বিজ্ঞানবাদ

ধারণা যে বিজ্ঞান হল শ্রেষ্ঠ বা সত্যের একমাত্র মাধ্যম

বিজ্ঞানবাদ বলতে সমাজের আদর্শিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক মূল্য নির্ধারণের সর্বোৎকৃষ্ট বা একমাত্র বস্তুনিষ্ঠ উপায় হিসাবে বিজ্ঞানের প্রয়োগ, ব্যবহার ও প্রচারকে বোঝায়। বিজ্ঞানবাদ শব্দটি সাধারণত সমালোচনামূলক অর্থে ব্যবহৃত হয় যা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বা অনুরূপ বৈজ্ঞানিক মান প্রয়োগের জন্য উপযুক্ত নয় বলে বিবেচিত ক্ষেত্রগুলোতে বিজ্ঞানের অযাচিত প্রয়োগকে নির্দেশ করে।

সারসংক্ষেপ

সম্পাদনা

বিজ্ঞানের দর্শনে বিজ্ঞানবাদ শব্দটি প্রায়শই যৌক্তিক দৃষ্টবাদের চরম অভিব্যক্তির সমালোচনাকে বোঝায়।[][] শব্দটি ফ্রেডরিখ হায়েকের[] মতো সমাজবিজ্ঞানী, কার্ল পপারের[] মতো বিজ্ঞানের দার্শনিক এবং হিলারি পুতনাম[]জেতান টডোরভের[] মতো দার্শনিকগণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলির যুক্তিহীন প্রয়োগ এবং সমস্ত জ্ঞানকে পরিমাপ বা নিশ্চিতকরণযোগ্যতার মাপকাঠিতে বিচার করার ঘটনা বর্ণনা করতে ব্যবহার করেছেন।[]

আরও সাধারণভাবে, বিজ্ঞানবাদকে প্রায়শই বিজ্ঞানের ‘অতিরিক্ত’ প্রয়োগ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়। বিজ্ঞানবাদ পরিভাষাটির দুটো অর্থ রয়েছেঃ প্রথমত, এটি বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিক দাবির ভুল ব্যবহারকে নির্দেশ করে। অর্থাৎ বিজ্ঞানের প্রয়োগ নাও হতে পারে এমন প্রসঙ্গে এটি যেমন প্রযোজ্য হতে পারে তেমনি যখন কোনো বিষয়কে বৈজ্ঞানিক তদন্ত ক্ষেত্রের বাইরে বলে বিবেচনা করা হয় কিংবা যেখানে বৈজ্ঞানিক উপসংহারে পৌঁছার জন্য পর্যাপ্ত গবেষণামূলক প্রমাণের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করা হয় এমন বিষয়ে বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিক দাবির অসারতা বোঝাতে পরিভাষাটির ব্যবহার রয়েছে। এই বিষয়টি বৈজ্ঞানিকদের অযথার্থ দাবির প্রতি নতি স্বীকার বা বিজ্ঞানসম্মত হিসাবে বর্ণিত যে কোনও ফলাফলকে কোনোরূপ সমালোচনা ছাড়াই মেনে নেওয়ার আগ্রহকেও অন্তর্ভুক্ত করে। এটি সামাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘অনমনীয় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি’ প্রয়োগ করে এ বিষয়ে একটা নিশ্চিততার দাবির বিষয়কে সম্বোধন করতে পারে যে ব্যাপারটিকে ফ্রেডরিখ হায়েক ‘বিজ্ঞানের প্রতি-বিপ্লব’ (১৯৫২) নামক গ্রন্থে ‘অসম্ভব’ বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ এই পদ্ধতিটিতে ‘মনুষ্য উপাদান’কে আমলে নেওয়া হয় না, যেখানে সামাজিক বিজ্ঞান প্রায় পুরোপুরী মনুষ্য ক্রিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, ধারণাটি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পদ্ধতি বা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে স্বীকৃত বিভাগ এবং বিষয়গুলি যে কোনও দার্শনিক বা অন্য কোনো সমস্যা তদন্তের একমাত্র সঠিক উপাদান গঠন করে বলে অনুমান করে নেয়। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান এবং একমাত্র বিজ্ঞানই বিশ্বকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে যথার্থভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে এমন পূর্বধারণার প্রচার করা হয় যা কিনা যেকোনো মানসিক ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার মাত্রা বহির্ভূত।[][]

বিজ্ঞানবাদ ‘শিক্ষা বা সংস্কৃতির অন্যান্য শাখার তুলনায় প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের উপর খুব বেশি আস্থা রাখে’ বলে টম সোরেল মত দিয়েছেন। আলেকজান্ডার রোজেনবার্গের মতো দার্শনিকরাও জ্ঞানের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে বিজ্ঞানকে গ্রহণ করার এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বিজ্ঞানবাদ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এটি কখনও কখনও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং এই পদ্ধতির সর্বজনীন প্রয়োগযোগ্যতার বর্ণনা দিতেও ব্যবহৃত হয়। অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে সর্বাধিক অনুমোদনযোগ্য বিশ্বদর্শন বা মানব শিক্ষার সব থেকে মূল্যবান অংশ ধরে নিয়ে বিজ্ঞানবাদ কখনও কখনও ঐতিহাসিক, দার্শনিক, অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক বিশ্বদর্শনকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে।

বিজ্ঞানবাদ প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বৈশিষ্টসূচক পদ্ধতিগুলিকেই প্রকৃত জ্ঞানের একমাত্র উৎস এবং এই পদ্ধতিগুলোই কেবল মানুষ এবং সমাজ সম্পর্কে সত্য জ্ঞানের দিশা দিতে পারে বলে অনুমান করে নেয়। বিজ্ঞানবাদ শব্দটি ঐতিহাসিক, দার্শনিক এবং সংস্কৃতি সমালোচকেরা মানব জ্ঞানের সকল ক্ষেত্রসমূহের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন।[১০]

ম্যাক্স ওয়েবারের চিন্তাধারার সমাজতাত্ত্বিক যেমন জার্গেন হেবারমাসম্যাক্স হোর্খেইমারের মতে, বিজ্ঞানবাদের ধারণাটি দৃষ্টবাদী দর্শনের সাথে ব্যাপকভাবে সম্পর্কিত, তবে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার সাংস্কৃতিক যৌক্তিকতার সাথেও ধারণাটির সম্পর্ক রয়েছে।[][১১]

আরো দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Rey, Abel (১৯০৯)। "Review of La Philosophie Moderne"। The Journal of Philosophy, Psychology and Scientific Methods6 (2): 51–3। জেস্টোর 2011609ডিওআই:10.2307/2011609 
  2. Maslow, Abraham (১৯৬২), "Preface", Toward a Psychology of Being (1st সংস্করণ), There are criticisms of orthodox, 19th Century scientism and I intend to continue with this enterprise 
  3. Hayek (জুন ১, ১৯৮০), The Counter Revolution of Science: Studies on the Abuse of Reason, Liberty Fund 
  4. Hacohen, Malachi Haim (২০০২)। Karl Popper: the formative years, 1902–1945: politics and philosophy in interwar Vienna। Cambridge University Press। আইএসবিএন 978-0-521-89055-7 
  5. Putnam, Hilary (১৯৯২)। Renewing Philosophy । Cambridge, MA: Harvard University Press। পৃষ্ঠা x। 
  6. Todorov, Tzvetan. The Imperfect Garden: the legacy of humanism. Princeton University Press. 2001. Pg. 20. "Scientism does not eliminate the will but decides that since the results of science are valid for everyone, this will must be something shared, not individual. In practice, the individual must submit to the collectivity, which "knows" better than he does."
  7. Outhwaite, William (২০০৯) [1988], Habermas: Key Contemporary Thinkers (2nd সংস্করণ), Polity Press, পৃষ্ঠা 22 
  8. Bannister, Robert (১৯৯৮), Behaviorism, Scientism and the Rise of The "Expert", ১২ অক্টোবর ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ৩ এপ্রিল ২০২০ 
  9. Haack, Susan (২০০৩), Defending Science Within Reason: Between Scientism and Cynicism, Amherst, NY: Prometheus Books 
  10. Lears, T.J. Jackson (৬ নভেম্বর ২০১৩)। "Get Happy!!"The Nation। সংগ্রহের তারিখ ২১ ডিসেম্বর ২০১৩...scientism is a revival of the nineteenth-century positivist faith that a reified "science" has discovered (or is about to discover) all the important truths about human life. Precise measurement and rigorous calculation, in this view, are the basis for finally settling enduring metaphysical and moral controversies—explaining consciousness and choice, replacing ambiguity with certainty. 
  11. Brunkhorst, Hauke (১৯৯৫)। "Dialectical Positivism of Happiness: Max Horkheimer's Materialist Deconstruction of Philosophy"। Seyla Benhabib; Wolfgang Bonss; John McCole। On Max Horkheimer: New Perspectives। The MIT Press। পৃষ্ঠা 74। আইএসবিএন 978-0262522076