বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
ট্যাগ: মোবাইল সম্পাদনা মোবাইল ওয়েব সম্পাদনা
→‎বর্ধমান রাজসভা: নতুন অনুচ্ছেদ
ট্যাগ: মোবাইল সম্পাদনা মোবাইল ওয়েব সম্পাদনা
৫৩৪ নং লাইন:
   এই সময় বিধবা বিবাহ নিয়ে যে নাটকটি বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, সেটি উমেশচন্দ্র মিত্রের। বিধবাদের বিবাহ দেওয়ার পিছনে যে সামাজিক মঙ্গল লুকিয়ে আছে তা তুলে ধরাই এই নাটক রচনায় অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।  হিন্দু নারীরা বহু বিবাহের ফলে যে বাল্যবিবাহ এবং অপেক্ষাকৃত কমবয়সী থেকেই তাদের চির বৈধব্য ভোগ করতে হচ্ছে তার উপর ভিত্তি করেই দুই মেয়ের বিবাহ হওয়ার কাহিনি। কীর্তিরাম ঘোষের মেয়ে সুলোচনা এবং অদ্বৈত দত্তের কন্যা প্রসন্ন কম বয়সে বিধবা। যৌবনের স্বাভাবিক চাওয়া-পাওয়া বশত সুলোচনা রামকান্ত বসুর পুত্র মন্মথর প্রতি গোপন প্রণয়ে লিপ্ত হয়। ফলস্বরূপ সুলোচনা সন্তান সম্ভবা হয়ে সমাজের চোখে অবৈধ এই বিষয়টি যথাযথ নয় বলেই  লজ্জা এড়াতে আত্মহত্যা করে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে লেখক বিধবাদের বিয়ে না দেওয়ার ফলের কথা বলেছেন। নাটকটি অভিনয়ের পর দর্শক সমাজে আলোড়ন তুলেছিল। সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা এই নাটকের অভিনয় সম্পর্কে লিখেছিল -- "বোধহয় বাঙলা ভাষায় এরূপ সর্বাঙ্গসুন্দর অভিনয় আর ...  ক্ষুদ্রাপি হয় নাই।" বিধবা বিবাহ নিয়ে এরকম আরো নাটক -- উমাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের 'বিধবা বিষম বিপদ' , যদুগোপাল চট্টোপাধ্যায়ের 'চপলা চিত্ত চাপল্য',  বিহারীলাল নন্দীর 'বিধবা পরিণয়োৎসব' যদুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের 'বিধবা বিলাস' ইত্যাদি।  লক্ষ করলে দেখা যাবে বেশিভাগ নাটকই , আইন পাশ হওয়ার পরে লেখা।
      প্রশ্ন থেকে যায়, নাটকের মাধ্যমে বিধবা-বিবাহ প্রচার করা হলেও বৃহত্তর সামাজিক স্তরে তার তেমন কোনো প্রভাব সেযুগে ফেলতে পারেনি।  আজও আমরা আকস্মিক স্বামীহারাদের অন্য চোখে দেখি। চাকরি বা সম্পত্তি  না থাকা বিধবাদের  বেঁচে থাকার ব্যবস্থা তাদের নিজেদেরকেই করতে হয়।  আধুনিক যুগেও তাদের নিয়ে লেখা তেমন কোন নাটক  সেই দায়বদ্ধতা কতটা পালন করছে , সেটাও এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। [[ব্যবহারকারী:ড. সেখ রমজান আলি|ড. সেখ রমজান আলি]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:ড. সেখ রমজান আলি|আলাপ]]) ১১:১৪, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ (ইউটিসি)
 
== বর্ধমান রাজসভা ==
 
সাহিত্য চর্চায় বর্ধমান রাজ
        --- ড. রমজান আলি
 
পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র রাজতন্ত্রের পতন ঘটলেও রাজসভা ও রাজ সভাশ্রিত সাহিত্যের সংখ্যা কম নেই। কবি-সাহিত্যিক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতেও তাদের পোষণা দান কম ছিল না। আর এই উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতার ফলে আমরা পেয়েছি সব অমর সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আরাকান,  কৃষ্ণনগর, গৌড় ইত্যাদির মতো বর্ধমান রাজসভার অবদান কোনো অংশে কম ছিল না।
   রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সুবাকে উনিশটি সরকারে ভাগ করেন। 'আইন-ই-আকবরী' অনুযায়ী বর্ধমান জেলার সঙ্গে সম্পর্কিত যে তিনটি সরকারের নাম পাওয়া যায় তার মধ্যে একটি 'শরিফাবাদ'। 'শরিফ' শব্দের অর্থ সম্ভ্রান্ত।  সেই অর্থে এলাকাটি ছিল অপেক্ষাকৃত সম্ভ্রান্ত অঞ্চল। এই অমলেই বর্ধমানের নাম হয় শরিফাবাদ। সেই সময় বীরভূমের দক্ষিণাংশ,  মুর্শিবাদ জেলার কান্দি আর বর্ধমান জেলার মধ্য অংশ জুড়ে এর সীমানা ছিল। বেড়েই চলেছে তাই বর্ধমান। বিরুদ্ধমত থাকলেও এটা আজ সত্য প্রমানিত যে জৈন ধর্মের ২৩ তম তীর্থঙ্কর মহাবীর, বর্ধমানের জৌগ্রামে বা জাম্বীয় গ্রামে এসে সিদ্ধিলাভ করে 'বর্ধমান' নাম গ্রহণ করেন।
মোঘল আর বর্ধমান ওতোপ্রতো সম্পর্কযুক্ত।    জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী অনুযায়ী কান্দাহারের পথে জন্ম নেওয়া অসাধারণ সুন্দরী মেহেরুন্নিসার সঙ্গে বিয়ে হয় আলি কুলি খানের। আলি বাঘ মেরে হলেন শের আফগান। তাকে সুবেদার করে পাঠানো হলো বাংলায়। দামোদরের তটে ছিল তাঁর প্রাসাদ। মেহেরের রূপ সেলিমের চোখ পড়েছিল। দিল্লির সিংহাসন পেয়ে তার নাকি পুরোনো প্রেম জেগে উঠে। আকবরের মৃত্যুর পর  মেহেরকে পাবার জন্য বর্ধমানে মানসিংহের জায়গায় গভর্নর করে পাঠানো হলো কুতুবুদ্দিনকে। লক্ষ্য নাকি মেহেরকে দিল্লিতে আনা। বর্তমান সাধনপুরে টেকনিক্যাল কলেজের কাছাকাছি মুখোমুখি যুদ্ধে উভয়েই খতম। এখন পুরাতন চকে পীরবাহারামের কবরখানায় তারা পাশাপাশি শুয়ে আছেন।
   বর্ধমানের মাটিতে পা রাখার পর,  কুতুবুদ্দিনকে সাহায্য করেছিলেন বেলেরা (বৈকুন্ঠপুর) গ্রামের কাপড় আর ধান-চালের ব্যবসায়ী সঙ্গম রায়। এসেছিলেন পাঞ্জাবের লাহোর শহরের অন্তর্গত কোটলি মহল্লা থেকে। সপ্তদশ শতাব্দির প্রথমদিকে তীর্থ যাত্রায় এসে ফেরার পথে বেলেরা গ্রামে ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য থেকে গেলেন। মোগলদের সঙ্গে যোগ স্থাপন করে,  আর সুদের কারবার করে রাতারাতি আরও বড়োলোক হয়ে গেলেন।
     পলাশি যুদ্ধের ঠিক একশো বছর আগে থেকে সঙ্গম রায় ও তার বংশধরেদের চৌধুরী থেকে জমিদার হয়ে উঠার ইতিহাস। সঙ্গম রায় > বঙ্কুবিহারী রায় > আবু রায় > বাবু রায় > ঘনশ্যাম রায় > কৃষ্ণরাম রায় > জগৎরাম রায় > কীর্তিচাঁদ রায় > মিত্রসেন রায় > চিত্রসেন রায়। চিত্রসেন ছিলেন অপুত্রক। তাই তিনি খুড়তুতো ভাই তিলকচাঁদকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। তিনিই বর্ধমানের প্রথম মহারাজধিরাজ। মহারাজ পরম্পরা হলেন তিলকচাঁদ > তেজচাঁদ > প্রতাপচাঁদ  > মহতাবচাঁদ। মহতাবের পুত্র না থাকায় তিনি ভাগ্নেয় আফতাবকে দত্তক পুত্র রূপে গ্রহণ করে তাকে মনোনীত করে যান। আফতাবেরও কোনো পুত্র ছিল না।  ব্রিটিশ  আমলে ধনদেয়ী তাঁর দেওয়ান বনবিহারীর পুত্র বিজনবিহারীকে দত্তক নিয়ে বিজয়চাঁদ নাম দিয়ে বর্ধমানের সিংহাসনে বসালেন। এঁদের পরম্পরাটি হলো  বিজয়চাঁদ > উদয়চাঁদ > ড. প্রণয়চাঁদ ( বেঁচে আছেন)।
          আবু রায়ের আমল থেকেই শিক্ষার সঙ্গে বর্ধমানের রাজাদের একটা যোগ ঘটে। শ্রীপাট বাঘনাপাড়ায় কবিরাজ রামচন্দ্র গোস্বামীর আখড়ায় পোষণা দিতেন। জগৎরামের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে তৎকালীন সময়ে কালনার বিখ্যাত কবি প্রাণবল্লভ লিখেছিলেন তাঁর ' জাহ্নবী মঙ্গল ' কাব্যটি।
আবু রায়ের পুত্র বাবু রায় বিপুল বিষয়-বৈভবের অধিকারী হয়েছিলেন। তিনি বেলেরা-বৈকুন্ঠপুর থেকে চটিবাটি তুলে বর্ধমান শহরের পশ্চিম উপকন্ঠে কাঞ্চননগরে বসবাস শুরু করেন। তার নাতি কৃষ্ণরামকে আইন-ই-আকবরী অনুযায়ী সম্রাট ঔরঙ্গজেব এক ফরমানে 'বাবুর পুত্র কিষণরাম ' বলে উল্লেখ করেছেন। তার নাতি জমিদার কীর্তিচাঁদ দক্ষিণ দামোদরের কবি ঘনরাম চক্রবর্তীকে কবিরত্ন উপাধী দিলেন। পোযণা পেয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহাকবি লিখলেন ':শ্রীধর্মমঙ্গল ' ও ' শ্রীসত্য নারায়ণ ব্রতকথা '। দামোদরের দক্ষিণে শাঁখারি গ্রামের  আর এক কবি নরসিংহ বসু রাজ-পোষণা পেয়ে লিখলেন আর একটি ধর্মমঙ্গল। অন্নদামঙ্গলের কবি ভারতচন্দ্রের সঙ্গে বর্ধমানের রাজাদের সম্পর্ক ভালো ছিল ন। বলা হয় তিনি নাকি সেই প্রতশোধ নিতেই তাঁর গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ড বিদ্যাসুন্দরে অবৈধ সুড়ঙ্গ পথে প্রেমে চড়িয়েছিলেন।
চিত্রসেনের সভাপণ্ডিত ছিলেন বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার। কবি কৃষ্ণনগরের রাজসভা ছেড়ে বর্ধমান রাজসভায় এসেছিলেন। তাঁর অমরকীর্তি গদ্য পদ্যে লেখা 'চিত্রচম্পূ' কাব্যটি। এটি রাজা চিত্রসেনকে নিয়ে রচিত। এছাড়া তিনি ' চন্দ্রাভিষেক ' নামে একটা নাটকও লিখেছিলেন।
 
     তেজচাঁদের উৎসাহে রামকান্ত রায় রচনা করলেন ধর্মমঙ্গল। শাক্ত সংগীত রচয়িতা কমলাকান্ত এই রাজার পোষণা পেয়েছিলেন। পুত্র প্রতাপ চাঁদের শিক্ষাগুরু ছিলেন কমলাকান্ত। তাঁর লেখা -- " ওরে নবমী নিশি না হইওরে অবসান " আসলে কন্যা বিজনের আশঙ্কায় মাতৃহৃদয়ের কান্না।
তেজচাঁদের শালক ও শ্বশুর পরাণচাঁদ বিদ্যাসুন্দর অনুসরণে লিখেছিলেন 'হরিমঙ্গল' কাব্য, যা বর্ধমানের অন্নদামঙ্গল নামে খ্যাত। এই কাব্যে বর্ধমান শহরের স্থাননাম মাহাত্ম, তৎকালীন হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতি ইত্যাদি জানা যায়। আজকের রাজ স্কুল, রাজ কলেজ, সংস্কৃত চতুষ্পাঠী, উদয়চাঁদ গ্রন্থাগার সবই তো রাজাদের দান। এ ব্যাপারে মহতাবের কৃতিত্বই বেশি। তিনি একটা বাংলা লিপিরও উদ্ভাবন করেন যা 'বর্ণপরিচয় ' নাম দিয়ে শ্রীরামপুর প্রেস থেকে ছাপানো হয়েছিল।
সংস্কৃত, উর্দু, ফারসী অনুবাদের পাশাপাশি রাজাদের পোষণায় রামায়ণ ও মহাভারত অনুবাদিত হয়। মহাভারত অনুবাদ করলেন কবি রামলোচন।
বাংলা নাটক ও নাট্যমঞ্চের ব্যাপারে পিছিয়ে ছিলেন না বর্ধমানের রাজারা। রাজসভার নট ও নাট্যকার হিসাবে খ্যাতিলাভ করেন কালিদাস সান্যাল। পরে তিনি কোলকাতার ন্যাশনাল থিয়েটারে যোগ দেন।
মহারাজ বিজয়চাঁদ নিজেই ছিলেন একাধারে শাসক, সাহিত্যিক এবং আধুনিক মানুষ। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় পরিকল্পিত এবং জলধর সেন ও অমূল্যচরণ সম্পাদিত 'ভারতবর্ষ' পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন তিনি। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি  -- দুই খন্ডে 'বিজয়গীতিকা ',  ত্রি-চিত্র ', 'ত্রিনাথ-মেলা', ' গীতাঞ্জলি' , ' মানসলীলা ', মন:শিক্ষা' ' ইত্যাদি।  ইংরাজিতে লেখা অসাধারণ ভ্রমণকাহিনি  ইম্প্রেশন্ দি ডাইরি অব এ ইউরোপিয়ান টুর। রাজ-গবেষক নীরদবরণ সরকারের উদ্যোগে এটি বাংলায় অনুদিত হয়েছে। বর্ধমান রাজ প্রতাপকে নিয়ে রাজকাহিনির উপর লেখা 'জাল প্রতাপচন্দ্র ' চোখে জল আনে।
একটা দেশ তিনটি খন্ডে বিভক্ত হওয়ার পর জমিদারী প্রথা উঠে গেলো। এখন সবই ইতিহাস হলেও সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই। শাসনের আড়ালে সাহিত্য সেবায়  বর্ধমানের রাজাদের এই অবদান বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সত্য হয়েই বেঁচে থাকবে। [[ব্যবহারকারী:ড. সেখ রমজান আলি|ড. সেখ রমজান আলি]] ([[ব্যবহারকারী আলাপ:ড. সেখ রমজান আলি|আলাপ]]) ১১:২৬, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ (ইউটিসি)