নেহেরুর পররাষ্ট্রনীতি

প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু আধুনিক ভারতের স্থপতি। জওহরলাল নেহেরু ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট হতে ১৯৬৪ সালের ২৭ মে পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন ভারতের অভ্যন্তরীন কোন্দল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নেহেরু ভারতের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। নেহেরু নিজে ও তার পরামর্শদাতাদের সহায়তায় বর্হিবিশ্বের সাথে দীর্ঘ ১৭ বছর দক্ষ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করেছেন।

এক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পরিচালিত পররাষ্ট্রনীতির ধারণা বাতিল করেন এবং নেহেরু নিজে পররাষ্ট্রনীতির মূল কাঠামো প্রণয়ন করেন এবং তার পররাষ্টনীতির বৈশিষ্ট্য ছিল- আদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি সাথে পঞ্চশীল, জোট নিরপেক্ষতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং বর্ণবাদ বিরোধী। তিনি অন্যান্য রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিসহ তৎকালীন আর্ন্তজাতিক বিষয়াবলীর উপর গুরুত্ব প্রদান করে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করেন। তিনি অভ্যন্তরীন নীতি ও পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন। নেহেরু আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ভারতকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নেহেরু ভারতের জন্য একটি সময়োপযোগী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করেন। ১৯৪৭-১৯৬৪ সময়কালে নেহেরুর পররাষ্টনীতির প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় পরাশক্তি ভারতের সাথে সুসসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। নেহেরুর পররাষ্ট্রনীতি সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা ও গান্ধীর সত্যাগ্রহ নীতি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। 

নেহেরুর পররাষ্ট্রনীতির আদর্শগত ধারণাঃ

নেহেরুর পররাষ্ট্রনীতি দুইটি আদর্শগত ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়। এগুলো হলোঃ

প্রথমত স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে মার্কিন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্লক থেকে স্পষ্টভাবে ভারতকে পৃথক রাখা এবং 

দ্বিতীয়তঃ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সকল ক্ষেত্রে ভারতের সুনাম ও সততা বজায় রাখা। 

জওহর লাল নেহরুর পররাষ্ট্রনীতি মূলনীতিঃ

১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল স্বাক্ষরিত পঞ্চশীল নীতির উপর ভিত্তি করে জওহর লাল নেহেরুর পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি গঠিত হয়। এ পাঁচটি মূলনীতি হলোঃ

১.অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা।

২.একে অপরের বিরুদ্ধে অনাক্রমণ।

৩.একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা।

৪.সমতা ও পারস্পরিক সুবিধা।

৫.শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

আর্ন্তজাতিক সংগঠন ও সম্মেলনঃ

১.কমনওয়েলথঃ নেহেরু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাথে সুসম্পর্ক রাখার অংশ হিসেবে ঘোষণা করেন যে, ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে ভারত প্রজাতন্ত্র হলে ব্রিটিশ কলোনী থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশসমূহকে নিয়ে গঠিত কমনওয়েলথ এ যোগদান করবে। 

২.জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনঃ ১৯৬১ সালে বেলগ্রেডে প্রতিষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জওহর লাল নেহেরুর আর্ন্তজাতিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হলো জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন। এ প্রেক্ষিতে টিটো, নাসের ও উ নু এর সাথে মিত্র গড়ে ওঠে, যার ফলাফল জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন। নেহেরু শান্তিবাদের প্রচারক এবং জাতিসংঘের একজন শক্তিশালী সমর্থক ছিলেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন দেশসমূহের প্রতিদ্বন্দ্বী ব্লক থেকে নিরপেক্ষ দেশসমূহের সহযোগিতায় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন নীতি প্রবর্তন করেন। 

৩.বান্দুং সম্মেলন বা আফ্রো-এশিয়ান সম্মেলন, ১৯৫৫ঃ ১৯৫৫ সালে ১৮-২৪ তারিখে বান্দুং এ অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশিয়ান সম্মেলনে নেহেরু অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও এ সম্মেলনে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা, মানবাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং বিশ্ব শান্তি ও সহযোগিতার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এ সম্মেলনে তার জোট নিরপেক্ষতা নীতি জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ সম্মেলনে জাতিসংঘের ১০ দফা “বিশ্ব শান্তি ও সহযোগিতা প্রচার ঘোষণা” এবং ভারতের  প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরুর পাঁচ মূলনীতি (অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা, একে অপরের বিরুদ্ধে অনাক্রমণ, একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, সমতা ও পারস্পরিক সুবিধা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান) সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

আর্ন্তজাতিক চুক্তিঃ

১.পঞ্চশীলঃ ভারত বিশ্বের সকল রাষ্ট্র, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে শান্তিপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪ সালে ২৮ এপ্রিল চীনের সাথে পাঁচটি দিকনিদের্শক সংবলিত শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা পঞ্চশীল নামে পরিচিত। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালের এপ্রিলে বার্মা, চীন, লাওস, নেপাল, ভিয়েতনাম, যুগোস্লাভিয়া ও কম্বোডিয়া এ নীতি গ্রহণ করে।

২.দিল্লী চুক্তি-১৯৫০ঃ দিল্লী  চুক্তি ভারত ও পাকিস্তানে মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। এ চুক্তির মাধ্যমে উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তনের সুযোগ প্রদান, অপহরণকৃত মহিলাদের মুক্ত করা, লুন্ঠিত মালামাল প্রেরণ প্রদান, সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ করা হয়। ১৯৫০ সালে ৮ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর মধ্যে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

৩.নেহেরু-নুন চুক্তি, ১৯৫৮ঃ ১৯৫৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নূন এর মধ্যে সীমানা নির্ধারণ ও ছিটমহল সংক্রান্ত যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তা নেহেরু-নূন চুক্তি নামে পরিচিত। এ চুক্তিতে তিনটি বিষয় প্রধান্য পায়, এগুলো হলোঃ

ক) সীমানা নির্ধারণ এবং ১২ নং দক্ষিণ বেরুবাড়ি ইউনিয়নের সীমান্ত সমস্যা সমাধান।

খ) ভারতে অবস্থিত পাকিস্থানের ৫৩ টি ছিটমহল এবং পাকিস্থানে অবস্থিত ভারতে ১১৩ টি ছিটমহল বিনিময় সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

গ) ভুলভাবে নির্ধারিত সীমানা সংশোধন।

৪.পানি চুক্তি-১৯৬০ঃ ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর করাচিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানে প্রসিডেন্ট আইয়ুব খানের মধ্যে পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির প্রেক্ষিতে পাকিস্তান সিন্ধু অববাহিকায়- সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব নদীর পানি প্রবাহ পাকিস্তানকে বণ্টন করা হয় এবং এর পাশাপাশি ভারত রবি, বিস ও শতদ্রু নদীর পানির প্রবাহ বিশেষভাবে ভারতের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। এ চুক্তিকে বিশ্বের সবচেয়ে সফল পানি বণ্টন চুক্তি বলে অভিহিত করা হয়।

৫.চিরস্থায়ী শান্তি ও বন্ধুত্ব চুক্তিঃ ১৯৪৯ সালের ৮ আগস্ট দার্জিলিং এ ভারত ও ভূটানের মধ্যে চিরস্থায়ী শান্তি ও বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

৬.ভারত-নেপাল শান্তি ও বন্ধুত্ব চুক্তিঃ ১৯৫০ সালের ৩১ জুলাই ভারত ও নেপালের মধ্যে ভারত-নেপাল শান্তি ও বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

৭.নেহেরু-কটিলাওয়ালা চুক্তিঃ ১৯৫৪ সালের ১৮ জানুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ও শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী জন কটিলাওয়ালা মধ্যে তামিল নাগরিক সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

 আর্ন্তজাতিক ভূমিকাঃ

১.কোরিয়া যুদ্ধ, ১৯৫০ঃ ১৯৫০ সালে সংঘঠিত কোরিয়া যুদ্ধ নিয়ে নেহেরু উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, এ যুদ্ধ তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধে পরিণত হতে পারে এবং এতে পারমাণবিক বোমার ব্যবহার হতে পারে। এর পাশাপাশি এ যুদ্ধ ভারতকে সম্পৃক্ত করতে পারে। ভারত কোরিয়া যুদ্ধে মধ্যস্থকারীর ভূমিকা গ্রহণ করে। এ প্রেক্ষিতে The New York Times পত্রিকায় প্রকাশ করে যে, the struggle for Asia “could be won or lost in the mind of one man – Jawaharlal Nehru”|

ভারত নিরাপত্তা পরিষদের ৮২ ও ৮৩ নং রেজুলেশনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে আক্রমণকারী দেশ উত্তর কোরিয়ার প্রতি নিন্দা জানায়। এর পাশাপশি দক্ষিণ কোরিয়াকে ৮৪ নং রেজুলেশনের মাধ্যমে অস্ত্র সহায়তা প্রদানকেও ভারত সমর্থন করেনি। ভারত জাতিসংঘ ভারতকে সৈন্য প্রেরণ করতে বললেও তা না করে ভারত উভয় কোরিয়াতে চিকিৎসক দল প্রেরণ করে। ১৯৪৭ সালে অবিভক্ত কোরিয়া সংক্রান্ত নির্বাচনে জাতিসংঘের ৯ সদস্য বিশিষ্ট পর্যবেক্ষণ দলের প্রধান ছিল ভারত। এ সকল যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেহেরুর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে বিশ্বরাজনীতি কোন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা তার অংশগ্রহণ ব্যতীত সম্পন্ন হয়নি। 

২.ইন্দো-চীন সম্পর্কঃ কোরিয়া যুদ্ধ সমাপ্তি পরে এশিয়ায় ক্ষণস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৪ সালের প্রথমভাগে ইন্দো-চীন পরিস্থিতি পরবর্তী সমস্যা হিসেবে উপনীত হতে থাকে। এ প্রেক্ষিতে ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নেহেরু অস্ত্রবিরতির প্রস্তাব করেন, যা ১৯৫৪ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত কলম্বো সম্মেলনে এশিয়ার বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ কর্তৃক সমর্থন লাভ করে। ইন্দো-চীন ¯œায়ুযুদ্ধের মারাক্তক হুমকীর মুখে পড়লে এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নেহেরু যে পরামর্শ প্রদান করেন, তা যথার্থতা লাভ করে।

৩.সুয়েজ খাল ইস্যুঃ ১৯৫৬ সালে মিশর সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করে। এই সিদ্ধান্ত খাল ব্যবহার কারীদের জন্য একটি মারাক্তক হুমকী এবং এ প্রেক্ষিতে ব্রিটেন ও ফ্রান্স এই খালের উপর আর্ন্তজাতিক নিয়ন্ত্রণ দাবি করে। কিন্তু ভারত এই খালের অত্যন্ত ব্যবহারকারী হলেও কনস্টান্টিনোপল কনভেনশন (১৮৮৮) অনুযায়ী সুয়েজ খালকে মিশরের অভ্যন্তরীন অংশ বলে উল্লেখ করে। ভারত ১৯৫৬ সালে আগস্ট লন্ডন সম্মেলনে কায়রো ও লন্ডন উভয় দেশকে জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানায়। পরবর্তীতে বৃটেন ও ফান্সের নেতৃত্বে ইসরাইল মিশর আক্রমণ করে এবং সুয়েজ খালে সৈন্যদল প্রেরণ করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ এ ঘটনার নিন্দা জ্ঞাপন করে। এ ঘটনাকে নেহেরু ‘ঘৃণ্য আগ্রাসন’ ও ‘অতীতের উপনিবেশিক পদ্ধতির দিকে প্রত্যাবর্তন’ বলে অভিহিত করেন।

৪.হাঙ্গেরীঃ ১৯৬৫ সালে অক্টোবর মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের হাঙ্গেরীতে অবৈধ প্রবেশের নিন্দা জানায়। এ অসন্তুষ্টির বর্হিপ্রকাশ হিসেবে পরবর্তী দুই বছর বুদাপেষ্টে কোন কূটনৈতিক প্রেরণ করেননি।

৫.কঙ্গোঃ ১৯৬০ সালের ৩০ জানুয়ারি কঙ্গো বেলজিয়ামের নিকট হতে স্বাধীনতা লাভের পর আটকে পড়া বেলজিয়ামের নাগরিকদের উদ্ধারের জন্য বেলজিয়াম পূনরায় সৈন্য প্রেরণ করে। কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের কাছে প্রয়োজনীয় সহায়তা চেয়ে আবেদন করে। এ প্রেক্ষিতে নেহেরু কঙ্গো থেকে বৈদেশিক সৈন্য অপসারন, গৃহযুদ্ধ বন্ধ, সংসদ আহবান ও নতুন সরকার গঠন করতে জাতিসংঘের কার্যকরী ভূমিকা পালনের জোর দাবি জানান। ১৯৬১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী সফলতার সাথে কাটাং এর গৃহযুদ্ধ বন্ধসহ কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে এবং ১৯৬৩ সালের মধ্যে সমগ্র দেশে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে।

৬.ইসরাইল ও ফিলিস্তিন ইস্যুঃ ভারত ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তানী বিভাজন পরিকল্পনাকে সমর্থন করেনি এবং ১৯৪৯ সালে ইসরাইলকে জাতিসংঘের অর্ন্তভূক্তি প্রসঙ্গে ভারত ভেটো প্রদান করে। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ভারত ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। নেহেরু ফিলিস্তিনে সমর্থক ছিলেন এবং তিনি ধর্মের ভিত্তি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং বিশেষ করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ছিলেন। ১৯৫৪ সালে নেহেরু আর্ন্তজাতিক আইনের লঙ্ঘন করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।

পরাশক্তির সাথে সম্পর্ক

১.মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রঃ ১৯৪৮ সালে নেহেরু কাশ্মীর ইস্যুতে মার্কিন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালের ১৩ অক্টোবর ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মাল্টি সপ্তাহ সফরকালে প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানের সাথে সাক্ষাত করেন। এ সফর দু’দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করে। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৪৮-১৯৫৯ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১.৭ বিলিয়ন উপহার হিসেবে প্রদান কওে যার মধ্যে ৯৩১ মিলিয়ন খাদ্য সহায়তা ছিল। ১৯৫৯ সালের ৯ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে আইজেনহাওয়ার ভারত সফর করেন। তিনি রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ ও প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সাথে সাক্ষাত করেন এবং সংসদে ভাষণ প্রদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ১ বিলিয়ন উন্নয়ন ঋণসহ ১.৩ বিলিয়ন খাদ্য বিনামূল্যে প্রদান করে। ভারতের সাথে চীনের মধ্যে সীমান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এ প্রেক্ষিতে ১৯৬২ সালের ২০ অক্টোবর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে ভারতের প্রতি সমর্থন প্রদানের জন্য অনুরোধ জানালে কেনেডি তাতে সম্মতি জ্ঞাপনসহ ম্যাকমোহন লাইনের প্রতি সমর্থন জানায় এবং বিমান ও অস্ত্র সহায়তা প্রদান করে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরুর পূর্ব পর্যন্ত এ সহযোগিতা অব্যাহত ছিল।  

২.সোভিয়েত ইউনিয়নঃ সোভিয়েত ইউনিয়নের তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের অংশ হিসেবে ১৯৫০ সালের শুরুতেই ভারতের সাথে ঘনিষ্ট দ্বিপাক্ষিক গড়ে ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৫৫ সালের জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের অংশ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন এবং ক্রশেভের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৫৯ সালে চীনের সাথে সীমান্ত বিরোধ ও ১৯৬২ সালের অক্টোম্বরে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন তার নিরপেক্ষতার কথা ঘোষণা করে, যা নেহেরুর পররাষ্ট্রনীতির বড় সাফল্য। এছাড়ার এসময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে। ১৯৬২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিগ-২১ জেট বিমান প্রস্তুতকরণ সংক্রান্ত প্রযুক্তি হস্তান্তর করে, যা ইতিপূর্বে চীনকে প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে জওহরলাল নেহেরু সময় ঘনিষ্ট দ্বিপাক্সিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তীতে অবিচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত ছিল। এটি নেহেরু পররাষ্ট্রনীতির বৃহৎ সাফল্য।

প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে সম্পর্কঃ

১.পাকিস্তানঃ নেহেরু ও কংগ্রেস পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হলেও স্নায়ুযুদ্ধকালীন ব্লক দেশগুলোর অসম রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার সাথে পাকিস্তানের মার্কিন ব্লকে অবস্থান, জুনাগড় সমস্যা ও কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তান সম্পর্কে তেমন অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। নেহেরু ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করতে চাইলেও রাজনৈতিক উদ্ভত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তা সফলতা অর্জন করতে পারেনি। যদিও এসময় উভয়দেশের মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

২.কাশ্মীর ইস্যুঃ কাশ্মীর সমস্যা একটি ভারত-পাকিস্তানের একটি চিরস্থায়ী সমস্যা এবং নেহেরু কাশ্মীর ইস্যুতে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সাথে আপস-মিমাংসায় পৌছাতে ব্যর্থ হন। তিনি জাতিসংঘের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেন। নেহেরু ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় কাশ্মীরে গনভোট অনুষ্ঠানের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। ১৯৫৩ সালে নেহেরু গনভোটে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯৫৩ সালে নেহেরু কাশ্মীরি রাজনীতিবিদ আব্দুল্লাহকে গ্রেপ্তার করেন, যদিও পূর্বে তাকে সমর্থন করেছিলেন। কারণ নেহেরু সন্দেহ করেন যে, তিনি ভারতের কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদীকে আশ্রয় প্রদান করে। এর পরিবর্তে বশির গুল মোহাম্মদকে দায়িত্ব প্রদান করেন। 

৩.চীনঃ নেহেরু শুরু থেকেই চীনের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার নীতি গ্রহণ করেন। ভারত ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারীতে নতুন গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৫০ সালে ভারত-চীন কূটনৈতিক সম্পর্ককে ‘হিন্দি-চীনী ভাই-ভাই’ বলে অভিহিত করা হয়। নেহেরু উভয় দেশের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নেহেরু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কমিউনিস্ট চীনকে সমর্থন, কোরিয়া যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন না করা এবং কোরিয়া সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে চীন তিব্বত দখল করলে ভারত অসন্তুষ্ট হয়। ১৯৫৪ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করে, যাতে ভারত তিব্বতের উপর চীনের অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং উভয় দেশ পঞ্চশীল নীতির অধীনের তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার ও পরিচালিত করতে একমত হয়। ১৯৫৯ সালে দালাইলামা তিব্বত বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে হাজার হাজার উদ্বাস্তু নিয়ে ভারতে আসলে ভারত আশ্রয় প্রদান করে, এঘটনাকে কেন্ত্র কওে উভয়দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

৪.ভারত-চীন যুদ্ধ, ১৯৬২ঃ ১৯৬২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর চীনা বাহিনী সেতুবন্ধ আক্রমণ করে এবং ভারতীয় বাহিনীকে বিতাড়িত করে, কিন্তু একে ক্ষুদ্র ঘটনা করে অভিহিত করা হয়। এসময় নেহেরু লন্ডন সম্মেলনে অবস্থান করছেন এবং দেশে ফিরে আসে ১২ অক্টোম্বর কলম্বো গমন করেন। এক সপ্তাহ পর চীনা বাহিনী ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে বিশেষ করে NEFA পূর্ব সেক্টরে ভারতীয় পোষ্টে (যা অরুনাচল প্রদেশ) ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে। এ প্রেক্ষিতে নেহেরু প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে ১৯৬২ সালের ৯ নভেম্বর পত্র প্রেরণ করেন ও সামরিক সহায়তা কামনা করেন। তিনি বৃটেনের সহায়তা কামনা করেন। এর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চীন একতরফাভাবে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করে। এটি নেহেরুর পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম সাফল্য। [এ, কে, এম কামরুল হাসান মিয়া]