নিয়া গ্লাসি নির্যাতন মামলা

নিয়া গ্লাসি নির্যাতন মামলা ছিল নিউজিল্যান্ডের রোটোরুয়ায় ৩ বছরের এক বালিকার ওপর নির্যাতন ও মৃত্যুর বিষয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের ফৌজদারি তদন্ত এবং পরবর্তীতে হত্যার বিচার।

নিয়া মারি গ্লাসি একটি ৩ বছরের মেয়ে ছিল যে তার মায়ের প্রেমিক এবং তার ভাইদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে শেষ পর্যন্ত হত্যার শিকার হয়েছিল। তার মৃত্যু নিউজিল্যান্ডে বড় ধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি করে, যার ফলে প্রচার মাধ্যমগুলিতে অসংখ্য বিবরণ বার হয়েছিল এবং প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক এই মামলা সম্পর্কে কথা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন।

নির্যাতন সম্পাদনা

২০০৭ সালের ৩ আগস্ট হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে এবং মস্তিষ্কে আঘাতে মারা যাওয়ার আগে নিয়া কয়েক সপ্তাহ ধরে কিংবা কয়েক মাস ধরে ব্যাপক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। আদালত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে তার উপর মোটা কাষ্ঠ খণ্ড ফেলা হয়েছিল এবং একটি কম্পিউটার গেম থেকে অনুলিপি করা কুস্তির চাল তার উপর অনুশীলন করা হয়েছিল। এছাড়াও, তার ওপর লাথি, মারধর, চড় চলেছিল, তার ওপর ঝাঁপ দেওয়া, তাকে জ্বলন্ত আগুনের ওপর ধরে রাখা, থুথু দেওয়ার মত অত্যাচার করা হয়েছিল। সর্বোচ্চ তাপে থাকা একটি কাপড়ের ড্রায়ারে তাকে রেখে ৩০ মিনিট পর্যন্ত ঘোরানো হয়েছিল।[১] একটি সোফার ভাঁজে তাকে রেখে তার ওপর বসা হয়েছিল, আবর্জনার স্তূপে ফেলা হয়েছিল, অর্ধনগ্ন করে বালির গর্ত দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, দেওয়ালে আছাড় মারা হয়েছিল, উঁচু স্থান থেকে মেঝেতে ফেলা হয়েছিল এবং বহিস্থ একটি ঘূর্ণায়মান কাপড় শুকানোর দড়িতে ঘোরানো হয়েছিল যতক্ষণ না সে ছিটকে পড়ে যায়।[২]

সেই সময় তার মা, ৩৫ বছর বয়সী লিসা মিশেল কুকা হাসপাতালকে বলেছিলেন যে তার আঘাতগুলি তার সঙ্গীর (তখন ১৭ বছর বয়সী ওয়্যারমু তে আরোহা তে ওয়ানাউ কার্টিস) কাঁধ থেকে পড়ে যাওয়ার ফলে হয়েছিল। পরে দেখা যায় যে নিয়ার মধ্য নর্থ আইল্যান্ড পরিবারটি একজনের ২১ তম জন্মদিন উদযাপন করছিল এবং বাচ্চাটি মেঝেতে পড়ে কোমায় চলে যাওয়ার ৩৬ ঘন্টা পরে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।[১] এরপরও লিসা ক্লাবে বের হতে থাকে এবং তার মেয়ে হাসপাতালে মারা যায়।[৩] বিচার চলাকালীন একজন ডাক্তার আদালতকে বলেন, যদি ছোট্ট মেয়েটিকে অজ্ঞান হওয়ার সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হতো, তাহলে সে হয়তো বেঁচে যেত।[৪]

বিচার সম্পাদনা

২০০৮ সালের নভেম্বরে চার সপ্তাহ ব্যাপী বিচারের পর নিয়া'র মা ৩৫ বছর বয়সী লিসা মিশেল কুকাকে দ্বিগুণ হত্যাকান্ডের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়: একটি আগের বছরের আগস্টে মৃত্যুর আগে শিশুটির চিকিৎসা করাতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য এবং একটি তাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য।[৫] লিসার সঙ্গী ১৯ বছর বয়সী ওয়্যারমু কার্টিস এবং তার ভাই ২২ বছর বয়সী মাইকেলকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সম্মুখীন হতে হয়। নিয়া'র চাচাতো ভাই ২০ বছর বয়সী মাইকেল পিয়ারসন এবং ১৮ বছর বয়সী মাইকেল কার্টিসের সঙ্গী অরিওয়া কেম্পকে হত্যার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি কিন্তু শিশু নিষ্ঠুরতার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। মুখ্য বিচারক জুডিথ পটার সাজা প্রদান করার সময়, একইরকম অভিঘাতে প্রভাবিত জুরিদের ধন্যবাদ জানানোর পরে প্রকাশ্যে কেঁদে ফেলেছিলেন, মামলাটি নিয়ে এতদূর এগোনোর জন্য তিনি জুরিদের ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।[৫]

কার্টিস ভাইদের পিতা এবং হলিউড অভিনেতা ক্লিফ কার্টিসের প্রথম চাচাতো ভাই উইলিয়াম কার্টিস,[৬] এর আগে একটি কথিত ঘটনার বিষয়ে নিয়াকে নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত হন কিন্তু নভেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত তার জন্য কোন বিচারের তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি।[৭]

পরে সম্পাদনা

নিয়া'র নির্যাতন নিউজিল্যান্ডে শিশুদের প্রতি সহিংসতা এবং নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রচারণার বিষয় হয়ে ওঠে।[৫] প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যে, কারোর অজান্তেই একটি শিশু এভাবে কষ্ট ভোগ করতে পারে এবং তিনি নিউজিল্যান্ডবাসীদের উৎসাহিত করেন শিশু নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে।[৮] আসলে সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকেই "নার্ক না হতে চাওয়া"[৫] বা গার্হস্থ্য সহিংসতার বিষয়ে পুলিশকে অবহিত করতে না চাওয়ার সংস্কৃতিকে নিয়া'র মৃত্যুতে অন্যতম প্রধান অবদানকারী হিসেবে দায়ী করেন। উদাহরণস্বরূপ, রাষ্ট্রের পক্ষের একজন সাক্ষী, অত্যাচারিত নিয়ার প্রতিবেশী, রাভিতি সিমিওনা নিউজিল্যান্ড টেলিভিশনকে বলেছিলেন যে তিনি বাচ্চাটিকে কাপড়ের শুকানোর দড়িতে ঝুলতে দেখেছিলেন, তিনি পুলিশকে ফোন না করার জন্য অনুতপ্ত।[৯]

নীল ডিজনি থিমযুক্ত গাড়ির সিটে সাদা এবং হলুদ পোশাক পরা নিয়া-র একটি স্বতন্ত্র ছবি নিউজিল্যান্ডের প্রচার মাধ্যমে শিশু নির্যাতন সম্পর্কিত গল্পগুলি সনাক্ত করতে ব্যবহার করা হয়েছে, নিয়া আক্ষরিক অর্থে একটি পোস্টার-শিশু হয়ে উঠেছে।[১০][১১]

২০১১ সালের শেষের দিকে নিয়া'র বাবার বোন মাতাকাপুয়া গ্লাসিকে তার প্রাক্তন সঙ্গী টোকোরা থানার বাইরে গুলি করে গুরুতর আহত করে, যাকে পরে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।[১২][১৩] ২০১২ সালে মাইকেল পিয়ারসনকে জামিন ভঙ্গসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগে ২ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।[১৪] ২০১৪ সালে নিয়া'র মা লিসাকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হয়, কিন্তু ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট তাকে পুনরায় ডেকে নেওয়া হয়। ২০১৭ সালে তাকে পুনরায় প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে।[১৫] অরিওয়া কেম্প একাধিক সন্তানের যত্ন নেন। [[১৬]

২০০৯ সালে নিউ জিল্যান্ডের গায়ক-গীতিকার মাইসি রিকা তার অ্যালবাম তোহু থেকে নিয়া গানটি প্রকাশ করেন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Cook, Stephen (২৯ জুলাই ২০০৭)। "Tot's injuries due to a fall, says mother"The New Zealand Herald। সংগ্রহের তারিখ ২১ নভেম্বর ২০০৮ 
  2. "Child murder case shocks NZ court"। BBC News। ১৮ নভেম্বর ২০০৮। সংগ্রহের তারিখ ২২ নভেম্বর ২০০৮ 
  3. "Toddler's sisters see torture"Fairfax New Zealand। Stuff.co.nz। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১০ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  4. "Brothers guilty of murdering New Zealand toddler Nia Glassie"The Australian। ৪ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ নভেম্বর ২০০৮ 
  5. Tahana, Yvonne; Vass, Beck (১৯ নভেম্বর ২০০৮)। "Nia Glassie case: 'We've got to learn to nark'"The New Zealand Herald। সংগ্রহের তারিখ ২২ নভেম্বর ২০০৮ 
  6. "Abused 3-year-old dies in hospital"The New Zealand Herald। ৩ আগস্ট ২০০৭। সংগ্রহের তারিখ ২২ নভেম্বর ২০০৮ 
  7. "Toddler Nia Glassie put in dryer before she died"The Daily Telegraph। ২১ অক্টোবর ২০০৮। সংগ্রহের তারিখ ২২ নভেম্বর ২০০৮ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  8. Rowan, Juliet; Johnston, Martin (৩০ জুলাই ২০০৭)। "Packed court for toddler abuse hearing"NZ Herald: New Zealand National news। সংগ্রহের তারিখ ২২ নভেম্বর ২০০৮ 
  9. "Questions of why Nia Glassie suffered asked after guilty verdicts"NZ Herald: New Zealand National news। ১৮ নভেম্বর ২০০৮। সংগ্রহের তারিখ ২২ নভেম্বর ২০০৮ 
  10. "Kerre Woodham : Save our kids from toxic adults"The New Zealand Herald। ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০১১ 
  11. Trevett, Claire (২০১১)। "Abusive mums may be tracked through life"The New Zealand Herald। সংগ্রহের তারিখ ১৩ ডিসেম্বর ২০১১ 
  12. "Mum still critical after shooting"The New Zealand Herald। ৪ ডিসেম্বর ২০১১। সংগ্রহের তারিখ ১১ ডিসেম্বর ২০১১Mata Glassie is the aunt of Nia, who died five years ago aged 3 after horrific abuse, including being shut inside a dryer which was then turned on. 
  13. Howie, Cherie (১১ ডিসেম্বর ২০১১)। "Gunman's family 'lost'"The New Zealand Herald। সংগ্রহের তারিখ ১১ ডিসেম্বর ২০১১Mourners gathered in Tokoroa yesterday for the funeral of Jamie Ginns, who took his own life after shooting and seriously injuring his former partner Matakapua Glassie outside Tokoroa police station eight days ago. 
  14. "Nia Glassie abuser returned to jail – Child abuse – NZ Herald News"The New Zealand Herald। ২৯ আগস্ট ২০১২। 
  15. http://www.paroleboard.govt.nz/decisions-of-public-interest/kuka_-_lisa_michelle_-_31012017.html
  16. http://www.nzherald.co.nz/nz/news/article.cfm?c_id=1&objectid=11820070