ব্যবহারকারী:Dhirajdatta1248/বাগধারার উৎসসন্ধানে

                                                   অকালকুস্মাণ্ড
  বাগধারাটির উৎপত্তি সম্পর্কে দুটি কাহিনী প্রচলিত আছে। প্রথমতঃ অকালে জাত ছাঁচিকুমড়া্ পূজায় বলিদান হয় না। সেই হিসাবে কাজের নয় বলে সে ব্যর্থ। এই ব্যাখ্যার ভিত্তিতে অকালকুষ্মাণ্ড- শব্দবন্ধটির আলংকারিক অর্থ হল-অকর্মণ্য, অকেজো ইত্যাদি অর্থাৎ সবদিক থেকে অপদার্থ ব্যক্তি। দ্বিতীয়তঃ ব্যাখ্যার উৎস হল মহাভারত। মহাভারতে আছে- অকালে গান্ধারী কুষ্মাণ্ডাকার এক মাংসপিণ্ড প্রসব করেন। সেই মাংসপিণ্ড থেকে গান্ধারীর শতপুত্র জন্ম নেয়। গান্ধারীর শত পুত্রের কারণে কুরুবংশ ধ্বংস হয়। এই আখ্যানের ভিত্তিতে ‘অকালকুষ্মাণ্ড’ শব্দবন্ধের অলঙ্কারিক অর্থ হল- পরিবারের কলঙ্ক, পরিবারের অনিষ্টকারী, পরিবারের বিনাশকারী কোন সদস্য। এখানে উল্লেখযোগ্য যে কারো মৃত্যু হলে হিন্দুরা কৌতুকে বলে থাকে- গয়াংগচ্ছ।     
                                                   অক্কা পাওয়া
   অক্কা পাওয়া- সম্পর্কে দুটি ব্যাখ্যা আছে। অক্কা, একটি প্রাচীন শব্দ, যার মুখ্য অর্থ হল ঈশ্বর। সম্ভবতঃ অকা বা আকা শব্দ থেকে শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। আরবী অকা, শব্দের অর্থ ঈশ্বর। সুতরাং অক্কা পাওয়ার অর্থ ঈশ্বরকে পাওয়া বা মৃত্যু হওয়া। ল্যাটিন আকা(acca) শব্দের অর্থ মাতা বা দেবী। এইঅর্থে অক্কা পাওয়া, শব্দবন্ধের অর্থ হল মাকে পাওয়া। বৈষ্ণবদের মধ্যে কেষ্ট পাওয়া শব্দবন্ধটি প্রচলিত আছে। কেউ মারা গেলে বৈষ্ণবেরা বলে- সে কেষ্ট পেয়েছে। বৈষ্ণবদের কেষ্ট পাওয়া- শব্দবন্ধের অনুসরণে শাক্তদের মধ্যেও অক্কা পাওয়া শব্দবন্ধটি যোগসূত্র থাকতে পারে। শব্দবন্ধটি মূলতঃ কৌতুকে বলা হয়ে থাকে, যেমন- হাঁপের টানে হরির বাপ অক্কা পেল। 
                                                     অক্ষয়বট
  গয়া, পুরী, প্রয়াগ, ভূবনেশ্বর, চন্দ্রনাথ ইত্যাদি তীর্থস্থানগুলিতে রোপিত অশ্বত্থ/বটগাছলিকে অক্ষয়বট বলা হয়। এই গাছগুলি দেবতাদের মত পূজাঅর্চনাদি পেয়ে থাকে। শাস্ত্রে বলা আছে এই গাছগুলির গোড়ায় জল দিলে এবং পূজা করলে অক্ষয়পূণ্য হয়। বটগাছগুলির সাথে অমরত্বের কোন সম্পর্ক নেই। তবে ‘অক্ষয়বট’ নামকরণের একটা কাহিনী আছে। গয়ার বটগাছ এদের মধ্যে প্রাচীনতম ও মহত্তম। কথিত আছে দশরথকে পিণ্ডদানের সাক্ষ্য দেওয়ায় সীতা প্রসন্ন হয়ে এই বটগাছকে ‘অক্ষয় হও’ বলে আশীর্বাদ করেছিলেন। তার থেকে অমরত্বের ধারণার উদ্ভব হয়েছে।  মহর্ষি গৌতম এই গাছতলে বসে ৬০ হাজার বংসর মহাদেবের আরাধনা করিয়াছিলেন। অতি প্রাচীন গাছগুলির ‘বিনাশ নেই’ ভাবার্থেই বাগধারাটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই মনোভাব থেকেই অক্ষয়বটের গৌণ তথা আলঙ্কারিক অর্থ হল- অতি প্রাচীন বা অতিবৃদ্ধ ব্যক্তি।   
                                                   অগত্যা মধুসূদন
  মধু নামে এক দৈত্যকে শ্রীকৃষ্ণের নিধন করেছিলেন। সেই কারণে তাঁর আরেক নাম মধুসূদন। পুরাণের বিভিন্ন কাহিনী থেকে জানা যায় যে বহু বিপদগ্রস্ত মানুষ শ্রীকৃষ্ণের শরণ নিয়েছেন। ‘মধুসূদনদাদার দই-এর ভাঁড়’ গল্পের বালককে তিনি বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন। এই গল্প থেকে বাগধারাটির উৎপত্তি। বাগধারাটির আলঙ্কারিক অর্থ অগতির গতি, অনন্যোপায়ের শেষ উপায়; নিরাশ্রয়ের শেষ আশ্রয় ইত্যাদি।   
                                                     অগস্ত্যযাত্রা
  অগস্ত্য বিশিষ্ট মুনির নাম। বিন্ধপর্বত তাঁর শিষ্য ছিল। বেদ অনুসারে সুমেরুপর্বত প্রদক্ষিণ করে সূর্যের উদয়াস্ত হয়। একবার বিন্ধপর্বতের ইচ্ছা হয়, সূর্য যেন তাকেও প্রদক্ষিণ করে উদিত ও অস্তমিত হয়। সূর্য অসম্মত হন। তাতে ভীষণ রেগে গিয়ে বিন্ধপর্বত ফুলতে ফুলতে সূর্যের গতিপথ রুদ্ধ করে। দেবতারা তাতে ভয় পেয়ে বিন্ধপর্বতের গুরু অগস্ত্যমুনির শরণাপন্ন হন। দেবতাদের অনুরোধে তিনি বিন্ধপর্বতের কাছে উপস্থিত হন। সে নতজানু হয়ে গুরুকে প্রণাম করলে গুরু তাকে বলেন যে  তিনি দক্ষিণাপথে যাচ্ছেন। যতদিন না তিনি ফিরে আসছেন ততদিন সে যেন নতজানু অবস্থাতেই থাকে। সেদিনটা ছিল পয়লা ভাদ্র। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর যাওয়ার ব্যাখ্যা হল বিষয়টা ছিল আর্যদের দাক্ষিণাত্যে উপনিবেশস্থাপন। অগস্ত্যমুনি আর কোন দিন ফিরে আসেন নি। তিনি দাক্ষিণাত্যে স্থায়ীভাবে থেকে যান। দ্রাবিড়গোষ্ঠীর লোকেরাও অগস্ত্যমুনিকে তাদের প্রথম জ্ঞান উপদেষ্টা বলে স্বীকার করে। সেই থেকে পয়লা ভাদ্রে যাত্রা নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। সাধারণভাবে ‘নিষিদ্ধযাত্রা’ বোঝাতে ‘অগস্ত্যযাত্রা’ বলা হয়। তবে ‘চিরদিনের জন্য যাত্রা’ বা ‘মৃত্যু’ অর্থেও বাগধারাটি ব্যবহৃত হয়। পাছে আর ফেরা না-হয় সেই ভয়ে এই দিনটিতে এখনও অনেকে কোথাও যাত্রা করেন না। কেউ যদি বলেন তিনি অগস্ত্যযাত্রা করছেন, তিনি বোঝাতে চান যে তিনি আর ফিরবেন না। 
                                                   অগ্নিপরীক্ষা 
  অগ্নিপরীক্ষা বললে সীতার অগ্নিপরীক্ষার কথা মনে হয়। রাবণকে নিধন করে রাম অযোধ্যায় ফিরে আসার উদ্যোগ নেন। তবে আসার আগে সন্দেহবশে সীতার অগ্নিপরীক্ষা করান। সীতা সসম্মানে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অগ্নিদেব স্বয়ং সীতাকে নিয়ে জলন্ত চিতা থেকে বেরিয়ে এসে রামের হাতে অর্পণ করেন। অতঃপর রামচন্দ্র সীতাসহ অযোধ্যায় ফিরে আসেন এবং রাজ্যশাসন শুরু করেন। বেশ চলছিল। কিছুদিনের মধ্যে প্রজাদের মধ্যে সীতাকে নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়। সকলে বলতে থাকে সীতার সতীত্বপরীক্ষা তাদের সম্মুখে হয় নি। প্রজাদের মনোভাবে বিরক্ত হয়ে রাম দ্বিরীয়বারের জন্য সীতার অগ্নিপরীক্ষার উদ্যোগ নেন। সীতার দুর্ভাগ্য। সতীলক্ষ্মী হয়েও সতী আখ্যা না পাওয়া রামায়ণের অনন্যচরিত্রা সীতাকেও দ্বিতীয়বারের জন্য অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়। সীতার মত পবিত্রচরিত্র দ্বিতীয় কোন মহাকাব্যে নেই। অপমানে ও লজ্জায় আহত সীতা দ্বিতীয়বারের জন্য অগ্নিপরীক্ষা না দিয়ে পাতালে প্রবেশ করেন। মা ধরিত্রী অতিস্নেহে তাঁকে কোলে তুলে নেন। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও কখনো কোন নারীকে এমন জলন্ত পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় নি। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ বাগধারাটি আলঙ্কারিক অর্থ হল- অতি কঠিন পরীক্ষা। 
                                                    অগ্নিশর্মা
  অগ্নিশর্মা কোন ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক চরিত্র নয়। বাগধারাটির উৎপত্তি সম্পর্কে জোর দিয়ে কিছু বলা যায় না। তবে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। শব্দটির মুখ্য অর্থ হল আগুনের মত উগ্র শর্মা। ‘শর্মা’ শব্দ থেকে আভাস পাওয়া যায় যে ব্যক্তিটি কোন এক কোপনস্বভাব ঋষি বা ব্রাহ্মণ অথবা একজন মহাক্রোধী শিক্ষক। যদি ঋষি হন তবে ইনি কথায় কথায় রেগে যাওয়া ক্ষ্যাপা দুর্বাসা মুনিও হতে পারেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় অগ্নিশর্মা হলেন একজন প্রখরমূর্তি শিক্ষক। সাধারণভাবে এই ভাবার্থেই ‘অগ্নিশর্মা’র গৌণ অর্থ করা হয়- অত্যন্ত ক্ষিপ্ত একজন ব্যক্তি।      

                                               অজাতশত্রু যুধিষ্ঠির
  ‘অজাতশত্রু’ শব্দের ভাবগত অর্থ হল- যার কোন শত্রু নেই না, যিনি কারও শত্রু নন বা যিনি কখনো কারো শত্রুতা করেন না ইত্যাদি। শব্দটির গৌণ কোন অর্থ নেই। মহাভারতে বলা হয় যে যুধিষ্টির অজাতশত্রু ছিলেন। কথাটা সর্বাংশে সঠিক নয়। কেন তিনি এই অভিধা পেলেন তার কোন সদুত্তর কোথাও নেই। রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য তবে কি তিনি কৌরবদের সাথে শত্রুতা কোন করেন নি? যদি সেটা সত্যি হয় তবে তিনি ভাইয়েদের সাথে অবশ্যই শত্রুতা করেছেন। এই বিভ্রান্তি এড়াবার জন্যই ‘ধর্মস্ব সূক্ষ্মা গতিঃ’ উক্তিটি করা হয়। তবে সন্দেহ নেই যে যুধিষ্ঠির একজন নির্বিরোধী ব্যক্তি ছিলেন। সেইজন্যে একজন নির্বিরোধী ব্যক্তিসম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘অজাতশত্রু যুধিষ্ঠির’ বাগধারাটি ব্যবহার করা হয়।      
                                                অতি আশ সর্বনাশ
  ‘অতি আশ সর্বনাশ’ বাগধারা বা প্রবাদটির উৎপত্তি সম্পর্কে দুটি কাহিনী আছে। প্রথমতঃ ঈশপের গল্পে আছে এক কুকুর এক টুকরা মাংস মুখে করে নিয়ে এক সাঁকো পার হচ্ছিল। সাঁকো থেকে নীচের দিকে তাকালে সে জলে নিজের ছায়া দেখতে পায়। সে ভাবে অন্য একটা কুকুর তারই মত মাংসের টুকরা নিয়ে খাল পার হচ্ছে। সেটা পাওয়ার লোভে সে জলে খাঁপ দেয়। তাতে সে নিজের টুকরাটাও হারায় এবং আন্যটাও পায় না। দ্বিতীয় গল্পে আছে একবনে এক কাক, এক কচ্ছপ, এক ইঁদুর ও এক হরিণ বন্ধুভাবে বাস করত। এক দিন কচ্ছপ ব্যাধের জালে বাঁধা পড়ে। তাকে মুক্ত করার জন্য অন্য তিনবন্ধু এক যুক্তি করে। যুক্তি অনুযায়ী হরিণ ব্যাধের পথের মাঝে মড়ার মত শুয়ে থাকে। জালে জড়ানো কচ্ছপকে নিয়ে ফেরার পথে ব্যাধ দেখে এক হরিণ মরে পড়ে আছে, আর কাক তার চোখ ঠোকরাচ্ছে। ব্যাধ তার মহাসৌভাগ্যে ভীষণ খুশি। সে কচ্ছপকে মাটিতে রেখে হরিণ নিতে এগিয়ে যায়। হরিণের কাছে পৌঁছুতেই কাক ব্যাধের মাথার উপর পাখা ঝাপটিয়ে তাকে ব্যতিব্যস্ত করতে থাকে যাতে এই ফাঁকে ইঁদুর জাল কেটে কচ্ছপকে মুক্ত করতে পারে। কাক যখন দেখে কচ্ছপ সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত সে উচ্চস্বরে ‘কা’ শব্দ করে উড়ে পালায়। তার ‘কা’ শব্দ শুনে হরিণও বিদ্যৎগতিতে লাফিয়ে জঙ্গলে হারিয়ে যায়। হতভম্ব ব্যাধ জালের কাছে ফিরে এসে দেখে জাল কাটা এবং কচ্ছপ তাতে নেই। সে ভাবল বেশি আশা না করলে তার এই ক্ষতি হত না। গল্পটির তাৎপর্য হল- একত্রে লড়ে বড় শত্রুকেও হারানো যায়- ‘সহায় বলবত্তর’। ‘অদ্য ভক্ষ্য ধনুর্গুণ’ গল্পের নীতিবাক্যও হল ‘অতি আশ সর্বনাশ’।
                                               অতিমন্থনে বাসুকীর বিষ
   পুরাণে বলা আছে দুর্বাসা মুনির অভিশাপে দেবী লক্ষ্মীর সমুদ্রগর্ভে স্থান হয়। লক্ষ্মীর অবর্তমানে পৃত্থিবী অন্ধকারময় ও শ্রীহীন হয়ে পড়ে। বিষ্ণুর আদেশে দেবতারা সমুদ্রমন্থনে উদ্যোগী হন। মন্থনে সমুদ্রগর্ভ থেকে বহুকাল ধরে সঞ্চিত অমৃত উঠে আসার সম্ভাবনা ছিল। সেকারণে অসুরেরা অমৃতের লোভে দেবতারদের সাথে সমুদ্রমন্থনে যোগ দেয়। মৈনাক পর্বতকে দণ্ড এবং বাসুকীনাগকে রজ্জু হিসাবে ব্যবহার করা হয়। অসুরেরা বাসুকীর মুখের দিক ধরে এবং দেবতারা লেজের দিক ধরে। মন্থন শুরু হয়। যথাসময়ে লক্ষ্মী উঠে আসেন। মন্থনের প্রয়োজনও ফুরায়। কিন্তু অমৃতের লোভে দেবতা ও অসুরেরা মন্থনকার্য চালিয়ে যায়। শেষপর্যন্ত অমৃত উঠে আসে।  তবে অতিমন্থনের তার সাথে বাসুকীর বিষও উঠে আসে। এই কাহিনী থেকে প্রবচনটির উৎপত্তি হয়। প্রবচনটির বক্তব্য হল বেশি কচলালে মধুর মত জিনিসও তেতো হয়।           
                                                  অদ্যভক্ষ্যধনুর্গুণ
  ‘হিতোপদেশের গল্প’ হল বাগধারাটির উৎস। গল্পে  আছে বনের ধারে এক ব্যাধ পাস করত। সে একদিন একটি হরিণ মেরে ফেরার পথে একটা শুয়োর দেখতে পায়। সে ঘাড় থেকে হরিণ নামিয়ে রেখে শুয়োর মারতে যায়। শুয়োরও তাকে প্রত্যাক্রমণ করে। তাতে উভয়েরই মৃত্যু হয়। লড়াইয়ের সময় তাদের পায়ের চাপে একটি সাপও মারা যায়।এক ক্ষুধার্ত শিয়াল বনে ঘুরতে ঘুরতে মৃত ব্যাধ, হরিণ, শুয়োর, সাপ এবং সঙ্গে পাশে পড়ে থাকা ব্যাধের ধনুকটি দেখতে পায়। ক্ষুধার্ত শিয়ালের কাছে পাঁচটি বিষয়ই পরমখাদ্য। সে মনে মনে ভাবে মানুষ, হরিণ ও শুয়োরে একমাস করে তার তিনমাস চলে যাবে; সাপে যাবে একদিন, আর আজকে খাবে ধনুকের ছিলা। ছিলায় কামড় দেওয়ামাত্র ধনুক ছিটকে এসে শিয়ালের মাথায় আঘাত করে। তাতে শিয়ালের মৃত্যু হয়। গল্পটির সারমর্ম হল অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না কবে কাজ করলে শিয়ালের দশা হতে পারে। বাগধারাটি এই অর্থ ব্যক্ত করে। ঘরে অন্নাভাব বোঝাতে বাগধারাটি ব্যবহৃত হয়, যেমন- ঘরে আমার অদ্যভক্ষ্যধনুর্গুণ অবস্থা। গল্পটির নীতিবাক্য হল- অতি আশ সর্বনাশ।        

                                                   অন্ধগোলাঙ্গুলন্যায়

  এই ন্যায়ের তাৎপর্য এই যে কোন মূর্খের উপদেশ নিলে কার্যসিদ্ধি তো হয় না পরন্তু মহাবিপদে পড়তে হয়।  ‘হিতোপদেশের গল্প’ হ’ল এই বাগধারার উৎস। গল্পের কাহিনী হ’ল এইরকম- একদিন এক অন্ধের বন্ধুর বাড়ী যাওয়ার ইচ্ছা হয়। কিছুদূর যাওয়ার পর সে পথ হারিয়ে ফেলে। অসহায় অবস্থায় সে তখন পথের ধারে বসে পড়ে। সেইসময় এক রাখাল তার গরুর পাল নিয়ে বাড়ী ফিরছিল। পথের ধারে অন্ধকে ঐভাবে বসে থাকতে দেখে তার কারণ জানতে চায়। অন্ধ তার অসহায় অবস্তার বর্ণনা দেয়। কারণ জেনে রাখাল অন্ধকে বলে-‘তুমি বন্ধুর বাড়ীর গরুর লেজ ধরে থাকো; সে তোমাকে বন্ধুর বাড়ীর পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে’। অন্ধও তাই করে। কিন্তু তার ফল হয় বিষম। লেজ ধরাতে গরু ভয় পেয়ে যায়। দিকবিদিকজ্ঞানশূন্য সে হয়ে ছুটতে থাকে। তাতে অন্ধের বন্ধুর বাড়ী যাওয়া তো হয় না বরং উলটে সে বারবার পড়ে গিয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়। গল্পটির নীতিকথা হল-মূর্খ বা খলের উপদেশ বা পরামর্শ কখনো গ্রহণ করা নেই। 
                                                    অন্ধপঙ্গুন্যায়
  এই ন্যায়ের তাৎপর্য এই যে যদি একজনের দ্বারা কোন কাজ সমাধা করা সম্ভব না হয় তবে আরেকজনের সাহায্য নিয়ে সেই কাজ সুষ্টভাবে সমাধা করা যায়। এটি একটি হিতোপদেশমূলক গল্পকাহিনী। গল্পটি এইরকম- কোন একসময়ে এক অন্ধ ও এক পঙ্গু পরস্পর বন্ধু ছিল। একদিন তাদের স্থানান্তরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। তারা পরমার্শ করে স্থির করে যে পঙ্গু অন্ধের পিঠে বসে পথের নির্দেশ দেবে আর অন্ধ সেই নির্দেশ অনুসারে পথ চলবে। এইভাবে পঙ্গুর চোখ এবং অন্ধের পা একত্রে দুরূহ সমস্যা সমাধান করে নির্দিষ্টস্থানে যথাসময়ে পৌঁছে যায়।  গল্পটির নীতিকথা হল ‘সহায় বলবত্তর’ বা ‘দশের লাঠি একের বোঝা’।   
                                                  অন্ধপরম্পরান্যায়
 এই ন্যায়ের তাৎপর্য হল এই যে, বহু অনভিজ্ঞলোক একত্র হলেও তারা কোন কাজ সুষ্টভাবে সম্পন্ন করতে পারবে না। হিতোপদেশমূলক একটি গল্পের কাহিনী হ’ল এইরকম- একদিন একদল অন্ধ হাত ধরাধরি করে একসাথে পথ চলছিল। কিছুদূরে পথের মাঝে একটা বিরাট গর্ত পড়ে। গর্তের মধ্যে প্রথম অন্ধ পড়লে অন্যেরাও পরস্পর জড়াজড়ি করে গর্তের মধ্যে পড়ে। উপদেশমূলক গল্পটির সারমর্ম হ’ল- হাজার মূর্খ একত্র হলেও একজন জ্ঞানীর সমান হয় না।             
                                            অন্ধহস্তিন্যায়/অন্ধের হস্তী দর্শন
   এই ন্যায়ের তাৎপর্য হল এই যে অনভিজ্ঞ ও অল্পদর্শী ব্যক্তিদের সিদ্ধান্ত  একদেশদর্শী হয়। হিতোপদেশমূলক এই গল্পের কাহিনী হল- একবার চার অন্ধ একসাথে মিলে একদিন এক চক্ষুস্মান ব্যক্তির কাছে হাজির হয়ে তার কাছে হাতী দেখতে কেমন জানতে চায়। ব্যাক্তিটি তখন তাদের এক হাতীশালায় নিয়ে যায়। একটি হাতীকে ছুঁইয়ে দিয়ে বলে-‘এই হল হাতী’। একেক অন্ধ হাতীর একেক অঙ্গ স্পর্শ করে মনে করে হাতী সেই অঙ্গেরই মত দেখতে। যে হাতীর গা ছুঁয়েছিল সে মনে করে হাতী দেওয়ালের মত দেখতে; যে পা ছুঁয়েছিল সে মনে করে হাতী থামের মত দেখতে; যে কান ছুঁয়েছিল সে মনে করে হাতী কূলার মতন দেখতে এবং যে লেজ ছুঁয়েছিল সে মনে করে হাতী দড়ির মত দেখতে। গল্পটির মর্মার্থ হল- অনভিজ্ঞ ও অল্পদর্শী ব্যক্তিরা একদেশ দেখে একপেশে সিদ্ধান্ত নিলে তাদের অভিজ্ঞতা অন্ধের হাতী দেখার সমান হবে। 
        
                                                 অন্নচিন্তা চমৎকারা
  বাগধারাটির সাথে মহাকবি কালিদাসের নাম জড়িয়ে আছে। কালিদাস  রাজা বিক্রমাদিত্যের সভাসদ ছিলেন। কিংবদন্তী যে একদিন কালিদাস অভূক্ত অবস্থায় রাজসভায় হাজির হন। স্বভাবতঃই তিনি সেদিন একটু স্তিমিত ছিলেন। স্ফূর্তি তাঁর কম ছিল। ফলে তাঁর কাব্যপ্রতিভার যথাযথ  স্ফুরণ হচ্ছিল না। রাজা বিক্রমাদিত্য তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে কালিদাস কবিতার মাধ্যমে তাঁর কারণ ব্যাখ্যা করেন। দুটি কবিতার পংক্তি ছিল। একটি হল- অন্নচিন্তা চমৎকারা, কাতরে কবিতা কুতঃ? এবং অনটি হল- অন্নচিন্তা চমৎকারা, কালিদাস বুদ্ধিহারা। তাঁর বক্তব্য ছিল এই যে  অন্নচিন্তার  এমনই গুণ যে পেটে অন্ন না পড়লে অন্য কোন গুণের প্রকাশ হয় না। বাগধারাই এই মনোভাবই ব্যক্ত করে অর্থাৎ পেটে ভাত না পড়লে কোন কাজে মন বসে না।    

                                               অশ্বত্থামা হত ইতি গজ
    বাগধারাটি মহাভারত থেকে সংগৃহীত হয়েছে। সত্যের আবরণে যুধিষ্ঠির যে মিথ্যাভাষণটি করেছিলেন সেটি হল-‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজঃ’। অশ্বত্থামা ছিলেন দ্রোণাচার্যের পুত্র। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষদিকে দ্রোণাচার্য কৌরবপক্ষের সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। দ্রোণাচার্যের রণচাতুর্যের সাথে পাণ্ডবপক্ষ পেরে উঠছিল না। তখন কৌশলী শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যের কাছে গিয়ে এই মিথ্যাভাষণ করেন। তিনি উচ্চস্বরে বলেন-'অশ্বত্থামা হত হয়েছেন'এবং নিম্নস্বরে বলেন-'এই অশ্বত্থামা একটি হাতি'। অসত্যভাষণের অপবাদ থেকে যুধিষ্ঠিরকে মুক্তি দিতে কাহিনীটির অন্য একটি ব্যাখ্যা আছে। সেটি যুধিষ্ঠির উক্তির প্রথম অংশ উচ্চারণ করামাত্র দামামা বেজে ওঠে। দামামার উচ্চশব্দে উক্তির দ্বিতীয় অংশ দ্রোণাচার্য শুনতে পান নি। তিনি ধরে নিয়েছিলেন অশ্বত্থামার মৃতুর কথাই যুধিষ্ঠির বলেছেন। প্রথম ব্যাখ্যাটাই যথার্থ ধরে নিয়ে কৌশলে কোন অসত্যকে সত্য হিসাবে প্রকাশ করা হলে ব্যঙ্গের স্বরে প্রবচনটি বলা হয়। প্রথম ব্যাখ্যাকে যথার্থ বলা হয়ে থাকে, বলার কারণ হল এই যে যুধিষ্ঠিরের সত্যবাদিতাকে ব্যঙ্গ করতে তির্যকভাবে তাঁকে ‘ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির’ বলা হয়।