ধর্মমঙ্গল: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
১২ নং লাইন:
=== লাউসেনের উপাখ্যান ===
ধর্মমঙ্গল কাব্যের দ্বিতীয় তথা প্রধান কাহিনিটি গড়ে উঠেছে লাউসেনের বীরত্বগাথাটিকে কেন্দ্র করে। ধর্মপূজার 'ঘরভরা' অনুষ্ঠানের জন্য এই কাহিনিটিকে গীত আকারে চব্বিশ পালায় বিভক্ত করে বারো দিন ধরে গাওয়া হয়।<ref>''বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস'', আশুতোষ ভট্টাচার্য, এ. মুখার্জি অ্যান্ড কোং প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ২০০৯ সং, পৃ. ৫৩৭</ref> এই কারণে এই কাহিনিটির অপর নাম 'বারোমতি' বা 'বার্মাতি'। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, "দেবকৃপাশ্রিত লাউসেন এই কাব্যের নায়ক এবং তাহার বীরত্বের অদ্ভুতরসের গল্পই ধর্মমঙ্গল কাব্যের প্রধান আকর্ষণ।"<ref>''বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত'', তৃতীয় খণ্ড: প্রথম পর্ব, পৃ. ২৯৩</ref> লাউসেনের উপাখ্যানটি নিম্নরূপ:<ref>''বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস'', পৃ. ৫৩৭-৪২</ref>
 
<blockquote>ধর্মঠাকুর মর্ত্যে পূজা প্রচারের জন্য উৎসুক ছিলেন। এমন সময় স্বর্গের নর্তকী জাম্ববতী শাপগ্রস্থ হয়ে বমতি নগরে বেণুরায়ের কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম হয় রঞ্জাবতী। রঞ্জাবতীর দিদি ছিলেন গৌড়েশ্বরের রাজমহিষী এবং তাঁর দাদা মহামদ ছিলেন গৌড়েশ্বরের মন্ত্রী। গৌড়েশ্বরের বিদ্রোহী সামন্ত তথা [[চণ্ডী|চণ্ডীর]] বরপুত্র ইছাই ঘোষের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে গৌড়েশ্বরের অপর সামন্ত তথা ঢেকুরগড়ের অধিপতি কর্ণসেনের ছয় পুত্র ও পুত্রবধূগণ যুদ্ধে নিহত হন। কর্ণসেন নিজেও পরাজিত হন। কর্ণসেনকে সান্ত্বনাস্বরূপ গৌড়েশ্বর নিজ শ্যালিকা রঞ্জাবতীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ দেন। বিবাহের পর রঞ্জাবতীকে নিয়ে কর্ণসেন ময়নাগড়ে নতুন সামন্তের পদে অধিষ্ঠিত হন। এদিকে বৃদ্ধ কর্ণসেনের সঙ্গে বোনের বিবাহ হওয়ায় ক্ষুব্ধ হন মহামদ। গৌড়েশ্বরের কাজের প্রতিবাদ করতে না পেরে কর্ণসেনের সঙ্গেই শত্রুতা করেন তিনি। কর্ণসেনকে বারবার 'পুত্রহীন' বলে গালি দিতে থাকেন মহামদ। এতে বিচলিত হয়ে রঞ্জাবতী পুত্রকামনায় কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন সহ ধর্মঠাকুরের পূজা করতে থাকেন। যথাকালে ধর্মঠাকুরের কৃপায় এক স্বর্গভ্রষ্ট দেবতা রঞ্জাবতীর গর্ভে জন্ম নেন। তাঁর নাম রাখা হয় লাউসেন। এতে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে মহামদ ইন্দা মেটে নামে এক অনুচরকে পাঠিয়ে লাউসেনকে অপহরণ করলেন। ধর্মঠাকুর কর্পূরবিন্দু থেকে আর একটি ছেলে সৃষ্টি করে রঞ্জাবতীকে দিলেন। তার নাম হল কর্পূর ধবল। এদিকে ধর্মঠাকুরের আজ্ঞায় [[হনুমান (দেবতা)|হনুমান]] লাউসেনকে উদ্ধার করে রঞ্জাবতীর কোলে ফিরিয়ে দিলেন। এইভাবে রঞ্জাবতী হলেন দুই পুত্রের জননী।
 
ক্রমে লাউসেন বড়ো হয়ে উঠল। লেখাপড়া ও অস্ত্রবিদ্যায় অর্জন করল বিশেষ ব্যুৎপত্তি, এদিলে মল্লযুদ্ধেও হয়ে উঠল এক অপ্রতিরথ যোদ্ধা। গৌড়েশ্বরকে নিজ বীরত্ব দেখিয়ে খ্যাতি অর্জনের উদ্দেশ্যে সে ভাই কর্পূর ধবলকে নিয়ে যাত্রা করল গৌড়ের উদ্দেশ্যে। পথে বাঘ, কুমির ইত্যাদি হিংস্র জন্তু বধ করে একদিকে যেমন নিজের খ্যাতি বৃদ্ধি করল, অন্যদিকে ভ্রষ্টা নারীদের প্রলোভন এড়িয়ে সে নৈতিক শুচিতারও পরিচয় দিল। এদিকে গৌড়ে পৌঁছেই লাউসেন মহামদের চক্রান্তে বন্দী হল। কিন্তু গৌড়েশ্বরকে বাহুবল দেখিয়ে খুশি করে সে অচিরেই মুক্তিলাভ করল। গৌড়েশ্বর তাঁকে প্রচুর পুরস্কার ও ময়নাগড়ের ইজারা দিলেন। ফেরার পথে কালু ডোম ও তার বউ লখ্যার সঙ্গে লাউসেনের সখ্যতা হল। লাউসেন এদেরও ময়নাগড়ে নিয়ে এল। কালুকে করল সেনাপতি। এরপর মহামদের চক্রান্তে গৌড়েশ্বর লাউসেনকে পাঠালেন কামরূপরাজকে দমন করতে। মহামদ ভেবেছিলেন প্রবল প্রতাপশালী কামরূপরাজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে লাউসেনের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু ধর্মঠাকুরের কৃপায় লাউসেন কামরূপরাজকে পরাজিত করে তাঁর কন্যা কলিঙ্গাকে বিয়ে করে দেশে ফিরল। এতে মহামদ ঈর্ষায় দগ্ধ হতে লাগলেন। তাঁর চক্রান্তে আবার গৌড়েশ্বর লাউসেনকে শিমূল রাজ্য আক্রমণ করতে পাঠালেন। লাউসেনও লোহার গণ্ডার কেটে শিমূল রাজকন্যা কানাড়াকে বিবাহ করে নিয়ে এল। এতে মহামদের ক্রোধ বেড়ে গেল। তাঁরই চক্রান্তে [[অজয় নদ|অজয় নদের]] তীরে ইছাই ঘোষের সঙ্গে লাউসেনের প্রবল যুদ্ধ হল। যুদ্ধে ইছাই পরাজিত ও নিহত হল। এরপর মহামদ লাউসেনকে অন্যভাবে বিপাকে ফেলার চেষ্টা করলেন। তিনি কৌশলে গৌড়েশ্বরকে দিয়ে আদেশ করালেন যে, লাউসেন যদি ধর্মঠাকুরের বরপুত্র হয়, তবে তাকে পশ্চিমে সূর্যোদয় ঘটিয়ে দেখাতে হবে, নচেত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। হাকন্দ নামক স্থানে ধর্মের কঠোর তপস্যা করে লাউসেন এই অসাধ্যটিও সাধন করল।
 
লাউসেন যখন হাকন্দে তপস্যা করছিল, তখন সেই সুযোগে মহামদ ময়নাগড় আক্রমণ করে। যুদ্ধে সপত্নী কালুরায় মারা যায়। লাউসেনের প্রথমা স্ত্রী কলিঙ্গা বীরবীক্রমে যুদ্ধ করে প্রাণত্যাগ করে। শেষে বীরাঙ্গনা কানাড়ার হাতে পরাজিত হয়ে মহামদ পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। দেশে ফিরে ধর্মঠাকুরের স্তব করে সকলকে বাঁচিয়ে তোলে লাউসেন। মর্ত্যে ধর্মঠাকুরের পূজা প্রচারিত হয়। মহামদ তাঁর কৃত পাপের জন্য কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্থ হয়। কিন্তু দয়াপরবশ হয়ে লাউসেন ধর্মঠাকুরের নিকট প্রার্থনা করে তাঁকে রোগ থেকে মুক্তি দেয়। এরপর পরম গৌরবে কিছুকাল রাজত্ব করে পুত্র চিত্রসেনের হাতে রাজ্যভার তুলে দিয়ে স্বর্গারোহণ করে লাউসেন।</blockquote>
 
== পাদটীকা ==