প্রথম মেনান্দ্রোস সোতের

প্রথম মেনান্দ্রোস সোতের (গ্রিক: Μένανδρος Α΄ ὁ Σωτήρς), যিনি পালি উৎসগুলিতে মিলিন্দ নামে পরিচিত, একজন ইন্দো-গ্রিক শাসক ছিলেন, যিনি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫[৩] থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৩০ পর্য্যন্ত পারোপামিসাদাই, আরাখোশিয়াপাঞ্জাব[২] অঞ্চল শাসন করেন। তার রাজ্য পশ্চিমে কাবুল নদী উপত্যকা হতে পূর্বে রাবী নদী পর্য্যন্ত এবং উত্তরে সোয়াট নদী উপত্যকা হতে দক্ষিণে আরাখোশিয়া পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রাচীন ভারতীয় লেখকদের মতে, তিনি পূর্বদিকে গাঙ্গেয় নদী উপত্যকা বরাবর পাটলিপুত্র পর্য্যন্ত সেনা অভিযান করেন।

প্রথম মেনান্দ্রোস সোতের
ইন্দো-গ্রিক রাজা
প্রথম মেনান্দ্রোস সোতেরের রৌপ্য মুদ্রায় তাঁর প্রতিকৃতি
রাজত্ব১৫৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ - ১৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
পূর্বসূরিদ্বিতীয় আন্তিমাখোস নিকেফোরোস
উত্তরসূরিপ্রথম জোইলোস দিকাইওস (পারোপামিসাদাই, আরাখোশিয়া)
আগাথোক্লেইয়া থেওত্রোপোস
(পাঞ্জাব)
জন্মকলসি[১][২] পারোপামিসাদাই, ইন্দো-গ্রিক রাজ্য
মৃত্যু১৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
এথেন্স
সঙ্গীআগাথোক্লেইয়া থেওত্রোপোস
বংশধরপ্রথম স্ত্রাতোন
পূর্ণ নাম
মহরজস ডিকাইওস মেনন্দ্রস
ধর্মবৌদ্ধ ধর্ম

রাজত্ব সম্পাদনা

প্রথম মেনান্দ্রোস সোতের ইন্দো-গ্রিক রাজ্যের পারোপামিসাদাই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ককেশাসের আলেকজান্দ্রিয়ার নিকটবর্তী কলসি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[১][পা ১][পা ২] গ্রিক-ব্যাক্ট্রিয় রাজ্যের পূর্বদিকে পারোপামিসাদাই, আরাখোশিয়াউত্তরাপথের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল পর্য্যন্ত তার রাজ্য বিস্তৃত ছিল। সগল নামক একটি সমৃদ্ধ নগর সম্ভবতঃ তার রাজধানী ছিল। প্রথম মেনান্দ্রোস সোতের শুঙ্গ রাজধানী পাটলিপুত্র পর্য্যন্ত সেনা অভিযান করেন, কিন্তু এই সময় গ্রিক-ব্যাক্ট্রিয় শাসক প্রথম ইউক্রাতিদেস তার রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত আক্রমণ করলে পাটলিপুত্র থেকে তাকে ফিরে যেতে হয়।[২] প্রথম ইউক্রাতিদেস তার নিকট পরাজিত হয়ে নিজ রাজ্যে পশ্চাৎ-অপসারণ করএ বাধ্য হন। স্ত্রাবোন তার জেওগ্রাফিকা গ্রন্থে প্রথম মেনান্দ্রোস সোতেরকে মহান আলেকজান্ডার অপেক্ষাও সফল সমরাধিনায়ক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।[পা ৩] যেহেতু প্রথম জোইলোস দিকাইওসের মুদ্রার ওপর প্রথম মেনান্দ্রোস সোতের নিজের নাম উৎকীর্ণ করেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাই প্রথম মেনান্দ্রোস সোতেরের রাজত্বকালেই প্রথম জোইলোস দিকাইওস তার রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল দখল করতে সক্ষম হন বলে মনে করেন।[৮]

মুদ্রা সম্পাদনা

প্রথম মেনান্দ্রোস সোতের প্রচুর রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ মুদ্রা প্রচলন করেন। এই সকল মুদ্রায় গ্রিক ও ভারতীয় বৈশিষ্ট্যের সর্বাধিক সংযুক্তি ঘটে। এই সকল মুদ্রায় গ্রিক লিপিতে বাসিলেওস সোতেরোস মেনান্দ্রোউ ΒΑΣΙΛΕΩΣ ΣΩΤΗΡΟΣ ΜΕΝΑΝΔΡΟΥ এবং খরোষ্ঠী লিপিতে মহারাজাস ত্রাতারস মেনাদ্রস উৎকীর্ণ রয়েছে। অসমুন্ড বোপেয়ারাচ্চির মতে, তার সামান্য সংখ্যক প্রথম দিককার রৌপ্য মুদ্রাগুলির এক পিঠে এথেনা ও অপর পিঠে পেঁচার চিত্র মুদ্রিত ছিল। এরপর তিনি মুদ্রাগুলিতে নিজের প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ করান, যা পূর্বেকার ভারতীয় শাসকদের মধ্যে অপরিচিত রীতি ছিল। এই সকল মুদ্রার অপর পিঠে বজ্র নিক্ষেপরত এথেনার প্রতীক মুদ্রিত থাকত, যা পরবর্তীকালে তার উত্তরাধিকারীরাও ব্যবহার করেন। এছাড়া তিনি শুধুমাত্র গ্রিক লিপিতেও কয়েকটি মুদ্রা প্রচলন করেন, যা সম্ভবতঃ ব্যাক্ট্রিয়া অঞ্চলে ব্যবহারের জন্য তৈরী করা হয়েছিল।[৯]

মিলিন্দপঞ্‌হ সম্পাদনা

 
প্রথম মেনান্দ্রোস সোতের ও নাগসেনের মধ্যে দার্শনিক আলোচনা

বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগসেন ও প্রথম মেনান্দ্রোস সোতেরের মধ্যেকার দার্শনিক আলোচনা মিলিন্দপঞ্‌হ নামক পালি বৌদ্ধ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে। মিলিন্দপঞ্‌হ-র মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে মিলিন্দ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। বলা আছে যে তাঁর নিরাপত্তার্থে সবসময়ে পঞ্চশত গ্রিক (যবন) সেনারা মোতায়েন করা থাকত।

মিলিন্দ প্রশ্নে, রাজা মিলিন্দের বর্ণনা:

উভয়ের মধ্যে শ্রামণের জম্বুদ্বীপে সাগল নগরে মিলিন্দ নামে রাজা হইয়া জন্মগ্রহণ করিলেন। তিনি পণ্ডিত, পারদর্শী, মেধাবী ও সুদক্ষ নরপতি ছিলেন। ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান সমস্ত যোগ বিধান ক্রিয়াদিতে সুবিবেচনার সহিত ধর্ম-কর্ম অনুষ্ঠান করিতেন। বহু শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। শ্রুতি, সম্মতি, সংখ্যা, যোগ, নীতি, বৈশেষিক, গণিত, গন্ধর্ব চিকিৎসা, চতুর্বেদ, পুরাণ, ইতিহাস, জ্যোতিষ, ইন্দ্রজাল, হেতু, মন্ত্রণা, যুদ্ধ, ছন্দ, সামুদ্রিক এই ঊনবিংশতি শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। তিনি তর্ক-শাস্ত্রে এমন বাগ্মী ছিলেন যে, তাঁহার বাগ্মিতায় কেহ ঠাঁই দিতে পারিত না। বহু তীর্থকরের মধ্যে সর্বপ্রধান ছিলেন। সমস্ত জম্বুদ্বীপে মিলিন্দ রাজের সমান কেহই ছিল না। যেমন জ্ঞানে, প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে, তেমন শারীরিক বল, শৌর্য, বীর্য, সাহসেও তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন। ধন বৈভবে তাঁহার সমকক্ষ কেহই ছিল না। অসংখ্য সৈন্য সামন্ত তাঁহার বিদ্যমান ছিল।


— মিলিন্দ প্রশ্ন - শ্রীমৎ প্রজ্ঞালোক মহাস্থবির (অনুবাদক), বনভন্তে প্রকাশনী, ১৯৩১

বৌদ্ধ পরম্পরানুসারে, ভিক্ষু নাগসেনের সঙ্গে তাঁর ধর্মালোচনায় অনুপ্রাণিত হয়ে মিলিন্দ বৌদ্ধধর্ম আমৃত্যু গ্রহণ করেন।

ভন্তে, নাগসেন, আমার দোষ, আমার অন্যায় বা অপরাধ ক্ষমা করুন। ভন্তে, নাগসেন, আজ হইতে জীবনের চরমসীমা পর্যন্ত ত্রিরত্নের শরণাগত হইতেছি, আমাকে উপাসক বলিয়া ধারণা করুন।


— মিলিন্দ প্রশ্ন - শ্রীমৎ প্রজ্ঞালোক মহাস্থবির (অনুবাদক), বনভন্তে প্রকাশনী, ১৯৩১

এবং তাঁর সাম্রাজ্যের ভার নিজের ছেলের হাতে সঁপে দিয়ে জাগতিক সংসার থেকে অবসর নেন। ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে পরে তিনি সাধনায় উত্তীর্ণ হয়ে অর্হৎ হন।

পুনরায় স্থবিরের প্রজ্ঞায় প্রসন্ন হইয়া পুত্র হস্তে রাজত্ব সমর্পণ করতঃ আগার ত্যাগ করিয়া অনাগারে প্রব্রজ্যা গ্রহণপূর্বক বিদর্শন ভাবনার শ্রীবৃদ্ধি সাধন করিয়া অরহত্বফল প্রাপ্ত হইলেন।


— মিলিন্দ প্রশ্ন - শ্রীমৎ প্রজ্ঞালোক মহাস্থবির (অনুবাদক), বনভন্তে প্রকাশনী, ১৯৩১

মৃত্যু সম্পাদনা

প্লুতার্কের বর্ণনানুসারে, প্রথম মেনান্দ্রোস সোতের একটি সামরিক অভিযানের সময় তার যুদ্ধশিবিরে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তার অস্থিভস্মের অধিকার নিয়ে তার রাজ্যের বিভিন্ন শহরের অধিবাসীদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। পরে ঠিক করা হয় যে, তার অস্থিভস্ম সমান ভাবে ভাগ করে বিভিন্ন শহরে রেখে তার ওপর স্মারক (?স্তূপ) নির্মাণ করা হবে।[পা ৪] মিলিন্দপঞ্‌হ গ্রন্থে বর্ণিত কাহিনীর সঙ্গে অবশ্য প্লুতার্কের বর্ণনা মেলে না।

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. Menander king in India, known locally as Milinda, born at a village named Kalasi near Alasanda (Alexandria-in-the-Caucasus), and who was himself the son of a king. After conquering the Punjab, where he made Sagala his capital, he made an expedition across northern India and visited Patna, the capital of the Mauraya empire, though he did not succeed in conquering this land as he appears to have been overtaken by wars on the north-west frontier with Eucratides.[২]:১৫৫
  2. Menander (not to be confused with the more famous Greek dramatist of the same name) was born somewhere in the fertile area to the south of the Paropaisadae or present Hindu Kush Mountains of Afghanistan. The only reference to this location is in the semilegendary Milindapanha (first or second century A.D.), which says that he was born in a village called Kalasi near Alasanda, some two hundred yojanas (about eighteen miles) from the town of Sagala (probably Sialkot in the Punjab). The Alasanda refers to the Alexandria in Afghanistan and not the one in Egypt.[৪]:৭১৭
  3. The Greeks who caused Bactria to revolt grew so powerful on account of the fertility of the country that they became masters, not only of Ariana, but also of India, as Apollodorus of Artemita says: and more tribes were subdued by them than by Alexander-- by Menander in particular (at least if he actually crossed the Hypanis towards the east and advanced as far as the Imaüs), for some were subdued by him personally and others by Demetrius, the son of Euthydemus the king of the Bactrians; and they took possession, not only of Patalena, but also, on the rest of the coast, of what is called the kingdom of Saraostus and Sigerdis. In short, Apollodorus says that Bactriana is the ornament of Ariana as a whole; and, more than that, they extended their empire even as far as the Seres and the Phryni.- জেওগ্রাফিকা, স্ত্রাবোন[৫][৬][৭]
  4. But when one Menander, who had reigned graciously over the Bactrians, died afterwards in the camp, the cities indeed by common consent celebrated his funerals; but coming to a contest about his relics, they were difficultly at last brought to this agreement, that his ashes being distributed, everyone should carry away an equal share, and they should all erect monuments to him.- Moralia: Praecepta gerendae reipublicae, Plutarch[১০][১১][১২][১৩]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Menander"Encyclopædia Britannica OnlineEncyclopædia Britannica, Inc.। সংগ্রহের তারিখ ৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ 
  2. Hazel, John (২০১৩)। Who's Who in the Greek World। Routledge। আইএসবিএন 9781134802241page=155 |আইএসবিএন= এর মান পরীক্ষা করুন: invalid character (সাহায্য) 
  3. O. Bopearachchi, Monnaies gréco-bactriennes et indo-grecques, Catalogue raisonné, Bibliothèque Nationale, Paris, 1991, 459 p., 69 pl.
  4. Magill, Frank Northen (২০০৩)। Dictionary of World Biography, Volume 1। Taylor & Francis। আইএসবিএন 9781579580407 
  5. Strabo (১৮৭৭)। "11.11.1"। Meineke, A.। Geographica (Greek ভাষায়)। Leipzig: Teubner। 
  6. Strabo (১৯২৪)। "11.11.1"। Jones, H. L.। Geographica 
  7. Strabo (১৯০৩)। "11.11.1"। Jones, H. L.। Geographica  At the Perseus Project.
  8. Senior R.C., MacDonald, D.: The Decline of the Indo-Greeks, Monographs of the Hellenic Numismatic Society, Athens (1998)
  9. "Monnaies Gréco-Bactriennes et Indo-Grecques, Catalogue Raisonné", Osmund Bopearachchi, 1991, Bibliothèque Nationale de France, আইএসবিএন ২-৭১৭৭-১৮২৫-৭.
  10. Plutarch। "28, 6"। Morals: Political Precepts (পিডিএফ)। The Online Library of Liberty। পৃষ্ঠা 147–148। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ 
  11. Bernardakis, Gregorius N., সম্পাদক (১৮৯৩)। "821d"। Moralia: Praecepta gerendae reipublicae (Greek ভাষায়)। Leipzig: Teubner। 
  12. Fowler, Harold North, সম্পাদক (১৯৩৬)। "28, 6"। http://www.perseus.tufts.edu/hopper/text?doc=Perseus%3Atext%3A2008.01.0333%3Asection%3D28  |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)
  13. Goodwin, William W., সম্পাদক (১৮৭৪)। "28, 6"। http://www.perseus.tufts.edu/hopper/text?doc=Perseus%3Atext%3A2008.01.0334%3Asection%3D28  |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)

আরো পড়ুন সম্পাদনা

প্রথম মেনান্দ্রোস সোতের
রাজত্বকাল শিরোনাম
পূর্বসূরী
দ্বিতীয় আন্তিমাখোস নিকেফোরোস
ইন্দো-গ্রিক শাসক
১৫৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ - ১৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
উত্তরসূরী
প্রথম জোইলোস দিকাইওস
(পারোপামিসাদাই, আরাখোশিয়া)
উত্তরসূরী
আগাথোক্লেইয়া থেওত্রোপোস
(পাঞ্জাব)