প্ল্যাঙ্কটন

জলজ বাস্তুতন্ত্রের ক্ষুদ্র অথবা আণুবীক্ষণিক জীব

প্লাঙ্কটন (Plankton) জলজ বাস্তুতন্ত্রের ক্ষুদ্র অথবা আণুবীক্ষণিক জীব। এসব জীব কিছুটা সচল বা সম্পূর্ণ নিশ্চল, ভেসে থাকে কিংবা ঢেউয়ের সঙ্গে বা স্রোতে ভেসে চলে। উপকূলীয়, ভাসমান ও তলদেশসহ যাবতীয় জলীয় আবাসস্থলই এসব প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাস। শৈবালজাতীয় উদ্ভিদের বড় বড় দল এবং সবুজ শৈবাল, নীল-সবুজ শৈবাল, ডেসমিড, ডায়াটম, প্রোটোজোয়া, রটিফার, ক্ল্যাডোসেরান, কোপেপড ও অস্ট্রাকোডের মতো অমেরুদন্ডী প্রাণী দ্বারা সাধারণত প্লাঙ্কটন দল গঠিত। উপরন্তু এই দলের মধ্যে কখনও কখনও অপরিণত বয়সের কিছু মাছ, বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর লার্ভা ও কৃমি থাকে।

সামুদ্রিক মাইক্রোপ্ল্যাঙ্কটন ও মেসোপ্ল্যাঙ্কটনছবিতে সালোকসংশ্লেষিত সায়ানোব্যাকটেরিয়া এবং ডায়াটম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাঙ্কটোনিক জীব রয়েছে, যার মধ্যে হলোপ্ল্যাঙ্কটন (প্ল্যাঙ্কটনের স্থায়ী বাসিন্দা) এবং মেরোপ্ল্যাঙ্কটন (প্ল্যাঙ্কটনের অস্থায়ী বাসিন্দা, যেমন, মাছের ডিম, কাঁকড়ার লার্ভা) উভয়ই রয়েছে।

গুরত্ব

সম্পাদনা

প্লাঙ্কটন বাস্ত্তসংস্থানে তাদের অপরিহার্য ভূমিকার জন্য গোটা জলভাগে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ক্ষুদ্র বা আণুবীক্ষণিক হলেও তাদের অবর্তমানে সেখানকার পুরো জীবন প্রক্রিয়াই স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে। উদ্ভিদজাত প্ল্যাঙ্কটন (phytoplankton) আলোকশক্তিকে সংশ্লেষপূর্বক খাদ্যে রূপান্তরে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, অন্যদিকে কিছু প্রাণিজাত প্লাঙ্কটন (zooplankton) উদ্ভিদ প্লাঙ্কটনের প্রাথমিক খাদক এবং তারা উৎপাদক থেকে পরবর্তী খাদ্যস্তরে শক্তি স্থানান্তর করে একটি প্রাণী থেকে আরেকটিতে শক্তির স্থানান্তর ঘটায়। কিছু মাছ জীবনভর প্লাঙ্কটন আহার করে এবং অধিকাংশ কার্পজাতীয় মাছ প্রধানত প্লাঙ্কটনভোজী। এটি সর্বস্বীকৃত যে পৃথিবীর সমৃদ্ধতম সবগুলি মাছচাষের আবাসগুলিই সেখানকার প্ল্যাঙ্কটন উৎপাদনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।

প্লাঙ্কটনের প্রকারভেদ

সম্পাদনা

প্লাঙ্কটন প্রধানত দুই ধরনের।যথা- উদ্ভিদজাত প্ল্যাঙ্কটন (phytoplankton) এবং প্রাণিজাত প্লাঙ্কটন (zooplankton)। উদ্ভিদ ও প্রাণী প্লাঙ্কটনের ধারাবাহিক সম্পূর্ণ তালিকা পাওয়ানি।

উদ্ভিদজাত প্লাঙ্কটন

সম্পাদনা
 
উদ্ভিদজাত প্লাঙ্কটন বা ফাইটোপ্লাঙ্কটন

ফাইটোপ্লাঙ্কটন বা উদ্ভিদজাত প্লাঙ্কটন (Phytoplankton) হলো প্ল্যাঙ্কটন সম্প্রদায়ের অটোট্রফিক (স্ব-ভোজী) অণুজীব এবং সমুদ্র ও মিঠা পানির বাস্তুতন্ত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান। "ফাইটোপ্লাঙ্কটন" নামটি এসেছে গ্রীক শব্দ ফাইটন (φυτόν) থেকে, যার অর্থ হলো 'উদ্ভিদ' এবং প্লাঙ্কটোস (πλαγκτός) থেকে, যার অর্থ হলো 'বিচরণকারী'। এরা আণুবীক্ষণিক, অতিক্ষুদ্র, অবাধ ভাসমান, স্রোতবাহিত উদ্ভিদ; সাধারণত এককোষী, মুক্ত বা কলোনিবদ্ধ; জীবনচক্রের কোনো কোনো পর্যায়ে বহুকোষী। এগুলো জীবনচক্রের ধরন ও আকার-আয়তন অনুসারে এবং বাস্ত্তসংস্থানের ভিত্তিতে ( rheoplankton, limnoplankton, haloplankton) শ্রেণিবদ্ধ করা হয়।

ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে তাদের শক্তি অর্জন করে, যেমন ভূমিতে গাছ এবং অন্যান্য গাছপালা করে। এর অর্থ হলো ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের অবশ্যই সূর্য থেকে আলো গ্রহণ করতে হবে, তাই তারা সমুদ্র এবং হ্রদের আলোকিত পৃষ্ঠ স্তরে (ইউফোটিক জোন) বসবাস করে। স্থলজ উদ্ভিদের তুলনায়, ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন একটি বৃহত্তর পৃষ্ঠ অঞ্চলে বিতরণ করে, কম ঋতুগত তারতম্যের সংস্পর্শে আসে এবং গাছের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে দ্রুত টার্নওভার (দিন বনাম দশক) করে থাকে। ফলস্বরূপ, ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বব্যাপী দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায়। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন সামুদ্রিক এবং মিঠা পানির খাদ্য জালের ভিত্তি তৈরি করে এবং বিশ্বব্যাপী কার্বন চক্রের মূল প্রভাবক। তারা বিশ্বব্যাপী সালোকসংশ্লেষণের ক্রিয়াকলাপের প্রায় অর্ধেক এবং অক্সিজেন উৎপাদনের অন্তত অর্ধেকের জন্য দায়ী, যদিও বৈশ্বিক উদ্ভিদ জৈববস্তুর পরিমাণে মাত্র 1%। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন খুব বৈচিত্র্যময়, সালোকসংশ্লেষণকারী ব্যাকটেরিয়া থেকে উদ্ভিদের মতো শৈবাল থেকে আরমার-ধাতুপট্টাবৃত ককোলিথোফোরস পর্যন্ত ভিন্ন। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠীগুলির মধ্যে রয়েছে ডায়াটম, সায়ানোব্যাকটেরিয়া এবং ডাইনোফ্ল্যাজেলেটস, যদিও অন্যান্য অনেক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। বেশির ভাগ ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন এত ছোট যে বিনা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে স্বতন্ত্রভাবে দেখা যায় না। যখন যথেষ্ট পরিমাণে এরা উপস্থিত থাকে, কিছু প্রজাতি তাদের কোষের মধ্যে ক্লোরোফিলের উপস্থিতির কারণে এবং কিছু প্রজাতিতে আনুষঙ্গিক রঞ্জক (যেমন ফাইকোবিলিপ্রোটিন বা জ্যান্থোফিল) উপস্থিত থাকার কারণে পানির পৃষ্ঠে রঙিন প্যাচ হিসাবে এরা লক্ষণীয় হতে পারে।

পুকুর বা ডোবায় অত্যধিক উদ্ভিদ-প্ল্যাঙ্কটন জমলে পানি বিবর্ণ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ Mycrocystis-এর প্রজাতিরা পানিতে গাঢ় নীল-সবুজ রঙ, আবার Gonium, Pandorina, Eudorina ও Euglena-এর প্রজাতি গাঢ়-সবুজ রঙ ছড়ায়। বাংলাদেশের কোন কোন বদ্ধজলাশয়ে কিছু ইউগ্লেনা প্রজাতির দরুন পানির উপরিভাগ লালচে-বাদামি বা চায়ের রং ধরে। বছরে বিভিন্ন সময়ে প্রচুর পরিমাণ Spirogyra, Pithophora species বা Hydrodictyon reticulatum জলাশয়ের উপরিতলের কাছাকাছি ভাসতে থাকে। মাঝেমধ্যে Aphanothece, Rivularia, Gloetrichia ধূসর রঙের আঠাল দলা, Chaetophora প্রজাতিগুলি সবুজ রঙের দলা বা Botryococcus braunii প্রজাতি পুরু কলোনি ছড়িয়ে কিছু কালের জন্য বদ্ধ জলাশয়ের গোটা উপরিতল ঢেকে ফেলতে পারে। এছাড়াও আরও কিছু ফাইটোপ্লাঙ্কটনের উদাহরণ হলো- Eudorina, Pleodorina, Volvox, Cloroccum, Pediastrum, Oocystis, Tetrallantos, Sceredesmus, Coelastrum, Ulothrix, Gloeotila, Oedogonium, Cladophora, Lolo, Stigeoclorium, Mougeotia, Zygenma, Spirogyra, Microcystis, Aphanothece, Syechococcus, Merismopedia, Dactylococcopis,Spirulina, Oscillatoria, Lynabya, Schizothrix, Symploca, Microcolaus, Cylindrospermum, Wollea, Nostoc, Aradaera, Raphidiopsis, Ssytorema, Monostyla ইত্যাদি গণের বিভিন্ন প্রজাতি।

প্রাণিজাত প্লাঙ্কটন

সম্পাদনা
 
জুপ্ল্যাঙ্কটনের নমুনা

প্রাণিজাত প্লাঙ্কটন বা জুওপ্লাঙ্কটন (ইংরেজি: Zooplankton) হলো মহাসাগর, সমুদ্র এবং তাজা পানির দেহে ভাসমান জীব। Zooplankton শব্দটি গ্রীক zoon (ইংরেজি ভাষায়) থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ "প্রাণী", এবং প্ল্যাঙ্কটোস (π), যার অর্থ "ওয়ান্ডারার" বা "ড্রিফটার"। পৃথক জুওপ্লাঙ্কটন সাধারণত আণুবীক্ষণিক হয়, কিন্তু কিছু (যেমন জেলিফিশ) বড় এবং খালি চোখে দৃশ্যমান।প্রাণীজাত প্লাঙ্কটনের বা জুওপ্লাঙ্কটনের মধ্যে রয়েছে Diaptomus, Cyclops, Mesocyclops, Macrocyclops, Microcyclops, Cypris, Stenocypris, Cyclestheria, Pleuretra, Rotaria, Embata, Anuraeossia, Brachionus, Platyias, Keratella, Euchlanis, Dipleuchlanis, Triplechilanis, Macrochaetus, Mytilina, Epiphane, Diplois, Monostyla ইত্যাদির প্রজাতি।

বাংলাদেশে প্লাঙ্কটন

সম্পাদনা

বাংলাদেশের সব জলজ বাস্ত্ততন্ত্র উদ্ভিদ ও প্রাণী প্লাঙ্কটনে সমৃদ্ধ।

বাংলাদেশে ফাইটোপ্লাঙ্কটন

সম্পাদনা

বাংলাদেশের কোন কোন বদ্ধজলাশয়ে কিছু ইউগ্লেনা প্রজাতির দরুন পানির উপরিভাগ লালচে-বাদামি বা চায়ের রং ধরে। বছরে বিভিন্ন সময়ে প্রচুর পরিমাণ Spirogyra, Pithophora species বা Hydrodictyon reticulatum জলাশয়ের উপরিতলের কাছাকাছি ভাসতে থাকে। মাঝেমধ্যে Aphanothece, Rivularia, Gloetrichia ধূসর রঙের আঠাল দলা, Chaetophora প্রজাতিগুলি সবুজ রঙের দলা বা Botryococcus braunii প্রজাতি পুরু কলোনি ছড়িয়ে কিছু কালের জন্য বদ্ধ জলাশয়ের গোটা উপরিতল ঢেকে ফেলতে পারে।

বাংলাদেশে স্বাদুপানির উদ্ভিদ প্ল্যাঙ্কটনের মুখ্য প্রতিনিধিদের অধিকাংশই Bacillariophyceae। অন্যান্য শৈবালবর্গ সাধারণত pH, খাদ্যবস্ত্ত, নাইট্রেট, ফস্ফেট ও অন্যান্য উপাত্ত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ডেসমিডের পছন্দ প্রধানত অম্লীয় পানি, আবার নীল-সবুজ শৈবাল, ইউগ্লেনয়েড ও ক্লোরোকক্কয়েড সদস্যরা উচ্চতর ক্ষারীয় মাধ্যম ও জৈবিকভাবে দূষিত পানি পছন্দ করে।

বাংলাদেশে নথিভুক্ত মিঠাপানির প্লাঙ্কটনিক গণসমূহ Chlorophyceae, Bacillariophyceae, Xanthophyceae, Chrysophyceae, Euglenophyceae, Dinophyceae, Chloromonadophyceae, Cryptophyceae ও Cyanophyceae শ্রেণিভুক্ত।

বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে Asterionella japonica-সহ কতক প্রজাতি পানিস্ফুটন (water bloom) ঘটায় এবং এসব ডায়াটম থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত বস্ত্তর দরুন জেলেদের শরীরে চুলকানি দেখা দেয়। উদ্ভিদ প্লাঙ্কটন স্বাদু ও সামুদ্রিক উভয় বাস্ত্ততন্ত্রের প্রাথমিক খাদ্যউৎপাদক এবং এগুলি মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর খাদ্যের প্রধান উৎস। অধিকন্তু, সালোক-সংশ্লেষণের মাধ্যমে তারা আবহমন্ডলের অক্সিজেনস্থিতি অব্যাহত রাখে। Spirulina-র মতো কোন কোন উদ্ভিদ প্লাঙ্কটন মানুষের খাদ্য ও ওষুধ যোগায়।

বাংলাদেশে উদ্ভিদ ও প্রাণী প্লাঙ্কটনের ধারাবাহিক সম্পূর্ণ তালিকা পাওয়া না গেলেও জ্ঞাত উদ্ভিদ প্লাঙ্কটনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য Eudorina, Pleodorina, Volvox, Cloroccum, Pediastrum, Oocystis, Tetrallantos, Sceredesmus, Coelastrum, Ulothrix, Gloeotila, Oedogonium, Cladophora, Lolo, Stigeoclorium, Mougeotia, Zygenma, Spirogyra, Microcystis, Aphanothece, Syechococcus, Merismopedia, Dactylococcopis,Spirulina, Oscillatoria, Lynabya, Schizothrix, Symploca, Microcolaus, Cylindrospermum, Wollea, Nostoc, Aradaera, Raphidiopsis, Ssytorema, Monostyla ইত্যাদি গণের বিভিন্ন প্রজাতি।

বাংলাদেশে প্রাণিজাত প্লাঙ্কটন

সম্পাদনা

বাংলাদেশে প্রাণী প্লাঙ্কটনের মধ্যে রয়েছে Diaptomus, Cyclops, Mesocyclops, Macrocyclops, Microcyclops, Cypris, Stenocypris, Cyclestheria, Pleuretra, Rotaria, Embata, Anuraeossia, Brachionus, Platyias, Keratella, Euchlanis, Dipleuchlanis, Triplechilanis, Macrochaetus, Mytilina, Epiphane, Diplois, Monostyla ইত্যাদির প্রজাতি।

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা