প্লান্টুনগান বন্দী শিবির

প্লান্টুনগান বন্দী শিবির (ইন্দোনেশীয়: Kamp Plantungan, আরেক নাম Instalasi Rehabilitasi Plantungan "প্লান্টুনগান পুনর্বাসন স্থাপনা") ছিল নিউ অর্ডার ইন্দোনেশিয়ার একটি বন্দী শিবির যা মহিলা বন্দীদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিলো।[১][২][৩] এই বন্দী শিবিরে থাকা প্রায় ৫০০ জনের মতন বন্দীরা ছিলো যাদের অধিকাংশ ইন্দোনেশিয়ার সমাজতান্ত্রিক দলের নিষিদ্ধ সদস্য, লেকরা, গারওয়ানি বা অন্যান্য বামপন্থী দলের সদস্য এবং "বি শ্রেণির" বন্দী যাদেরকে কোন প্রমাণ বা অভিযোগ ব্যতীত বন্দী করা হয়েছিলো।[১][৩] এই বন্দী শিবির মধ্য জাভার সেমারাং এর নিকট কেন্ডাল রিজেন্সিতে অবস্থিত যা ১৯৭১ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছিলো।[৪] প্লান্টুনগানের গুরুত্বপূর্ণ বন্দীদের মাঝে ছিলেন উমি সারদজোনো (গারওয়ানির প্রধান), সালাওয়াতি দাউদ, মিয়া বুস্তাম (একজন শিল্পী যিনি সিন্দু সুদজোজোনোর স্ত্রী ছিলেন), অধ্যাপক সুমিইয়ারসি সিউইরিনি (বামপন্থী রাজনীতিবিদ) এবং সিতি সুরাতিহ (ওলোয়ান হুতাপিয়া নামক গুরুত্বপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক দলের নেতার স্ত্রী)।

ইতিহাস সম্পাদনা

কুষ্ঠ হাসপাতাল সম্পাদনা

বন্দী শিবিরটি মধ্য জাভা প্রদেশের প্লান্টুনগান জেলার কেন্দাল রিজেন্সিতে অবস্থিত ছিল, এর পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামের নামও ছিলো প্লান্টুনগান।[৫] উনবিংশ শতাব্দীতে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ যুগে জায়গাটি ছিলো একটি সামরিক হাসপাতাল যেখানে কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসা করা হতো; এই স্থানটি হাসপাতালের জন্য বাছাই করার কারণ ছিলো এর পার্শ্ববর্তী গরম ঝরনার জন্য যা কুষ্ঠ রোগীদের জন্য ভালো বলে বিবেচিত হতো।[৩][৬][৭] বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে প্লান্টুনগান দ্য স্যালভেশন আর্মির ব্যবস্থাপনায় মূলত কুষ্ঠ রোগীদের জন্য সেবা কেন্দ্রে পরিণত হয়।[৮][৭][৯][৩] ডাচ ইস্ট ইন্ডিজে জাপানি আক্রমণের পর স্যালভেশন আর্মির কর্মীদের জাপানিদের দ্বারা আটক করা হলেও হাসপাতালটির সেবা অব্যাহত থাকে।[৭] ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার পর এটি সেবা প্রদান করতে থাকে এবং ১৯৫৭ সালে জাতীয়করণ করার মাধ্যমে এটিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হয়।[৩][৭] কুষ্ঠ হাসপাতালটি ১৯৬০ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয়; এটি ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় থাকলেও, নতুন করে ইন্দোনেশীয় সরকার হাসপাতাল ভবন পুনর্নির্মাণ করার পর এটিকে বন্দী শিবিরে রূপান্তরিত করে।[৩]

বন্দী শিবির পরিচালনার বছর (১৯৭১–৭৯) সম্পাদনা

শিবিরটিতে ১৯৭১ সালে কপকামতিব নামক ইন্দোনেশীয় সরকারের সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় বি শ্রেণির (ইন্দোনেশীয়: Golongan B) রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য অন্তরীণ স্থলে পরিণত করা হয়।[৫] বি শ্রেণিতে সেসব রাজনৈতিক বন্দীদের রাখা হয় যাদের বিরুদ্ধে ১৯৬৫ সালের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি কিন্তু কর্তৃপক্ষ দ্বারা শাস্তি দেওয়া হয়েছে।[১] কয়েকশো স্থানান্তরিত মহিলা বন্দী সমেত বন্দীদের প্রথম দলটি ১৯৭১ এর এপ্রিলে পৌঁছায়।[১০][১১] আরো কিছু বন্দীদের একই বছরের জুলাইতে জাকার্তা, সেমারাং, যোগকর্তা থেকে স্থানান্তর করা হয়।[১১] অধিকাংশ বন্দীদের ১৯৬৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আন্দোলনের পর বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাদের মাঝে বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দলের সদস্য ছিলো।[১১] কারাগার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার বদলে প্লান্টুনগানকে নমনীয়ভাবে একটি পুনর্বাসন আসন হিসাবে উল্লেখ করা হয় যেখানে প্রাক্তন কমিউনিস্ট সদস্যরা সমাজে মিশতে পারার ক্ষমতা অর্জন করার আগ পর্যন্ত থাকতে পারে।[১১]

বন্দী শিবির পরিচালনার বছরগুলোয় বিরাট সংখ্যক গারওয়ানি নেতা এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ছাড়াও উচ্চতর কমিউনিস্ট নেতাদের স্ত্রীরা থাকতেন। তাদের মধ্যে ছিলেন গারওয়ানির প্রাক্তন প্রধান উমি সারদজোনো, সাংবাদিক ও স্বাধীনতাকামী সালাওয়াতি দাউদ, সিন্দু সুদজোজোনোর স্ত্রী, মিয়া বুস্তাম, বামপন্থী নেত্রী অধ্যাপক ডাক্তার সুমিইয়ারসি সিউইরিনি, কমিউনিস্ট পার্টি নেতা ওলোয়ান হাতাপেয়ার ধাত্রী সিতি সুরাতিহ ইত্যাদি।[১২] বাকিরা ছিলেন কৃষক কর্মী, ট্রেড ইউনিয়ন সদস্য এবং কমিউনিস্ট সম্পৃক্ত সংগঠনের অগুরুত্বপূর্ণ সদস্য; অন্যান্য বন্দীদের পূর্ববর্তী বন্দীশালা থেকে মুক্তির প্রক্রিয়া চলমান থাকা অবস্থায় তাদের প্লান্টুনগানে স্থানান্তর করা হয়।[১] ডাক্তার সুমিইয়ারসি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন যিনি এই বন্দী শিবিরে বন্দী ছিলেন; তিনি শিবিরে একটি মেডিকেল ইউনিট চালাতেন যা পরের দিকে আশেপাশের এলাকা থেকে রোগী আনতে সক্ষম হয়েছিলো।[১৩] রাজনৈতিক বন্দী শিবিরের অবস্থা অনেকটা ভালো ছিলেন সেগুলো যথেষ্ট ছিলো না যেখানে বন্দীদের পরিশ্রমের কাজ করতে বাধ্য করা, পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে না দেওয়া, বিপজ্জনক প্রাণীর সংস্পর্শে রাখা, মানসিক নির্যাতন এবং ধর্মগ্রন্থ ব্যতীত অন্য কিছু পড়তে না দেওয়া হতো।[১][১২][১৩] দৈহিক কর্ম বিভাগগুলো পৃথক শ্রেণিতে ভাগ হয়ে যেতো: কৃষক, জেলে, মালি, সেলাই, কারুশিল্প, উৎপাদন এবং বিপণন; এই কাজগুলোর ফলে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে বন্দীরা পরিমিত আয় করতেন।[১৩]

১৯৭৫ সালের পরবর্তী কালে অবসরপ্রাপ্ত সেনাপতি সুমিত্রোর সাথে ইন্দোনেশিয়ার শিক্ষাবিদদের প্রতিনিধি দল বন্দী শিবির পরিদর্শন করেন এবং বিস্তারিতভাবে সবার সাক্ষাৎকার নেন এবং তাদের মানসিক পরীক্ষা করান।[১৪] তারা বন্দীদের পরিস্থিতি ও তাদের মানসিক অবস্থা খুব ভালো নির্ধারণ করেন।[১৪] এই অপপ্রচারিক অনুশীলন মূলত বিভিন্ন মানবাধিকার প্রচারণা সংস্থা বিশেষত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস এবং বিভিন্ন খ্রিস্টীয় ও মানবাধিকার দলের বন্দীদের নিয়ে উৎকন্ঠার বিপরীতে প্রতিক্রিয়া হিসেবে আয়োজন করা হয়।[১৫][১৬] ইন্দোনেশীয় সরকার ১৯৭৪ সালে বন্দীদের ছেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দলেও তার পরিবর্তে অন্যান্য বন্দী শিবিরে তাদের স্থানান্তর করে।[১০] এরপর ১৯৭৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেরাল্ড ফোর্ডের ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের পূর্বে সরকার আবারো সকল বন্দীদের মুক্ত করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রাখেনি।[১০] বন্দী শিবিরটিতে থাকা বাকি বন্দীদেরকে ১৯৭৯ সালে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রচারণার ফলে মুক্তি দেওয়া হয়।[১৭]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Budiardjo, Carmel (আগস্ট ১৯৭৪)। "Political imprisonment in Indonesia"Bulletin of Concerned Asian Scholars6 (2): 20–23। আইএসএসএন 0007-4810ডিওআই:10.1080/14672715.1974.10410744 
  2. Pohlman, Annie (২০১৪)। Women, sexual violence and the Indonesian killings of 1965-66 (ইংরেজি ভাষায়)। New York: Taylor & Francis। পৃষ্ঠা 13–4। আইএসবিএন 9781317817949 
  3. Lestariningsih, Amurwani Dwi (২০১১)। "1: Kamp Plantungan"। Gerwani: kisah tapol wanita di Kamp Plantungan (ইন্দোনেশীয় ভাষায়)। Jakarta: Penerbit Buku Kompas। পৃষ্ঠা 1–34। আইএসবিএন 9789797096021 
  4. Adam, Asmi Warman (২০১৯)। "5. Suharto's grievous human right: The case of Buru Islands abuses"। Wieringa, Saskia E.; Pohlman, Annie; Melvin, Jess। The International People's Tribunal for 1965 and the Indonesian genocide। Abingdon, Oxon: Taylor & Francis। আইএসবিএন 9780429764950 
  5. Setiawan, Hersri (২০০৩)। Kamus Gestok (ইন্দোনেশীয় ভাষায়) (Cet. 1 সংস্করণ)। Yogyakarta: Galang Press। পৃষ্ঠা 228। আইএসবিএন 9789799341815 
  6. Bergen, Leo van (২০১৮)। Uncertainty, anxiety, frugality : dealing with leprosy in the Dutch East Indies, 1816-1942। Singapore: NUS Press। পৃষ্ঠা 68–9। আইএসবিএন 9789814722834 
  7. "Leprozerie Plantoengan Vooroorlogse toestand wordt er al weer benaderd LIEFDEWERK."De Locomotief (ওলন্দাজ ভাষায়)। Semarang। ১৫ জুলাই ১৯৪৯। পৃষ্ঠা 2। 
  8. Bergen, Leo van (২০১৮)। Uncertainty, anxiety, frugality : dealing with leprosy in the Dutch East Indies, 1816-1942। Singapore: NUS Press। পৃষ্ঠা 137। আইএসবিএন 9789814722834 
  9. "Dienst Lepra-bestrijding steeds actief."De locomotief: Samarangsch handels- en advertentie-blad (ওলন্দাজ ভাষায়)। Semarang। ২৩ নভেম্বর ১৯৫৪। পৃষ্ঠা 2। 
  10. "De lijdensweg der politieke Gevangenen Indonesie"Trouw (ওলন্দাজ ভাষায়)। Meppel। ২৯ জুলাই ১৯৭৭। পৃষ্ঠা 7। 
  11. Lestariningsih, Amurwani Dwi (২০১১)। "4: Pemindahan Tapol ke Plantungan"। Gerwani: kisah tapol wanita di Kamp Plantungan (ইন্দোনেশীয় ভাষায়)। Jakarta: Penerbit Buku Kompas। পৃষ্ঠা 141–84। আইএসবিএন 9789797096021 
  12. Dirgantoro, Wulandani (২০১৭)। "3. Haunting in the Archipelago"। Feminisms and Contemporary Art in Indonesia (ইংরেজি ভাষায়)। Amsterdam: Amsterdam University Press। পৃষ্ঠা 111–3। আইএসবিএন 9789048526994 
  13. Sumarmiyati, Christina (২০১৭)। "The Horrific Torture And Rape"। Marching, Soe Tjen। The End of Silence। Amsterdam: Amsterdam University Press। পৃষ্ঠা 94–104। আইএসবিএন 9789048534364 
  14. Robinson, Geoffrey (২০১৮)। "Chapter 8. Mass Incarceration"। The Killing Season (ইংরেজি ভাষায়)। Princeton University Press। পৃষ্ঠা 225। আইএসবিএন 9781400888863 
  15. "Detainees tell of deaths in camps"। The Guardian (ইংরেজি ভাষায়)। London। ২১ অক্টোবর ১৯৭৭। পৃষ্ঠা 7। 
  16. "Vrouwen-organisaties schrijven Indonesische generaal Laat vrouwelijke gevangenen vrij."De waarheid (ওলন্দাজ ভাষায়)। Amsterdam। ৮ জুন ১৯৭৭। পৃষ্ঠা 8। 
  17. Roosa, John (২০২০)। Buried histories : the anticommunist massacres of 1965-1966 in Indonesia। Madison, Wisconsin: University of Wisconsin Press। পৃষ্ঠা 141। আইএসবিএন 9780299327309