নির্বাক যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অ্যানিমেশন

১৯০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের সূচনা ঘটে। ঐ বছর ভিটাগ্রাফ কোম্পানির স্বল্পদৈর্ঘ্য নির্বাক অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র "হিউমোরাস ফেজেজ অব ফানি ফেসেস (মজার চেহারার সরস দশা)" মুক্তি পায়। [১] গার্টি দ্য ডাইনোসর(১৯১৪),কোকো দ্য ক্লাউন এবং ফেলিক্স দ্য ক্যাটের মুক্তির মাধ্যমে অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র আরো পরিশীলিত হতে শুরু করে।

হিউমোরাস ফেজেজ অব ফানি ফেসেস এর স্ক্রিনশট

শুরুর দিকে কিছু কিছু অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রে জাদু দেখানো হতো। আবার কিছু কিছু চলচ্চিত্র কমিক স্ট্রিপ অবলম্বন করে নির্মিত হয়েছিল। অ্যানিমেশনবিহীন নির্বাক চলচ্চিত্রের (অর্থাৎ যেগুলোতে মানুষ অভিনয় করতেন) মতো অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র পরিবেশিত হওয়ার সময়ও সিনেমা হলে অর্গান বা অর্কেস্ট্রা বাজানো হতো। [২]

ইতিহাস সম্পাদনা

ব্রিটিশ আমেরিকান চলচ্চিত্রনির্মাতা জে স্টুয়ার্ট ব্ল্যাকটন সর্বপ্রথম অ্যানিমেশন কৌশল ব্যবহার করেন। তিনি এনচেন্টেড ড্রয়িংস (১৯০০) চলচ্চিত্রে আঁকা ছবির উপর এ কৌশলগুলো এমনভাবে প্রয়োগ করেন, যেন মনে হবে ছবিগুলো একের পর এক কোন জাদুকরি মন্ত্রে বিলীন হয়ে যাচ্ছে । ১৯০৬ সালে "হিউমোরাস ফেজেজ অব ফানি ফেসেস" চলচ্চিত্রে দেখা যায়, ব্ল্যাকটন কালো বোর্ডে কতকগুলো ছবি এঁকেছেন (ছবিগুলো ছিল মূলত অ্যানিমেটেড কাটআউট)। স্বতঃস্ফূর্ত গতিতে সেই ছবিগুলো একটি একটি করে প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রথাগত ক্যামেরার ফিল্ম ব্যবহার করে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পাওয়া প্রথম অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র এটি। তবে অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রের প্রথাগত ধারার প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র হিসেবে ফ্যান্টাসমাগরি (১৯০৮) স্বীকৃতি লাভ করে। এরপর অনেক শিল্পীই অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে শুরু করেন। এদের মধ্যে একজন উইনসর ম্যাকে। প্রতিটি ডিটেলের প্রতি তাঁর নিখুঁত দৃষ্টি ছিল। তিনি ফ্রেমগুলো কাগজে অঙ্কন করতেন এবং পটভূমি ও কার্টুনগুলো বারবার সেই ফ্রেমের মাধ্যমে পরিবর্তন করা হত। লিটল নিমো,গার্টি দ্য ডাইনোসর এবং সিংকিং অব লুসিতানিয়া তার নির্মিত বিখ্যাত অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র।

১৯১০ সালের দিকে বড় বড় অ্যানিমেশন স্টুডিওগুলো প্রসার পেতে শুরু করে, এবং ম্যাকের মত শিল্পীরা হারিয়ে যেতে শুরু করেন। [৩] ১৯১০ সালের দিকে "কার্টুন শিল্প" একটি পৃথক শিল্পের মর্যাদা পেতে শুরু করে এবং চলচ্চিত্র থিয়েটারে প্রদর্শন করার জন্য কার্টুন নির্মাণ শুরু করে।

১৯১৩ সালে রাউল বারে পেগ সিস্টেম নামক বিশেষ এক ধরনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। অ্যানিমেশনের প্রথম যুগে ছবিগুলো কাগজে এঁকে এদের নিচে দুইটি ছিদ্র করা হত এবং দুইটি পিন ছিদ্রের মধ্যে আটকে দিয়ে কাগজগুলো দেয়ালে সাঁটানো হত। পেগ পদ্ধতি কাজটিকে আরো সহজ করে তুলে। তিনি "স্ল্যাশ অ্যান্ড টিয়ার" নামের একটি কৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন, যার ফলে কার্টুন ছবি সম্পূর্ণ পটভূমি না এঁকেই নির্মাণ করা যায়। [৪] বারে এডিসন স্টুডিও-তে যোগ দেবার পর একটি অ্যানিমেশন স্টুডিও গড়ে তুলেন, যা জনপ্রিয় কমিক স্ট্রিপ ম্যাট এবং জেফের (১৯১৬-১৯২৬) সফল চলচ্চিত্রায়ণ করতে সক্ষম হয়। স্টুডিওটি পরবর্তী জীবনে সুনাম অর্জনকারী অ্যানিমেটর ফ্রাঙ্ক মোসার, গ্রেগরি লা কাভা, টম নর্টন এবং প্যাট সুলিভানের ক্যারিয়ারের ভিত্তি গড়ে দেয়।

১৯১৪ সালে জন ব্রে "জন ব্রে স্টুডিওস"নির্মাণ করেন, যা অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন করে। এর কর্মচারী আর্ল হার্ড স্বচ্ছ সেলুলয়েড কাগজে গতিশীল বস্তুর অ্যানিমেশনের কলাকৌশল উদ্ভাবন করেন, যা সেল টেকনিক নামে পরিচিত। [৩] এর ফলে জন ব্রে স্টুডিওস বিশ্বের প্রথম অ্যানিমেটেড সিরিজ "কর্নেল হিজা লায়ার" নির্মাণ করে। [৫] পল টেরি, ম্যাক্স ফ্লেশার, ওয়াল্টার ল্যান্টজসহ অনেক উচ্চাভিলাষী কার্টুনিস্ট এখানে তাদের ক্যারিয়ার শুরু করেন। এটি ১৯১৪ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। "ফারমার আলফাফা" এবং "ববি বাম্পস" এ স্টুডিও নির্মিত বিখ্যাত কার্টুন চরিত্র।

১৯১৫ সালে ম্যাক্স ফ্লেশার রোটোস্কপিং নামক এক ধরনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। যার ফলে অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র গতিশীল বা "লাইভ-অ্যাকশন"ভাবে নির্মাণ করা সম্ভব হয়। "আউট অব দ্য ইঙ্কওয়েল"(১৯১৮-১৯২৯) সিরিজে এই পদ্ধতিটিই প্রয়োগ করা হয়। সেখানে ম্যাক্স ফ্লেশার ভাঁড়ের চরিত্রে অভিনয় করতেন, যেটি কো-কো-ক্লাউন নামে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে।

মিডিয়া মুঘল উইলিয়াম রেন্ডলফ হার্স্ট ১৯১৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করেন। বারে স্টুডিওর অনেক প্রতিভাবান শিল্পীই এতে যোগ দেন। হার্স্ট এর সংবাদপত্রের কমিক স্ট্রিপগুলোকে এখানে অনেক ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রে রূপায়িত করা হয়। ১৯১৮ সালে বন্ধ হয়ে যাবার আগে অনেক উদীয়মান অ্যানিমেশন প্রতিভা এখানে কাজ করেছেন। "ক্রেজি ক্যাট"ছিল এর সবচেয়ে বিখ্যাত প্রযোজনা।

নির্বাক যুগে অস্ট্রেলীয়-আমেরিকান প্যাট সুলিভান প্রযোজিত ফেলিক্স দ্য ক্যাট সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯১৯ সালের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ফেলাইন ফলিস- এ সর্বপ্রথম এর আবির্ভাব ঘটে। পুরো বিশের দশক জুড়েই এটি জনপ্রিয় ছিল। তবে ১৯৩০ সালে সুলিভান একে সবাক সিরিজে রূপান্তর করে জনপ্রিয়তা অর্জনে ব্যর্থ হন।[৬]

কৌতুকাভিনেতা চার্লস বোয়ার ১৯২০ সালে অনেক অদ্ভুতধর্মী অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এর অনেকগুলোই আজ হারিয়ে গেছে।

নির্বাক অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের তালিকা সম্পাদনা

নির্বাক চলচ্চিত্রের একটি অসম্পূর্ণ তালিকা নিচে দেওয়া হলো:

মুক্তির সাল চলচ্চিত্রনির্মাতা শিরোনাম
১৯০৬ জে. স্টুয়ার্ট ব্ল্যাকটন হিউমোরাস ফেজেজ অব ফানি ফেসেস
১৯১১ উইনসর ম্যাকে লিটল নিমো
১৯১২ উইনসর ম্যাকে হাউ এ মসকিটো অপারেটস
১৯১৪ উইনসর ম্যাকে গার্টি দ্য ডাইনোসর
১৯১৫ উইলিস ও ব্রায়েন দ্য ডাইনোসর অ্যান্ড দ্য মিসিং লিঙ্ক: এ প্রিহিস্টোরিক ট্র্যাজেডি
১৯১৮ উইনসর ম্যাকে দ্য সিংকিং অব লুসিতানিয়া
১৯২১ উইনসর ম্যাকে দ্য সেনাটোরস
১৯২১ জন কোলম্যান টেরি জয়স অ্যান্ড গ্লুমস
১৯২৫ উইলিস ও ব্রায়েন দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Lenburg, Jeff। Encyclopedia of American Cartoons 
  2. https://web.archive.org/web/20080908004550/http://www.neh.gov/news/humanities/2005-01/savingsilents.html
  3. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২১ আগস্ট ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ আগস্ট ২০২০ 
  4. https://archive.org/details/whoswhoinanimate0000lenb
  5. https://web.archive.org/web/20091119055944/http://animation.filmtv.ucla.edu/NewSite/WebPages/Histories.html
  6. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১৪ জুলাই ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ আগস্ট ২০২০