'পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ' হচ্ছে এমন ধরনের উদ্ভিদ যারা মাটির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না হয়ে অন্য গাছের পৃষ্ঠের উপরে বৃদ্ধি পায় এবং বায়ু, বৃষ্টি, জল (সামুদ্রিক পরিবেশে)বা এর চারপাশে জমে থাকা ধ্বংসাবশেষ থেকে বেঁচে থাকার জন্য আর্দ্রতা এবং পুষ্টি আহরণ করে। পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ পুষ্টি চক্রে অংশ নেয় এবং অন্য সকল জীবের মত বাস্তুতন্ত্রের ভিন্নতা ও জৈববস্তুপুঞ্জ উভয়ের উপস্থিতি ঘটে থাকে। এরা বহু প্রজাতির খাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। সাধারণত, একটি গাছের পুরানো অংশ পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ জন্মানোর সব থেকে উপযুক্ত স্থান। পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ পরজীবী থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে, এরা শারীরিক সহায়তার জন্য অন্যান্য উদ্ভিদের উপর বৃদ্ধি পায় এবং পোষক দেহের উপর কোন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে দেয় না। পরাশ্রয়ী প্রজাতির জীব কিন্তু উদ্ভিদ নয় এমন প্রজাতিকে এপিবাইওন্ট বলা হয়।[১] পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ সাধারণত নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে (যেমনঃ শ্যাওলা, লিভারওয়োর্টস, লিকেন এবং শৈবাল) বা গ্রীষ্মমণ্ডলীতে (যেমনঃ ফার্ন, ক্যাকটি, অর্কিড এবং ব্রোমেলিয়েড) পাওয়া যায়।[২] পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ প্রজাতিগুলি তাদের ন্যূনতম জল এবং মাটির প্রয়োজনীয়তার কারণে গৃহের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজে ব্যবহার করা যায়।[৩] পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ বিভিন্ন প্রাণী, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া এবং মাইক্সোমাইসেটস সহ অন্যান্য জীবের জন্য একটি সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ আবাসস্থল সরবরাহ করে থাকে।[৪] পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ রাউনকিয়ার ব্যবস্থার উপবিভাজনগুলির মধ্যে একটি। পরাশ্রয়ী উদ্ভিদকে কখনও কখনও "এয়ার প্লান্ট" বলা হয় কারণ তাঁদের শিকড় মাটিতে থাকে না। শৈবালের অনেক জলজ প্রজাতি রয়েছে যা জলজ পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ।

তিলান্দসিয়া বুড়গেই মাক্সিকোর একটি ওক গাছে বৃদ্ধি পাচ্ছে
পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ গাছের কাণ্ডে বা কখনও কখনও গাছের ছাউনিতে বেড়ে উঠতে পারে
ব্রাজিলের বনের একটি গাছে পরাশ্রয়ী অর্কিড
অর্কিডের আঁকড়ে ধরে থাকা মূল

স্থলজ পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ সম্পাদনা

সর্বাধিক পরিচিত পরাশ্রয়ী উদ্ভিদগুলোর মধ্যে আছে শ্যাওস, অর্কিড এবং ব্রোমেলিয়েড যেমনঃ স্প্যানিশ শ্যাওলা (তিলানডসিয়া জাতির অন্তর্ভুক্ত), তবে পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ গুলি উদ্ভিদ রাজ্যের প্রতিটি বড় গ্রুপে পাওয়া যেতে পারে। স্থলজ পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের ৮৯% (প্রায় ২৪০০০) প্রজাতিই ফুল গাছ। দ্বিতীয় বৃহত্তম গোত্রটি হ'ল লেপটোস্পোরানিয়েট ফার্ন, যা প্রায় ২৮০০ প্রজাতি (মোট পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ প্রজাতির ১০%)। বস্তুত সমস্ত ফার্নের প্রায় এক তৃতীয়াংশই পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ।[৫] তৃতীয় বৃহত্তম গোত্র মুগুর শ্যাওলা, এর প্রায় ১৯০টি প্রজাতি রয়েছে, তন্মদ্ধে গজাল শ্যাওলা, কিছু সংখ্যক ফার্ন, জেনেটেলস এবং সাইক্যাড উল্লেখযোগ্য।[৬] পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ বাস্তুবিদ্যায় প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন এ.এফ.ডব্লিউ শিম্পার। আর্দ্র ক্রান্তীয় বনাঞ্চলে সর্বাধিক পরিমানে পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের সমাবেশ লক্ষণীয়, তবে শ্যাওলা এবং লাইচেন প্রায় সকল এলাকায় দেখা যায়। ইউরোপে শিকড় ব্যবহার করে এমন কোনও উত্সর্গীকৃত পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যায় না, তবে স্যাঁতসেঁতে অঞ্চলে (মূলত পশ্চিম উপকূলীয় প্রান্তে) গাছে প্রচুর শ্যাওলা এবং লাইচেনের সমাহার দেখা যায় এবং সাধারণ পলিপোডি ফার্ন শাখা বরাবর পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ আকারে বৃদ্ধি পায়। কদাচিৎ, ঘাস, ছোট গুল্ম বা ছোট গাছ নিলম্বিত মাটিতে জন্মাতে পারে।

হলো-পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ বা হেমি-পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ সম্পাদনা

পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ সাধারণত হলো-পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ বা হেমি-পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ এই দুইভাগে করা যায়। হলো-পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ এমন একটি উদ্ভিদ যা মাটির সংস্পর্শ ছাড়াই পুরো জীবনচক্র ব্যয় করে এবং হেমি-পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ হ'ল এমন একটি উদ্ভিদ যার শিকড় মাটিতে পৌঁছতে বা মাটির সাথে যোগাযোগ স্থাপনের আগে জীবনের অর্ধেক সময় ব্যয় করে।[৭] অর্কিড হলো-পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের একটি উদাহরণ এবং স্ট্র্যাংলার ফিগস হেমি-পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের একটি উদাহরণ।

উদ্ভিদের পুষ্টির সম্পর্ক সম্পাদনা

পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ মাটির সাথে সংযুক্ত থাকে না ফলে অন্যান্য উৎস থেকে (যেমনঃ শিশির, বৃষ্টি এবং কুয়াশা) পুষ্টি গ্রহণ করে অথবা মাটিতে শিকড়যুক্ত উদ্ভিদ থেকে পচন বা লচিং এবং ডিনাইট্রোজেন স্থিরকরণের প্রক্রিয়ায় পুষ্টিকর উপাদান গ্রহণ করে।[৮] ক্যানোপিতে উচ্চতর পোষকে আশ্রিত পরাশ্রয়ী উদ্ভিদগুলো মাটিতে সীমাবদ্ধ উদ্ভিদগুলো তুলনায় বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে যেখানে কম আলো থাকে এবং নিরামিষাশীরা সক্রিয় হতে পারে। পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ জলাধারগুলিতে বসবাসকারী কিছু সংখ্যক জন্তুর জীবন ধারনের জন্য জরুরী যেমন কিছু ধরনের ব্যাঙ এবং আর্থ্রোপড।

পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ তাদের হোস্টের অণু পরিবেশের বাস্তুতন্ত্রে প্রচুর প্রভাব বিস্তার করে কারণ তারা তাদের অভ্যন্তরে জল ধরে রাখে এবং মাটিতে পানির উপস্থিতি হ্রাস করে।[৯] কিছু অ-সংবহনতান্ত্রিক পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ যেমন লাইচেন এবং শ্যাওলা দ্রুত জল গ্রহণের দক্ষতার জন্য সুপরিচিত।[১০] পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ এদের পোষকদেহে শীতল এবং আর্দ্র পরিবেশ তৈরি করে এবং পানি সংশ্লেষের মাধ্যমে পোষকের অতিরিক্ত পানির দ্বারা সম্ভাব্য ক্ষতি হ্রাস করে।

সামুদ্রিক পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ সম্পাদনা

 
ভারী পরাশ্রয়ী বৃদ্ধি

সামুদ্রিক পরিবেশের পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের বাস্তুসংস্থান স্থলজ পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের তুলনায় পৃথক হয়ে থাকে। সামুদ্রিক ব্যবস্থায় পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে আছে শৈবাল, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, স্পঞ্জস, ব্রাইজোয়ানস, এসিডিডিয়ানস, প্রোটোজোয়া, ক্রাস্টেসিয়ানস, মল্লাস্কস এবং অন্য কোনও উদ্ভিদজীব যা উদ্ভিদের পৃষ্ঠের উপরে বৃদ্ধি পায় যেমন সেগ্রেসেস বা শ্যাওলা।[১১][১২] পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ প্রজাতির পত্তন হালকা, তাপমাত্রা, স্রোত, পুষ্টি এবং ট্রফিক পারস্পরিক ক্রিয়া সহ বিভিন্ন কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। শৈবাল সামুদ্রিক পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত।[১২] আলোকসংশ্লিষ্ট পরাশ্রয়ী উদ্ভিদগুলি জলজ পরিবেশে প্রচুর পরিমাণে সালোকসংশ্লেষণ সংঘটিত হওয়ার নিয়ামক।[১৩] পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ প্রজাতির মিশ্রণ এবং পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের পরিমাণ পরিবেশের পরিবর্তনের সূচক হতে পারে। পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের সাম্প্রতিক প্রাচুর্যতার কারণের সাথে সেচ কাজে ব্যবহারিত পানি এবং ঝড়সৃষ্ট পানির মাধ্যমে পরিবেশে নাইট্রোজেন বেড়ে যাওয়ার সাথে সম্পৃক্ত। পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের প্রাচুর্যতা এদের পোষক উদ্ভিদগুলোর নানারুপ ক্ষতি ও মৃত্যুর কারণ, বিশেষত সামুদ্রিক উদ্ভিদরাজির ক্ষেত্রে।[১১] কারণ অতিরিক্ত পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ সূর্যের আলো প্রবেশে বাধার সৃষ্টি করে। সামুদ্রিক পরিবেশে পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের ক্রমবর্ধমান আধিক্য চোখে পড়ার মত।[১৪]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Hickey, M.; King, C. (২০০১)। The Cambridge Illustrated Glossary of Botanical Terms। Cambridge University Press। 
  2. Webster's Third New International Dictionary of the English Language, Unabridged. (1976). Vol. I, p. 764. Encyclopædia Britannica, Inc. Chicago.
  3. Dabbs, Amy (১৯ ডিসেম্বর ২০১৪)। "Epiphytes are easy to grow Houseplants get water from air"Post and Courier। সংগ্রহের তারিখ ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬ 
  4. Sydney E. Everhart; Joseph S. Ely; Harold W. Keller (২০০৯)। "Evaluation of tree canopy epiphytes and bark characteristics associated with the presence of corticolous myxomycetes" (পিডিএফ)Botany87 (5): 509–517। ডিওআই:10.1139/b09-027। ২০১৩-০৯-২৬ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। 
  5. Hogan, C Michael, 2010. Fern. Encyclopedia of Earth. National council for Science and the Environment ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৯ নভেম্বর ২০১১ তারিখে. Washington, DC
  6. Schuettpelz, Eric (২০০৭), The evolution and diversification of epiphytic ferns (পিডিএফ), Duke University PhD thesis, ২০ জুন ২০১০ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ২ এপ্রিল ২০২০ 
  7. Nieder, Jürgen; Prosper´ı, Juliana (২০০১)। "Epiphytes and their contribution to canopy diversity"Plant Ecology153: 51–63। ডিওআই:10.1023/A:1017517119305 [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  8. Zotz, Gerhard; Hietz, Peter (নভেম্বর ২০০১)। "The physiological ecology of vascular epiphytes: current knowledge, open questions"Journal of Experimental Botany52 (364): 2067–2078। ডিওআই:10.1093/jexbot/52.364.2067 
  9. Stanton, D.E., Chávez, J.H., Villegas, L., Villasante, F., Armesto, J., Hedin, L.O., Horn, H. "Epiphytes Improve Host Plant Water Use by Microenvironment Modification", Functional Ecology (journal), doi: 10.1111/1365-2435.12249
  10. Johansson, Dick (১৯৭৪)। "ECOLOGY OF VASCULAR EPIPHYTES IN WEST AFRICAN RAIN FOREST" (পিডিএফ)59। ২৪ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ এপ্রিল ২০২০ 
  11. "MV Commission" (পিডিএফ) 
  12. "www.SeagrassLI.org Cornell Cooperative Extension Eelgrass Restoration"www.seagrassli.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৬-২৬ 
  13. "Marine Plants / Algae - Biscayne National Park (U.S. National Park Service)"www.nps.gov (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৬-২৬ 
  14. "An Assessment of Coastal Hypoxia and Eutrophication in U.S. Waters" (পিডিএফ)NOAA। ৭ মে ২০১৭ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা।