আল-কুরতুবি: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
InternetArchiveBot (আলোচনা | অবদান)
2টি উৎস উদ্ধার করা হল ও 0টি অকার্যকর হিসেবে চিহ্নিত করা হল। #IABot (v2.0beta10ehf1)
SA Faruq (আলোচনা | অবদান)
ট্যাগ: মোবাইল সম্পাদনা মোবাইল ওয়েব সম্পাদনা উচ্চতর মোবাইল সম্পাদনা
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত ১৮টি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না)
২১ নং লাইন:
'''ইমাম আবু আবদুল্লাহ আল কুরতুবি''' বা '''আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আহমেদ ইবনে আবু বকর আল আনসারি আল কুরতুবি''' ({{lang-ar|'''أبو عبدالله القرطبي'''}}) ছিলেন [[কর্ডো‌বা|কর্ডো‌বার]] একজন বিখ্যাত [[মুফাসসির]], [[মুহাদ্দিস]] ও [[ফকিহ]]। তিনি ফিকহের [[মালিকি]] মাজহাবের অনুসারী ছিলেন। [[তাফসীর আল কুরতুবি]] নামক কুরআনের তাফসির গ্রন্থের জন্য তিনি বেশি পরিচিত।
 
== ইমাম কুরতুবী (রহ:) এর জীবনী ==
 
ইমাম কুরতুবি ১৩শ শতাব্দীতে [[স্পেন|স্পেনের]] [[কর্ডো‌বা|কর্ডো‌বায়]] জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন একজন কৃষক। ১২৩০ সালে স্প্যানিশ আক্রমণের সময় তার বাবা মারা যান। তরুণ বয়সে কুরতুবি পাত্র তৈরির জন্য তার পরিবারে মাটি আনার কাজ করেছেন। কর্ডো‌বায় তিনি তার শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ১২৩৬ সালে রাজা প্রথম ফার্নান্ডো কর্ডো‌বা দখল করে নিলে তিনি [[আলেক্সান্দ্রিয়া]] চলে যান। সেখানে তিনি [[হাদিস]] ও [[তাফসীর]] অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি [[কায়রো]] যান এবং মুনিয়া আবিল খুসাবে বসবাস শুরু করেন। বাকি জীবন তিনি এখানে অতিবাহিত করেছেন। ইমাম কুরতুবি তার সৌজন্যতা ও জীবনযাপন ধারার জন্য পরিচিত ছিলেন। ১২৭৩ সালে ইমাম কুরতুবি মৃত্যুবরণ করেন। মুনিয়া আবিল খুসাবে তাকে দাফন করা হয়। ১৯৭১ সালে তার মাজারের পাশে তার নামে মসজিদ নির্মিত হয়েছে।<ref>26, el-Kasabî Mahmûd Zelat. p. 30</ref>
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) হিজরী ৭ম শতকের একজন প্রখ্যাত স্প্যানিশ মুফাস্সির, ফকীহ ও ধর্মতাত্ত্বিক। কর্ডোভার পতনের পর এই অনন্য ইলমী প্রতিভার দ্যুতি নীলনদ বিধৌত মিসরে বিচ্ছুরিত হয়। নিরলস জ্ঞানসাধনার মাধ্যমে তিনি রচনা করেন তাঁর জগদ্বিখ্যাত তাফসীর ‘আলে-জামে লি-আহকামিল কুরআন’। যা ‘তাফসীরে কুরতুবী’ নামে খ্যাত। আহকামুল কুরআন বিষয়ক এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ও অসাধারণ তাফসীর। তাফসীর সাহিত্যের দিগ্বলয়ে এটি চির ভাস্বর।
 
== নাম ও বংশ পরিচয় ==
 
ইমাম কুরতুবীর আসল নাম মুহাম্মাদ। কুনিয়াত বা উপনাম আবু আব্দুল্লাহ।[1] কেউ কেউ তাঁর উপাধি ‘শামসুদ্দীন’ (দ্বীনের সূর্য) বলে উল্লেখ করেছেন।[2] তবে পূর্ববর্তী মনীষীদের রচিত জীবনীগ্রন্থগুলিতে এ উপাধি লক্ষ্য করা যায় না। তাঁর বংশপরিক্রমা হল- মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন আবুবকর বিন ফার্হ (فَرْح) আল-আনছারী আল-খাযরাজী আল-আন্দালুসী আল-কুরতুবী।[3] মদীনার আনছার সম্প্রদায়ের খাযরাজ গোত্রের দিকে সম্পর্কিত হওয়ায় তিনি তাঁর ‘কিতাবুত তাযকিরাহ’ গ্রন্থের ভূমিকায় তাঁর নামের শেষে আল-আনছারী আল-খাযরাজী এবং ‘আন্দালুস’ বা স্পেনের ‘কুরতুবা’ (কর্ডোভা) জন্মস্থান হওয়ায় আল-কুরতুবী লিপিবদ্ধ করেছেন। তবে ইলমী পরিমন্ডলে তিনি ইমাম কুরতুবী রূপেই সমধিক খ্যাত ও পরিচিত। এমনকি কুরতুবী নামটি উচ্চারিত হলে সর্বাগ্রে স্পেনের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের কথাই আমাদের মানসপটে ভেসে উঠে। {{sfn|[1]. জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী, তাবাকাতুল মুফাস্সিরীন, তাহকীক : আলী মুহাম্মাদ ওমর (সঊদী আরব : ওয়াকফ মন্ত্রণালয়, ১৪৩১/২০১০), পৃঃ ৯২, জীবনী ক্রমিক ৮৮।
 
[2]. ইসমাঈল পাশা বাগদাদী, হাদিয়াতুল আরিফীন ২/১২৯।
 
[3]. ইমাম কুরতুবী, কিতাবুত তাযকিরাহ বিআহওয়ালিল মাওতা ওয়া উমূরিল আখিরাহ, তাহকীক : ড. ছাদেক বিন মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম (রিয়াদ : মাকতাবাতু দারিল মিনহাজ, ১ম প্রকাশ, ১৪২৫ হিঃ), ১ম খন্ড, পৃঃ ১০৯।}}
 
== জন্ম ==
 
ইমাম কুরতুবীর জন্ম তারিখ সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয় যে, তিনি হিজরী সপ্তম শতকের প্রথম দিকে কর্ডোভায় জন্মগ্রহণ করেন।[4] তাফসীরে কুরতুবীতে সূরা আলে ইমরানের ১৬৯নং আয়াতের তাফসীরে তিনি তাঁর পিতার মৃত্যুসন ৬২৭ হিজরী বলে উল্লেখ করেছেন। জমিতে ফসল কর্তনরত অবস্থায় ইউরোপীয় খ্রিষ্টানরা কর্ডোভায় আক্রমণ করলে তাঁর পিতাসহ অনেকে নিহত ও বন্দী হন। তখন তিনি পিতার দাফন-কাফন সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর তিনজন শিক্ষককে জিজ্ঞেস করেন।[5] এ ঘটনা থেকে অনুমিত হয় যে, তিনি তখন ছোট ও ছাত্র ছিলেন। সম্ভবতঃ তিনি তাঁর জীবনের দ্বিতীয় দশকে ছিলেন। অর্থাৎ তাঁর জন্ম হয়েছিল ৭ম হিজরী শতকের প্রথম দিকে।[6] শায়খ আলবানী (রহঃ)-এর খ্যাতিমান ছাত্র জীবনীকার মাশহূর হাসানের মতে তিনি ৬০০-৬১০ হিজরীর দিকে জন্মগ্রহণ করেন।[7] ইমাম কুরতুবীর ‘কিতাবুত তাযকিরাহ’ গ্রন্থের মুহাক্কিক ড. ছাদেক বিন মুহাম্মাদের মতে ৬২৭ হিজরীতে পিতার মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ১৭-২৩ বছর ছিল। এ হিসাবে আনুমানিক ৬০৪-৬১০ হিজরীর মাঝামাঝি সময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।[8] আল্লাহই সর্বাধিক অবগত। {{sfn|[4]. আব্দুল্লাহ ঈদান আহমাদ আয-যাহরানী, তারজীহাতুল কুরতুবী ফিত-তাফসীর (প্রথম থেকে সূরা বাক্বারার ১৮৮ আয়াত পর্যন্ত), অপ্রকাশিত এম.এ থিসিস, উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব, ১৪২৮-১৪২৯ হিঃ, পৃঃ ১৫।
 
[5]. ইমাম কুরতুবী, আল-জামে লি-আহকামিল কুরআন (বৈরূত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়াহ, ১৪১৩/১৯৯৩), ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ১৭৪।
 
[6]. তারজীহাতুল কুরতুবী ফিত-তাফসীর, পৃঃ ১৫-১৬।
 
[7]. মাশহূর হাসান, আল-ইমাম আল-কুরতুবী শায়খু আইম্মাতিত তাফসীর (দামেশক : দারুল কলম, ১ম প্রকাশ, ১৪১৩ হিঃ/১৯৯৩ খ্রিঃ), পৃঃ ২০।
 
[8]. কিতাবুত তাযকিরাহ ১/২৭।}}
 
== শৈশব ও শিক্ষা ==
 
ইমাম কুরতুবী মুওয়াহ্হিদীন[9] শাসকদের যুগে কর্ডোভায় পিতার কাছে লালিত-পালিত হন এবং ৬৩৩ হিজরীতে (১২৩৬ খ্রিঃ) কর্ডোভার পতন পর্যন্ত সেখানে বসবাস করেন। তাঁর পিতা একজন দরিদ্র কৃষক ছিলেন। ৬২৭ হিজরীতে খ্রিষ্টানদের হাতে নিহত হওয়ার দিন তিনি জমির ফসল কর্তন করছিলেন। যেমন ইমাম কুরতুবী তাঁর তাফসীরে বলেন,أغار العدو- قصمه اللهُ- صَبِيحَةَ الثَّالِثِ مِنْ رَمَضَانَ الْمُعَظَّمِ سَنَةَ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ وَسِتِّمِائَةٍ وَالنَّاسُ فِي أَجْرَانِهِمْ عَلَى غَفْلَةٍ، فَقَتَلَ وَأَسَرَ، وَكَانَ مِنْ جُمْلَةِ مَنْ قُتِلَ وَالِدِيْ رَحِمَهُ الله- ‘৬২৭ হিজরীর মহিমান্বিত রামাযান মাসের তিন তারিখ ভোরে শত্রু আক্রমণ করে। আল্লাহ তাকে ধ্বংস করুক! তখন মানুষ ক্ষেতে ফসল কাটায় ব্যস্ত ছিল। সে হত্যা করে ও বন্দী করে। নিহতদের মধ্যে আমার পিতাও ছিলেন। আল্লাহ তাঁর উপরে রহম করুন’।[10]
 
ইমাম কুরতুবী বাল্যকালে শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করেন। এ সময় কুরআন মাজীদ শিক্ষার পাশাপাশি তিনি আরবী ভাষা ও কবিতা শিক্ষা করেন। তদানীন্তন স্পেনে এটাই ছিল শিক্ষার সাধারণ রীতি। অথচ অন্যান্য মুসলিম দেশে মুসলিম বাচ্চারা ছোটবেলায় শুধু কুরআন মাজীদ পড়া শিখত।[11]
 
কর্ডোভায় ইমাম কুরতুবী দারিদ্রে্যর মাঝে লালিত-পালিত হন। যৌবনকালে তাঁর কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, ولقد كنت في زمن الشباب أنا وغيري ننقل التراب على الدواب من مقبرة عندنا تسمى بمقبرة اليهود خارج قرطبة… إلى الذين يصنعون القرمد للسقف- ‘কর্ডোভার বাইরে অবস্থিত ইহুদীদের একটি কবরস্থান থেকে যৌবনকালে আমি ও আমার বন্ধুরা পশুর পিঠে মাটি বহন করে ছাদের জন্য যারা টালি তৈরী করত তাদের কাছে নিয়ে আসতাম’।[12] মুহাক্কিক ড. ছাদেক বলেন, فالذي يظهر أن القرطبي كان يتكسب من عمله هذا، لأن الذين يصنعون تلك الحجارة للسقف ما يصنعونها في العادة إلا لبيعها- ‘সম্ভবত কুরতুবী তাঁর এই কাজের মাধ্যমে অর্থোপার্জন করতেন। কারণ যারা ছাদের জন্য সেই টালিগুলি তৈরী করত তারা সাধারণত বিক্রয়ের উদ্দেশ্যেই তা তৈরী করত’।[13]
 
বাল্যকালেই ইমাম কুরতুবীর মাঝে দ্বীনী ইলম শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ ও অদম্য স্পৃহা সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি এ সময় জ্ঞানচর্চায় ব্যাপৃত থাকতেন। কর্ডোভার বিখ্যাত আলেম-ওলামার মজলিসে গিয়ে তিনি জ্ঞানসমুদ্রের মূল্যবান মণিমুক্তা আহরণ করতেন। শুধু শিক্ষকমন্ডলীর কাছ থেকে জ্ঞানার্জনেই তাঁর জ্ঞানের ক্ষুধা মিটত না। বরং বিভিন্ন বই-পুস্তক গভীর অভিনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করে তিনি তাঁর জ্ঞানের দিগন্তকে সম্প্রসারিত করতেন। যেমন তিনি বলেন, حسب ما رويته أو رأيته ‘যেমনটা আমি বর্ণনা করেছি বা দেখেছি’।[14] তিনি আরো বলেন, وكنت بالأندلس قد قرأت أكثر من كتب المقرئ الفاضل أبي عمرو عثمان بن سعيد بن عثمان توفي سنة أربع و أربعين وأربعمائة- ‘আমি আন্দালুসে বিশিষ্ট ক্বারী আবু আমর ওছমান বিন সাঈদ বিন ওছমান (মৃঃ ৪৪৪ হিঃ)-এর অধিকাংশ গ্রন্থ অধ্যয়ন করেছিলাম’।[15]
 
অন্যত্র তিনি বলেন,وقد تصفّحتُ كتاب الترمذي أبي عيسى، وسمعت جميعه، فلم أقف على هذا الحديث فيه، فإن كان في بعض النسخ فالله أعلم، وأما كتاب النسائي فسمعت بعضه وكان عندي كثير منه، فلم أقف عليه وهو نُسَخ، فيحتمل أن يكون في بعضها، و الله أعلم- ‘আমি আবু ঈসা তিরমিযীর (জামে) গ্রন্থটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি এবং এর পুরোটাই শুনেছি। আমি সেখানে এ হাদীছটি পাইনি। তবে অন্য কোন কপিতে থাকলে তা আল্লাহই সর্বাধিক অবগত। পক্ষান্তরে নাসাঈর (সুনান) গ্রন্থটির কিছু অংশ আমি শ্রবণ করেছি। এর বৃহদাংশ আমার কাছে মওজুদ আছে। সেখানেও আমি হাদীছটি পাইনি। তবে সুনানে নাসাঈর কতিপয় পান্ডুলিপি রয়েছে। হতে পারে অন্য কোন কপিতে হাদীছটি আছে। আল্লাহই সর্বাধিক অবগত’।[16]
 
ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে আমরা দেখতে পাই যে, তদানীন্তন সময়ে কর্ডোভা জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করেছিল। সেখানে অনেক সমৃদ্ধ পাঠাগার ছিল। এমনকি বলা হয়েছে যে,إذا مات عالم بإشبيلية فأريد بيع كتبه حملت إلى قرطبة حتى تباع فيها- ‘ইশবীলিয়ায় কোন আলেম মৃত্যুবরণ করার পর তার গ্রন্থসমূহ বিক্রয়ের মনস্থ করা হলে সেগুলি কর্ডোভায় আনা হত এবং সেখানে বিক্রয় করা হত’।[17] বহু আলেম-ওলামা ও সমৃদ্ধ লাইব্রেরীতে ঠাসা ইলমী পরিবেশে ইমাম কুরতুবীর শিক্ষা জীবনের তরী সঠিক পথেই এগুচ্ছিল। {{sfn|[9]. মুহাম্মাদ বিন তুমারত (৪৮৫-৫২৪ হিঃ/১০৯২-১১৩০ খ্রিঃ) ৫২৪ হিজরীতে মাগরিবে মুওয়াহ্হিদীন রাজত্ব (دولة الموحِّدين) প্রতিষ্ঠা করেন।
 
[10]. তাফসীরে কুরতুবী ৪/১৭৪, সূরা আলে ইমরানের ১৬৯নং আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
 
[11]. মুকাদ্দামা ইবনে খালদূন (কায়রো : দারু ইবনিল জাওযী, ১ম প্রকাশ, ২০১০), পৃঃ ৪৯০, ‘শিশুশিক্ষা এবং মুসলিম দেশগুলিতে তার পদ্ধতিগত ভিন্নতা’ অনুচ্ছেদ।
 
[12]. কিতাবুত তাযকিরাহ ১/১৬৮।
 
[13]. ঐ, ১/২৮।
 
[14]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৩২।
 
[15]. কিতাবুত তাযকিরাহ ৩/১১৯৭।
 
[16]. কিতাবুত তাযকিরাহ ১/১৮৭।
 
[17]. আহমাদ বিন মুহাম্মাদ আল-মাক্কারী, নাফহুত তীব মিন গুছনিল আন্দালুস আর-রাতীব, তাহকীক: ড. ইহসান আববাস (বৈরূত: দারু ছাদির, ১৩৮৮/১৯৬৮), ১/১৫৫ ‘কর্ডোভার কিছু বিবরণ ও এর খ্যাতি’ শিরো. দ্রঃ।}}
 
== শিক্ষকগণ ==
আন্দালুসে থাকা অবস্থায় তিনি যেসব শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা অর্জন করেন তারা হলেন,
 
১. ইবনু আবী হাজ্জাহ (মৃঃ ৬৪৩/১২৪৫ খ্রিঃ) : আবু জা‘ফর আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ কায়সী কুরতুবী ওরফে ইবনু আবী হাজ্জাহ একজন প্রখ্যাত নাহবী, মুহাদ্দিছ, ফকীহ ও ক্বারী ছিলেন। তিনি ইমাম কুরতুবীর প্রথমদিকের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে তিনি ইলমে কিরাআতে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।[18] ঐতিহাসিক মার্রাকুশী (৬৩৪-৭০৩ হিঃ) বলেন, تلا بالسبع في بلده على أبي جعفر بن أبي حجة ‘তিনি তাঁর দেশে আবু জা‘ফর ইবনু আবী হাজ্জাহর নিকট সাত কিরাআতে কুরআন পাঠ করেন’।[19] কর্ডোভায় খ্রিষ্টানদের আকস্মিক আক্রমণে নিহত পিতার গোসল সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি তাঁর শিক্ষক ইবনু আবী হাজ্জাহকে প্রথম জিজ্ঞেস করেছিলেন। ইমাম কুরতুবী বলেন,فَسَأَلْتُ شَيْخَنَا الْمُقْرِئَ الْأُسْتَاذَ أَبَا جَعْفَرٍ أَحْمَدَ الْمَعْرُوفَ بِأَبِي حَجَّةَ فقال: غسله وصلي عَلَيْهِ، فَإِنَّ أَبَاكَ لَمْ يُقْتَلْ فِي الْمُعْتَرَكِ بَيْنَ الصَّفَّيْنِ- ‘অতঃপর আমি আমাদের শিক্ষক ক্বারী আবু জা‘ফর আহমাদ ওরফে ইবনু আবী হাজ্জাহকে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন, তুমি তোমার পিতাকে গোসল দাও এবং তার উপর জানাযার ছালাত পড়ো। কারণ তোমার পিতা যুদ্ধক্ষেত্রে দু’লের মধ্যে লড়াইয়ের সময় নিহত হননি’।[20]
 
২. রবী বিন আব্দুর রহমান (৫৬৯-৬৩২/১২৩৫ খ্রিঃ) : আবু সুলায়মান রবী বিন আব্দুর রহমান বিন আহমাদ বিন আব্দুর রহমান বিন রবী আশ‘আরী কর্ডোভার অধিবাসী এবং এর শেষ বিচারক ছিলেন। তিনি ইশবীলিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন।[21] পিতাকে গোসল দান সংক্রান্ত বিষয়ে ইবনু আবী হাজ্জাহর পর কুরতুবী তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। ইমাম কুরতুবী বলেন, ثُمَّ سَأَلْتُ شَيْخَنَا رَبِيعَ بْنَ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَحْمَدَ بْنِ رَبِيعِ بْنِ أُبَيٍّ فَقَالَ: إِنَّ حُكْمَهُ حُكْمُ الْقَتْلَى فِي الْمُعْتَرَكِ ‘অতঃপর আমি আমাদের শিক্ষক রবী বিন আব্দুর রহমান বিন আহমাদ বিন রবী বিন উবাইকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, যুদ্ধের ময়দানে নিহতদের মতোই তাঁর হুকুম’।[22]
 
৩. আবু আমের ইয়াহ্ইয়া বিন আব্দুর রহমান বিন আহমাদ বিন রবী আশ‘আরী (মৃঃ ৬৩৯/১২৪১ খ্রিঃ) : ইমাম কুরতুবী তাঁর সম্পর্কে বলেছেন,أخبرنا الشيخ الفقيه الإمام المحدث القاضي أبو عامر يحيى بن عامر بن أحمد بن منيع الأشعري نسبا ومذهبا بقرطبة- أعادها الله- في ربيع الآخر عام ثمانية وعشرين وستمائة قراءة مني عليه- ‘শায়খ ফকীহ ইমাম মুহাদ্দিছ কাযী আবু আমের ইয়াহ্ইয়া বিন আমের বিন আহমাদ বিন মানী‘ আশ‘আরীর নিকট পড়ার সময় ৬২৮ হিজরীর রবীউল আখের মাসে আমাদেরকে কর্ডোভায় বর্ণনা করেন। আল্লাহ তা পুনরুদ্ধার করুন’।[23] মার্রাকুশী বলেন,وروى-أى القرطبى- عن أبي عامر بن ربيع وأكثر عنه- ‘কুরতুবী আবু আমের বিন রবী থেকে অনেক হাদীছ বর্ণনা করেছেন’।[24] তিনি কুরতুবীকে অধিকাংশ হাদীছ বর্ণনার ইজাযত দিয়েছেন।[25]
 
৪. আবুল হাসান আলী বিন কুতরাল (৫৬৩-৬৫১/১২৫৩ খ্রিঃ) : আবুল হাসান আলী বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ বিন কুতরাল আনছারী কুরতুবী মালেকী আন্দালুসের বিভিন্ন শহরে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। ইলমে বালাগাতে তিনি বিশেষ পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন।[26] ইমাম কুরতুবী তদীয় শিক্ষক রবীর পর তাঁর নিকট পিতার গোসল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। যেমন তিনি বলেন, ثُمَّ سَأَلْتُ قَاضِيَ الْجَمَاعَةِ أَبَا الْحَسَنِ عَلِيَّ بْنَ قُطْرَالٍ وَحَوْلَهُ جَمَاعَةٌ مِنَ الْفُقَهَاءِ فَقَالُوا: غَسِّلْهُ وَكَفِّنْهُ وَصَلِّ عَلَيْهِ – ‘অতঃপর আমি প্রধান বিচারপতি আবুল হাসান আলী বিন কুতরালকে জিজ্ঞেস করলাম। তখন তার পাশে একদল ফকীহ ছিলেন। তারা বললেন, তাকে গোসল দাও, কাফন পরাও এবং তার উপর জানাযার ছালাত পড়ো’।[27]
 
৫. আবু মুহাম্মাদ বিন হাওতুল্লাহ (৫৪৯-৬১২/১২১৪ খ্রিঃ) : ইনি স্পেনের একজন খ্যাতিমান মুহাদ্দিছ, কবি ও নাহবী ছিলেন। কর্ডোভার বিচারক থাকার সময় শেষোক্ত দু’জন শিক্ষকের কাছ থেকে ইমাম কুরতুবী জ্ঞানার্জন করেন।[28] {{sfn|[18]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৬৩-৬৪।
 
[19]. মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আল-মার্রাকুশী, আয-যায়ল ওয়াত তাকমিলাহ, তাহকীক : ড. ইহসান আববাস গং (তিউনেসিয়া : দারুল গারব আল-ইসলামী, ১ম প্রকাশ, ২০১২), ৩য় খন্ড, পৃঃ ৪৯৫, জীবনী ক্রমিক ১১৫৪।
 
[20]. তাফসীরে কুরতুবী ৪/১৭৪।
 
[21]. জামাল আব্দুল্লাহ আবু সুহলূব, মানহাজুল কুরতুবী ফিল কিরাআ-ত ওয়া আছারুহা ফী তাফসীরিহী, অপ্রকাশিত এম.এ থিসিস, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, গাযা, ফিলিস্তীন, পৃঃ ২৮-২৯।
 
[22]. তাফসীরে কুরতুবী ৪/১৭৪।
 
[23]. ঐ, ৩/১৫৫, বাক্বারাহ ২৪৫ নং আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
 
[24]. আয-যায়ল ওয়াত তাকমিলাহ ৩/৪৯৫।
 
[25]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৬৭।
 
[26]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৬৮-৬৯; তারজীহাতুল কুরতুবী, পৃঃ ২২।
 
[27]. তাফসীরে কুরতুবী ৪/১৭৪।
 
[28]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৬৯-৭০।}}
 
== মিসরে হিজরত ==
 
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) ৬৩৩ হিজরী পর্যন্ত কর্ডোভায় অবস্থান করেন। কর্ডোভার পতনের পর তিনি ভগ্ন হৃদয়ে আনুমানিক ২০/২৫ বছর বয়সে মিসরে হিজরত করেন।[29] দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইতিহাস ও জীবনীগ্রন্থগুলিতে তাঁর কর্ডোভা থেকে মিসর হিজরতের কোন বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায় না। তাছাড়া প্রশ্ন হ’ল, আন্দালুস ত্যাগের পর কেন তিনি মিসরকে হিজরতস্থল হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন? অথচ কর্ডোভার পতনের পর এর অধিবাসীরা ইশবীলিয়ায় হিজরত করেছিলেন। এর উত্তরে বলা যায়, কুরতুবী যে সময় মিসরে হিজরত করেছিলেন, তখন তা বিভিন্ন দেশ ও জাতির আলেমদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। সাথে সাথে সেখানে ইলমী পরিবেশ ও নিরাপত্তা বজায় ছিল। তাই এই নিরাপদ পরিবেশে বিভিন্ন শ্রেণীর আলেম-ওলামার কাছ থেকে জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্যে তিনি মিসরে হিজরত করেন।[30] উল্লেখ্য যে, একই কারণে আন্দালুসের বেশ কয়েকজন আলেম, কবি ও সাহিত্যিক এ সময় মিসরে হিজরত করেন। তাদের মধ্যে শায়খ আবুবকর তুরতূশী (মৃঃ ৫২০ হিঃ), শাতিবী, ইবনু মালেক অন্যতম।[31]
 
দ্বিতীয়ত, তদানীন্তন সময়ে আববাসীয় খেলাফতের রাজধানী ইরাকের বাগদাদ আলেম-ওলামার পদভারে মুখরিত থাকত। অথচ তিনি সেখানেও হিজরত করেননি। এর কারণ হিসাবে বলা যায়, সম্ভবত তিনি রাজধানীর ডামাডোল থেকে দূরে থাকতে চাচ্ছিলেন। কারণ রাজধানীই তো রাজনৈতিক ঘটনাবলীর কেন্দ্রবিন্দু, ফিৎনা-ফাসাদ ও শত্রুপক্ষের আক্রমণের লক্ষ্যবস্ত্ত হয়ে থাকে। যদি কুরতুবীর মিসরে হিজরত করার এটিই কারণ হয়ে থাকে তবে তার ধারণা সত্যে পরিণত হয়েছিল। কারণ তিনি মিসরে অবস্থানকালীন সময়ে হালাকূ খান ও তার সেনাবাহিনী বাগদাদ আক্রমণ করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এবং অধিকাংশ আলেম ও ফকীহকে হত্যা করে।[32] {{sfn|[29]. ঐ, পৃঃ ১৭, ৩৭।
 
[30]. মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান বিন মুহাম্মাদ হাস্সূনী, ‘তারজামাতুল ইমাম আল-কুরতুবী’, www.alukah.net।
 
[31]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৩৭।
 
[32]. কিতাবুত তাযকিরাহ ১/৩১।}}
 
== ভ্রমণ ==
মিসরে আসার পর তিনি সেখানকার বিভিন্ন শহরে-নগরে পরিভ্রমণ করে ইলমে দ্বীন হাছিল করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল-
 
১. আলেকজান্দ্রিয়া : মিশর হিজরত করে ইমাম কুরতুবী সর্বপ্রথম এ অনিন্দ্যসুন্দর শহরে আসেন। এখানে তিনি বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন এবং আবুল আববাস কুরতুবী ওরফে ইবনুল মুযাইয়িন (৫৯৮-৬৫৬হিঃ/১২৫৮ খ্রিঃ), আবু মুহাম্মাদ ইবনু রাওয়াজ ও আবু মুহাম্মাদ আব্দুল মু‘তী লাখমীর নিকট থেকে জ্ঞান আহরণ করেন।[33]
 
আবুল আববাস কুরতুবী মালেকী মাযহাবের শীর্ষস্থানীয় আলেম ছিলেন। তিনি আলেকজান্দ্রিয়ায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। ইলমে হাদীছ, ফিক্বহ এবং আরবী ভাষা ও সাহিত্যে গভীর মনীষার অধিকারী এই মহান মনীষী ‘আল-মুফহিম ফী শরহে ছহীহ মুসলিম’ নামে মুসলিমের একটি শরাহ লিখেন। ইমাম নববী ছহীহ মুসলিমের শরাহ লেখার সময় এর দ্বারা উপকৃত হন। ঐতিহাসিক ইবনু ফারহূন ও মাক্কারী বলেন, سمع من الشيخ أبي العباس أحمد بن عمر القرطبي مؤلف المفهم في شرح مسلم بعض هذا الشرح- ‘তিনি আল-মুফহিম ফী শরহে মুসলিম প্রণেতা শায়খ আবুল আববাস আহমাদ বিন ওমর কুরতুবীর কাছ থেকে এই শরাহ-এর কিয়দংশ শুনেছেন’।[34]
 
ইমাম কুরতুবী তাঁর শিক্ষকমন্ডলীর মধ্যে তাঁর নাম উল্লেখ করেছেন, তাঁর গ্রন্থাবলী দ্বারা উপকৃত হয়েছেন এবং তাঁর নিকট থেকে অনেক হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তিনি তাকে شَيْخُنَا الْفَقِيهُ الْإِمَامُ ‘আমাদের শায়খ, ফক্বীহ ও ইমাম’, مِنَ الْعُلَمَاءِ الْمُحَقِّقِيْنَ ‘মুহাক্কিক আলেমদের অন্যতম’ প্রভৃতি গুণে বিভূষিত করেছেন।[35]
 
ইমাম কুরতুবী বলেন, سمعت شيخنا الإمام أبا العباس أحمد بن عمر القرطبي بثغر الإسكندرية- ‘আমি আমাদের শিক্ষক ইমাম আবুল আববাস আহমাদ বিন ওমর কুরতুবীর নিকট থেকে আলেকজান্দ্রিয়া সমুদ্রবন্দর এলাকায় শ্রবণ করেছি।[36] হাদীছে নববীর তাখরীজ, এর দুর্লভ শব্দের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও দুর্বোধ্য বিষয় সমূহের সমাধানে কুরতুবী তাঁর এই শিক্ষক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।[37]
 
আবু মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াহ্হাব ইবনু রাওয়াজ ইস্কানদারানী (৫৫৪-৬৪৮/১২৫০ খ্রিঃ) একজন প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ ও ফকীহ ছিলেন। মার্রাকুশী[38], দাঊদী[39], সুয়ূত্বী[40] প্রমুখ তাঁকে ইমাম কুরতুবীর শিক্ষকগণের মধ্যে গণ্য করেছেন। ইমাম কুরতুবীও ‘কিতাবুত তাযকিরাহ’ গ্রন্থের কয়েক জায়গায় তাঁর থেকে হাদীছ বর্ণনার ও তাঁর নিকট কতিপয় গ্রন্থ অধ্যয়নের কথা উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিক মার্রাকুশী বলেছেন, وأكثر عنه ‘তিনি তাঁর নিকট থেকে অনেক হাদীছ বর্ণনা করেছেন’।[41]
 
আলেকজান্দ্রিয়াতেও তিনি তাঁর নিকট থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। যেমন একটি হাদীছ বর্ণনার পর ইমাম কুরতুবী বলেন,أنبأناه الشيخ المسن الحاج الراوية أبو محمد عبد الوهاب بن ظافر بن علي بن فتوح بن أبي الحسن القرشي- عرف بابن رواج- بمسجده بثغر الإسكندرية حماه الله- ‘শায়খ অশীতিপর হাজী রাবী আবু মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন যাফের বিন আলী বিন ফুতূহ বিন আবুল হাসান কুরাশী ওরফে ইবনু রাওয়াজ আলেকজান্দ্রিয়া সমুদ্রবন্দর এলাকায় তাঁর মসজিদে আমাদের নিকট এই হাদীছটি বর্ণনা করেছেন’। আল্লাহ শহরটিকে রক্ষা করুন![42]
 
তাছাড়া আলেকজান্দ্রিয়ায় তিনি আবু মুহাম্মাদ আব্দুল মু‘তী বিন আবিছ ছানা লাখমীর নিকট (মৃঃ ৬৩৮/১২৪১) থেকেও হাদীছ বর্ণনা করেছেন। যেমন ইমাম কুরতুবী নিজেই বলেন,وَسَمِعْتُ شَيْخَنَا الْإِمَامَ أَبَا مُحَمَّدٍ عَبْدَ الْمُعْطِي بِثَغْرِ الْإِسْكَنْدَرِيَّةِ ‘আমি আমাদের শিক্ষক ইমাম আবু মুহাম্মাদ আব্দুল মু‘তীর কাছ থেকে আলেকজান্দ্রিয়া সমুদ্রবন্দর এলাকায় শুনেছি…’।[43]
 
ঐতিহাসিক মার্রাকুশী তাকে ইমাম কুরতুবীর শিক্ষকদের মধ্যে গণ্য করে বলেন, ورحل إلى المشرق وروى هنالك عن أبي العباس أحمد بن عمر الأنصاري القرطبي وأبو محمد عبد المعطي بن محمد بن عبد المعطي اللخمي الإسكندراني- ‘তিনি প্রাচ্যে সফর করেছেন এবং সেখানে আবুল আববাস আহমাদ বিন ওমর আনছারী কুরতুবী ও আবু মুহাম্মাদ আব্দুল মু‘তী বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল মু‘তী লাখমী ইস্কানদারানীর নিকট থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন’।[44] কুরতুবী তাঁর কাছ থেকে ‘ইমলা’ (শ্রুতলিখন) সূত্রে তাঁর ‘আর-রিসালাতুল কুশায়রিয়াহ’-এর ব্যাখ্যাগ্রন্থটি শুনেছেন।[45]
 
২. ফাইয়ূম : তিনি কারাফীর সাথে মিসরের এই শহরে সফর করেন। ঐতিহাসিক ছালাহুদ্দীন ছাফাদী উল্লেখ করেছেন যে, ইবনু সাইয়িদিন নাস ইয়া‘মুরী বলেছেন,
 
تَرَافَقَ الْقُرْطُبِيّ الْمُفَسّر وَالشَّيْخ شهَاب الدّين الْقَرَافِيّ فِي السّفر إِلَى الفيوم وكل مِنْهُمَا شيخ فنه فِي عصره الْقُرْطُبِيّ فِي التَّفْسِير والْحَدِيث والقرافي فِي المعقولات-
 
‘মুফাস্সির কুরতুবী ও শায়খ শিহাবুদ্দীন কারাফী একসাথে ফাইয়ূম সফর করেন। তাদের প্রত্যেকেই স্বীয় যুগে স্ব স্ব বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ছিলেন। কুরতুবী তাফসীর ও হাদীছে এবং কারাফী মা‘কূলাতে’।[46] এ সফরে উভয়ে উভয়ের কাছ থেকে ইলমী ফায়েদা হাছিল করেন।
 
৩. মানছূরাহ : ৬৪৭ হিজরীতে ইমাম কুরতুবী এ শহরে সফর করেন এবং সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে শায়খ আবু আলী হাসান বিন মুহাম্মাদ বাকরীর (৫৭৪-৬৫৬ হিঃ/১২৫৮ খ্রিঃ) নিকট হাদীছ অধ্যয়ন করেন। যেমন ইমাম কুরতুবী নিজেই তাঁর তাফসীরে বলেছেন,قرأت على الشَّيْخِ الْإِمَامِ الْمُحَدِّثِ الْحَافِظِ أَبِي عَلِيٍّ الْحَسَنِ بن محمد بن محمد بن محمد بن عَمْرُوكٍ الْبَكْرِيِّ بِالْجَزِيرَةِ قُبَالَةَ الْمَنْصُورَةِ مِنَ الدِّيَارِ الْمِصْرِيَّةِ- ‘আমি মিসরের মানছূরার নিকটবর্তী জাযীরাহ নামক স্থানে শায়খ ইমাম মুহাদ্দিছ হাফেয আবু আলী হাসান বিন মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ বিন আমরূক বাকরীর নিকট পড়েছি’।[47] তিনি আরো বলেন,أخبرناه عالياً الشيخ الإمام الحافظ المسند أبو الحسن علي بن محمد بن محمد بن محمد بن عمروك البكري التيمي من ولد أبي بكر الصديق رضي الله عنه قراءة عليه بالمنصورة بالديار المصرية في يوم الجمعة الثالث عشر من شهر رجب الفرد سنة سبع وأربعين وستمائة- ‘৬৪৭ হিজরীর রজব মাসের ১৩ তারিখ শুক্রবার আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর বংশধর শায়খ ইমাম নির্ভরযোগ্য হাফেয আবুল হাসান আলী বিন মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ বিন আমরূক বাকরী তায়মীর নিকট মিসরের মানছূরায় পড়ার সময় তিনি আমাদের নিকট এই হাদীছটি উচ্চসনদে বর্ণনা করেছেন’।[48]
 
৪. কায়রো : সম্ভবত ইমাম কুরতুবী কায়রোতেও কিছু সময় বসবাস করেন। কারণ তখন এটি ছিল মিসরের রাজধানী। তিনি এখানকার খ্যাতিমান আলেমদের কাছ থেকে ইলম অর্জন করেন এবং তাদের অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হন।[49]
 
৫. মুনয়াতু বানী খাছীব : মিসরের আসইঊত প্রদেশের উত্তরে মুনয়াতু বানী খাছীব (বর্তমানে আল-মিনয়া নামে পরিচিত) নামক স্থানে ইমাম কুরতুবী স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এবং এখানেই মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর প্রিয় শিক্ষক আবুল হাসান আলী বিন হিবাতুল্লাহ লাখমী ওরফে ইবনুল জুম্মাইযীর (৫৫৯-৬৪৯/১২৫১ খ্রিঃ) সাহচর্য লাভের জন্য তিনি এখানে থিতু হন। দাঊদী[50] ও সুয়ূত্বী[51] তাঁকে ইমাম কুরতুবীর শিক্ষকদের মধ্যে গণ্য করেছেন। যেমন কুরতুবী বলেন,…أنبأناه الشيخ الفقيه الإمام مفتي الأنام أبو الحسن علي بن هبة الله الشافعي بمنية بني خصيب على ظهر النيل- ‘শায়খ ফকীহ ইমাম জগদ্বাসীর মুফতী আবুল হাসান আলী বিন হিবাতুল্লাহ শাফেঈ মিসরের মুনয়াতু বানী খাছীবে আমাদের নিকট এই হাদীছটি বর্ণনা করেছেন’।[52] তিনি তাঁর কাছ থেকে ইলমে হাদীছ, নাহু, কিরাআত ও ফিক্বহ-এর জ্ঞান হাছিল করেন।[53]
 
তাছাড়া তিনি ‘আত-তারগীব ওয়াত তারহীব’ সংকলক যাকিউদ্দীন মুনযেরী (৫৮১-৬৫৬ হিঃ), ইমাম আবুল কাসেম কূমী, শায়খ আবুল হাসান আলী বিন মুহাম্মাদ ইয়াহ্ছূবী প্রমুখের নিকট থেকেও জ্ঞানার্জন করেন।[54] {{sfn|[33]. ইবনু নাছিরুদ্দীন দামেশকী, তাওযীহুল মুশতাবাহ, তাহকীক : মুহাম্মাদ নাঈম আরকূসী (বৈরূত: মুআস্সাসাতুর রিসালাহ, ১৯৯৩), ৭ম খন্ড, পৃঃ ৬৫; আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৩৮।
 
[34]. ইবনু ফারহূন, আদ-দীবাজ আল-মুযাহ্হাব ফী মা‘রেফাতে ওলামায়ে আ‘য়ানিল মাযহাব (কায়রো: দারুত তুরাছ, তাবি), ২/৩০৯, জীবনী ক্রমিক ১১৪; নাফহুত তীব ২/২১১।
 
[35]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৭২।
 
[36]. কিতাবুত তাযকিরাহ ১/১৮৭।
 
[37]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৭৪।
 
[38]. আয-যায়ল ওয়াত তাকমিলাহ ৫/৪৯৫।
 
[39]. হাফেয শামসুদ্দীন দাঊদী, তাবাকাতুল মুফাস্সিরীন (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-ইলমিয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৪০৩ হিঃ/১৯৮৩ খ্রিঃ), ২য় খন্ড, পৃঃ ৭০, জীবনী ক্রমিক ৪৩৪।
 
[40]. তাবাকাতুল মুফাস্সিরীন, পৃঃ ৯২।
 
[41]. আয-যায়ল ওয়াত তাকমিলাহ ৩/৪৯৫।
 
[42]. কিতাবুত-তাযকিরাহ ১/৩৪১।
 
[43]. তাফসীরে কুরতুবী, ১০/২৭৪, কাহ্ফ ৫০ নং আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
 
[44]. আয-যায়ল ওয়াত তাকমিলাহ ৩/৪৯৫।
 
[45]. তাফসীরে কুরতুবী ১১/৩০, কাহফ ৭৯-৮২ আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
 
[46]. ছালাহুদ্দীন ছাফাদী, আল-ওয়াফী বিল ওফায়াত (বৈরূত: দারু ইহ্ইয়াইত তুরাছিল আরাবী, ১ম প্রকাশ, ১৪২০/২০০০), ২য় খন্ড, পৃঃ ৮৭, জীবনী ক্রমিক ৪৭২।
 
[47]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/৯২, ছাফফাত ১৮০-৮২ আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
 
[48]. কিতাবুত তাযকিরাহ ২/৭৯৬।
 
[49]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৩৯।
 
[50]. তাবাকাত ২/৭০।
 
[51]. তাবাকাত, পৃঃ ৯২।
 
[52]. কিতাবুত তাযকিরাহ ১/৩৪১।
 
[53]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৪০, ৮২।
 
[54]. তাফসীরে কুরতুবী, উর্দূ অনুবাদ : ড. হাফেয ইকরামুল হক ইয়াসীন (শরী‘আহ একাডেমী, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামাবাদ, পাকিস্তান, ১ম প্রকাশ, ২০০৪), ১ম খন্ড, পৃঃ ৭২।}}
<ref>26, el-Kasabî Mahmûd Zelat. p. 30</ref>
 
 
== ইমাম কুরতুবী (রহঃ)-এর রচনা সমূহ ==
 
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) সর্বদা ইবাদত-বন্দেগী ও জ্ঞান সাধনায় নিয়োজিত থাকতেন। তিনি শহরের কোলাহলমুক্ত নির্ঝঞ্ঝাট গ্রামীণ পরিবেশে নীরবে রচনা করে গেছেন তাঁর সুবিশাল সাহিত্যকর্ম।[1] এসব রচনা বিভিন্ন শাস্ত্রে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ও গভীর জ্ঞানের পরিচয় বহন করে। তাইতো ঐতিহাসিকগণ বলেছেন,لَهُ تصانيف مفيدة تدل على كَثْرَة اطلاعه ووفور فضله ‘তাঁর অনেক উপকারী গ্রন্থ রয়েছে। যা তাঁর অধিক অধ্যয়ন ও অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর বহন করে’।[2] আধুনিক গবেষক মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান বিন মুহাম্মাদ হাসূনী বলেন, وهى مؤلفات منقطعة النظير في بابها ‘এগুলি অতুলনীয় গ্রন্থ’।[3]
 
ইমাম কুরতুবী (রহঃ)-এর গ্রন্থ সমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এতে ইলমের বড়াই বা আত্মম্ভরিতার লেশমাত্র নেই। বরং সর্বত্র বিনয়-নম্রতার ছাপ বিদ্যমান রয়েছে। তাছাড়া তাঁর রচনা সমূহে সমকালীন ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও সামাজিক সমস্যা সমূহ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত ব্যক্ত হয়েছে। ফলে সেগুলি ইতিহাসের বিশ্বস্ত উপাদনে পরিণত হয়েছে।[4] নিম্নে তাঁর রচনাবলী সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল :
 
১. তাফসীরে কুরতুবী :
 
ইমাম কুরতুবী (রহঃ)-এর রচনা সমূহের মধ্যে তাফসীরে কুরতুবী সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও উপকারী। এর পূর্ণাঙ্গ নাম হ’ল اَلْجَامِعُ لِأَحْكَامِ الْقُرْآنِ، وَالْمُبَيِّنُ لِمَا تَضَمَّنَ مِنَ السُّنَّةِ وَآىِ الْفُرْقَانِ তবে এটি ‘তাফসীরে কুরতুবী’ নামেই সমধিক খ্যাত ও পরিচিত। এটি প্রথমতঃ কায়রোর দারুল কুতুব আল-মিসরিয়্যাহ থেকে ২০ খন্ডে প্রকাশিত হয়। ১৯৩৩-১৯৫০ সালের মধ্যে এর মুদ্রণ শেষ হয়। ১৯৬১ সালে আদ-দারুল ক্বওমিইয়াহ এটি ৮০ জুয বা খন্ডে প্রকাশ করে। অতঃপর ১৯৬৭ সালে কায়রোর দারুল কিতাবিল আরাবী প্রথম সংস্করণের ফটোকপি মুদ্রণ করে। এরপর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে এর বহু সংস্করণ বের হয়েছে।[5] তন্মধ্যে আব্দুর রায্যাক আল-মাহদীর তাহক্বীক্বকৃত বৈরূতের দারুল কিতাবিল আরাবী থেকে ২০ খন্ডে প্রকাশিত (২০০৪) সংস্করণ এবং ড. আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল মুহসিন আত-তুর্কীর তাহক্বীক্বকৃত বৈরূতের মুআস্সাসাতুর রিসালাহ থেকে ২৪
 
খন্ডে প্রকাশিত (২০০৬) সংস্করণ সবচেয়ে সুন্দর ও উপকারী। {{sfn|[1]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৪০-৪১।
 
[2]. আল-ওয়াফী বিল অফায়াত ২/৮৭; উয়ূনুত তারীখ ২১/২৭; যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ৫০/৭৫।
 
[3]. ‘তারজামাতুল ইমাম আল-কুরতুবী’ www.alukah.net.।
 
[4]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৯৭।
 
[5]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ১০২।}}
 
==তাফসীরে কুরতুবীর ধরন==
বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে তাফসীর গ্রন্থ সমূহ দু’প্রকার। ১. তাফসীরে ‘উমূমী বা সাধারণ তাফসীর। এতে আয়াতের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী প্রত্যেক আয়াতের তাফসীর ও তার বিষয়বস্ত্ত বর্ণনা করা হয়। ২. তাফসীরে মাওযূঈ বা বিষয়ভিত্তিক তাফসীর। এতে কোন একটি বিষয়ের আয়াত সমূহের উপরে বেশী জোর দেয়া হয়। যেমন : ফিক্বহী তাফসীর বা আহকাম সংক্রান্ত আয়াত সমূহের তাফসীর প্রভৃতি।[6] ইমাম কুরতুবীর তাফসীরে উভয় প্রকারের সন্নিবেশ ঘটেছে। তাঁর তাফসীরের নামের প্রথম অংশ (اَلْجَامِعُ لِأَحْكَامِ الْقُرْآنِ) বিষয়ভিত্তিক তাফসীরের প্রতি নির্দেশ করে। অর্থাৎ এতে কুরআন মাজীদের আয়াত সমূহের আলোকে ফিক্বহী বিধি-বিধান (Legal study of the Holy Quran) বর্ণনা করা হয়েছে। আর এর দ্বিতীয় অংশ (وَالْمُبَيِّنُ لِمَا تَضَمَّنَ مِنَ السُّنَّةِ وَآىِ الْفُرْقَانِ) সাধারণ তাফসীরের দিকে ইঙ্গিত করে। অর্থাৎ ফিক্বহী বিধি-বিধান ছাড়াও এতে সকল আয়াতের সাধারণ তাফসীর (Generel Commentary) এবং এতদপ্রসঙ্গে আগত হাদীছ সমূহের ব্যাখ্যা রয়েছে। তাছাড়া তাফসীরের নামের প্রথমে اَلْجَامِعُ শব্দটি উল্লেখ করে তিনি এদিকে ইঙ্গিত প্রদান করেছেন যে, এই তাফসীরে কুরআন মাজীদের ফিক্বহী পর্যালোচনা নির্দিষ্ট একটি মাযহাবের মতামত উল্লেখ করার সাথে শর্তযুক্ত হবে না। বরং এটি ফিক্বহী মতামত সমূহের এক সারগর্ভ পর্যালোচনা হবে, যাতে প্রসিদ্ধ মাযহাব সমূহের মতামতগুলি উল্লেখ করা হবে।[7] এজন্যই গবেষক মুছত্বাফা ইবরাহীম আল-মাশীনী তাফসীরে কুরতুবীকে ‘ফিক্বহী বিশ্বকোষ’ (موسوعة فقهية) বলে আখ্যায়িত করেছেন।[8] {{sfn|[6]. যেমন আবূ বকর জাছ্ছাছ ও ইবনুল আরাবীর আহকামুল কুরআন, নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী (রহঃ)-এর নায়লুল মারাম মিন তাফসীরে আয়াতিল আহকাম প্রভৃতি।
 
[7]. তাফসীরে কুরতুবী (উর্দূ অনুবাদ), ১ম খন্ড, পৃঃ 1xxii।
 
[8]. মুছত্বাফা ইবরাহীম আল-মাশীনী, মাদরাসাতুত তাফসীর ফিল আন্দালুস (বৈরূত : মুআস্সাসাতুর রিসালাহ, ১ম প্রকাশ, ১৪০৬/১৯৮৬), পৃঃ ৫০২।}}
 
==রচনার কারণ ও উদ্দেশ্য==
তাফসীরে কুরতুবীর ভূমিকায় ইমাম কুরতুবী (রহঃ) এই তাফসীরটি রচনার কারণ ও উদ্দেশ্যে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,
 
فلما كان كتاب الله هو الكفيل بجميع عُلُومِ الشَّرْعِ، الَّذِي اسْتَقَلَّ بِالسُّنَّةِ وَالْفَرْضِ، وَنَزَلَ بِهِ أَمِينُ السَّمَاءِ إِلَى أَمِينِ الْأَرْضِ، رَأَيْتُ أن أشتغل به مَدَى عُمُري، وأستفرغ فيه مُنَّتي، بأن أكتب تَعْلِيقًا وَجِيزًا، يَتَضَمَّنُ نُكَتًا مِنَ التَّفْسِيرِ وَاللُّغَاتِ، وَالْإِعْرَابِ وَالْقِرَاءَاتِ، وَالرَّدِّ عَلَى أَهْلِ الزَّيْغِ وَالضَّلَالَاتِ، وَأَحَادِيثَ كَثِيرَةً شَاهِدَةً لِمَا نَذْكُرُهُ مِنَ الْأَحْكَامِ وَنُزُولِ الْآيَاتِ، جَامِعًا بَيْنَ مَعَانِيهِمَا، وَمُبَيِّنًا مَا أَشْكَلَ مِنْهُمَا، بِأَقَاوِيلِ السَّلَفِ، وَمَنْ تَبِعَهُمْ مِنَ الْخَلَفِ. وَعَمِلْتُهُ تَذْكِرَةً لِنَفْسِي، وَذَخِيرَةً لِيَوْمِ رَمْسِي، وَعَمَلًا صَالِحًا بَعْدَ مَوْتِي.
 
‘আল্লাহর কিতাব যখন যাবতীয় শারঈ জ্ঞানের আধার, যা সুন্নাত ও ফরযকে কায়েম করেছে এবং যা নিয়ে আকাশের আমীন [জিব্রীল (আঃ)] যমীনের আমীনের [রাসূল (ছাঃ)] নিকটে অবতরণ করেছেন, তখন আমি সংক্ষিপ্ত তাফসীর লেখার কাজে সারাজীবন ব্যস্ত থাকতে এবং এ বিষয়ে আমার যাবতীয় শক্তি-সামর্থ্য নিয়োজিত করতে চেয়েছি। যাতে তাফসীর ও ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনার সাথে সাথে ই‘রাব ও ক্বিরাআত, বক্র হৃদয়ের অধিকারী ও পথভ্রষ্ট ব্যক্তিদের খন্ডন থাকবে। আর এতে আমরা আহকাম ও আয়াতের শানে নুযূল উল্লেখ করত তার সমর্থনে অনেক হাদীছও প্রমাণস্বরূপ পেশ করব। কুরআন-সুন্নাহর ভাবের মাঝে সমন্বয়কারী এই তাফসীরটি সারগর্ভ এবং পূর্ববর্তী ও তাদের অনুসরণকারী পরবর্তী আলেমদের মতামত সহ দুর্বোধ্য বিষয়ের ব্যাখ্যাকারী হবে। আমি নিজের জন্য নছীহত, আমার কবরের জন্য পাথেয় এবং আমার মৃত্যুর পর এটি যেন আমার জন্য সৎকর্ম হয় সেজন্য এই তাফসীরটি রচনা করেছি’।[9] {{sfn|[9]. তাফসীরে কুরতুবী ১/৬, ভূমিকা দ্রঃ।}}
 
==শর্ত ও অনুসৃত পদ্ধতি==
 
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তাঁর তাফসীরের ভূমিকায় তার শর্ত এবং ‘মানহাজ’ বা অনুসৃত পদ্ধতি উল্লেখ করেছেন। যার সারমর্ম হ’ল :
 
১. তিনি বলেন,وَشَرْطِي فِي هَذَا الْكِتَابِ : إِضَافَةُ الْأَقْوَالِ إِلَى قَائِلِيهَا، وَالْأَحَادِيثِ إِلَى مُصَنِّفِيهَا، فَإِنَّهُ يُقَالُ: مِنْ بَرَكَةِ الْعِلْمِ أَنْ يُضَافَ الْقَوْلُ إِلَى قَائِلِهِ ‘এ গ্রন্থে আমার শর্ত হ’ল, বক্তব্য সমূহকে তার প্রবক্তাদের দিকে এবং হাদীছগুলিকে এর সংকলকদের দিকে সম্বন্ধ করা। কেননা বলা হয়ে থাকে, ইলমের বরকত হ’ল, বক্তব্যকে বক্তার দিকে সম্বন্ধ করা’।[10]
 
২. মুফাস্সিরদের উদ্ধৃত বহু কিচ্ছা-কাহিনী ও ঐতিহাসিকদের বর্ণিত বহু ঘটনার মধ্যে ব্যাখ্যার জন্য যতটুকু উল্লেখ না করলেই নয় তিনি ততটুকু উল্লেখ করেছেন।
 
৩. বিধি-বিধান সম্পর্কিত আয়াতের মর্ম যেন পাঠক বুঝতে পারে সেজন্য তিনি মাসআলা সমূহকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
 
৪. কোন আয়াতে বিধি-বিধান না থাকলে সেখানে আয়াতটির সাধারণ তাফসীর করেছেন।
 
৫. আয়াতের শানে নুযূল, ক্বিরাআত, ই‘রাব ও দুর্বোধ্য শব্দের অর্থ আরবদের কবিতার উদ্ধৃতি সহ উল্লেখ করেছেন।[11] অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তাঁর বর্ণিত শর্ত সমূহ ও মানহাজ অনুসরণ করেছেন। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয়ও ঘটেছে। {{sfn|তাফসীরে কুরতুবী ১/৬, ভূমিকা দ্রঃ। [10]. ঐ। [11]. ঐ ১/৬-৭।}}
 
==তাফসীরে কুরতুবীর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য==
 
তাফসীরে কুরতুবীর অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নে এর কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হ’ল :
 
১. সারগর্ভ ভূমিকা :
 
তিনি তাঁর তাফসীরের শুরুতে উলূমুল কুরআন বিষয়ক একটি সারগর্ভ ভূমিকা লিপিবদ্ধ করেছেন। এতে ফাযায়েলে কুরআন, কুরআন তেলাওয়াতের নিয়ম-নীতি, ই‘রাবুল কুরআন, তাফসীর ও মুফাস্সিরদের ফযীলত, কুরআন মাজীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, নিজস্ব রায় দ্বারা তাফসীর করার বিষয়ে ভীতি প্রদর্শন, মুফাস্সিরদের স্তর, হাদীছ দ্বারা কুরআনের ব্যাখ্যা, কুরআন সংকলনের ইতিহাস, সূরা ও আয়াত সমূহের বিন্যাস, ই‘জাযুল কুরআন (কুরআনের অলৌকিকতা) প্রভৃতি বিষয় উল্লেখ করেছেন, যা কুরআন গবেষক ও মুফাস্সিরের জানা আবশ্যক।[12]
 
২. আয়াতকে মাসআলায় বিভক্তকরণ :
 
তিনি এক বা একাধিক আয়াত উল্লেখ করত সেগুলিকে মাসআলায় বিভক্ত করেছেন। যে মাসআলাগুলি আবার কয়েকটি বাবের অধীনে আলোচিত হয়েছে। যেমন সূরা ফাতিহার তাফসীরকে চারটি বাবে বিভক্ত করেছেন। অতঃপর প্রথম বাবে সূরা ফাতিহার ফযীলত ও নাম সমূহকে সাতটি মাসআলায় বিভক্ত করা হয়েছে।[13] দ্বিতীয় বাবে এর শানে নুযূল ও বিধি-বিধান সমূহকে ২০টি মাসআলায় বিভক্ত করেছেন।[14] তৃতীয় বাব আমীন সম্পর্কিত। এতে ৮টি মাসআলা রয়েছে।[15] ৪র্থ বাবে সূরার অর্থ, ক্বিরাআত, ই‘রাব ও প্রশংসাকারীদের ফযীলত আলোচিত হয়েছে। এতে ৩৬টি মাসআলা রয়েছে।[16]
 
কখনো কখনো বাব ও শিরোনামে বিন্যস্ত না করে মাসআলা উল্লেখ করত আয়াতের তাফসীর করা হয়েছে।[17]
 
তবে আলোচিত সব মাসআলা যে ফিক্বহী বিধি-বিধান সংক্রান্ত তা কিন্তু নয়। যেমন তাফসীরে কুরতুবীর ভূমিকায় ইমাম কুরতুবী (রহঃ) উল্লেখ করেছেন,فَضَمَّنْتُ كل آية تتضمن حُكْمًا أَوْ حُكْمَيْنِ فَمَا زَادَ، بِمَسَائِلَ نُبَيِّنُ فِيهَا مَا تَحْتَوِي عَلَيْهِ مِنْ أَسْبَابِ النُّزُولِ وَالتَّفْسِيرِ الْغَرِيبِ وَالْحُكْمِ، فَإِنْ لَمْ تَتَضَمَّنْ حُكْمًا ذَكَرْتُ مَا فِيهَا مِنَ التَّفْسِيرِ وَالتَّأْوِيلِ، هَكَذَا إِلَى آخِرِ الْكِتَابِ. ‘প্রত্যেকটি আয়াতের অধীনস্থ একটি, দু’টি বা ততোধিক বিধানকে আমি মাসায়েল হিসাবে উল্লেখ করেছি। এতে শানে নুযূল, দুর্বোধ্য শব্দের ব্যাখ্যা এবং ফিক্বহী বিধি-বিধান বর্ণনা করেছি। যদি আয়াতটি বিধি-বিধান সম্পর্কিত না হয় তাহ’লে সেখানে আয়াতের সাধারণ তাফসীর উল্লেখ করেছি। গ্রন্থের শেষ পর্যন্ত এ ধারা বজায় রাখা হয়েছে’।[18]
 
কখনো মাসআলার অধীনে ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন ছিয়াম সম্পর্কিত আয়াতের (বাক্বারাহ ১৮৩) দ্বিতীয় মাসআলায় ছিয়ামের ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, اَلثَّانِيَةُ : فَضْلُ الصَّوْمِ عَظِيمٌ، وَثَوَابُهُ جَسِيمٌ ‘২য় মাসআলা : ছিয়ামের ফযীলত অনেক এবং এর ছওয়াব অগণিত’।[19] কখনো এমন তাফসীর উল্লেখ করা হয়েছে ফিক্বহী মাসআলার সাথে যার কোন সম্পর্কই নেই। যেমন ওযূর আয়াতের শেষ মাসআলায় বলা হয়েছে,اَلثَّانِيَةُ وَالثَّلَاثُوْنَ قَوْلُهُ تَعَالَى: (مَا يُرِيدُ اللهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُمْ مِنْ حَرَجٍ) أَيْ مِنْ ضِيقٍ فِي الدِّينِ، ‘৩২তম মাসআলা : মহান আল্লাহর বাণীمَا يُرِيدُ اللهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُمْ مِنْ حَرَجٍ ‘আল্লাহ তোমাদের উপর কোনরূপ সংকীর্ণতা চান না’ অর্থাৎ দ্বীনের মধ্যে সংকীর্ণতা।[20] আবার কখনো কোন কোন মাসআলায় আক্বীদা সংক্রান্ত বিষয় আলোচনা করা হয়েছে।[21]
 
৩. অবতরণকাল ও ফযীলত বর্ণনা :
 
সূরার প্রথমে তিনি এর অবতরণের সময়কাল ও ফযীলত বর্ণনা করেছেন। যেমন সূরা বাক্বারার প্রথমে তিনি বলেন,وَأَوَّلُ مَبْدُوءٍ بِهِ الْكَلَامُ فِي نُزُولِهَا وَفَضْلِهَا وَمَا جَاءَ فِيهَا، وَهَكَذَا كُلُّ سُورَةٍ إِنْ وَجَدْنَا لَهَا ذَلِكَ، ‘প্রথমে এ সূরাটির অবতরণের সময়কাল, ফযীলত এবং এ বিষয়ে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে তা আলোচনা করা হবে। এভাবে প্রত্যেক সূরার প্রথমে তার অবতরণকাল ও ফযীলত বর্ণনা করব যদি তা পাওয়া যায়’।[22]
 
৪. হাদীছের উপর নির্ভরতা :
 
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তাঁর তাফসীরে হাদীছের উপর নির্ভর করেছেন। তিনি এ গ্রন্থে ৬৫০০-এর বেশী হাদীছ উল্লেখ করেছেন।[23] তিনি কখনো কখনো গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যানের দিক থেকে হাদীছের সনদ ও মতন সম্পর্কে স্বীয় মতামত ব্যক্ত করেছেন। যেমন তাফসীরে কুরতুবীর ভূমিকায় তিনি বলেছেন, وَكَثِيرًا مَا يجئ الْحَدِيثُ فِي كُتُبِ الْفِقْهِ وَالتَّفْسِيرِ مُبْهَمًا، لَا يَعْرِفُ مَنْ أَخْرَجَهُ إِلَّا مَنِ اطَّلَعَ عَلَى كتب الحديث، فيبقى من لا خبرة لَهُ بِذَلِكَ حَائِرًا، لَا يَعْرِفُ الصَّحِيحَ مِنَ السَّقِيمِ، وَمَعْرِفَةُ ذَلِكَ عِلْمٌ جَسِيمٌ، فَلَا يُقْبَلُ مِنْهُ الِاحْتِجَاجُ بِهِ، وَلَا الِاسْتِدْلَالُ حَتَّى يُضِيفَهُ إِلَى مَنْ خَرَّجَهُ مِنَ الْأَئِمَّةِ الْأَعْلَامِ، وَالثِّقَاتِ الْمَشَاهِيرِ مِنْ عُلَمَاءِ الْإِسْلَامِ. وَنَحْنُ نُشِيرُ إِلَى جُمَلٍ مِنْ ذَلِكَ فِي هَذَا الْكِتَابِ، وَاللهُ الْمُوَفِّقُ لِلصَّوَابِ. ‘ফিক্বহ ও তাফসীরের গ্রন্থ সমূহে প্রায়শ সূত্রবিহীন হাদীছ আসে। হাদীছ গ্রন্থ সমূহ সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ব্যতীত কেউ হাদীছটির সূত্র জানে না। ফলে এ বিষয়ে যার অভিজ্ঞতা নেই (অর্থাৎ সাধারণ পাঠক) তিনি এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান যে, ছহীহ ও যঈফ হাদীছের মধ্য পার্থক্য করতে পারেন না। অথচ এর পরিচয় লাভ অনেক বড় ইলম। সূত্রবিহীন হাদীছ পেশকারী ব্যক্তির কথা গ্রহণ করা যায় না এবং তার পেশকৃত হাদীছ দ্বারা দলীল সাব্যস্ত করাও যায় না। যতক্ষণ না নির্ভরযোগ্য ওলামায়ে কেরাম ও প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিছগণের মধ্যে কারো দিকে সেটিকে সম্বন্ধ করা হয়। আমরা এ গ্রন্থে এ জাতীয় বহু বর্ণনার দিকে ইঙ্গিত করব। আল্লাহ যেন সঠিক বিষয়টা উপস্থাপনের তৌফিক দেন’।[24] এতদসত্ত্বেও তিনি কিছু যঈফ, মুনকার ও মাওযূ (জাল) হাদীছ উল্লেখের ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করেছেন। বিশেষত তাফসীরের শেষ তৃতীয়াংশে তিনি অনেক ত্রুটিপূর্ণ ও জাল হাদীছ উল্লেখ করেছেন। সম্ভবতঃ ছা‘লাবী ও ওয়াহিদীর তাফসীর থেকে তিনি এগুলি গ্রহণ করেছেন। তবে তাফসীরে কুরতুবীতে ছহীহ ও হাসান হাদীছের সংখ্যাই বেশী।[25]
 
এ ব্যাপারে জীবনীকার ও গবেষক শায়খ মাশহূর হাসানের অভিমত হ’ল, ছহীহ হাদীছ সমূহ বর্ণনার ক্ষেত্রে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) সেগুলির উৎস ও সংকলনকারীদের নাম উল্লেখ করেছেন। তবে যেগুলির শুদ্ধাশুদ্ধির ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত হ’তে পারেননি, সেগুলির উৎস ও সংকলনকারীদের নাম এড়িয়ে গেছেন।[26] যেমন সূরা ফাতিহার আল-হামদুলিল্লাহ-এর তাফসীরে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) উল্লেখ করেছেন-
 
وَيُذْكَرُ الْحَمْدُ بِمَعْنَى الرِّضَا … وَقَالَ عَلَيْهِ السَّلَامُ: (أَحْمَدُ إِلَيْكُمْ غَسْلَ الْإِحْلِيلِ) أَيْ أَرْضَاهُ لَكُمْ.
 
‘ اَلْحَمْدُশব্দটিকে الرِّضَا বা সন্তুষ্টি অর্থেও উল্লেখ করা হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মূত্রপথ ধৌত করার প্রশংসা করি’। অর্থাৎ আমি তোমাদের জন্য তা পসন্দ করি।[27] তবে হাদীছটি কোন গ্রন্থে এবং কে সংকলন করেছেন তা তিনি উল্লেখ করেননি। মূলতঃ এটি ইবনু আববাস (রাঃ)-এর উক্তি।[28] তাফসীরে কুরতুবীর মুহাক্কিক্ব আব্দুর রায্যাক আল-মাহদী বলেন, وَلَمْ أَرَهُ مُسْنَدًا ‘আমি একে সনদসহ পাইনি’।[29] এ জাতীয় হাদীছগুলির মূল উৎস খুঁজে বের করে তার শুদ্ধাশুদ্ধি ও দুর্বলতা সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত শুধু ইমাম কুরতুবী (রহঃ) উল্লেখ করেছেন বলেই সেগুলি গ্রহণ করা যাবে না।[30]
 
৪. মাযহাবী গোঁড়ামি পরিহার :
 
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) মালেকী মাযহাবের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেন। তাঁর শিক্ষকবৃন্দের মধ্যে মালেকী মাযহাবের খ্যাতনামা আলেম-ওলামা ছাড়াও শাফেঈ মাযহাবের অনেক বিদ্বান ছিলেন। ইমাম মালেক ও মালেকী মাযহাবের প্রতি ইমাম কুরতুবী (রহঃ)-এর গোঁড়ামি ও অন্যায্য পক্ষপাত ছিল না। দলীলের দিক থেকে দুর্বল হ’লেও তিনি ইমাম মালেক (রহঃ)-এর মত গ্রহণ করেছেন এমনটি নয়। বরং দলীল যে মাযহাবের পক্ষে গেছে তিনি সে মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। অনুরূপভাবে তিনি বিরোধীদের দলীল সমূহ দুর্বলভাবে উপস্থাপন করেননি। বরং পূর্ণ আমানতদারির সাথে সূক্ষ্মভাবে সেগুলি উল্লেখ করেছেন এবং তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন।[31]
 
আধুনিক গবেষক ড. মুহাম্মাদ হুসাইন আয-যাহাবী যথার্থই বলেছেন,وخير ما في الرجل أى : القر طبي أنه لا يتعصب لمذهبه المالكى، بل يمشى مع الدليل حتى يصل إلى ما يرى أنه الصواب، أيا كان قائله- ‘ইমাম কুরতুবীর প্রশংসনীয় দিক হ’ল, তিনি মালেকী মাযহাবের প্রতি গোঁড়ামি প্রদর্শন করেন না। বরং দলীলের সাথে চলেন। যতক্ষণ না তাঁর দৃষ্টিতে সঠিক মতামতের দিকে পৌঁছেন। সে মতের প্রবক্তা যেই হোক না কেন’।[32]
 
তাঁর মাযহাবী গোঁড়ামি পরিহারের কয়েকটি কারণ রয়েছে। যেমন :
 
ক. তাক্বলীদ বর্জন : ইমাম কুরতুবী (রহঃ) মালেকী মাযহাবের অন্ধ তাক্বলীদ করেননি। তিনি ছিলেন মুজতাহিদ। তাক্বলীদ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হ’ল, اَلتَّقْلِيدُ لَيْسَ طَرِيقًا لِلْعِلْمِ وَلَا مُوَصِّلًا لَهُ، لَا فِي الْأُصُولِ وَلَا فِي الْفُرُوعِ، وَهُوَ قَوْلُ جُمْهُورِ الْعُقَلَاءِ وَالْعُلَمَاءِ- ‘তাক্বলীদ ইলমের কোন পথ নয় এবং সেদিকে তা পৌঁছিয়েও দেয় না। উছূল (মূলনীতি) ও ফুরূ‘ (শাখা-প্রশাখা) কোন ক্ষেত্রেই নয়। এটিই অধিকাংশ জ্ঞানী-গুণী ও আলেমের অভিমত’।[33]
 
খ. সূক্ষ্ম বুঝ, জ্ঞানের গভীরতা এবং বিভিন্ন মাযহাবের আলেমদের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ।[34]
 
গ. ইমাম কুরতুবী (রহঃ) সুন্নাতে নববীকে অত্যন্ত শক্তভাবে অাঁকড়ে ধারণকারী ছিলেন। তিনি তাঁর মুহাদ্দিছ শিক্ষকগণের আচার-আচরণ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিলেন। হাদীছের উপর পূর্ণ দখল তাঁকে তাক্বলীদের গন্ডীমুক্ত করেছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোন মতকে প্রাধান্য দেয়ার সময় তিনি হাদীছের উপর নির্ভর করতেন।[35] সঙ্গত কারণেই ঐতিহাসিক মার্রাকুশী তাঁর সম্পর্কে বলেছেন,وكان من أهل العلم بالحديث والاعتناء التام بروايته ‘তিনি মুহাদ্দিছ এবং হাদীছ বর্ণনার প্রতি পূর্ণ যত্নবান ছিলেন’।[36]
 
যেমন সূরা বাক্বারার ১৮৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ১২তম মাসআলায় তিনি রামাযান মাসে দিনের বেলায় ভুলক্রমে আহারকারীর বিধান সম্পর্কে আলেমদের মতভেদ উল্লেখ করেছেন। এ ব্যাপারে ইমাম মালেক (রহঃ)-এর অভিমত হ’ল সে ছিয়াম ভঙ্গকারী বলে সাব্যস্ত হবে এবং তাকে ঐ দিনের ছিয়ামের কাযা আদায় করতে হবে। কিন্তু ইমাম কুরতুবী তাঁর মত প্রত্যাখ্যান করে বলেন,
 
وَعِنْدَ غَيْرِ مَالِكٍ: لَيْسَ بِمُفْطِرٍ كُلُّ مَنْ أَكَلَ نَاسِيًا لِصَوْمِهِ. قُلْتُ: وَهُوَ الصَّحِيحُ، وبه قال الجمهور: إن مَنْ أَكَلَ أَوْ شَرِبَ نَاسِيًا فَلَا قَضَاءَ عَلَيْهِ وَإِنَّ صَوْمَهُ تَامٌّ، لِحَدِيثِ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِذَا أَكَلَ الصَّائِمُ نَاسِيًا أَوْ شَرِبَ نَاسِيًا فَإِنَّمَا هُوَ رِزْقٌ سَاقَهُ اللهُ تَعَالَى إِلَيْهِ وَلَا قَضَاءَ عَلَيْهِ وَفِي رِوَايَةٍ وَلْيُتِمَّ صَوْمَهُ فَإِنَّ اللهَ أَطْعَمَهُ وَسَقَاهُ-
 
‘ইমাম মালেক ব্যতীত অন্যদের নিকটে যে ব্যক্তি ভুলে আহার করবে সে ছিয়াম ভঙ্গকারী হবে না। আমার (কুরতুবী) বক্তব্য হ’ল, এ মতটিই সঠিক। অধিকাংশ বিদ্বান এ মতের প্রবক্তা যে, যে ছিয়াম অবস্থায় ভুলে কিছু খেয়ে ফেলবে বা পান করবে তাকে ছিয়াম কাযা করতে হবে না এবং তার ছিয়াম পূর্ণ হয়ে যাবে। কেননা আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘ছায়েম যদি ভুল করে খেয়ে ফেলে বা পান করে তাহ’লে সেটি আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক বলে গণ্য হবে। আর তার ওপর কোন কাযা নেই। অন্য বর্ণনায় আছে, এমতাবস্থায় সে যেন তার ছিয়াম পূর্ণ করে নেয়। কেননা আল্লাহ তাকে খাওয়াছেন ও পান করায়েছেন’।[37]
 
অনুরূপভাবে সূরা বাক্বারার ৪৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ১৬তম মাসআলায় ছোটদের ইমামতি জায়েয কি-না এ ব্যাপারে পক্ষ-বিপক্ষের মতামত উল্লেখ করেছেন। অতঃপর ছোটদের ইমামতি জায়েয না হওয়া সম্পর্কে ইমাম মালেক ও অন্যদের মতের বিরোধিতা করে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন,قٌلْتُ : إِمَامَةُ الصَّغِيرِ جَائِزَةٌ إِذَا كَانَ قَارِئًا ‘আমার বক্তব্য হ’ল, ছোট বাচ্চা যদি ক্বারী হয় তাহ’লে তার ইমামতি জায়েয’।[38] এর প্রমাণ স্বরূপ তিনি বুখারীর একটি হাদীছ পেশ করেছেন, যেখানে ৬/৭ বছরের এক বালক ক্বারীর ছালাতে ইমামতির কথা উল্লেখ আছে।[39] উপরোক্ত দু’টি উদাহরণ থেকে স্পষ্টতঃ বুঝা যাচ্ছে যে, ইমাম কুরতুবী (রহঃ) মাযহাবী গোঁড়ামি পরিহার করে দলীলকে প্রাধান্য দিতেন।
 
৫. ইস্রাইলী বর্ণনার স্বল্পতা :
 
তাফসীরে কুরতুবীতে তুলনামূলকভাবে ইস্রাইলী বর্ণনা অনেক কম।[40] ভূমিকায় এদিকে ইঙ্গিত করে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন,وَأَضْرِبُ عَنْ كَثِيرٍ مِنْ قَصَصِ المفسرين، وأخبار المؤرخين، إلا ما لا بُدَّ مِنْهُ وَلَا غِنًى عَنْهُ لِلتَّبْيِينِ، ‘আমরা মুফাস্সিরদের বর্ণিত বহু কাহিনী এবং ঐতিহাসিকদের বর্ণিত অনেক ঘটনা উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকব। তবে ব্যাখ্যার জন্য যতটুকু উল্লেখ না করলেই নয় ততটুকু উল্লেখ করব’।[41]
 
ড. আবু শাহবার মতে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) তাঁর তাফসীরকে অধিক ইস্রাঈলী বর্ণনা ও জাল হাদীছ থেকে মুক্ত রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। যেমনভাবে তিনি ফেরেশতামন্ডলী ও নবীদের নিষ্পাপত্ব বা আক্বীদায় ঘাটতি সৃষ্টিকারী কিছু ইস্রাঈলী ও জাল বর্ণনা উল্লেখ করার পর সেগুলি বাতিল বলে সাব্যস্ত করেছেন বা যঈফ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন, হারূত ও মারূতের ঘটনা, দাঊদ ও সুলায়মান (আঃ)-এর ঘটনা, গারানীকের ঘটনা, যায়নাব বিনতে জাহাশ (রাঃ)-এর সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর বিবাহের ঘটনা প্রভৃতি।[42] এসব ইস্রাঈলী ঘটনা বাতিল সাব্যস্তকরণের সময় কখনো তিনি সনদসহ পুরো ঘটনা উল্লেখ করে মুফাসসির ও আলেমদের অভিমত উল্লেখ পূর্বক সেগুলির দীর্ঘ সমালোচনা করেছেন এবং তা খন্ডন করেছেন। আবার কখনো সনদ বাদ দিয়ে শুধু মূল ঘটনা সংক্ষেপে উল্লেখ করত সেগুলি খন্ডন করেছেন এবং তার দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।[43]
 
যেমন হারূত ও মারূত নামক ফেরেশতাদ্বয় সম্পর্কে ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীছ বর্ণনা করার পর তিনি বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য হ’ল, ইবনু ওমর প্রমুখ থেকে এসব বর্ণনা প্রমাণিত হওয়া তো দূরের কথা; বরং তা যঈফ। এর কোনকিছুই বিশুদ্ধ নয়। কারণ এটি এমন একটি কথা, ফেরেশতাদের ব্যাপারে মূলনীতি যাকে প্রত্যাখ্যান করে। যারা আল্লাহর অহি-র যথার্থ আমানতদার এবং তাঁর রাসূলগণের নিকট প্রেরিত দূত’।[44]
 
৬. বাতিল ফিরক্বা সমূহের মত খন্ডন :
 
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের একজন বড় আলেম ছিলেন। তিনি তাঁর তাফসীরে খারেজী, মু‘তাযিলা, শী‘আ, ক্বাদারিয়াহ, মুরজিয়া, চরমপন্থী ছূফী প্রভৃতি বাতিল ফিরক্বা সমূহের মত খন্ডন করেছেন।[45] ভূমিকায় তিনি وَالرَّدِّ عَلَى أَهْلِ الزَّيْغِ وَالضَّلَالَاتِ বলে এদের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
 
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে পরিবর্তন করবে এবং এমন বিদ‘আত সৃষ্টি করবে, যা আল্লাহ পসন্দ করেন না এবং যে বিষয়ে তিনি অনুমতিও দেননি, সে হাউযে কাওছার থেকে বিতাড়িত, দূরে অবস্থানকারী এবং কালো মুখমন্ডলের অধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিতাড়িত ও দূরে অবস্থানকারী হবে ঐ ব্যক্তি, যে মুসলমানদের জামা‘আতের বিরোধিতা করেছে এবং তাদের পথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যেমন খারেজীরা তাদের বিভিন্ন ফিরক্বার ভিত্তিতে, রাফেযীরা তাদের সৃষ্ট গোমরাহীর কারণে এবং মু‘তাযিলারা তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রবৃত্তি পূজার কারণে। এরা সবাই দ্বীনের মধ্যে পরিবর্তনকারী এবং বিদ‘আত সৃষ্টিকারী’।[46]
 
সা‘দ বিন আবু ওয়াক্কাছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, কোন এক যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন আলী (রাঃ)-কে তার স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করেছিলেন তখন আমি তাঁকে বলতে শুনেছি,أَمَا تَرْضَى أَنْ تَكُونَ مِنِّى بِمَنْزِلَةِ هَارُونَ مِنْ مُوسَى غَيْرَ أَنَّهُ لاَ نَبِىَّ بَعْدِى ‘তুমি কি মূসা (আঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত হারূণ (আঃ)-এর মতো আমার স্থলাভিষিক্ত হ’তে রাযী আছ? তবে জেনে রাখ যে, আমার পরে আর কোন নবী নেই’।[47] ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, ‘এই হাদীছ দ্বারা রাফেযী, ইমামিয়াহ ও শী‘আদের সকল দল-উপদল এ বিষয়ে প্রমাণ পেশ করেছে যে, নবী করীম (ছাঃ) আলী (রাঃ)-কে সকল উম্মতের উপর খলীফা নিযুক্ত করেছিলেন। এমনকি ইমামিয়ারা ছাহাবীদেরকে কাফের সাব্যস্ত করেছে। আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছিত করুন! কেননা তাদের দৃষ্টিতে ছাহাবীরা আলী (রাঃ)-এর খলীফা হওয়ার নছের উপর আমল পরিত্যাগ করেছে এবং ইজতিহাদের মাধ্যমে তাদের মধ্য থেকে আলী ব্যতীত অন্য ব্যক্তিকে খলীফা নিযুক্ত করেছে। শী‘আদের মধ্যে অনেকে আলী (রাঃ)-কে কাফের সাব্যস্ত করেছে। কারণ তিনি তার খলীফা হওয়ার দাবী উত্থাপন করেননি। এদের কাফের হওয়ার ব্যাপারে এবং যারা তাদের কথা অনুসরণ করে তাদের কাফের হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তারা জানে না যে, এটি ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় স্থলাভিষিক্ত নিযুক্তকরণ। যেমন প্রতিনিধি নিযুক্তকারীর পদচ্যুতি বা মৃত্যুর মাধ্যমে কাউকে প্রতিনিধি নিযুক্তির বিষয়টি শেষ হয়ে যায়। তার মৃত্যুর পরেও তা বহাল থাকার দাবী করে না। এর মাধ্যমে ইমামিয়াহ ও অন্যরা যে বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত সেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
 
নবী করীম (ছাঃ) ইবনে উম্মে মাকতূম ও অন্যদেরকে মদীনার দায়িত্বশীল নিযুক্ত করেছিলেন। এর মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে তাদের স্থায়ী খলীফা হওয়া আবশ্যক হয় না। আর একথার ভিত্তিতেও যে, হারূণ (আঃ)-কে মূসা (আঃ)-এর সাথে মূল রিসালাতে শরীক করা হয়েছিল। এতে তারা যে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছে তার কোন দলীল নেই। হেদায়াত লাভের তাওফীকদাতা একমাত্র আল্লাহ’।[48]
 
অনুরূপভাবে তিনি মু‘তাযিলাদের অভিমত বান্দা তার কর্মের স্রষ্টা এবং জ্ঞান যাকে সুন্দর বলে সেটিই সুন্দর প্রভৃতি ভ্রান্ত মতবাদ খন্ডন করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সঠিক আক্বীদা প্রমাণ করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ বান্দার কর্মের স্রষ্টা এবং বান্দা কর্ম বাস্তবায়নকারী। আর আক্বল নয়, বরং শরী‘আতই ভাল-মন্দের মানদন্ড।[49] {{sfn|তাফসীরে কুরতুবী ১/৬, ভূমিকা দ্রঃ [12]. ঐ, ১/৭-৭৬।
 
[13]. ঐ, ১/৭৭-৮১।
 
[14]. ঐ, ১/৮১-৮৯।
 
[15]. ঐ, ১/৮৯-৯২।
 
[16]. ঐ ১/৯২-১০৬।
 
[17]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ১০৯।
 
[18]. তাফসীরে কুরতুবী ১/৬।
 
[19]. ঐ ১/২৬৯।
 
[20]. ঐ, ৬/৭২, মায়েদাহ ৬ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র.।
 
[21]. ঐ, ২/২০২, বাক্বারাহ ১৮৫ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র.।
 
[22]. ঐ, ১/১০৭।
 
[23]. তাফসীরে কুরতুবী, তাহকীক্ব : আব্দুর রায্যাক আল-মাহদী (বৈরূত : দারুল কিতাবিল আরাবী, ১৪২৪/২০০৪), ১/৭।
 
[24]. তাফসীরে কুরতুবী ১/৬, ভূমিকা দ্রঃ।
 
[25]. তাহকীক্ব তাফসীরে কুরতুবী ১/৭।
 
[26]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ১১১।
 
[27]. তাফসীরে কুরতুবী ১/৯৪।
 
[28]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা হা/৬০০।
 
[29]. তাহকীক্ব তাফসীরে কুরতুবী ১/১৭৯, হা/২২৬।
 
[30]. আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ, আত-তা‘লীকাতুল হাফিলাহ আলাল আজবিবাহ আল-ফাযিলাহ (আলেপ্পো : মাকতাবুল মাতবূ‘আত আল-ইসলামিইয়াহ, ২য় সংস্করণ, ১৪০৪/১৯৮৪), পৃঃ ১৩৬-১৩৯।
 
[31]. ড. আল-কাছাবী মাহমূদ যালাত, আল-কুরতুবী ওয়া মানহাজুহু ফিত-তাফসীর (বৈরূত : আল-মারকাযুল আরাবী লিছ ছাক্বাফাতি ওয়াল উলূম, তাবি), পৃঃ ৩৪৪।
 
[32]. ড. মুহাম্মাদ হুসাইন আয-যাহাবী, আত-তাফসীর ওয়াল মুফাস্সিরূন (কায়রো : মাকতাবা অহবাহ, ১৯৭৬), ২/৩৩৮।
 
[33]. তাফসীরে কুরতুবী, ২/১৪২, বাক্বারাহ ১৭০ আয়াতের তাফসীর দ্রঃ।
 
[34]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ১৬৫।
 
[35]. ঐ, পৃঃ ৫৮, ১৬৫।
 
[36]. আয-যায়ল ওয়াত তাকমিলাহ ৩/৪৯৫।
 
[37]. দারাকুৎনী হা/২২৬৫,২২৬৭, দারাকুৎনী বলেন, হাদীছটি ছহীহ ও এর সকল রাবী ছিকাহ বা নির্ভরযোগ্য; ইবনু খুযায়মাহ হা/১৯৯০; ইবনু হিববান হা/৩৫২১; এর শাহেদ দ্র. বুখারী হা/১৯৩৩; মুসলিম হা/১১৫৫; তাফসীরে কুরতুবী ২/২১৫, ঐ তাহকীক্ব ২/৩১৯, হা/৯৩৮।
 
[38]. তাফসীরে কুরতুবী ১/২৪০।
 
[39]. বুখারী হা/৪৩০২(فَنَظَرُوا فَلَمْ يَكُنْ أَحَدٌ أَكْثَرَ قُرْآنًا مِنِّى، لِمَا كُنْتُ أَتَلَقَّى مِنَ الرُّكْبَانِ، فَقَدَّمُونِى بَيْنَ أَيْدِيهِمْ، وَأَنَا ابْنُ سِتٍّ أَوْ سَبْعِ، سِنِينَ)
 
[40]. লেখক মন্ডলী, মু‘জামু তাফাসীরিল কুরআনিল কারীম (আইসিসকো : ১৪১৭/১৯৯৭), পৃঃ ৪৮৩।
 
[41]. তাফসীরে কুরতুবী ১/৬।
 
[42]. ড. মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আবু শাহবাহ, আল-ইস্রাঈলিয়্যাত ওয়াল মাওযূ‘আত ফী কুতুবিত তাফসীর (কায়রো : মাকতাবাতুস সুন্নাহ, ৪র্থ সংস্করণ, ১৪০৮ হিঃ), পৃঃ ১৩৭।
 
[43]. মাদরাসাতুত তাফসীর ফিল আন্দালুস, পৃঃ ৫৬০।
 
[44]. তাফসীরে কুরতুবী ২/৩৬, বাক্বারাহ ১০২ আয়াতের তাফসীর দ্র.।
 
[45]. মান্নাউল ক্বাত্তান, মাবাহিছ ফী উলূমিল কুরআন (রিয়াদ : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ১৪২১/২০০০), পৃঃ ৩৯০; আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ২৩৬-৩৭।
 
[46]. তাফসীরে কুরতুবী ৪/১০৮, আলে ইমরান ১০৬ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র.।
 
[47]. মুসলিম হা/২৪০৪।
 
[48]. তাফসীরে কুরতুবী ৭/১৭৬-৭৭, আ‘রাফ ১৪২ আয়াতের তাফসীর দ্র.।
 
[49]. ড. সুলায়মান আল-কার‘আবী ও ড. মুহাম্মাদ বিন আলী আল-হাসান, আল-বায়ান ফী উলূমিল কুরআন (সঊদী আরব : মাকতাবাতুয যিলাল, ২য় সংস্করণ, ১৪১৫/১৯৯৪), পৃঃ ৩৯০।}}
 
==তাফসীরে কুরতুবীর ইলমী মূল্য==
 
১. ইবনু ফারহূন (৭৬০-৭৯৯ হিঃ) বলেন,وهو من أجل التفاسير وأعظمها نفعاً أسقط منه القصص والتواريخ وأثبت عوضها أحكام القرآن واستنباط الأدلة وذكر القراءات والإعراب والناسخ والمنسوخ ‘এটি অত্যন্ত উপকারী গুরুত্বপূর্ণ তাফসীর গ্রন্থ সমূহের অন্যতম। তিনি এই তাফসীর থেকে কিচ্ছা-কাহিনী ও ঐতিহাসিক ঘটনার অবলুপ্তি ঘটিয়ে তদস্থলে কুরআনের বিধি-বিধান ও দলীল সাব্যস্ত করেছেন। তাছাড়া তিনি ক্বিরাআত, ই‘রাব এবং নাসিখ ও মানসূখ উল্লেখ করেছেন’।[50]
 
২. ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হিঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, যামাখশারী, কুরতুবী ও বাগাবীর তাফসীর কি কুরআন ও সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী, নাকি অন্য কোন তাফসীর? এর জবাবে তাফসীরে কাশশাফকে মু‘তাযিলা আক্বীদাপুষ্ট তাফসীর হিসাবে আখ্যায়িত করার পর তিনি বলেন,وتَفْسِيرُ الْقُرْطُبِيِّ خَيْرٌ مِنْهُ بِكَثِيرٍ، وَأَقْرَبُ إِلَى طَرِيقَةِ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ، وَأَبْعَدُ مِنَ الْبِدَعِ ‘তাফসীরে কুরতুবী এর চেয়ে অনেক ভাল। এটি কুরআন-সুন্নাহর অনুসারীদের তরীকার অধিক নিকটবর্তী এবং বিদ‘আত থেকে অনেক দূরে’।[51]
 
৩. হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮ হিঃ) বলেন, وقد سارت بتفسيره العظيم الشّأن الرُّكْبان، وهو كامل فِي معناه ‘তাঁর বিশাল মর্যাদাপূর্ণ তাফসীরটি কাফেলা সাথে করে নিয়ে গেছে। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ তাফসীর’।[52]
 
৪. ইবনু শাকির আল-কুতুবী (৬৮৬-৭৬৪ হিঃ) বলেন, وهو مليح إلى الغاية ‘এটি অত্যন্ত চমৎকার তাফসীর’।[53]
 
৫. ছালাহুদ্দীন ছাফাদী (৬৯৬-৭৬৪ হিঃ) বলেন, وَقد سَارَتْ بتفسيره الركْبَان وَهُوَ تَفْسِير عَظِيم فِي بَابه ‘তাঁর তাফসীরটি নিয়ে আরোহীদল দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ তাফসীর’।[54]
 
৬. জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (৮৪৯-৯৯১ হিঃ) বলেন,مصنف التفسير المشهور، الذي سارت به الركبان ‘প্রসিদ্ধ তাফসীরের রচয়িতা। যে তাফসীর নিয়ে আরোহীদল (পৃথিবীব্যাপী) ছড়িয়ে পড়েছিল’।[55]
 
৭. ঐতিহাসিক ইবনে খালদূন (৭৩২-৮০৮ হিঃ) তাঁর প্রসিদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থ ‘কিতাবুল ইবার’-এর ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন যে, প্রাচ্যে তাফসীরে কুরতুবীর ব্যাপক খ্যাতি ছিল।[56]
 
৮. ইবনুল ইমাদ হাম্বলী (১০৩২-১০৮৯ হিঃ) বলেন,والتفسير الجامع لأحكام القرآن الحاكي مذاهب السلف كلها وما أكثرَ فوائدَهُ ‘আল-জামি লি-আহকামিল কুরআন তাফসীরটি পূর্ববর্তী বিদ্বানদের সকল মাযহাবের কথা বর্ণনাকারী। এর উপকারিতা অনেক বেশী’।[57]
 
৯. হাজী খলীফা (১০১৭-১০৬৮ হিঃ) বলেন,وهو كتاب كبير مشهور بتفسير القرطبي في مجلدات ‘তাফসীরে কুরতুবী নামে প্রসিদ্ধ কয়েক খন্ডে বিভক্ত এটি একটি বড় গ্রন্থ’।[58]
 
১০. আধুনিক সালাফী বিদ্বান শায়খ মুহাম্মাদ বাহজাতুল বায়তার (১৮৯৪-১৯৭৬) বলেন,إن هذا التفسير جامع، وبيانه رائع ‘এই তাফসীরটি সারগর্ভ এবং এর বর্ণনা চমৎকার’।[59]
 
১১. ড. মুহাম্মাদ হুসাইন আয-যাহাবী বলেন, وعلى الجملة فإن القرطبى رحمه الله فى تفسيره هذا حُرٌّ فى بحثه، نزيهٌ فى نقده، عفٌّ فى مناقشته وجدله، مُلِمٌّ بالتفسير من جميع نواحيه، بارع فى كل فن استطرد إليه وتكلَّم فيه- ‘মোটকথা, কুরতুবী (রহঃ) তাঁর এই তাফসীরে স্বাধীন গবেষক এবং সমালোচনা, পর্যালোচনা ও বিতর্কে নিষ্কলুষ ব্যক্তি হিসাবে পরিদৃষ্ট হন। তিনি এতে তাফসীরের সকল দিকের প্রতি খেয়াল রেখেছেন। তিনি এতে যে সকল বিষয়ের অবতারণা করেছেন এবং যেসব বিষয়ে আলোচনা করেছেন তাতে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন’।[60]
 
১২. الموسوعة العربية العالمية বিশ্বকোষে বলা হয়েছে,وهو تفسير كامل عنى فيه بالمسائل الفقهية إلى جانب العلوم الأخرى، ‘এটি একটি পূর্ণাঙ্গ তাফসীর। এতে ফিক্বহী মাসআলা-মাসায়েল-এর প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য জ্ঞানও আলোচিত হয়েছে’।[61]
 
১৩. জীবনীকার শায়খ মাশহূর হাসান বলেন,ولا شك أنه أهم آثاره العلمية، وأنه ذو قيمة عالية بين كتب التفسير- ‘নিঃসন্দেহে তাফসীরে কুরতুবী তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইলমী অবদান। তাফসীর গ্রন্থ সমূহের মাঝে এটির মূল্য অপরিসীম’।[62]
 
১৪. আধুনিক গবেষক আমির বিন ঈসা আল-লাহব বলেন, فهو فريد في بابه لايستغنى عنه العالم فضلا عن طالب العلم، ‘এটি একটি মূল্যবান তাফসীর। ছাত্র তো দূরের কথা, কোন আলেমও এ থেকে অমুখাপেক্ষী থাকতে পারে না’।[63]
 
১৫. তাফসীরে কুরতুবী ও তাফসীর ইবনে কাছীরের প্রসিদ্ধ মুহাক্কিক্ব আব্দুর রায্যাক আল-মাহদী বলেন,التفاسير الفقهية وهى كثيرة، وأعظمها وأكثرها جمعا، تفسير القرطبي، فإنه جمع فأوعى حيث سرد أقوال الفقهاء وأدلتهم بإنصاف وأمانة. ‘ফিক্বহী তাফসীরের সংখ্যা অনেক। তন্মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে বেশী বক্তব্য সংকলনকারী হল তাফসীরে কুরতুবী। কেননা তিনি সংকলন ও সংরক্ষণ করেছেন এবং ইনছাফ ও আমানতের সাথে ফকীহদের বক্তব্য ও তাদের দলীল সমূহ উল্লেখ করেছেন’।[64] তিনি আরো বলেন,فهذا التفسير من أنفع التفاسير، وأحسنها فى ميدانه- ‘এটি উপকারী ও সুন্দর তাফসীর সমূহের অন্যতম’।[65]
 
১৬. ড. ফাহ্দ বিন আব্দুর রহমান বিন সুলায়মান আর-রূমী বলেন,وتفسير ابن العربى والقرطبى أفضل وأشهر تفاسير آيات الأحكام القرآنية حتى يومنا هذا- ‘ইবনুল আরাবী ও কুরতুবীর তাফসীর কুরআনের আহকাম সংক্রান্ত আয়াত সমূহের তাফসীরগুলির মধ্যে অদ্যাবধি শ্রেষ্ঠ ও প্রসিদ্ধ’।[66]
 
১৭. তাফসীরে কুরতুবীর উর্দূ অনুবাদক ড. হাফেয ইকরামুল হক ইয়াসীন বলেন, ‘আল্লামা কুরতুবীর এই বিশাল অবদান মূলতঃ ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের Encyclopedia বা বিশ্বকোষ। যাতে তাফসীর, হাদীছ, ফিক্বহ ও অন্যান্য ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক মূল্যবান ভান্ডার এক জায়গায় পাওয়া যায়। আলেমগণ প্রথম দেখাতেই এর জ্ঞানগত মর্যাদার প্রশংসা না করে থাকতে পারেন না। ছাত্ররা তাদের জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণের জন্য একে সুমিষ্ট ঝরণা মনে করে। আর সাধারণ মানুষের জন্য এটি জ্ঞানের এক বিশাল ভান্ডার’।[67] {{sfn|[50]. আদ-দীবাজ আল-মুযাহ্হাব ২/৩০৯।
 
[51]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া ১৩/৩৮৭; ঐ, মুক্বাদ্দামা ফী উছূলিত তাফসীর (বৈরূত : দারু ইবনে হাযম, ২য় সংস্করণ, ১৪১৮/১৯৯৭), পৃঃ ১১৩।
 
[52]. তারীখুল ইসলাম ৫০/৭৫।
 
[53]. উয়ূনুত তারীখ ২১/৩৭।
 
[54]. আল-ওয়াফী বিল অফায়াত ২/৮৭।
 
[55]. ত্বাবাক্বাতুল মুফাস্সিরীন, পৃঃ ৯২।
 
[56].وتبعه القرطبى فى تلك الطريقة على منهاج واحد فى كتاب آخر مشهور بالشرق দ্র: মুক্বাদ্দামা ইবনে খালদূন (কায়রো : দারু ইবনিল জাওযী, ১ম প্রকাশ, ২০১০), পৃঃ ৩৭২, অধ্যায়-৬, অনুচ্ছেদ-১১।
 
[57]. শাযারাতুয যাহাব ৭/৫৮৫।
 
[58]. কাশফুয যুনূন (বৈরূত : দারু ইহ্ইয়াইত তুরাছিল আরাবী, তাবি), ১/৫৩৪, ‘জীম’ অধ্যায়।
 
[59]. মাজাল্লাতুল মুজাম্মা আল-ইলমী আল-আরাবী, দামেশক, বর্ষ ২০, সংখ্যা ১১-১২, অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৯৪৫, পৃঃ ৫৬৫।
 
[60]. আত-তাফসীর ওয়াল মুফাস্সিরূন ২/৩৪১।
 
[61]. আল-মাওসূ‘আতুল আরাবিয়্যাহ আল-আলামিয়্যাহ (রিয়াদ : মুআস্সাসাতু আ‘মালিল মাওসূ‘আহ, ২য় সংস্করণ, ১৪১৯/১৯৯৯), ১৮শ খন্ড, পৃঃ ১৬৩।
 
[62]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৯৮।
 
[63]. ঐ, মানহাজুল ইমাম আল-কুরতুবী ফী তাফসীরে আয়াতিল আহকাম ফী কিতাবিহি আল-জামে লি-আহকামিল কুরআন, দিরাসাতুন তাহলীলিয়াহ, ১৪২৯/২০০৮; k-tb.com/book/Quraan07064-منهج-الإمام-القرطبي-في- ।
 
[64]. তাফসীর ইবনে কাছীর, তাহকীক্ব: আব্দুর রায্যাক আল-মাহদী (বৈরূত: দারুল কিতাবিল আরাবী, ১৪৩২/২০০১), ১ম খন্ড, পৃঃ ৭।
 
[65]. তাহকীক্ব তাফসীরে কুরতুবী ১/৮।
 
[66]. ঐ, মানহাজুল মাদরাসাহ আল-আন্দালুসিয়াহ ফিত-তাফসীর ছিফাতুহু ওয়া খাছায়িছুহু (রিয়াদ : মাকতাবাতুত তাওবাহ, ১৪১৭/১৯৯৭), পৃঃ ১৬।
 
[67]. তাফসীরে কুরতুবী (উর্দূ অনুবাদ), ১ম খন্ড, পৃঃ lxxiii।}}
 
==পরবর্তী মুফাস্সিরদের উপর তাফসীরে কুরতুবীর প্রভাব==
 
তাফসীরে কুরতুবীর গুরুত্ব, খ্যাতি ও মর্যাদা উল্লেখিত উক্তি সমূহ থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। স্বভাবতঃই পরবর্তী মুফাস্সিরগণ ইমাম কুরতুবী (রহঃ)-এর তাফসীর দ্বারা উপকৃত ও প্রভাবিত হয়েছেন। এদের মধ্যে হাফেয ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হিঃ) ও ইমাম শাওকানী (১১৭৩-১২৫০ হিঃ) (রহঃ)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা দু’জন তাফসীরে কুরতুবী থেকে অনেক বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। তবে ইবনু কাছীর (রহঃ) কুরতুবীর বক্তব্যের মর্মার্থ উল্লেখ করেছেন, নছ নয়।[68] তাছাড়া খতীব শারবীনী (মৃঃ ৯৭৭ হিঃ) তাঁর আস-সিরাজুল মুনীর, সুলায়মান বিন ওমর (মৃঃ ১২০৪ হিঃ) তাফসীরে জালালাইন-এর হাশিয়া আল-ফুতূহাত আল-ইলাহিয়াহ, আবুস সঊদ (মৃঃ ৯৮২ হিঃ) তাঁর ইরশাদুল আকলিস সালীম, নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী (১২৪৮-১৩০৭ হিঃ) তাঁর ফাতহুল বায়ান ফী মাক্বাছিদিল কুরআন এবং শানক্বীতী (মৃঃ ১৩৯৩ হিঃ) তাঁর আযওয়াউল বায়ান-এ তাফসীরে কুরতুবীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।[69] {{sfn|[68]. আল-কুরতুবী ওয়া মানহাজুহু ফিত-তাফসীর, পৃঃ ৪১৮-৪২৬।
 
[69]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ১০১; ড. মিফতাহ সানূসী, আল-কুরতুবী হায়াতুহু ওয়া আছারুহুল ইলমিইয়াহ ওয়া মানহাজুহু ফিত-তাফসীর (লিবিয়া : বেনগাযী বিশ্ববিদ্যালয়, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৮), পৃঃ ২৯৩; তারজীহাতুল কুরতুবী ফিত-তাফসীর, পৃঃ ২৭।
}}
 
==ইমাম কুরতুবী (রহঃ)-এর রচনা সমূহ==
 
২. আত-তাযকিরাহ বি-আহওয়ালিল মাওতা ওয়া উমূরিল আখিরাহ : ইমাম কুরতুবী (রহঃ)-এর গ্রন্থ সমূহের মাঝে তাফসীরে কুরতুবীর পর এটি সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও বহুল পঠিত। শায়খ মুহাম্মাদ মাখলূফ (মৃঃ ১৩৬০ হিঃ) উক্ত গ্রন্থের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, كتاب ليس له مثيل فى بابه ‘এটি এমন একটি গ্রন্থ, যার তুলনীয় কোন গ্রন্থ নেই’।[1] হাজী খলীফা বলেন, هو كتاب مشهور فى مجلد ضخم ‘বৃহৎ একটি খন্ডে সংকলিত এটি একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ’।[2] শায়খ শিহাবুদ্দীন করাফী বলেন, من أراد استيعابه، فعليه به ‘যে ব্যক্তি (ক্বিয়ামতের দিন সিঙ্গায় ফুঁৎকার দেওয়ার বিষয়ে) অবগত হতে চায়, সে যেন আত-তাযকিরাহ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করে’।[3]
 
আধুনিক কয়েকজন গবেষক বলেছেন, لقد سمت مكانته بين الخاصة والعامة، وجل المؤلفات فى هذا الباب تعتمد عليه، وهو بلا منازع مؤلف فريد فى نوعه. ‘সাধারণ মানুষ ও বিশিষ্ট ব্যক্তি সবার মাঝে এ গ্রন্থটি উচ্চমর্যাদা লাভ করেছে। এ বিষয়ে রচিত অধিকাংশ গ্রন্থ এর উপর নির্ভর করে। নিঃসন্দেহে এটি একটি অনন্য গ্রন্থ’।[4]
 
ইমাম কুরতুবী (রহঃ)-এর যুগে মানুষ মৃত্যু ও আখিরাতকে ভুলে গিয়ে দুনিয়া নিয়ে অত্যন্ত ব্যতি-ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তদানীন্তন সময়ের মানুষদের এহেন দুনিয়ালিপ্সা দর্শনে ব্যথিত হয়ে মানুষকে পরকালমুখী করার জন্য ইমাম কুরতুবী (রহঃ) উক্ত গ্রন্থটি ৬৫৮ হিজরীর পরে রচনা করেন।[5]
 
এর ভূমিকায় ইমাম কুরতুবী (রহঃ) এটি রচনার উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে বলেন,فإني رأيتُ أنْ أَكتُبَ كِتابًا وجيزًا، يكون تَذْكِرةً لِنَفْسِي وعملاً صالحًا بعد موتي فى ذِكْرِ الموتِ، وأحْوالِ الموْتى، وذِكْرِ الحشْرِ، والنشرِ، والجنّةِ، والنّارِ، والفِتَنِ، والأشرَاطِ. ‘আমি মৃত্যু, মৃত ব্যক্তিদের অবস্থা সমূহ, পুনরুত্থান, জান্নাত, জাহান্নাম, ফিৎনা সমূহ ও ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ লেখার মনস্থ করলাম। যেটি আমার নিজের জন্য নছীহত এবং আমার মৃত্যুর পরে আমার জন্য সৎকর্ম হবে’।[6]
 
এতে অনুসৃত পদ্ধতি সম্পর্কে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন,
 
نَقلْتُه مِن كُتبِ الأئمة، وثقات أعلام هذه الأمة حسبَ ما رويته أو رأيته، وسترى ذلك منسوبا مبينا إن شاء الله ةعالى، وسميةه: كةاب الةذكرة بأحوال الموةى وأمور الآخرة. وبوبته بابا بابا، وجعلت عقب كل باب فصلا أو فصولا نذكر فيه ما يُحتاج إليه من بيان غريب، أو فقه في حديث، أو إيضاح مشكل، لتكمُلَ فائدته، وتعظُمَ منفعته،
 
‘আমি ইমামদের ও এই উম্মতের নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিছদের গ্রন্থ সমূহ থেকে এ গ্রন্থটি সংকলন করেছি। যেমনটা আমি বর্ণনা করেছি বা দেখেছি। ইনশাআল্লাহ আপনি তা সুস্পষ্ট উদ্ধৃতি সহ দেখতে পাবেন। আর আমি এর নামকরণ করেছি আত-তাযকিরাহ বি-আহওয়ালিল মাওতা ওয়া উমূরিল আখিরাহ। আমি গ্রন্থটিকে কতিপয় অধ্যায়ে বিন্যস্ত করেছি এবং প্রত্যেক অধ্যায়ের পরে এক বা একাধিক অনুচ্ছেদ উল্লেখ করেছি। আমি সেখানে দুর্বোধ্য শব্দের ব্যাখ্যা, ফিক্বহুল হাদীছ বা জটিল জিনিসের ব্যাখ্যা উল্লেখ করব। যাতে এর পূর্ণাঙ্গ ও বিশাল উপকারিতা হাছিল হয়’।[7]
 
গ্রন্থটির গুরুত্ব বিবেচনা করে ইমাম সুয়ূত্বী (রহঃ) ‘শারহুছ ছুদূর বি-হালিল মাওতা ওয়াল কুবূর’ এবং আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী (মৃঃ ৯৭৩) ‘মুখতাছার তাযকিরাতুল ইমাম আল-কুরতুবী’ নামে তা সংক্ষিপ্ত করেন। উভয়টিই প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন আলী নূরুদ্দীন সুহাইমী আযহারী (মৃঃ ১১৮৭) ‘আত-তাযকিরাতুল ফাখিরাহ ফী আহওয়ালিল আখিরাহ’ নামেও উক্ত গ্রন্থটি সংক্ষিপ্ত করেন। মিসরের দারুল কুতুব আল-মিসরিইয়াহ ও ইস্তাম্বুলের ফাতিহ গ্রন্থাগারে এর পান্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে।[8]
 
ড. ছাদেক বিন মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম ৩ খন্ডে এটি তাহক্বীক্ব করে পিএইচ.ডি ডিগ্রী লাভ করেছেন। রিয়াদের দারুল মিনহাজ থেকে ১৪২৫ হিজরীতে এটি প্রকাশিত হয়েছে। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৫৩৯। এ যাবৎ প্রকাশিত সংস্করণ সমূহের মাঝে এটি সবচেয়ে উপকারী ও গবেষণালব্ধ।
 
৩. আত-তিযকার ফী ফাযলিল আযকার :
 
ঐতিহাসিক ইবনু ফারহূন গ্রন্থটি সম্পর্কে বলেছেন,وضعه على طريقة التبيان للنووى لكن هذا أتم منه، وأكثر علما، ‘ইমাম নববীর আত-তিবয়ান ফী আদাবি হামালাতিল কুরআন গ্রন্থের আদলে তিনি এটি রচনা করেছেন। কিন্তু এটি তার চেয়ে বেশী পূর্ণাঙ্গ ও জ্ঞানগর্ভ’।[9]
 
তাফসীরে কুরতুবীর পর ইমাম কুরতুবী (রহঃ) এটি রচনা করেন বলে প্রতিভাত হয়। গ্রন্থটির বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে ইমাম কুরতুবী নিজেই বলেছেন,
 
فرأيت أن أكتب فى ذلك كتابا وجيزا على فضل القرآن وقارئه، ومستمعه، والعامل به، وحرمته، وحرمة القرآن، وكيفية تلاوته، والبكاء عنده، وفضل من قرأه معربا، وذم من قرأه رياء وعجبا، إلى غير ذلك مما تضمنه الكتاب، حسبما هو مبين في أبواب،
 
‘আমি এ বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ লেখার মনস্থ করলাম। কুরআন, কুরআনের পাঠক, এর শ্রবণকারী ও তার উপর আমলকারীর ফযীলত ও মর্যাদা, কুরআনের মর্যাদা, তেলাওয়াতের পদ্ধতি, কুরআন তেলাওয়াতকালে ক্রন্দন, বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াকারীর ফযীলত, লোক দেখানো ও দম্ভভরে পাঠকারীর নিন্দা প্রভৃতি। যা বিভিন্ন অধ্যায়ে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হবে’।[10]
 
গ্রন্থটি রচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ইমাম কুরতুবী বলেন,فاستخرت الله سبحانه فى ذلك، وسألته التيسير علىَّ فى ذلك، فيسر لي تخريج أربعين بابا فى فضل كتابه العزيز وقارئه ومستمعه والعامل به. ‘আমি গ্রন্থটি রচনার ব্যাপারে আল্লাহর নিকট ইস্তেখারা করলাম এবং তিনি যেন তা রচনা আমার জন্য সহজ করে দেন সেই তাওফীক চাইলাম। তিনি তার প্রিয় কিতাবের ফযীলত এবং এর পাঠক, শ্রোতা ও এর উপর আমলকারীর ফযীলত সম্পর্কে ৪০টি অধ্যায় রচনা করা আমার জন্য সহজ করে দিলেন’।[11] বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে এর একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।
 
৪. আল-আসনা ফী শারহি আসমাইল্লাহিল হুসনা ও ছিফাতিহিল উলয়া :
 
এ গ্রন্থে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) আল্লাহর গুণবাচক নাম সমূহ ও গুণাবলী সম্পর্কে সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। গবেষক তারেক আহমাদ মুহাম্মাদ এটি দুই খন্ডে তাহক্বীক্ব ও তাখরীজ করেছেন। ১৪১৬/১৯৯৫ সালে সর্বপ্রথম এই গ্রন্থটি মিসরের তানতার দারুছ ছাহাবাহ লিত-তুরাছ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮২৭।
 
উক্ত গ্রন্থের ১ম খন্ডের বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে ইমাম কুরতুবী নিজেই বলেছেন,وَذَكَرْنَا مِنَ الْأَسْمَاءِ مَا اجْتُمِعَ عَلَيْهِ وَمَا اخْتُلِفَ فِيهِ مِمَّا وَقَفْنَا عَلَيْهِ فِي كُتُبِ أَئِمَّتِنَا مَا يُنَيِّفُ عَلَى مِائَتَي اسْمٍ. ‘আমরা আমাদের ইমামদের কিতাব সমূহ থেকে অবগত হয়ে আল্লাহর দুই শতাধিক নাম উল্লেখ করেছি। এর মধ্যে কিছু নামের ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করা হয়েছে আর কিছু নামের ব্যাপারে মতভেদ করা হয়েছে’।[12]
 
আর ২য় খন্ডের বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন,
 
فلما ذكرنا ما وقفنا عليه من أسماء الله الحسنى، رأيت أن أضيف إليها ما لم أذكره من الآى والأحاديث التى جاء فيها من ذكر الصفات ما لم يتقدم له ذكر على جهة الاختصار والتقريب ردا على المجسمة وأصحاب التشبيه،
 
‘আমরা যখন আমাদের অবগতি অনুযায়ী আল্লাহর সুন্দর নাম সমূহ উল্লেখ করলাম, তখন আল্লাহর গুণাবলী সংক্রান্ত (কায়াবাদী) আয়াত ও হাদীছ সমূহ যা ইতিপূর্বে সংক্ষিপ্ততার কারণে উল্লেখ করিনি তা উল্লেখ করা পসন্দ করলাম। মুজাস্সিমাহ ও সাদৃশ্যবাদীদের খন্ডনে আমি এগুলি উল্লেখ করেছি’।[13] উক্ত গ্রন্থে তিনি কুরআন মাখলূক কি-না এ বিষয়ে আক্বীদা বর্ণনা করে বলেন,مذهب أهل السنة والجماعة أن القرآن كلام الله منزل غير مخلوق، منه بدأ وإليه يعود، ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মতে নিশ্চয়ই কুরআন আল্লাহর অবতীর্ণ কালাম বা বাণী, যা সৃষ্ট নয়। তাঁর নিকট থেকেই এর সূচনা হয়েছে এবং তার নিকটেই তা ফিরে যাবে’।[14]
 
গ্রন্থটি ৭৩১ হিজরীর রজব মাসে রচিত।[15] হাজী খলীফা এই গ্রন্থটি সম্পর্কে বলেছেন, وهذا الشرح كبير ومفيد ‘এই শরাহটি বড় ও উপকারী’।[16]
 
৫. কামউল হিরছ বিয-যুহদ ওয়াল কানা‘আহ ওয়া রাদ্দু যুল্লিস সুওয়াল বিল-কাসবি ওয়াছ ছিনা‘আহ : ঐতিহাসিক ইবনু ফারহূন গ্রন্থটি সম্পর্কে বলেন,لم أقف على تأليف أحسن منه فى بابه، ‘এ বিষয়ে এর চেয়ে ভাল কোন গ্রন্থের কথা আমি জানি না’।[17]
 
গ্রন্থটি রচনার কারণ ও অনুসৃত পদ্ধতি সম্পর্কে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন,فرأيت أن أجمع فى ذلك كتابا يكون جامعا، مهذبا، كتابا مقربا، يزيد على معانيها، ويربى على ما فيها، جعلته أربعين بابا، كل باب الحديث والحديثين والثلاثة، ثم عقبت ذلك بالتفسير والتبيان، ليكمل فائدته، ويعظم منفعته، ‘আমি এ সম্পর্কে একটি সারগর্ভ, পরিমার্জিত ও সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ সংকলনের ইচ্ছা পোষণ করলাম। যেটি এ বিষয়ে রচিত পূর্ববর্তী গ্রন্থ সমূহের চেয়ে বেশী তাৎপর্যপূর্ণ ও সমৃদ্ধ হবে। আমি এ গ্রন্থটিকে ৪০টি অধ্যায়ে বিভক্ত করেছি। প্রত্যেকটি অধ্যায়ে একটি, দু’টি বা তিনটি হাদীছ রয়েছে। অতঃপর আমি সেগুলি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছি। যাতে এর পূর্ণাঙ্গ ও বিশাল উপকারিতা হাছিল হয়’।[18]
 
২১৪ পৃষ্ঠার উক্ত গ্রন্থে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) দুনিয়ার প্রতি আগ্রহী হওয়ার অসুখের তিনটি চিকিৎসার কথা উল্লেখ করেছেন। ১. দুনিয়াতে আশা কম করা। ২. অল্পে তুষ্ট থাকা। ৩. দুনিয়াবিমুখতা।[19]
 
৬. আল-ই‘লাম বিমা ফী দ্বীনিছ নাছারা মিনাল মাফাসিদ ওয়াল আওহাম ওয়া ইযহারু মাহাসিনি দ্বীনিল ইসলাম : এ গ্রন্থটিকে ইমাম কুরতুবী (রহঃ)-এর দিকে নিসবত করা হয়েছে। জনৈক খ্রিস্টানের تثليث الوحدانية في معرفة الله শীর্ষক গ্রন্থের জবাবে তিনি এটি রচনা করেন।[20]
 
তবে এটি আদৌ ইমাম কুরতুবী রচিত কি-না তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। বরং এটাই সঠিক যে, এটি আল-মুফহিম শারহু ছহীহ মুসলিম গ্রন্থের লেখক ইমাম কুরতুবী (রহঃ)-এর শিক্ষক আবুল আববাস আল-কুরতুবী রচিত। আধুনিক গবেষক ড. আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন রুমাইয়ান ও হাসান ওয়ায়েল ইসমাঈল হাজ্জী এমনটিই প্রমাণ করেছেন।[21]
 
এছাড়া তাঁর আরো অনেক গ্রন্থ এখনো অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। আর কিছু মহাকালের করাল গ্রাসে হারিয়ে গেছে। এজন্য প্রাচীন জীবনীকারগণ তাঁর রচনা সমূহ সম্পর্কে বলেছেন,وله تآليف وتعاليق مفيدة غير هذه، ‘এগুলি ছাড়া তাঁর আরো অনেক উপকারী গ্রন্থ ও টীকা রয়েছে’।[22] ঐতিহাসিক ছাফাদী বলেন, وأشياء تدل على إمامته وكثرة اطلاعه ‘তাঁর আরো কিছু গ্রন্থ রয়েছে। যা তার ইমামত ও অধিক অধ্যবসায়ের প্রমাণ বহন করে’।[23]{{sfn|
[1]. ঐ, শাজারাতুন নূর আয-যাকিইয়াহ, তাখরীজ ও তা‘লীক : আব্দুল মাজীদ খিয়ালী (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-ইলমিইয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৪২৪/২০০৩), ১ম খন্ড, পৃঃ ২৮২, জীবনী ক্রমিক ৬৯৮।
 
[2]. কাশফুয যুনূন ১/৩৯০, বাবুত তা দ্র.।
 
[3]. শিহাবুদ্দীন কারাফী, আল-ইসতিগনা ফী আহকামিল ইসতিছনা, তাহকীক : ড. ত্বহা মুহসিন (বাগদাদ : মাতবা‘আতুল ইরশাদ, ১৪০২/১৯৮), পৃঃ ৪৪০।
 
[4]. আব্দুল্লাহ খালেদ ও অন্যান্য, কিতাব আত-তাযকিরাহ বি-আহওয়ালিল মাওতা ও উমূরিল আখিরাহ’ লিল ইমাম আল-কুরতুবী : দিরাসাতুন তা‘রীফিয়াহ ওয়াছফিয়াহ, মাজাল্লাহ আল-ইসলাম ফী আ-সিয়া, বর্ষ ১৩, খন্ড ২, ডিসেম্বর’১৬, পৃঃ ১৪১।
 
[5]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ৩৮-৩৯; মাজাল্লাহ আল-ইসলাম ফী আ-সিয়া, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪০।
 
[6]. আত-তাযকিরাহ ১/১০৯-১১০।
 
[7]. ঐ ১/১১০।
 
[8]. আল-ইমাম আল-কুরতুবী, পৃঃ ১৩৩; আত-তাযকিরাহ ১/৬৮-৬৯।
 
[9]. আদ-দীবাজ আল-মুযাহ্হাব ২/৩০৯।
 
[10]. ইমাম কুরতুবী, আত-তিযকার ফী ফাযলিল আযকার (দামেশক : দারুল বায়ান, ১৪০৭/১৯৮৭), পৃঃ ১৩-১৪।
 
[11]. ঐ, পৃঃ ১৫।
 
[12]. তাফসীরে কুরতুবী, আ‘রাফ ১৮০ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্র.।
 
[13]. আল-আসনা ২/৩।
 
[14]. ঐ ২/১৮৭।
 
[15]. ঐ ২/২০৩।
 
[16]. কাশফুয যুনূন ২/১৫।
 
[17]. আদ-দীবাজ ২/৩০৯।
 
[18]. ইমাম কুরতুবী, কামউল হিরছ বিয-যুহদ ওয়াল কানা‘আহ ওয়া রাদ্দু যুল্লিস সুওয়াল বিল কাসবি ওয়াছ ছিনা‘আহ, তাহকীক্ব: মাজদী ফাতহী আস-সাইয়িদ (তানতা : দারুছ ছাহাবাহ লিত-তুরাছ, ১ম প্রকাশ, ১৪০৯ হিঃ/১৯৮৯ খ্রি.), পৃঃ ১৫।
 
[19]. ঐ, পৃঃ ৬।
 
[20]. কুরতুবী, আল-ই‘লাম বিমা ফী দ্বীনিছ নাছারা মিনাল মাফাসিদ ওয়াল আওহাম ওয়া ইযহারু মাহাসিনি দ্বীনিল ইসলাম, তাহকীক্ব : ড. আহমাদ হিজাযী আস-সাকা (মিসর : দারুত তুরাছিল আরাবী, তাবি), পৃঃ ৬, ২৬৩।
 
[21]. আরাউল কুরতুবী ওয়াল মাযিরী আল-ই‘তিকাদিয়াহ মিন খিলালি শারহাইহিমা লি-ছহীহ মুসলিম (দারু ইবনিল জাওযী, ১ম প্রকাশ, ১৪২৭ হিঃ), ১/১০৯-১১০; মানহাজুল ইমাম আবিল আববাস আল-কুরতুবী ফি কিতাবিহী আল-ই‘লাম..., এম.এ থিসিস, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, গাযা, ফিলিস্তীন, ১৪৩৯/২০১৮, পৃঃ ৩১-৩৪।
 
[22]. আদ-দীবাজ ২/৩০৯।
 
[23]. আল-ওয়াফী বিল অফায়াত ২/৮৭।}}
 
==মনীষীদের দৃষ্টিতে ইমাম কুরতুবী (রহঃ)==
 
১. ঐতিহাসিক ইবনু ফারহূন বলেছেন, كَانَ من عباد الله الصَّالِحين وَالْعُلَمَاء العارفين الورعين الزاهدين فِي الدُّنْيَا المشغولين بِمَا يعنيهم من أُمُور الْآخِرَة، أوقاته معمورة مَا بَين توجه وَعبادَة وتصنيف- ‘তিনি আল্লাহর সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি মুত্তাক্বী ও দুনিয়াবিমুখ একজন বিদগ্ধ আলেম ছিলেন। পরকালে কল্যাণ বয়ে আনবে এমন কর্মে নিয়োজিতদের মধ্যে তিনি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ, ইবাদত-বন্দেগী ও গ্রন্থ রচনায় তাঁর সময় কাটত’।[24]
 
২. হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী বলেন,إمام متفنن متبحر فى العلم، ‘তিনি অভিজ্ঞ ও বিশাল পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন’।[25] তিনি আরো বলেন,رحل وكتب وسمع، وكان يقظا فهما حسن الحفظ مليح النظم حسن المذاكرة ثقة حافظا، ‘তিনি জ্ঞানার্জনের জন্য সফর করেছেন, ইলম লিপিবদ্ধ আকারে সংরক্ষণ করেছেন এবং আলেমদের মজলিসে হাযির হয়ে ইলম হাছিল করেছেন। তিনি প্রত্যুৎপন্নমতি, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, প্রবল স্মৃতিশক্তির অধিকারী, ভাল কবি, ভাল শিক্ষক, নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী এবং হাফেয (ইলম সংরক্ষণকারী) ছিলেন’।[26]
 
৩. ইবনু শাকির আল-কুতুবী বলেন, كان شيخا فاضلا ‘তিনি একজন সম্মানিত শায়খ ছিলেন’।[27]
 
৪. ইবনুল ইমাদ হাম্বলী বলেন,وكان إماما علما، من الغوَّاصين على معانى الحديث، حسن التصنيف، جيد النقل، ‘তিনি ইমাম, শীর্ষস্থানীয় আলেম, হাদীছের মর্মার্থ সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী, সুলেখক এবং বর্ণনা ও সংকলনে অভিজ্ঞ ছিলেন’।[28]
 
৫. হাফেয আহমাদ দুময়াতী (মৃঃ ৭৪৯ হিঃ) বলেন,وكان من العلماء العاملين ومن الأئمة المعتمدين، ‘তিনি আলেম বা-আমল এবং নির্ভরযোগ্য ইমামদের অন্যতম ছিলেন’।[29]
 
৬. الموسوعة العربية العالمية তে বলা হয়েছে, فقيه مفسر عالم باللغة، ... كان القرطبى عالما كبيرا منقطعا إلى العلم منصرفا عن الدنيا، فترك ثروة علمية تقدر بثلاثة عشر كتابا ما بين مطبوع ومخطوط، ‘ইমাম কুরতুবী ফক্বীহ, মুফাস্সির ও ভাষাবিজ্ঞানী। তিনি একজন বড় আলেম, নিরবচ্ছিন্নভাবে জ্ঞান সাধনাকারী এবং দুনিয়াবিমুখ ছিলেন। তিনি মুদ্রিত-অমুদ্রিত ১৩টি ইলমী সম্পদ (গ্রন্থ) রেখে গেছেন’।[30]
 
৭. আল-বায়ান ফী উলূমিল কুরআন গ্রন্থে বলা হয়েছে, وهو من العلماء العاملين، الزاهدين فى الدنيا، المتصفين بالخلال الحميدة والصفات المجيدة، العارفين بالله ثم فى مختلف فنون العلم والمعرفة، ‘তিনি আমলকারী আলেম, দুনিয়াবিমুখ, উত্তম ও প্রশংসনীয় গুণের অধিকারী, আল্লাহওয়ালা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পারদর্শীদের অন্যতম ছিলেন’।[31]
 
৮. Tafsir : Its Growth and Development in Muslim Spain গ্রন্থে বলা হয়েছে, He was one of
 
those Spanish exegetes whose thoughts and works enriched the repository of tafsir literature tremendously. ‘তিনি ঐ সকল আন্দালুসীয় মুফাস্সিরদের একজন ছিলেন, যাদের চিন্তা ও কর্ম তাফসীর শাস্ত্রের ভান্ডারকে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করেছে’।[32] {{sfn|[24]. আদ-দীবাজ আল-মুযাহ্হাব ২/৩০৮।
 
[25]. তারীখুল ইসলাম ৫০/৭৫।
 
[26]. নাফহুত তীব ২/২১১।
 
[27]. উয়ূনুত তারীখ ২১/২৭।
 
[28]. শাযারাতুয যাহাব ৭/৫৮৫।
 
[29]. আয-যায়ল ওয়াত তাকমিলাহ ৫/৪৯৫, হাশিয়া দ্র.।
 
[30]. আল-মাওসূ‘আতুল আরাবিইয়াহ আল-আলামিইয়াহ ১৮/১৬৩।
 
[31]. আল-বায়ান ফী উলূমিল কুরআন, পৃঃ ৩৭৭।
 
[32]. Dr. Muhammad Ruhul Amin, Tafsir : Its Growth and Development in Muslim Spain (Dhaka : University Grants Commission, 2006), P. 150.}}
 
==উপসংহার==
 
পরিশেষে বলা যায়, ইমাম কুরতুবী (রহঃ) ইসলামী জ্ঞান জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি একজন খ্যাতিমান মুফাস্সির, ফক্বীহ, ভাষাতাত্ত্বিক ও মুজতাহিদ আলেম ছিলেন। তিনি সর্বদা জ্ঞান-সাগরে ডুব দিয়ে অসাধারণ সব গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। যা মুসলিম উম্মাহর জন্য অমূল্য সম্পদ। তাঁর রচিত তাফসীরে কুরতুবী তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেছে। গবেষকগণ এটাকে ‘ফিক্বহী বিশ্বকোষ’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। কুরআন মাজীদের আহকাম সংক্রান্ত আয়াত সমূহের ব্যাখ্যা জানার জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তাফসীর। সেজন্য বিদ্বানগণ এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। গবেষকগণ এর নানা দিক নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। ফলে প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে জ্ঞানের নিত্য-নতুন দ্বার উদঘাটিত হচ্ছে।
 
==দৃষ্টিভঙ্গি==