পর্যায় সারণির ইতিহাস

পর্যায় সারণির ইতিহাস উপাদানগুলির রাসায়নিক এবং ভৌত বৈশিষ্ট্য বোঝার ক্ষেত্রে দুই শতাব্দীর বিকাশের প্রতিফলন ঘটায়, যাতে প্রধানত অবদান রেখেছেন- অঁতোয়ান লাভোয়াজিয়ে, ইয়োহান ভোলফগাং ডোবেরেইনার, জন নিউল্যান্ড, ইউলিয়ুস লোটার মাইয়ার, গ্লেন থিওডোর সিবোর্গ এবং আরও কিছু রসায়নবিদ

১৮৬৯ সালে রুশ ভাষায় তৈরিকৃত মেন্দেলিয়েভের পর্যায় সারণি।

২০১২ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ১১৮টি মৌল শনাক্ত হয়েছে। গোড়ার দিকে বিজ্ঞানীরা মৌলগুলোকে ধাতু এবং অধাতু, এই দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন। কিন্তু এই বিভাজন খুব বেশি ফলপ্রসূ হয়নি, কারণ ধাতব ও অধাতব মৌলের ধর্মের প্রভেদ খুব স্পষ্ট নয়। ডাল্টনের পরমাণুতত্ত্ব প্রকাশিত হওয়ার পর মৌলসমূহের পারমাণবিক ভরের সঙ্গে তাদের ধর্মের সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত সঠিক পারমাণবিক ভর নির্ণয়ের পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি, ততদিন পর্যন্ত মৌলের স্বাভাবিক শ্রেণিবিন্যাসের কাজ বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। মৌলসমূহের সঠিক পারমাণবিক ভর নির্ণীত হওয়ার পরেই মৌলসমূহের পারমাণবিক গুরুত্ব ও তাদের ধর্মের সমন্বয় সাধন করে মৌলগুলোর শ্রেণিবিন্যাসের প্রচেষ্টা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। যা থেকে আধুনিক পর্যায় সারণির উদ্ভব হয়।

১৭৮৯ সালে রসায়নবিদ অঁতোয়ান লাভোয়াজিয়ে তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ৩৩ টি রাসায়নিক উপাদানকে ধাতু ও অধাতু, এই দুইভাগে বিভক্ত করেন। যদিও লাভোয়াজিয়ের সমসাময়িক রসায়নবিদগণ আরও উন্নত শ্রেণীবিন্যাসকরণ পদ্ধতির সন্ধান করছিলেন।

১৮২৯ সালে জার্মান রসায়নবিদ ইয়োহান ভোলফগাং ডোবেরেইনার প্রমাণ করেন, তিনটি করে মৌল একই ধর্ম প্রদর্শন করে। তিনি প্রথমে পারমাণবিক ভর অনুযায়ী তিনটি করে মৌল সাজিয়ে মৌলের একটি সারণি তৈরি করেন। ডোবেরেইনার আরো প্রমাণ করেন, ২য় মৌলের পারমাণবিক ভর ১ম ও ৩য় মৌলের পারমাণবিক ভরের যোগফলের অর্ধেক বা তার কাছাকাছি। একে ডোবেরেইনারের ত্রয়ীসূত্র বলে।

ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী বিজ্ঞানী জন নিউল্যান্ড ১৮৬৪ সালে তখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত মৌলগুলোকে তাদের ভর অনুসারে সাজিয়ে মৌলগুলোর প্রতি অষ্টম মৌলসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মের মধ্যে মিল পান।

পরবর্তীকালে ১৮৬৯ সালে রুশ বিজ্ঞানী দিমিত্রি মেন্ডেলিফের সকল মৌলের জন্য একটি সাধারণ পর্যায় সূত্র আবিষ্কার করেন, যা হলো- "মৌলসমূহের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম তাদের পারমাণবিক ভর বৃদ্ধির সঙ্গে পর্যায় ক্রমে আবর্তিত হয়"। উক্ত সূত্রানুসারে তিনি ও জার্মান বিজ্ঞানী ইউলিয়ুস লোটার মাইয়ার মিলে আধুনিক পর্যায় সারণি প্রকাশ করেন। তখন ৬৭ টি মৌল নিয়ে পর্যায় সারণি গঠিত হয়েছিল যার মধ্যে ৬৩ টি আবিষ্কৃত হয়েছিলো। ১৯০০ সালের মধ্যে আরও ৩০ টি মৌল পর্যায় সারণিতে যুক্ত হয়। এভাবেই সূচনা হয় আধুনিক পর্যায় সারণির।

মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণি আবিষ্কার ছিল রসায়নের জগতে এক নতুন যুগের সূচনা। যদিও প্রাথমিক অবস্থাতে মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণিতে বেশ কিছু ভুল ছিল। এই ভুলগুলির মধ্যে অন্যতম ভুল ছিল পর্যায় সারণিতে অসম্পূর্ণ সারির উপস্থিতি। যদিও, তখনও সমস্ত প্রাকৃতিক মৌলও আবিষ্কৃত হয়নি। পরে মোজলে, পাউলিং, বার্টলেট-দের মত বিজ্ঞানীরা ধীরে ধীরে বিভিন্ন এই ভুলগুলি সংশোধন করেন।

প্রথমদিকে পারমাণবিক ভরের উপর নির্ভর করে পর্যায় সারণি সাজানো হয়েছিল। কিন্তু এতে মৌলের ধর্মের শ্রেণিবিন্যাসকরণে ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। ১৯১৩ সালে রসায়নবিদ হেনরি মোসলে পারমাণবিক ভরের পদলে পারমাণবিক সংখ্যা অনুযায়ী মৌলসমূহকে সাজানোর প্রস্তাব দেন। বর্তমানে আধুনিক পর্যায় সারণির জনক তাকে বলা হয়।

আন্তর্জাতিক রসায়ন ও ফলিত রসায়ন সংস্থা (International Union of Pure and Applied Chemistry বা সংক্ষেপে IUPAC) এখন পর্যন্ত ১১৮টি মৌলিক পদার্থকে শনাক্ত করেছে। IUPAC সংস্থাটি আন্তর্জাতিকভাবে রসায়ন ও ফলিত রসায়নের বিভিন্ন নিয়মকানুন, ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের কোনটি গ্রহণ করা যায় এবং কোনটি বর্জন করা উচিত এই বিষয়গুলো দেখাশোনা এবং নিয়ন্ত্রণ করে। ১১৮ টি মৌলের মধ্যে ৯২ টি মৌল (হাইড্রোজেন থেকে ইউরেনিয়াম) প্রকৃতিতে স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায় (যদিও ৪৩ ও ৬১ নং মৌলদুটিকে প্রকৃতিতে স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যায় না) এবং বাকি ২৬ টি মৌল পরীক্ষাগারে তৈরি করা হয়েছে।

লাভোয়াজিয়ে মাত্র ৩৩টি মৌল নিয়ে ছক তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। মেন্দেলিয়েভ ৬৩টি আবিষ্কৃত মৌল এবং একটি অনাবিষ্কৃত মৌল নিয়ে পর্যায় সারণি নামে যে ছকটি তৈরি করেছিলেন, বর্তমানে সেটি ১১৮টি মৌলের আধুনিক পর্যায় সারণি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

২০১৯ সালে জাতিসংঘ পর্যায় সারণি উদ্ভাবনের ১৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করে, এবং পর্যায় সারণিকে "বিজ্ঞানের অন্যতম যুগান্তকারী অর্জন" নামে অভিহিত করে।

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র ও টীকা

সম্পাদনা