নেরিকা (ধান) বাংলাদেশে নবপ্রবর্তিত এক নতুন প্রজাতির ধান যা বন্যাপরবর্তী সময়ে নাবী আমন হিসেবে চাষ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। এটি একটি উচ্চ ফলনশীল ধান (উফশী)। দেশের বন্যাকবলিত এলাকায় পানি সরে যাওয়ার পর যেসব এলাকায় আমন ধান রোপণের সময় পার হয়ে যায় অথবা প্রচলিত আমন ধানের চারা থাকে না, সেখানে নেরিকা ধানের চাষ করা যায়। তুলনামূলকভাবে অল্প সময়ে ধান ফলে এবং পাকে। স্বল্পজীবনকাল, প্রতিকূলসহিষ্ণু এবং বছরের যে কোন সময় চাষ করার উপযোগিতার কারণে নেরিকা ধান চাষে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জ্জন করেছে। হাওর ও দক্ষিণাঞ্চলসহ দুর্গত এলাকায় চাষের জন্য নেরিকা ধান জাতটি খুবই উপযোগী।[১] এটি আফ্রিকা থেকে আনীত ধান এবং স্থানীয়ভাবে বীজ উৎপাদন করে এর আবাদ বৃদ্ধি করা হচ্ছে।[২]

অন্তর্দেশীয় উপত্যকায় ধান চাষ

আবিষ্কার নামকরণ সম্পাদনা

"নিউ রাইস ফর আফ্রিকা", সংক্ষিপ্ত নাম "নেরিকা", থেকেই নেরিকা ধানের নাম। এশিয়া মহাদেশের "অরাইজা স্যাটাইভা" প্রজাতির সঙ্গে আফ্রিকানর প্রজাতি ‘’অরাইজা গস্ন্যাবারিমা’’ ইন্টারস্পেসিফিক শঙ্করায়নের মাধ্যমে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে পরীক্ষাগারে নেরিকা জাতের ধান উদ্ভাবিত হয়। প্রজননের ইতিহাসে অরাইজা স্যাটাইভা ও অরাইজা গস্ন্যাবারিমা প্রজাতির মধ্যে ইন্টারস্পেসিফিক শঙ্করায়ন করে উচ্চ ফলনশীল জাতের নেরিকা ধান উদ্ভাবন পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সাফল্য বলে দাবি করেছেন গবেষকরা। নেরিকা প্রজাতির ধান উদ্ভাবনের জন্য ড. মন্টি জোন্স প্যাট্রিক এবং হাইব্রিড ধান উদ্ভাবনের জন্য প্রফেসর ইয়ান লং পিংকে বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার-২০০৪ যৌথভাবে প্রদান করা হয়।[২]

প্রচলন সম্পাদনা

এ দেশে আফ্রিকার ধান নেরিকা’র পরীক্ষামূলক চাষাবাদ শুরু হয় ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে মাত্র ৬০ গ্রাম বীজ দিয়ে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে এই ধানের আবাদের হার বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। স্থানীয় ভাবে বীজ উৎপাদন করে এ ধানের চাষ বাড়ানো হচ্ছে। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে এই ধানের ৪৫ মেট্রিক টন বীজ উৎপাদন হয়। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে নেরিকা-১ ও ৪ জাতের দুই মেট্রিক টন এবং নেরিকা-১০ এক মেট্রিক টন ধান বীজ উগান্ডা থেকে আমদানি করা হয়। এর পরপরই বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশান (বিএডিসি) বিভিন্ন বীজ উৎপাদন খামার এবং চুক্তিবদ্ধ চাষী এলাকার মাধ্যমে ২০১০-১১ বোরো মৌসুমে প্রায় ১৮০ মেট্রিক টন বীজ উৎপাদন করে। ২০১১-১২ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন খামার ও চুক্তিবদ্ধ চাষী জোনের মাধ্যমে আউশ মৌসুমে ৮৪ মেট্রিক টন নেরিকা ধানের বীজ উৎপাদন হয়। দুই বছরে প্রায় ৫০০ মেট্রিক টন বীজ উৎপাদন করেছে বিএডিসি। নেরিকা জাতের ধানের আবাদ ক্রমবর্ধমান।

গুণগত বৈশিষ্ট্য সম্পাদনা

নেরিকা ধান বর্ধনশীল পর্যায়ের। এর পাতা চওড়া, মসৃণ, কাণ্ড শক্ত। দ্রুত সময়ের মধ্যে গাছের বৃদ্ধি ঘটে। পুনঃউৎপাদনশীল পর্যায়ে নেরিকা ধান অরাইজা স্যাটাইভা’’র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পাওয়ায় নেরিকা উচ্চ ফলনশীল। আদর্শস্থানীয় ব্যবস্থাপনায় নেরিকা ধানের ফলন হেক্টরপ্রতি ছয় টন পর্যন্ত হয়ে থাকে। স্বাভাবিক পর্যায়ের ব্যবস্থাপনায় হেক্টরপ্রতি চার টন ও সাধারণ ব্যবস্থাপনায় হেক্টরপ্রতি দুই টন ধান উৎপাদন সম্ভব। ৯০-১০০ দিনের মধ্যে নেরিকা-১০ উৎপাদন হয়ে থাকে। ৯৫-১০০ দিনের মধ্যে নেরিকা-১ ও নেরিকা-৪ উৎপাদন হয়। আলোকসংবেদনশীল বিধায় আমাদের দেশে আউশ, আমন ও বোরো তিন মৌসুমেই চাষাবাদের উপযোগী। এক মৌসুমের ফসল কেটেই সেই বীজ দিয়ে পরবর্তী মৌসুমের ফসল আবাদ করা যায়। এক হাজার ধানের ওজন ২৬ থেকে ৩৬ গ্রাম। এর ফলন প্রচলিত জাতের তুলনায় এক থেকে দেড় টন বেশি।

বিশেষগুণাবলী সম্পাদনা

এই ধান প্রতিকূলতা সহিষ্ণু। এই ধান পোকাসহিষ্ণু। বেশি। লবণাক্ত মাটিতে এই ধানের চাষ সম্ভব।এই ধান খরাসহিষ্ণু। বৃষ্টিনির্ভর উঁচু জমিতে চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত। এই ধান গাছের শেকড়, মাটির গভীরে এক মিটার পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে। ফলে গাছ খুব শক্ত, মজবুত হয় এবং মাটির গভীর থেকে খাদ্য উৎপাদন ও পানি সংগ্রহ করতে পারে। ধান ঝরে পড়ে না। ফলে কাটার সময় ফসলের কোন ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। এই ধান পাকার পরও গাছ সবুজ ও শক্ত থাকে। ফলে ফসল বিনষ্ট হয় না। সুন্দর সোনালি রঙের কারণে অনেক দূর থেকেই নেরিকা ধান শনাক্ত করা যায়।[৩]

খরা প্রতিরোধী সম্পাদনা

এটি খরাসহিষ্ণু বিধায় ২১ দিন পর্যন্ত পানি না পেলেও ফসলের ক্ষতি হয় না।

প্রজাতি সম্পাদনা

নেরিকা ধানের রয়েছে কয়েক প্রজাতির জাত। এই ধানের জাত নেরিকা-১ থেকে ১৮ পর্যন্ত। বিভিন্ন প্রজাতির বিভিন্ন বেশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন নেরিকা-১, নেরিকা-৪, নেরিকা-১০ ইত্যাদি। এর মধ্যে এক হাজার ধানের ওজন ২৬ থেকে ৩৬ গ্রামের ধান কাটার পর মাত্র তিন দিনের মধ্যে আবারও বীজ বোনা যায়। সরাসরি ধান ছিটিয়ে কিংবা বীজতলায় চারা তুলে এই ধান চাষ করা সম্ভব।

ফলন সম্পাদনা

নেরিকা-১ হেক্টরপ্রতি সাড়ে চার মেট্রিক টন, নেরিকা-৪ পাঁচ মেট্রিক টন এবং নেরিকা-১০ ছয় মেট্রিক টন উৎপাদন সম্ভব। ব্রিধান-২৮ ও ব্রিধান-২৯ পাকতে ১২৫-১৩০ দিন লাগলেও নেরিকা ধান মাত্র ৯০ দিনে পেকে যায়। এ জাতটির চালে পুষ্টিমানও বেশি। প্রোটিনের পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ। এশিয়ার অন্য ধানের জাতে প্রোটিন প্রায় আট শতাংশ। মাধবপুর উপজেলার ইটাখোলা বীজ উৎপাদন খামারে নেরিকা-১০ জাতের ধানে হেক্টরপ্রতি ফলন হয়েছে ৫ দশমিক ৯৫ টন। [৩] তবে মরুপ্রবণ রাজশাহী এলাকায় এই ধান চাষ করে খুব কম ফলন পাওয়া গেছে। [৪]

খাদ্যগুণ সম্পাদনা

এই ধানের চালে রয়েছে নয় দশমিক ৫১ থেকে ১১ দশমিক ৮১ ভাগ উচ্চমাত্রার প্রোটিন। ভাত সুস্বাদু। ২৩ থেকে ২৭ দশমিক আট ভাগ পর্যন্ত এমাইজোল বেশি হওয়ায় ভাত হয় ঝরঝরে।

চাষের পদ্ধতি সম্পাদনা

নেরিকা ধান উঁচু জমিতে চাষ উপযোগী। জমিতে দাঁড়ানো পানি সহ্য করতে পারে না। সেচের প্রয়োজন সামান্য। ধানের বর্ধনশীল, কাইচ থোর ও ফুল বের হওয়ার সময় জমিতে জো-অবস্থায় রস থাকা আবশক। সুনিষ্কাশিত বেলে দোআশ ও এটেল দোআশ মাটি এ ধানের উপযোগী। পাহাড়ি জমিতে জুম চাষও করা যাবে।[৫]

জমি তৈরি সম্পাদনা

জমি শুকনো অবস্থায় চাষ ও মই দিয়ে উত্তম রূপে তৈরি করতে হবে। এর ওপর নির্ভর করে প্রয়োগকৃত সারের কার্যকরি ব্যবহার, মাটির রজ্রতা, বাতাল চলাচল, অঙ্কুরোদগম, চারা গজানো, মাটিতে গাছের প্রতিষ্ঠা ও বৃদ্ধি লাভ। জমির মাটি ঝুরঝুরে ও সমান হবে। জমে থাকা পানি নেরিকা ধানের জন্য ক্ষতিকর। সেচ খরচ কম।

বীজ শোধন সম্পাদনা

বীজ বপনের ২-৩ দিন পূর্বে শোধন করে নিলে বীজবাহিত ও মাটি বাহিত রোগ মুক্ত থাকে এবং সমভাবে বীজের অঙ্কুরোদগমন হয়।

বপন সময় সম্পাদনা

নেরিকা ধান আলোক অসংবেদনশীল হওয়ায় আউশ (মার্চ-এপ্রিল), আমন (জুলাই-আগস্ট), বোরো (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) তিন মৌসুমেই আবাদ উপযোগী। স্বল্প জীবনকাল হওয়ায় নাবী আউশ ও নাবী আমন হিসাবে আবাদ হয়। বীজে সুপ্ততা না থাকায় পূর্ববর্তী মৌসুমের বীজ দিয়ে পরবর্তী মৌসুমে ধান আবাদ করা সম্ভব।

বপন পদ্ধতি সম্পাদনা

ডিবলিং পদ্ধতি: প্রতি বপন স্থানে ৫-৭ টি বীজ বপন করে চারার বয়স ১৪-২১ দিন হলে ২-৩ টি চারা রেখে বাঁকি চারা তুলে ফেলতে হবে। বপনের দূরত্ব হবে ২০ সেমি। বীজের হার হেক্টর প্রতি ৫০-৬০ কেজি। এ ছাড়াও সরাসরি ধান বীজ বপন পদ্ধতি, ম্যানুয়ালী বীজ বপন পদ্ধতি, সীড-ড্রিল মারা বীজ বপন পদ্ধতি, প্রি-জার্মিনেটেড পদ্ধতি, আট লাইনে বীজ বপন পদ্ধতি, কাদাময় জমিতে বীজ বপন, বন্যা পরবর্তী জমিতে নাবী আমন, ছিটিয়ে বীজ বপন পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়।

আগাছা দমন সম্পাদনা

জমি ভালভাবে চাষ ও মই দিয়ে তৈরি, আগাছামুক্ত বীজ বপন, অনুমোদিত হারে বীজ বপন, নিড়ানী বা আগাছা দমন যন্ত্র ব্যবহার, প্রয়োজনে ওষুধ প্রয়োগে আগাছা দমন করা যায়।

প্রি-জার্মিনেট সম্পাদনা

এতে ২-৩ দিনের মধ্যে চারা ভালভাবে গজায় ও গাছ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রি-জার্মিনেটের জন্য বীজ ২৪ ঘণ্টা পরিষ্কার পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। এরপর ৩ বার ধুয়ে ৪৮ ঘণ্টা বীজ জাগ দিয়ে রাখতে হবে যেন বীজের মুখ ফেটে অঙ্কুরায়নের পূর্বাবস্থায় আসে।

সার ব্যবস্থাপনা সম্পাদনা

একর প্রতি ১১০ কেজি ইউরিয়া, ৫০ কেজি টিএসপি, ৫০ কেজি এনওপি, ৫ কেজি রোরনমনেট, ৫ কেজি দস্তা ও ৪০ কেজি জিপসাম সার নিয়ম মেনে প্রয়োগ করতে হবে।

সেচ ব্যবস্থাপনা সম্পাদনা

নেরিকা ধান দাঁড়ানো পানি সহ্য করতে পারে না। বৃষ্টিনির্ভর চাষাবাদে সারা মৌসুমে ৫ দিন ১৫-২০ মিমি বৃষ্টিপাত যথেষ্ট। কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাত না হলে বপনকালে, কাইচ থোর অবস্থায় ও ফুল ফোটার সময় গম আবাদের মতো হালকা সেচ দিতে হবে যাতে মাটিতে জো-অবস্থায় রস থাকে।

রোগ ও পোকামাড় দমন ব্যবস্থা সম্পাদনা

ব্লাষ্ট, পাতা পোড়া রোগ, খোল পোড়া, মাজরা পোকা, গলমাছি, গান্ধি পোকা, বাদামী গাছ ফড়িং ইত্যাদি পোকার আক্রমণ ও রোগ বালাই হতে পারে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে এ সমস্যা সমাধান সম্ভব।

ফসল কর্তন, মাড়াই, শুকানো ও সংরক্ষণ সম্পাদনা

নেরিকা ধানের ৮০ ভাগ দানা খড়ের রং ধারণ করলে ধান কর্তনের উপযুক্ত সময়। ধান কাটার সাথে সাথে মাড়াই করা যায়। এর পর শুকাতে হবে। খাদ্যশস্য হিসাবে ১৪% ও বীজ হিসাবে ১২% আর্দ্রতায় বীজ সংরক্ষণ করতে হবে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা