পার্বতীকুমার সরকার

ড.পার্বতীকুমার সরকার ( ২ সেপ্টেম্বর ১৯২৩ - ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৬) ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় বাঙালি ভূতাত্ত্বিক ও সমাজতত্ত্ববিদ। তিনি ছিলেন স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্ক এর ভূতত্ত্ব বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক এবং পরে ইমেরিটাস অধ্যাপক হন। [১]

পার্বতীকুমার সরকার
জন্ম(১৯২৩-০৯-০২)২ সেপ্টেম্বর ১৯২৩
কাঁচড়াপাড়া
মৃত্যু১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৬(1996-12-19) (বয়স ৭৩)
দাম্পত্য সঙ্গীমঞ্জুশ্রী চাকী সরকার (বি.১৯৫৮)
সন্তানরঞ্জাবতী সরকার (কন্যা)
পিতা-মাতাসুরেন্দ্রনাথ সরকার (পিতা)
সুবর্ণলতা সরকার (মাতা)

জন্ম ও শিক্ষা জীবন সম্পাদনা

পার্বতীকুমার সরকারের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কাঁচরাপাড়ায়। পিতা সুরেন্দ্রনাথ সরকার ও মাতা সুবর্ণলতা সরকার। জন্মের পরই মাতাপিতা হাওড়ার শালকিয়ায় চলে আসায় তার বিদ্যালয়ের পাঠ শুরু হয় শালকিয়াতেই। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি শালকিয়া স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন এবং মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে আই.এসসি ও পদার্থবিদ্যায় সাম্মানিকসহ বি.এসসি পাশ করেন। স্নাতক হওয়ার পর কিছুদিন তিনি কলেজেই ডেমনস্টেটর হিসাবে কাজ করেন। পরে ভূগোল বিষয়ের ছাত্র হিসাবে যোগ দেন এবং ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এসসি পাশ করেন। ভূগোল বিভাগে প্রথম প্রবর্তিত স্টেট স্কলারশিপ লাভ করে তিনি ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে উচ্চ শিক্ষার্থে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের যান। পশ্চিমবঙ্গে বন্যার সমস্যা বিষয়ে গবেষণা করে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবন সম্পাদনা

দেশে ফিরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে অধ্যাপনা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে 'স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' চালু হলে, তিনি আফ্রিকান বিভাগে যোগ দেন এবং সেখান থেকেই আফ্রিকা সম্পর্ক তার পঠনপাঠন ও গবেষণা শুরু হয় এবং অল্প সময়েই তিনি বিশেষজ্ঞের স্বীকৃতি লাভ করেন। এরপর চণ্ডীগড়ে নতুন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে, তিনি ভূগোল বিভাগে ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে নবগঠিত নাইজিরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে সস্ত্রীক নাইজিরিয়া যান। সেখানে ভূগোল বিভাগ সংগঠনে অসামান্য দক্ষতার স্বীকৃতিতে তিনি সোশ্যাল সায়েন্সে বিভাগের ডিন পদে উন্নীত হন। আফ্রিকায় অবস্থানকালে পার্বতীকুমার আফ্রিকার জাতি গঠনের সমস্যা এবং পলিটিক্যাল জিওগ্রাফির উপর বেশ কয়েকটি মৌলিক গবেষণামূলক নিবন্ধ রচনা করেন। পরে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে নাইজিরিয়াতে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে তিনি ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে সপরিবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং নিউ ইয়র্কের আলস্টার কাউন্টিতে অবস্থিত 'স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্কে'র নিউ পলৎজ ক্যাম্পাসে আফ্রিকা বিশেষজ্ঞ হিসাবে যোগ দেন। সেখানে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় শিক্ষক হিসাবে সকলের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। দীর্ঘ ঊনিশ বৎসর অধ্যাপনার পর ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। খ্যাতিমান অধ্যাপকের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমে 'ডিস্টিংগুইস্ট প্রফেসর' ও পরে 'ইমেরিটাস প্রফেসর' উপাধিতে ভূষিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময় তিনি নিয়মিতই আফ্রিকান স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশন ও তার সদস্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।

অবসর গ্রহণের পর দেশে ফিরে ইন্ডিয়ান জিয়োগ্রাফার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং জিয়োগ্রাফিক্যাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার সভাপতি হন। সেই সঙ্গে জলবায়ুবিদ্যা তথা আবহ বিজ্ঞান বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর পদে অধ্যাপনা করেন। ভূতত্ত্বের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বৈজ্ঞানিক পত্র-পত্রিকায় অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন।১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তার রচিত গ্রন্থ- ডেভেলপমেন্ট থ্রু ইনট্রিগেশন অন দ্য ইস্ট আফ্রিকান এক্সপেরিয়েন্স সমাজবিজ্ঞান মহলে বিশেষ সমাদৃত লাভ করেছিল। রবীন্দ্রভাবনার উপর অধ্যাপক সরকারের জীবনদর্শন গড়ে উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অধ্যাপক নির্মল বসুর সংস্পর্শে আসেন। তার যুক্তিবাদী মনের উপর অধ্যাপক বসুর প্রভাব গভীরভাবে পড়েছিল। দক্ষিন এশিয়ার কলা ও সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে তিনি ও তার খ্যাতনামা নৃত্যশিল্পী মঞ্জুশ্রী চাকী সরকারের সঙ্গে যুগ্মভাবে বহু প্রবন্ধ রচনা করেন। সেগুলি বিভিন্ন সময়ে দেশবিদেশের পত্রপত্রিকার প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক পার্বতীকুমার সরকারের আগ্রহেই ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের শান্তিনিকেতনে গঠিত হয় অখিল ভারত ভূবিদ্যা ও পরিবেশ সমিতি। কলকাতার সল্টলেকে মঞ্জুশ্রী চাকী সরকারের প্রতিষ্ঠিত ডান্সার্স গিল্ড এর প্রাণপুরুষ ছিলেন তিনি।

পারিবারিক জীবন ও জীবনাবসান সম্পাদনা

অধ্যাপক পার্বতীকুমার সরকার ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী মঞ্জুশ্রী চাকীকে (১৯৩৪ - ২০০০) বিবাহ করেন। তাদের একমাত্র কন্যাসন্তান রঞ্জাবতী সরকারও (১৯৬৩ - ১৯৯৯) ছিলেন একজন স্বনামধন্য নৃত্যশিল্পী। পার্বতীকুমার সরকার ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ডিসেম্বর বিদেশে প্রয়াত হন এবং তার মরদেহ কলকাতায় এনে অন্তিম সংস্কারের ব্যবস্থা করেন মঞ্জুশ্রী। [২]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা ২১৮, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
  2. "রঞ্জাবতীর মৃত্যু আজও রহস্য! তাঁর ব্যর্থ প্রেমিক উত্তীয়, প্রাক্তন স্বামী স্যমন্তকের মৃত্যুও কুয়াশায় মোড়া"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-২৪