বাংলার প্রতিমাশিল্পের চালি

প্রাচীন বঙ্গদেশে দুর্গাপ্রতিমায় ধ্রুপদী চালা ও চালচিত্র ব্যবহার করা হত। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জমিদার ও রাজবাড়িতে এবং বেশকিছু সাবেকি পুজো মণ্ডপে ধ্রুপদী চালা এবং চালচিত্রের ব্যবহার করা হয়। বাংলা হাজার হাজার বছরের শক্তি উপাসনার পীঠস্থান। বঙ্গীয় শিল্পরীতিতে শক্তি উপাসনার বারংবার প্রতিফলন ঘটেছে। বঙ্গদেশে প্রতিমাশিল্প ও মৃৎশিল্পে প্রতিমার চালি ও চালচিত্রের ব্যবহার এই শাক্ত শিল্পরীতির একটি অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

বাংলার দুর্গাপ্রতিমা চালারীতি

ইতিহাস সম্পাদনা

উপমহাদেশে একমাত্র বাংলাতেই কাদামাটি দিয়ে দেবী পূজার প্রতিমা নির্মাণ হয়। কাজেই প্রতিমার তৈরিতে চালির ব্যবহার সম্পূর্ণ বাংলার সংস্কৃতির নিজেস্ব উপাদান। প্রাচীন কালে শুধু একচালার প্রতিমা নির্মাণ হত। তখন শুধু মাত্র এক ধরনের চালির ব্যবহার হত যার নাম "বাংলা চালি" কালক্রমে বিবর্তিত হয়ে ও শিল্পীর ভাবনায় তৈরি হলো ধ্রুপদী রীতির নতুন নতুন চালি। বর্তমানে সাবেকি প্রতিমায় যে সব চালির ব্যবহার হচ্ছে তার অধিকাংশই সেই প্রাচীন ধারা অনুসরণ করছে।[১]

চালির প্রকারভেদ সম্পাদনা

বাংলার প্রতিমায় চালি গুলি শিল্পসৌকার্সের পাশাপাশি পৌরাণিক উপাখ্যান শ্রীশ্রীচণ্ডী এর শাক্তদর্শন অনুসরণ করছে। আকার আকৃতি,প্রাচীনত্ব ও শাক্তদর্শন অনুযায়ী এই চালি গুলিকে অনেক গুলো ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সবচেয়ে প্রাচীন চালি হলো "বাংলা চালি" । পরবর্তী কালের আছে "মঠচৌরি চালি" ও "টানাচৌরি চালি" । এরপর আসে "মার্কিনি চালি" । ছাড়াও রয়েছে ইত্যাদি চালি।[২]

বাংলা চালি সম্পাদনা

বঙ্গদেশের সর্বাধিক পুরোনো চালি। মনে করা হয় কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা এই চালির আবিস্কারক। এই চালি কিছুটা অর্ধচন্দ্রাকার যা একচালার প্রতিমার মূল কাঠামোয় ডিবিপ্রতিমার পেছনে উপরের দিকে সংযুক্ত থাকে। এই চালি কিন্তু প্রতিমার একচালার কাঠামোর চেয়ে অনেক বড় হয়। এতটাই বড় যে অর্ধচন্দ্রাকার এই চালি কাঠামো ছাড়িয়ে কাঠামোর বাহিরে দুই পাশে কিছুটা ঝুলে থাকে। চালিতে যে চালচিত্র ব্যবহার করা হয় তাতে মহাদেবশ্রীশ্রীচণ্ডী বর্ণিত কাহিনী অঙ্কন করা থাকে। শুধুমাত্র "বাংলা মুখ" আদলের প্রতিমায় এই চালি ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে মূলত কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে দুর্গাপ্রতিমায় এই "বাংলা চালি" ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও কৃষ্ণনগরের রায়বাড়ির দুর্গাপ্রতিমায় "বাংলা চালি" ব্যবহার করা হয়। "বাংলা চালি" ব্যবহৃত হয় এমন প্রতিমা গুলি নির্মিত হয় প্রাচীন বাংলা রীতিতে। কখন সম্পূর্ণ মাটিতে তৈরি হয় দেবীর পরনের শাড়ি। সেই শাড়িতে সোনার গহনার কাজ করা হয়। দেবীর বহন হিসেবে থাকে দেবসিংহ বা গোঘটক।

মঠচৌরি চালি সম্পাদনা

এই চালি অনেকটাই স্থাপত্য ঘেঁষা। একচালার দেবী প্রতিমার পেছনে তিন শিখর বিশিষ্ঠ চালার নিচের দিকে আবার তিনটি অর্ধচন্দ্রকার চালা থাকে। পেছনের শিখর তিনটি কিছুটা দ্রাবিড় স্থাপত্যএর আদলে তৈরি মন্দিরের গোপুরমের বা প্রবেশ তোরণের মত। "বাংলা চালি"তে কোনো পৃথক তিন শিখরের অস্তিত্ব নেই। পরিবর্তে একটানা একটি অর্ধাচন্দ্রাকার চালি ছিল। কিন্তু, এই চালিতে তিন শিখর যুক্ত তিনটি অর্ধচন্দ্রাকার চালি বর্তমান। এই তিন শিখর বিশিষ্ট চালা শাক্তশাস্ত্র গুলির সত্য-রজ-তম গুনকে ইঙ্গিত করছে। শ্রীশ্রীচণ্ডী তে দেবীকে "ত্রিগুনাতিকা" বলা হয়েছে। এই ত্রিগুন হলো সত্য, রজ এবং তম। এই ত্রিগুনে দেবীর তিনটি পৃথক পৃথক রূপ রয়েছে যথাক্রমে লক্ষী, সরস্বতী ও দুর্গা। শাক্তদর্শন অনুযায়ী একত্রে ত্রিদেবীর আরাধনায় হলো দুর্গোৎসব। বঙ্গদেশে দুর্গোৎসবের ক্ষেত্রে, এই ত্রিদেবীর আরাধনা একচালার প্রতিমাতে অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু মঠচৌরি চালিতে এই তিনটি পৃথক শিখর বিশিষ্ট তিনটি অর্ধচন্দ্রাকার চালির মাধ্যমে ত্রিদেবীর উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কলকাতার হাটখোলার দত্তবাড়িতে মঠচৌরি চালির ব্যবহার দেখা যায়। যে সকল দুর্গাপ্রতিমায় এই চালি ব্যবহার করা হয় সেই সব প্রতিমার প্রাচীন বাংলা রীতিতে নির্মিত। দেবীর মুখ "বাংলা মুখ" আদলের। প্রতিমার পরনে মাটির শাড়ি থাকে। পটুয়ার তুলিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে এই শাড়ি। রং তুলি দিয়ে শাড়িতে আঁকা শ্রীশ্রীচণ্ডীর কাহিনী। সাবেক ডাকের সাজের প্রতিমায় দেবীর বহন হিসেবে থাকে দেবসিংহ বা গোঘটক(গোধা)

টানাচৌরি চালি সম্পাদনা

তিন শিখর বিশিষ্ট মঠচৌরি চালি থেকে তিনটি অর্ধচন্দ্রাকার চালা সরিয়ে ফেললে যে নতুন চালা তৈরি হয় তাকে বলে টানাচৌরি চালি। অর্ধচন্দ্রাকার অংশটি থাকে না পরিবর্তে পরপর তিনটি শিখর একটানা একটি সরলরেখায় বসানো থাকে বলেই এই চালির নাম "টানাচৌরি"। এই চালির তিনটি শিখরও শাক্তদর্শনের সত্য রজ ও তম গুণের প্রতীক। শুধুমাত্র বাংলার "চৌধুরী" উপাধি যুক্ত জমিদার বাড়ীগুলি এই চালি ব্যবহার করে বলে এটাকে "চৌধুরী"দের নিজেস্ব চালি বলা হয়। তাই এর অপর নাম "চৌধুরী চালি" । কলকাতার সাবর্ন রায় চৌধুরী পরিবারের ৮ টি দুর্গাপুজোর মধ্যে অধিকাংশ পুজোর প্রতিমা এই চালি ব্যবহার করে। এছাড়া হাওড়ার আন্দুলের দত্ত চৌধুরী বাড়ী এই চালি ব্যবহার করে।

মার্কিনি চালি সম্পাদনা

পশ্চিমবঙ্গের বর্তমানে পারিবারিক ও সার্বজনীন সাবেকি পুজো গুলির অধিকংশ পুজোর প্রতিমাই এই চালা রীতি অনুসরণ করে। এই চালি অনেকটাই আধুনিক স্থাপত্য ঘেঁষা। একচালার প্রতিমার পেছনে অর্ধবৃত্তাকার একটি চালা থাকে, অর্ধ অর্ধবৃত্তকার চালা শেষ হলে দুইপারে দুটি থাম শুরু হয়ে ভূমি স্পর্শ করেছে। ব্রিটিশ আমলে চালির ব্যবহার সর্বাধিক বেড়েছিল। কলকাতার বিখ্যাত বাগবাজার সার্বজনীন পুজোর প্রতিমা এই চালারীতি অনুসরণ করে।

সর্বসুন্দরী চালি সম্পাদনা

খোপ চালি সম্পাদনা

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "বনেদিবাড়ির পুজোর প্রস্তুতিতে কালের পরিবর্তনের ছোঁয়া"। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬। ১৩ জুলাই ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।  Authors list-এ |প্রথমাংশ1= এর |শেষাংশ1= নেই (সাহায্য)
  2. "শীতেই শুরু হয় বনেদি বাড়ির পুজোর প্রস্তুতি"। ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭।