পৌর রেল পরিবহন
পৌর রেল পরিবহন একটি সামষ্টিক পরিভাষা যা দিয়ে কোনও পৌর (অর্থাৎ শহর) বা উপপৌর (অর্থাৎ উপশহর) এলাকাগুলির ভেতরে বা চারপাশে যাত্রীসেবা প্রদানকারী বিভিন্ন স্থানীয় পর্যায়ের রেল পরিবহন ব্যবস্থাকে বোঝায়। পৌর রেল পরিবহন ব্যবস্থাগুলিকে মোটা দাগে নিচে উল্লেখ করা বিভিন্ন ধরনে ভাগ করা যেতে পারে, তবে একই ব্যবস্থাতে বা একই যাত্রাপথে (লাইনে) একাধিক ধরনের পরিবহন ব্যবস্থার প্রয়োগ ঘটতে পারে।

ধরন সম্পাদনা
ট্রামগাড়ি সম্পাদনা
ট্রামগাড়ি ব্যবস্থা বা ট্রাম পরিবহন ব্যবস্থা একটি রেলভিত্তিক যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা যেখানে রেলগাড়িটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিংবা সম্পূর্ণরূপে গাড়ি চলার সড়কপথের উপর দিয়ে চলে (যাকে সড়কপথে চালিত রেলগাড়ি বা ইংরেজিতে "স্ট্রিট রানিং ট্রেন" Street running train বলে), যেটির যাত্রী ধারণক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম এবং যেটি প্রায়শই বিরতি দিয়ে চলে।
ট্রামযাত্রীরা সাধারণত সড়কের স্তর থেকে বা ফুটপাত থেকে সামান্য উপরে উঠে ট্রামে চড়েন বা প্রবেশ করেন, তবে নিচু মেঝের ট্রামগাড়িগুলিতে সড়ক থেকে উপরে না উঠেই সরাসরি রাস্তার স্তরে থেকেই ট্রামে প্রবেশ করা সম্ভব। অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ দূরত্বের যাত্রাপথগুলিকে আন্তঃপৌর যাত্রাপথ (interurban) বা দূরপ্রসারী রেলপথ (radial railways) বলা হয়। বেশিরভাগ আন্তঃপৌর যাত্রাপথ আর অবশিষ্ট নেই; এগুলি নিত্যযাত্রী রেল বা লঘুভার রেলে উন্নীত করা হয়েছে বা পরিত্যক্ত করা হয়েছে।
ট্রামকে ইংরেজিতে ট্র্যাম এবং উত্তর আমেরিকার ইংরেজিতে স্ট্রিটকার (streetcar) বা ট্রলি (trolley) বলা হয়। জার্মানিতে একে ষ্ট্রাসেনবান (Straßenbahn) বা সংক্ষেপে "এস-বান" (S-bahn) বলে, যার আক্ষরিক অর্থ "সড়কপথের রেলগাড়ি"।
আধুনিক হালনাগাদকৃত উন্নত ট্রাম পরিবহন ব্যবস্থাগুলির যাত্রী ধারণক্ষমতা ঐতিহ্যবাহী ট্রামগাড়ির তুলনায় বেশি হয়ে থাকে।
লঘু রেল সম্পাদনা
লঘুভার রেল পরিবহন ব্যবস্থা এক ধরনের রেলভিত্তিক পৌর পরিবহন ব্যবস্থা যেটির যাত্রী ধারণক্ষমতা ও গতিবেগ ট্রামগাড়ির চেয়ে বেশি, যেটি সাধারণত মোটরযান চলাচলের সড়ক থেকে পৃথকীকৃত সম্পূর্ণ নিজস্ব চলার অধিকারবিশিষ্ট (right of way) পথে চলাচল করে কিন্তু অন্য সব যান চলাচল থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ধাপের (grade-seperated) একটি পথে চলাচল করে না (যে ব্যাপারটি দ্রুতগ্রামী গণপরিবহন ব্যবস্থাগুলিতে দৃশ্য হয়)। লঘুভার রেলব্যবস্থাগুলিতে সাধারণত বহু-বগির রেলগাড়ি (multiple-units train) ব্যবহার করা হয়, যা একবগির ট্রামগাড়ি অপেক্ষা ভিন্ন। লঘুভার রেল মূলক ট্রামগাড়ির একটি বিবর্তিত রূপ। এই লঘুভার রেল ব্যবস্থাগুলির মধ্যে গতিবেগ, যাত্রী ধারণক্ষমতা ও বিস্তারে তাৎপর্যপূর্ণ বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। হালকা-উন্নয়নকৃত ট্রাম ব্যবস্থা থেকে শুরু করে কিছু দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থাও (কিছু স্তরচ্ছেদবিশিষ্ট) এর আওতায় পড়ে।
লঘুভার রেলকে ইংরেজিতে লাইট রেল (light rail) বলে। জার্মানিতে একে "ষ্টাটবান" (Stadtbahn), যার আক্ষরিক অর্থ "নগর রেলগাড়ি"।
দ্রুতগামী গণপরিবহন সম্পাদনা
দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থা বলতে সাধারণত একটি পৌর এলাকার অভ্যন্তরে অবস্থিত এমন এক ধরনের রেল পরিবহন ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেটির যাত্রী ধারণক্ষমতা উচ্চ, যেটি নিয়মিত ও ঘনঘন হারে সেবা প্রদান করে এবং সাধারণত অন্যান্য যানচলাচল পথ থেকে (এমনকি অন্য রেল পরিবহন ব্যবস্থার পথগুলি থেকেও) সম্পূর্ণরূপে পৃথক ধাপে পরিচালিত হয়। দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থাকে প্রায়শই ভারী রেল (heavy rail) বলা হয় এবং এভাবে এটিকে লঘু রেল ও দ্রুতগামী বাস পরিবহন ব্যবস্থা থেকে পৃথক করা হয়।
বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলেই দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থাগুলি "মেট্রো" নামে পরিচিত, যা কিনা "মেট্রোপলিটান" (Metropolitan) শব্দটির সংক্ষিপ্ত রূপ, যা কিনা আবার "মেট্রোপলিটান রেলওয়ে" (Metropolitan railway অর্থাৎ মহানগর রেলব্যবস্থা) কথাটির প্রথম অংশ থেকে এসেছে। মেট্রোপলিটান রেলওয়ে ছিল বিশ্বের প্রথম রেলভিত্তিক দ্রুত গণপরিবহন ব্যবস্থার নাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু শহরে, স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ও কানাডার টরন্টো শহরে "সাবওয়ে" (Subway) পরিভাষাটি প্রচলিত। লন্ডন শহরের ব্যবস্থাটির নাম "লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড" এবং একে অনেক সময় "টিউব" (Tube) নামেও ডাকা হয়। জার্মানির ব্যবস্থাগুলিকে "উন্টারগ্রুন্ডবান" (Untergrundbahn) বা সংক্ষেপে "উ-বান" (U-Bahn) বলে, যার আক্ষরিত অর্থ ভূগর্ভস্থ রেল। পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার বহু ব্যবস্থার (যেমন তাইপেই, চেন্নাই, সিঙ্গাপুর নামে "এমআরটি" শব্দসংক্ষেপটি ব্যবহার করা হয়, যার সম্প্রসারিত রূপ হল "ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট" অর্থাৎ দ্রুতগ্রামী গণপরিবহন। যেসব ব্যবস্থা মূলত ভূমি থেকে উত্তোলিত রেলপথে চলাচল করে, সেগুলিকে "এল" দিয়ে (যেমন শিকাগো 'এল') বা "স্কাইট্রেন" (Skytrain) দিয়ে নির্দেশ করা হতে পারে (যেমন ব্যাংককের বিটিএস স্কাইট্রেন ও কানাডার ভ্যাংকুভারের স্কাইট্রেন (ভ্যাংকুভার)। অপেক্ষাকৃত কম প্রচলিত কিছু নামের মধ্যে আছে স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলিতে প্রচলিত "টি-বানে", যেটি হল "টুনেলবানা" শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ, যার আক্ষরিক অর্থ "সুড়ঙ্গ পথ" এবং এমটিআর বা ম্যাস ট্রানজিট রেলওয়ে (অর্থাৎ গণপরিবাহী রেলপথ)।
একরেল (মনোরেল) সম্পাদনা
একরেল বা মনোরেল এমন এক ধরনের রেলপথ যাতে রেলপথটিতে (ট্র্যাক) একটিমাত্র রেল (লোহার দণ্ডের সারি) বসানো থাকে। এর বিপরীতে ঐতিহ্যবাহী রেলপথগুলিতে দুইটি সমান্তরাল রেল বসানো থাকে।
নিত্যযাত্রী রেল সম্পাদনা
নিত্যযাত্রী রেল, আঞ্চলিক রেল বা উপপৌর রেল ব্যবস্থা সাধারণত মূল রেলব্যবস্থার পথ ব্যবহার করে, যে রেলপথগুলি আন্তঃনগর রেল ও মালবাহী রেলগাড়িগুলি ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে পারে। এই ব্যবস্থাগুলি দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থা বা লঘু রেলব্যবস্থাগুলির চেয়ে কম ঘনঘন সেবা প্রদান করে থাকে কিন্তু অপেক্ষাকৃত বেশি দ্রুত চলাচল করে, এগুলিতে বিরতির সংখ্যাও কম হয় এবং এগুলি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করে। এইসব ট্রেনের প্রতি বগিতে যাত্রী ধারণক্ষমতাও উচ্চ হয়ে থাকে।
যদিও ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ার অনেক নিত্যযাত্রী রেলব্যবস্থাগুলি দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থার মতো সমান ঘনঘন ও একই ধরনের বগি ব্যবহার করে যাতায়াত করে, তা সত্ত্বেও এগুলিকে নিত্যযাত্রী রেলই বলা হয়, কেননা এগুলি আন্তঃনগরী যাত্রীবাহী রেলগাড়ি ও মালবাহী রেলগাড়ির সাথে একই পথে চলে।
স্বয়ংক্রিয় নির্দেশিত পথের রেল সম্পাদনা
স্বয়ংক্রিয় নির্দেশিত পথের রেলব্যবস্থাগুলি (Automated Guideway Transit) সাধারণত মধ্যম যাত্রী ধারণক্ষমতা নিয়ে চলাচল করে।
ঢালু রজ্জুরেল সম্পাদনা
ঢালু রজ্জুরেল (funicular ফিউনিকুলার) একটি রজ্জুচালিত ঢালু রেলপথ যেখানে নিম্নগামী রেলগাড়ির ওজন ব্যবহার করে ঊর্ধ্বগামী রেলগাড়িকে ঢালের উপরে ওঠানো হয়।
রজ্জু গাড়ি সম্পাদনা
গণপরিবহনের প্রেক্ষাপটে রজ্জু গাড়ি বলতে এমন একটি ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেখানে একটি সর্বদা চলমান রজ্জু স্থির গতিবেগে এর সাথে সংযুক্ত বগিগুলিকে টেনে নিয়ে যায়। একটি বগি রজ্জুর সাথে নিজেকে আটকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে ও যাত্রা শেষে রজ্জুটি ছেড়ে দেয়। রজ্জু গাড়িগুলির সাথে ঢালু রজ্জুরেলের পার্থক্য হল ঢালু রজ্জুরেলে রেলগাড়িটি সবসময় রজ্জুতে আটকানো থাকে। আবার "কেবল রেলওয়ে" বা রজ্জুরেল বলতে ঢালু রজ্জুরেলের সদৃশ্য একটি ব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে রেলগাড়িগুলি আলাদা করে যুক্ত বা বিযুক্ত করতে হয়।
নামকরণে বিভ্রাট সম্পাদনা
কখনও কখনও পৌর যাত্রী পরিবহন সংস্থাগুলি তাদের যাত্রাপথের এমন নাম দেয়, যা উপরোক্ত কারিগরি বিভাজনের সঠিক প্রতিফলন হয় না। উদাহরণস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন নগরীর গ্রিন লাইন নামক রেলপথটিকে "সাবওয়ে" (অর্থাৎ পাতালরেল) ডাকা হয়, অথচ এটির বেশিরভাগ অংশই মাটির উপরে অবস্থিত। বিপরীতক্রমে লন্ডনের ডকল্যান্ডস লাইট রেলওয়ে, লস অ্যাঞ্জেলেসের সি লাইন এবং চীনের কিছু মেট্রো লাইনকে "লাইট রেল" নামে ডাকা হলেও এগুলি আসলে দ্রুতগামী গণপরিবহন ব্যবস্থা, কেননা এগুলি সম্পূর্ণ পৃথক ধাপে অবস্থিত এবং উচ্চহারে অনেক ঘন ঘন সেবা প্রদান করে।
অনেক শহরেই সাবওয়ে বা এলেভেটেড রেলওয়ে নাম ব্যবহার করা হয়, যদিও তাদের ব্যবস্থাগুলিতে ভূগর্ভস্থ পাতালরেল ও ভূমি থেকে উত্তোলিত উড়ালরেল উভয়েরই সমবায় ঘটেছে। যেমন লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের অর্ধেকেরও কম অংশ ভূগর্ভে পাতালরেল হিসেবে অবস্থিত। নিউ ইয়র্ক সিটি সাবওয়েতেও উত্তোলিত উড়ালরেল ও ভূগর্ভস্থ পাতাল রেলের সমবায় ঘটে ছে। শিকাগো এল ও ভ্যাংকুভার স্কাইট্রেল ব্যবস্থাগুলি কেন্দ্রীয় পৌর এলাকাগুলিতে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গপথে যাতায়াত করে।
আরও দেখুন সম্পাদনা
তথ্যসূত্র সম্পাদনা
আরও পড়ুন সম্পাদনা
- "Electric Railway Transportation", Annals of the American Academy of Political and Social Science (January 1911) 37 (1): 1–202 – 17 articles by experts in 1911.