land of Two Rivers: A History of Bengal from the Mahabharata to Mujib, নীতীশকুমার সেনগুপ্ত, 2011, p. 40
  4. গৌড়রাজমালার ভূমিকা, দীনেশচন্দ্র সরকার, ১৯৭৫
  5. Pattattalmangalam Grant of Nandivarman, কে. ভি. সুব্রহ্মণ্য আয়ার, Epigraphia Indica, Vol. 18, 1925, p. 115.
  6. গৌড়রাজমালা/মাৎস্যন্যায়—গোপাল, রমাপ্রসাদ চন্দ, ১৯১২
  7. গৌড়রাজমালা/ধর্ম্মপাল, রমাপ্রসাদ চন্দ, ১৯১২
  8. Udayasundarîkathâ of Soddhala, Gaekwad's Oriental Series, ed. Chimanlal Dalal & Embar Krishnamacharya, 1920, pp. 4-6
  9. The Pālas of Bengal/Chapter 2, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯১৫
  10. গৌড়রাজমালা/দেবপাল, রমাপ্রসাদ চন্দ, ১৯১২
  11. গৌড়রাজমালা/দেবপালের দিগ্বিজয়, রমাপ্রসাদ চন্দ, ১৯১২
  12. Dynastic History of Magadha, George E. Somers, 1977, p. 185
  13. গৌড়রাজমালা/রাজেন্দ্রচোলের অভিযান, রমাপ্রসাদ চন্দ, ১৯১২
  14. বিমলরত্ন-লেখনামা, অনু. দীপঙ্কর লামা, ২০০৮

old সম্পাদনা

वरमेको गुणी पुत्रो निर्गुणैश्च शतैरपि | एकश्चन्द्रस्तमो हन्ति न च ताराः सहस्त्रशः ||६||