পৌত্তলিকতাবাদ
পৌত্তলিকতাবাদ ( লাতিন paganus 'গ্রামীণ, গ্রাম্য', পরে 'সাধারণ নাগরিক') শব্দটি চতুর্থ শতকে প্রারম্ভিক খ্রিস্টানরা প্রথম ব্যবহার করেন রোমান সাম্রাজ্যের সেইসব মানুষের জন্য, যারা বহুদেববাদে বিশ্বাস করত,[১] অথবা খ্রিস্টধর্ম, ইহুদিধর্ম ও সামারীয় ধর্ম ছাড়া অন্যান্য জাতিগত ধর্মে বিশ্বাসী ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের সময়, কেউ পৌত্তলিক বলে বিবেচিত হত হয় তারা খ্রিস্টানদের তুলনায় গ্রামীণ ও প্রাদেশিক থাকায়, অথবা তারা milites Christi (খ্রিস্টের সৈনিক) ছিল না বলেই।[২][৩] খ্রিস্টান লেখায় হেলেন, জেন্টাইল এবং হিথেন শব্দগুলিও বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হত।[১]
আচারবিধি অনুসারে বলিদান ছিল প্রাচীন গ্রিক-রোমান ধর্মীয় বিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।[৪] এটি একজন ব্যক্তি খ্রিস্টান নাকি পৌত্তলিক তা নির্ধারণে ব্যবহৃত হত।[৪] পৌত্তলিকতাবাদকে প্রায়শই “গ্রাম্য জনসাধারণের ধর্ম” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।[১][৫]
মধ্যযুগে এবং তার পরবর্তী সময়ে, পৌত্তলিকতাবাদ শব্দটি খ্রিস্টধর্ম ছাড়া অন্য যে কোনো ধর্মের জন্য প্রয়োগ করা হতো, এবং এতে ভ্রান্ত দেবতার প্রতি বিশ্বাসের ধারণা অন্তর্ভুক্ত ছিল।[৬][৭] পৌত্তলিক শব্দটি বহু-ঈশ্বরবাদের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হয়েছে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।[৮]
১৯শ শতকে, পৌত্তলিকতাবাদে অনুপ্রাণিত বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী নিজেদের পরিচয়ে এই শব্দটি গ্রহণ করে। ২০শ শতকে এটি আধুনিক পৌত্তলিকতাবাদ, আধুনিক পৌত্তলিক আন্দোলন, এবং বহুদেববাদ পুনর্গঠনবাদীদের একটি আত্মপরিচয় হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। আধুনিক পৌত্তলিক ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো প্রায়ই প্রকৃতির উপাসনা সহ এমন সব বিশ্বাস ও আচার অনুসরণ করে, যা প্রধান ধর্মগুলোর থেকে ভিন্ন।[৯][১০]
প্রাচীন পৌত্তলিক ধর্ম ও বিশ্বাস সম্পর্কে সমসাময়িক জ্ঞান এসেছে বিভিন্ন উৎস থেকে—যেমন নৃতাত্ত্বিক ক্ষেত্রগবেষণা, পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন, এবং শাস্ত্রীয় যুগের লেখকদের বিবরণ। আজকের আধুনিক পৌত্তলিক ধর্মগুলো সাধারণত সর্বেশ্বরবাদ, সর্বেশ্বর-অন্তর্গতবাদ, বহুদেববাদ বা প্রাণবাদ ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে, তবে কিছু ধর্ম একেশ্বরবাদীও।[১১][১২][১৩]
সংজ্ঞা
সম্পাদনাখ্রিস্টীয় যুগের শুরুতে "পৌত্তলিকতাবাদ" নামে কোনও একক ধর্ম ছিল—এমনটি বলা সম্ভবত বিভ্রান্তিকর। বরং বলা যেতে পারে যে খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে প্রতিযোগিতার পূর্বে পৌত্তলিকদের সেই অর্থে কোনও ধর্ম ছিল না, যেভাবে আমরা আজ "ধর্ম" শব্দটি ব্যবহার করি। তাদের মধ্যে ধর্মীয় আচার বা বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক বিতর্কের রীতি ছিল না (দার্শনিক আলোচনা বা প্রাচীন ইতিহাসভিত্তিক রচনার বাইরে), কোনো সংগঠিত বিশ্বাসব্যবস্থা ছিল না যাতে ব্যক্তিকে আনুগত্য প্রদর্শনের আহ্বান জানানো হতো, ধর্মীয় বিষয়ে আলাদা কোনো কর্তৃত্ব কাঠামো ছিল না, এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণভাবে, পরিবার ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছাড়া নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠী বা ভাবধারার প্রতি তাদের কোনো আনুগত্য ছিল না। যদি এটি পৌত্তলিক জীবনের সঠিক ব্যাখ্যা হয়, তাহলে বলা যায় যে পৌত্তলিকতাবাদ মূলত দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় শতাব্দীতে খ্রিস্টান, ইহুদি ও অন্যান্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও পারস্পরিক ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি একটি ধর্মীয় ধারণা।
— J. A. North, 1992, 187–88, [১৪]
পৌত্তলিকতাবাদকে সংজ্ঞায়িত করা অত্যন্ত জটিল এবং সমস্যাসঙ্কুল। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শব্দসমূহের প্রেক্ষাপট বোঝা গুরুত্বপূর্ণ।[১৫] প্রারম্ভিক খ্রিস্টানরা তাদের চারপাশের বিচিত্র পূজাপদ্ধতিগুলিকে সুবিধার্থে ও বক্তৃতার কৌশল হিসেবে একটি একক গোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করত।[১৬] যদিও পৌত্তলিকতাবাদ সাধারণত বহুদেববাদকে নির্দেশ করে, তথাপি খ্রিস্টান ও প্রাচীন পৌত্তলিকদের মধ্যকার মূল পার্থক্য একেশ্বরবাদ বনাম বহুদেববাদ ছিল না, কারণ সব পৌত্তলিকই যে বহু দেবতার পূজারী ছিল তা নয়। ইতিহাসে অনেক পৌত্তলিকই একজন সর্বোচ্চ স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করত। তবে অধিকাংশ পৌত্তলিকই অধীনস্থ দেবতা বা দাইমন কিংবা ঐশ্বরিক প্রবাহতে বিশ্বাস করত।[১৩] খ্রিস্টানদের দৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কেউ একমাত্র সত্য ঈশ্বরের উপাসক কিনা। যারা ছিলেন না—তারা হোক বহুদেববাদী, একেশ্বরবাদী বা নাস্তিক—তাদের গির্জার বাইরের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং তারা "পৌত্তলিক" বলে চিহ্নিত হতেন।[১৭]
তদ্রূপ, প্রাচীন পৌত্তলিকদের কাছে কোনো গোষ্ঠীকে উপাস্য দেবতার সংখ্যার ভিত্তিতে আলাদা করা অস্বাভাবিক মনে হতো। তারা পন্টিফদের কলেজ বা এপুলোনেস প্রভৃতি পুরোহিতগোষ্ঠী ও ধর্মীয় আচারপ্রথাকে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ মনে করত।[১৮]
পৌত্তলিকতাবাদকে প্রাক-খ্রিস্টান দেশজ ধর্ম হিসেবে উল্লেখ করাও সঠিক নয়, কারণ সব ঐতিহাসিক পৌত্তলিক ধর্মই প্রাক-খ্রিস্টান ছিল না অথবা তাদের পূজাস্থানের দেশীয় উৎসও ছিল না।[১৫]
এর নামকরণের ইতিহাসের কারণে, পৌত্তলিকতাবাদ ঐতিহ্যগতভাবে শাস্ত্রীয় বিশ্বের আশেপাশের প্রাক-খ্রিস্টান এবং অ-খ্রিস্টান সংস্কৃতিগুলোর একটি সম্মিলিত রূপ হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। এর মধ্যে গ্রিক-রোমান, কেল্টিক, জার্মানিক এবং স্লাভ জাতিগোষ্ঠীগুলোর ধর্মবিশ্বাস অন্তর্ভুক্ত।[১৯] তবে আধুনিক লোকজবিদ ও সমসাময়িক পৌত্তলিকদের ভাষায় এই ধারণা আরও সম্প্রসারিত হয়েছে এবং প্রারম্ভিক খ্রিস্টানদের ব্যবহৃত চার-সহস্রাব্দব্যাপী সীমারেখা ছাড়িয়ে প্রাগৈতিহাসিক যুগের ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলোতেও তা প্রয়োগ করা হয়েছে।[২০]
উপলব্ধি
সম্পাদনাখ্রিস্টানদের দৃষ্টিতে পৌত্তলিকতাবাদকে প্রায়ই ভোগবাদী মানসিকতার সঙ্গে একত্রে দেখা হতো। এটি এমন মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করত যারা ইন্দ্রিয়সুখনিষ্ঠ, বস্তুবাদী, আত্মভোগে রত, ভবিষ্যৎ নিয়ে উদাসীন এবং প্রধানধারার ধর্মগুলোর প্রতি আগ্রহহীন। পৌত্তলিকদের সাধারণত এমন এক স্টেরিওটাইপিকাল রূপে বর্ণনা করা হতো যা এই ধর্মের সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করতে ইচ্ছুকদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করত।[২১]
এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ভিত্তি করে জি. কে. চেস্টারটন লিখেছিলেন: "পৌত্তলিক ব্যক্তি সুস্পষ্ট বোধে নিজেকে উপভোগ করতে চেয়েছিল। কিন্তু সভ্যতার শেষে এসে সে আবিষ্কার করল, একজন মানুষ নিজের আনন্দ ভোগ করতে করতে আর কিছু উপভোগ করতে পারে না।"[২২]
অন্যদিকে, কবি অ্যালজারন চার্লস সুইনবার্ন এই একই প্রসঙ্গে ভিন্নধর্মী মন্তব্য করেন: "তুমি জয়ী হয়েছ, হে ফ্যাকাশে গ্যালিলিয়; তোমার নিঃশ্বাসে পৃথিবী হয়ে গেছে ধূসর; আমরা ভুলে যাওয়ার মদ্যপানে মত্ত হয়েছি, আর মৃত্যুতে তৃপ্তি পেয়েছি।"[২৩]
জাতিকেন্দ্রিকতা
সম্পাদনাসম্প্রতি পৌত্তলিক শব্দটির প্রচলিত ব্যবহার জাতিকেন্দ্রিক (ethnocentric) ও নৈতিক একমেবাদী (moral absolutist) দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত—এই ধারণা প্রস্তাব করা হয়েছে।[২৪][২৫]
গবেষক ডেভিড পেটস উল্লেখ করেন, বিশেষত খ্রিস্টধর্মের প্রসঙ্গে, "...স্থানীয় ধর্মগুলোকে প্রধান 'বিশ্বধর্মগুলোর' বিপরীতে সংজ্ঞায়িত করা হয়; ফলে সেগুলোকে নিজেদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে নয়, বরং বিশ্বধর্ম যা নয় তার প্রতিচ্ছবি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।"[২৬]
পেটস আরও বলেন, বিভিন্ন সংস্কৃতির নানান আধ্যাত্মিক, ধর্মীয় ও দার্শনিক ধারণাগুলো যেগুলোকে "পৌত্তলিক" নামে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর অধ্যয়ন প্রারম্ভিক নৃতত্ত্বচর্চায় আব্রাহামীয় ধর্মগুলোর বিপরীতে করা হতো। তিনি এই দ্বৈততা (binary) কে জাতিকেন্দ্রিকতা এবং ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে ব্যাখ্যা করেন।[২৭]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ Brown, Peter (১৯৯৯)। "Pagan"। Bowersock, Glen Warren; Brown, Peter; Grabar, Oleg। Late Antiquity: A Guide to the Postclassical World । Harvard University Press। পৃষ্ঠা 625–26। আইএসবিএন 978-0-674-51173-6।
- ↑ J. J. O'Donnell (1977), Paganus: Evolution and Use ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৯ মার্চ ২০১৯ তারিখে, Classical Folia, 31: 163–69.
- ↑ Augustine, Divers. Quaest. 83.
- ↑ ক খ Jones, Christopher P. (২০১৪)। Between Pagan and Christian। Cambridge, Massachusetts: Harvard University Press। আইএসবিএন 978-0-674-72520-1।
- ↑ Owen Davies (২০১১)। Paganism: A Very Short Introduction। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 1–2। আইএসবিএন 978-0-19-162001-0।
- ↑ Aitamurto, Kaarina (২০১৬)। Paganism, Traditionalism, Nationalism: Narratives of Russian Rodnoverie। Routledge। পৃষ্ঠা 12–15। আইএসবিএন 978-1-317-08443-3।
- ↑ Owen Davies (২০১১)। Paganism: A Very Short Introduction। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 1–6, 70–83। আইএসবিএন 978-0-19-162001-0।
- ↑ Davies, Owen (2011). Paganism: A Very Short Introduction. New York: Oxford University Press. আইএসবিএন ৯৭৮-০১৯১৬২০০১০.
- ↑ Paganism, Oxford Dictionary (2014)
- ↑ Paganism ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৫ জুন ২০১৮ তারিখে, The Encyclopedia of Religion and Nature, Bron Taylor (2010), Oxford University Press, আইএসবিএন ৯৭৮-০১৯৯৭৫৪৬৭০
- ↑ Lewis, James R. (২০০৪)। The Oxford Handbook of New Religious Movements। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 13। আইএসবিএন 0-19-514986-6।
- ↑ Hanegraff, Wouter J. (১০০৬)। New Age Religion and Western Culture: Esotericism in the Mirror of Secular Thought। Brill। পৃষ্ঠা 84। আইএসবিএন 90-04-10696-0।
- ↑ ক খ Cameron 2011, পৃ. 28, 30।
- ↑ Cameron 2011, পৃ. 26–27।
- ↑ ক খ Davies 2011, Defining paganism।
- ↑ Cameron 2011, পৃ. 26।
- ↑ Cameron 2011, পৃ. 27, 31।
- ↑ Cameron 2011, পৃ. 29।
- ↑ Cameron 2011, পৃ. 28।
- ↑ Davies 2011, Chapter 1: The ancient world।
- ↑ Antonio Virgili, Culti misterici ed orientali a Pompei, Roma, Gangemi, 2008
- ↑ Heretics, জি. কে. চেস্টারটন, ২০০৭, হেন্ড্রিকসন পাবলিশার্স ইনক., পৃষ্ঠা ৮৮
- ↑ Hymn to Proserpine
- ↑ Hanegraaff, Wouter (২০১৬)। "Reconstructing "Religion" from the Bottom Up"। Numen। 63 (5/6): 576–605। hdl:11245.1/8b66dd94-5e6c-4c56-95ec-dbf822201e46। এসটুসিআইডি 171686966। জেস্টোর 44505310। ডিওআই:10.1163/15685276-12341439।
- ↑ Blumberg, Antonia (২৭ মে ২০১৬)। "What Not To Say When You Meet Someone Who Is Pagan"। Huffington Post। সংগ্রহের তারিখ ২৩ মার্চ ২০২১।
- ↑ Petts, David (২৬ মে ২০১১)। Pagan and Christian: Religious Change in Early Medieval Europe। London: Bristol Classical Press। পৃষ্ঠা 31। আইএসবিএন 978-0-7156-3754-8।
- ↑ Kourbage, Melanie। "Kourbage on Petts, 'Pagan and Christian: Religious Change in Early Medieval Europe'"। Humanities and Social Sciences Online। H-German। সংগ্রহের তারিখ ২৩ মার্চ ২০২১।