নিনেভেহ
নিনেভেহ (/ ˈnɪnɪvə / NIN-iv-ə; আক্কাদিয়ান ভাষায়: 𒌷𒉌𒉡𒀀, URUNI.NU.A, Ninua; বাইবেলে উল্লিখিত হিব্রু ভাষায়: נִינְוֵה, Nīnəwē; আরবি ভাষায়: نَيْنَوَىٰ, Naynawā; সিরিয়াক ভাষায়: ܢܝܼܢܘܹܐ, Nīnwē[১]), যা আধুনিক কালের কুইয়ুঞ্জিক নামেও পরিচিত, ছিল উচ্চ মেসোপটেমিয়ার একটি প্রাচীন আসিরীয় শহর। বর্তমানে এটি ইরাকের মোসুল শহরে অবস্থিত। এটি টাইগ্রিস নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত ছিল এবং নব্য-আসিরীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। সে সময় কয়েক দশক ধরে এটি বিশ্বের বৃহত্তম শহরের মর্যাদা লাভ করেছিল। পরবর্তীতে আজকের নিনেভেহ গভর্নোরেট এ শহরের নামানুসারেই নামকরণ করা হয়।[২]
ܢܝܼܢܘܹܐ | |
অবস্থান | মসুল, নিনেভেহ গভর্নরেট, ইরাক |
---|---|
অঞ্চল | মেসোপটেমিয়া |
স্থানাঙ্ক | ৩৬°২১′৩৪″ উত্তর ৪৩°০৯′১০″ পূর্ব / ৩৬.৩৫৯৪৪° উত্তর ৪৩.১৫২৭৮° পূর্ব |
ধরন | বসতি |
এলাকা | ৭.৫ কিমি২ (২.৯ মা২) |
ইতিহাস | |
পরিত্যক্ত | ৬১২ খ্রিষ্টপূর্ব |
ঘটনাবলি | নিনেভের যুদ্ধ |
খ্রিস্টপূর্ব ৬১২ অব্দে আসিরিয়ায় এক তিক্ত গৃহযুদ্ধের পর ব্যাবিলনীয়, মেডিস, পারস্য, সিথিয়ান এবং সিমেরিয়ানদের সমন্বয়ে গঠিত একটি জোটবদ্ধ বাহিনীর দ্বারা নিনেভেহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এরপর থেকে শহরটি আর কখনও রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। তবে প্রাচীনকালের শেষের দিকে এটি একটি খ্রিস্টান বিশপের আসন ছিল। [উদ্ধৃতি প্রয়োজন] মধ্যযুগে মোসুলের তুলনায় শহরটির গুরুত্ব কমে যায় এবং ১৩শ শতাব্দীর মধ্যে অধিকাংশই পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
ঐতিহাসিক মোসুল নগর কেন্দ্রের নদীর ওপারে এর ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। দেয়ালঘেরা এলাকার দুটি মূল ঢিবি, বা টিলা-ধ্বংসাবশেষ হলো - টেল কুয়ুঞ্জিক এবং টেল নবী ইউনুস, যেখানে ইউনুসের (জোনা) মাজারও রয়েছে। হিব্রু বাইবেল এবং কোরআন অনুসারে, ইউনুস ছিলেন একজন নবী যিনি নিনেভেহর মানুষকে উপদেশ দিতেন। নিনেভেহর ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রচুর পরিমাণে আসিরীয় ভাস্কর্য এবং অন্যান্য নিদর্শন উদ্ধার করা হয়েছে, যেগুলি বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন জাদুঘরে স্থান পেয়েছে।[৩]
নাম
সম্পাদনাইংরেজি নাম 'Nineveh' এসেছে ল্যাটিন 'Nīnevē' এবং গ্রীক 'Nineuḗ' (Νινευή) থেকে। এই শব্দগুলো আবার হিব্রু 'Nīnəweh' (נִינְוֶה) থেকে এসেছে, যার উৎপত্তি আক্কাডিয়ান ভাষার 'Ninua' (অথবা 'Ninâ') অথবা 'Ninuwā'। এই শহর 'Mari' ভাষায় 'Ninuwa', আরামাইক ভাষায় 'Ninawa', সিরিয়াক ভাষায় 'Ninwe' (ܢܸܢܘܵܐ) এবং ফার্সি ভাষায় 'Nainavā' (نینوا) নামেও পরিচিত ছিল।
এই নামের মূল অর্থ পরিষ্কার না, তবে সম্ভবত এটি শহরের একজন পৃষ্ঠপোষক দেবীর নামকে নির্দেশ করে। শহরটি 'Nineveh এর দেবী ইনান্না' নামে পরিচিত দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছিল, এবং 'Nina' ছিল সুমেরিয়ান এবং আসিরিয়ান ভাষায় এই দেবীর একটি নাম। আসিরিয়ান কিউনিফর্ম বর্ণমালায় 'Ninâ' (𒀏) চিহ্নটি একটি মাছ এবং একটি ঘরকে নির্দেশ করে (আরামাইক 'nuna' শব্দটিও 'মাছ' বোঝায়)। এর অর্থ সম্ভবত ছিল 'মাছের স্থান', অথবা তিগ্রিস নদী বা মাছের সাথে সম্পর্কিত একজন দেবীকেও এটি নির্দেশ করতে পারত, যার উৎস সম্ভবত হুরিয়ান ভাষায়। পুরাতন ব্যবিলনীয় ভাষায় 'নুন/নুনা' শব্দটি মাছের Anthiinae গণকে নির্দেশ করে, যা Nineveh নামের সাথে মাছের যোগসূত্রের সম্ভাবনাকে আরও উস্কে দেয়। কোরআনে জোনাহকে "ধু'ন-নুন" বলা হয়, যার অর্থ "মাছের মালিক", যেখানে "নুন" মানে "মাছ"।
অন্যান্য নাম
সম্পাদনা'Nabī Yūnus' হল 'প্রফেট জোনাহ' এর আরবি নাম (বাংলায় 'হযরত ইউনুস')। লেয়ার্ডের মতে, 'Kuyunjiq' ছিল একটি তুর্কি নাম ("kouyunjik", "koyun" এর ক্ষুদ্র রূপ, যার অর্থ তুর্কি ভাষায় "ভেড়া"), আরবরা এটি 'Armousheeah' নামে চিনতো। মনে করা হয় এই নামের সাথে কারা কোয়ুনলু রাজবংশের সম্পর্ক রয়েছে। এগুলো নগরীর খোসর নদীর উত্তর এবং দক্ষিণে অবস্থিত এলাকাকে নির্দেশ করে: Kuyunjiq শহরের দেয়াল দ্বারা ঘেরা সম্পূর্ণ উত্তর অংশের জন্য ব্যবহৃত হতো যেটি Tell Kuyunjiq টিলার জন্য বিখ্যাত। অন্যদিকে, 'Nabī' (বা আরও প্রচলিত 'Nebi') Yunus হলো দক্ষিণাঞ্চলের নাম, যেটি প্রফেট জোনাহ/ ইউনুসের মসজিদ ঘিরে অবস্থিত (এটি Tell Nebi Yunus টিলায়)।
ভূগোল
সম্পাদনাপ্রাচীন নিনভেহ নগরের ধ্বংসাবশেষ, যেখানে কুয়ুঞ্জিক এবং নবী ইউনুসের টিলাগুলি অবস্থিত, তা ইরাকের মসুল শহরের কাছে প্রায় ১,৯০০ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। দজলা (টাইগ্রিস) ও খসর নদীর মিলনস্থলে সমতল ভূমিতে এই স্থানটি অবস্থিত। প্রায় ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাচীর দ্বারা এই পুরো বিস্তৃত অঞ্চলটি ঘেরা ছিল। বর্তমানে মসুল শহরের নবী ইউনুস উপশহর এলাকার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে এই বিশাল এলাকায় ধ্বংসস্তূপ পরিলক্ষিত হয়।
খসর নদী নিনভেহ স্থানটিকে দ্বিখণ্ডিত করেছে। খসর নদীর উত্তরের অংশটিকে কুয়ুঞ্জিক বলা হয় এবং এখানেই কুয়ুঞ্জিক টিলা অবস্থিত। খসরের দক্ষিণ অংশটি নবী ইউনুস নামে পরিচিত এবং ইউনুস নবীর মসজিদটি এখানেই অবস্থিত। এছাড়াও এসারহাদন/আশুরবানিপালের একটি প্রাসাদও এই এলাকার তলদেশে রয়েছে।
ভূমধ্যসাগর ও ভারত মহাসাগরের মধ্যকার প্রধান সড়কপথে দজলা নদী অতিক্রম করার ক্ষেত্রে নিনভেহ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল। ফলে পূর্ব ও পশ্চিমের সংযোগকারী এই নগরী বিভিন্ন উৎস থেকে প্রচুর সম্পদের অধিকারী হয়। এই কারণেই নিনভেহ এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান প্রাচীন নগরী এবং নব্য-অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের শেষ রাজধানী হিসেবে গড়ে ওঠে।
বাইবেলীয় নিনেভেহ
সম্পাদনাহিব্রু বাইবেলে, নিনেভেহ শহরের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় আদিপুস্তক ১০:১১ পদে: "অশূর সেই দেশ ছেড়ে চলে গিয়ে নিনেভেহ গড়ে তোলে"। কিছু আধুনিক ইংরেজি অনুবাদে এই পদের হিব্রুতে "অশূর" শব্দটিকে একজন ব্যক্তির পরিবর্তে "অশূরীয়" দেশ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, ফলে অশূরের পরিবর্তে নিমরদকে নিনেভেহের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। স্যার ওয়াল্টার র্যালির ধারণা যে নিমরদ নিনেভেহ এবং আদিপুস্তক ১০:১১-১২তে বর্ণিত শহরগুলি নির্মাণ করেছিলেন, এটিও পণ্ডিতরা খণ্ডন করেছেন। মৃত সাগর স্ক্রোলের মধ্যে পাওয়া পনেরটি জুবলি পাঠের আবিষ্কারের পরে জানা গেছে যে কুমরানের ইহুদি সম্প্রদায়গুলির মতে, আদিপুস্তক ১০:১১ অশূরকে নিনেভেহ শহর প্রদানের বিবরণ নিশ্চিত করে। অশূরকে নিনেভেহ প্রদানের ধারণাটি গ্রিক সেপ্টুয়াজিন্ট, কিং জেমস বাইবেল, জেনেভা বাইবেল এবং রোমান ইতিহাসবিদ ফ্লাভিয়াস জোসেফাসের "অ্যান্টিকুইটিস অফ দ্য জিউস"-এও সমর্থিত (অ্যান্টিকুইটিস, আই, ভি আই, ৪)।
নিনেভেহ ছিল অশূরীয় সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধ রাজধানী এবং বাইবেলের রাজা হিজকিয়া (יְחִזְקִיָּהוּ) এবং ইহুদিয়ান নবী যিশাইয় (ישעיה) শাসনকালে অশূরের রাজা সন্হেরিবের আবাসস্থল ছিল। হিব্রু ধর্মগ্রন্থে যেমন নথিভুক্ত আছে, সন্হেরিবের মৃত্যু নিনেভেহতেই তাঁর দুই পুত্রের হাতে ঘটেছিল, যারা পরে আর্মেনিয়া বা `rrt (Urartu)- এর সামন্ত রাজ্যে পালিয়ে গিয়েছিল। নহূম নবীর পুস্তকটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে নিনেভেহর বিরুদ্ধে নবীঘোষিত অভিশাপগুলিতে উৎসর্গিত। এর ধ্বংস এবং চূড়ান্ত বিরানিভূমিতে পরিণত হওয়ার কথা ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। এর পরিণতি আশ্চর্যজনক, আকস্মিক এবং মর্মান্তিক ছিল। বাইবেল অনুসারে, এটি ছিল ঈশ্বরের ক্রিয়া, অশূরীয়দের অহংকারের উপর তাঁর বিচার। ভবিষ্যদ্বাণী পূরণ করে, ঈশ্বর "ঐ স্থানের সম্পূর্ণ ধ্বংস" করেছিলেন। এটি একটি "পরিত্যক্ত স্থানে" পরিণত হয়েছিল। সফনিয় নবীও পুস্তকে অশূরীয় সাম্রাজ্যের পতনের সাথে সাথে নিনেভেহর ধ্বংসেরও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। নিনেভেহ বইটিরও ভিত্তিস্বরূপ।
অশূরীয় সাম্রাজ্যের সময়ে রচিত যোনা গ্রন্থে নিনেভেহকে "প্রায় তিন দিনের যাত্রাপথের বিস্তৃতির" একটি "অত্যন্ত বড় শহর" হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যার জনসংখ্যা সেই সময়ে "এক লাখ বিশ হাজারেরও বেশি" বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আদিপুস্তক ১০:১১-১২তে চারটি শহরের নাম রয়েছে "নিনেভেহ, রহোবোথ, কালাহ এবং রেসেন", এবং দ্ব্যর্থবোধকভাবে বলা হয়েছে যে হয় রেসেন বা কালাহ হল "বড় শহর"। কুযুঞ্জিক, নিমরুদ, কারামলেশ এবং খুরসাবাদের ধ্বংসাবশেষ একটি অনিয়মিত চতুর্ভুজের চার কোণ তৈরি করে। এই চারটি স্থান থেকে গঠিত চতুর্ভুজের মধ্যে যে সম্পূর্ণ অঞ্চলটি রয়েছে তাকে সাধারণত "বড় শহর" নিনেভেহ এর ধ্বংসাবশেষ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যোনার গ্রন্থে নিনেভেহর বর্ণনা সম্ভবত আশেপাশের শহরগুলি রেহোবোথ, কালাহ এবং রেসেন সহ বৃহত্তর নিনেভেহর উল্লেখ।
যোনা গ্রন্থে নিনেভেহকে ধ্বংসযোগ্য মন্দ শহর হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে। ঈশ্বর যোনাকে নিনেভেহবাসীদের তাদের আসন্ন ধ্বংসের কথা বলতে পাঠিয়েছিলেন এবং এর ফলে তারা উপবাস ও অনুশোচনা করেছিল। ফলস্বরূপ, ঈশ্বর শহরটিকে রক্ষা করেছিলেন; যোনা যখন এর প্রতিবাদ করেছিলেন, ঈশ্বর বলেছিলেন যে তিনি নগরের লোকদের প্রতি দয়া দেখাচ্ছেন যারা ভালো এবং মন্দ মধ্যে পার্থক্য করতে জানেনা ("যারা তাদের ডান হাত এবং বাম হাতের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না") এবং শহরের জন্তুদের প্রতিও দয়া পরায়ণ।
নিনেভেহর অনুশোচনা এবং মন্দতা থেকে পরিত্রাণ হিব্রু তানাখে পাওয়া যায়, যাকে ওল্ড টেস্টামেন্টও বলা হয়, খ্রিস্টান নিউ টেস্টামেন্টে এবং মুসলিম কোরআনেও এর উল্লেখ রয়েছে। আজ অবধি, সিরিয়াক এবং ওরিয়েন্টাল অর্থোডক্স গির্জাগুলি নিনেভেহ উপবাসের সময় যোনার মাছের পেটের ভিতরে কাটানো তিন দিনের স্মরণে অনুষ্ঠান পালন করে। কিছু খ্রিস্টান এই ধর্মীয় ছুটির দিনে গির্জায় খাবার ও পানীয় ত্যাগ করে উপবাস পালন করে থাকেন। অন্যান্য মাংসের পাশাপাশি দুগ্ধজাত পণ্য, মাছ থেকেও বিরত থাকার জন্য গির্জা অনুসারীদের উৎসাহিত করে।
প্রত্নতত্ত্ব
সম্পাদনামধ্যযুগে কিছু লোকের কাছে নিনেভের অবস্থান অবিচ্ছিন্নভাবে জানা ছিল। ১১৭০ সালে বেঞ্জামিন অফ টুডেলা এবং তার কিছু পরে রেগেন্সবার্গের পেটাচিয়াহ সেখানে গিয়েছিলেন। ১৭৬১-১৭৬৭ সালে ড্যানিশ অভিযানের সময় কার্স্টেন নিবুর এর অবস্থান বিস্তারিত নথিভুক্ত করেছিলেন। নিবুর পরবর্তীতে লিখেছিলেন, "নদীর কাছাকাছি না যাওয়া পর্যন্ত এত উল্লেখযোগ্য একটি স্থানে রয়েছি তা আমি জানতামই না। তারপর তারা আমাকে একটি বড় পাহাড়ের উপর একটি গ্রাম দেখিয়েছিল, যাকে তারা নুনিয়া বলে এবং একটি মসজিদ, যেখানে নবী ইউনুস (জোনা) কে সমাধিস্থ করা হয়েছে। এই এলাকার আরেকটি পাহাড়কে বলা হয় কাল্লা নুনিয়া বা নিনেভের দুর্গ। তার উপরে অবস্থিত একটি গ্রাম যার নাম কইন্দসুগ।"
প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের হুমকি
সম্পাদনা২০০৩ সাল নাগাদ, নিনেভেহ প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকাটি সুরক্ষামূলক ছাদ না থাকায় ক্ষয়ের সম্মুখীন হয়। এছাড়া, লুটপাট এবং অবৈধ খননের ফলে এর অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্রমবর্ধমান শহরতলির কাছাকাছি অবস্থানের কারণেও নিনেভের ভবিষ্যৎ সংরক্ষণ আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
মসুল বাঁধটি দীর্ঘদিন যাবৎ যথাযথ সংস্কারের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে, নিনেভেহ এবং পুরো মসুল শহরই ধ্বংসের মুখে রয়েছে। ১৯৮০-এর দশকে বাঁধটির ব্যর্থতার ঝুঁকি কমাতে দ্বিতীয় একটি বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প বাতিল করা এবং ২০১৪ সালের আইএসআইএল অধিগ্রহণের পর সেখান থেকে কর্মীদের পালিয়ে আসা এবং যন্ত্রপাতি চুরি হওয়ার কারণে পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে। বাঁধটি ভেঙে পড়লে, পুরো প্রত্নস্থলটি ১৪ মিটারেরও বেশি পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে।
২০১০ সালের অক্টোবরে GHF (Global Heritage Fund) "সেভিং আওয়ার ভ্যানিশিং হেরিটেজ" শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে নিনেভেহকে অপরিবর্তনীয় ধ্বংসের "প্রান্তে" থাকা ১২টি স্থানের মধ্যে অন্যতম হিসাবে চিহ্নিত করে। তারা উল্লেখ করে যে এর পেছনে প্রধান কারণ হল যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, উন্নয়নের চাপ এবং লুটপাট ।
এখন পর্যন্ত, নিনেভেহর সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে আইএসআইএল বা দায়েশের ইচ্ছাকৃত ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড। ২০১৪ সালে যখন প্রথম এলাকাটি তাদের দখলে চলে যায়, তখন ইরাকিরা যদি মসুল শহর মুক্ত করার চেষ্টা করে তবে তারা নিনেভের দেয়াল ধ্বংস করে দেওয়ার হুমকি দেয়। এছাড়া, ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলিও ধ্বংসের নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, দায়েশ সদস্যরা মসুল জাদুঘরে বেশ কয়েকটি নিদর্শন ভাঙচুর করে এবং আরও অনেকগুলো বিক্রির উদ্দেশ্যে চুরি করে নেয় । এই জাদুঘরের বেশিরভাগ প্রদর্শনীই ছিল অ্যাসিরীয় যুগের, যেগুলোকে দায়েশ কট্টর ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী কুফরি ও মূর্তিপূজার প্রতীক হিসাবে ঘোষণা করেছিল। পরবর্তীতে দায়েশ উগ্রবাদীরা খোরসাবাদ, নিমরুদ এবং হাত্রা সহ অন্যান্য বড় UNESCO বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অংশগুলিও ধ্বংস করে। ২০১৬ সালে, আদাদ গেট, উত্তরের শহরের দেয়াল, মাশকি গেট এবং পূর্ব দুর্গের অংশগুলোও দায়েশের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। দায়েশ কুইয়ুনজিক অংশে নতুন আবাসন গড়ে তোলারও নির্দেশ প্রদান করে এবং দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে একটি প্রশস্ত রাস্তা খুলে দেয় (বর্তমানে আল আসাদি রোড নামে পরিচিত)।
নিনেভের প্রার্থনা (রোগেশন অফ দ্য নাইনভাইটস)
সম্পাদনাপ্রাচীন প্রাচ্যের গির্জা, ক্যালডিয়ান ক্যাথলিক চার্চ, সিরিয়াক ক্যাথলিক চার্চ, সিরিয়াক অর্থোডক্স চার্চ, পূর্বের অ্যাসিরিয়ান চার্চ এবং সিরো-মালবার চার্চের সাধু সন্তরা "বা'উতা দ্য নিনওয়া" (ܒܥܘܬܐ ܕܢܝܢܘܐ) নামক একটি উপবাস পালন করেন যার অর্থ "নিনেভের প্রার্থনা"। কপ্ট এবং ইথিওপিয়ান অর্থোডক্সরাও এই উপবাস পালন করে।
জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে নিনভেহ
সম্পাদনাইংরেজ রোমান্টিক কবি এডউইন অ্যাথারস্টোন 'দ্য ফল অফ নিনভেহ' নামে একটি মহাকাব্য রচনা করেন। কাব্যটিতে আসিরীয় সাম্রাজ্যের আধিপত্যে থাকা সমস্ত জাতির রাজা সারদানাপালাসের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহের বর্ণনা রয়েছে। রাজা একজন বড় অপরাধী যে যুদ্ধবন্দী একশো বন্দীকে মৃত্যুদন্ড দেয়। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর, মেডিয়ান এবং ব্যাবিলনীয় সৈন্যদের দ্বারা, যথাক্রমে যুবরাজ আর্বাসেস এবং পুরোহিত বেলেসিসের নেতৃত্বে, এই শহরটি জয় করা হয়। এরপর রাজা নিজের প্রাসাদে আগুন লাগিয়ে দেন এবং তার সমস্ত উপপত্নীদের সাথে ভিতরে মারা যান।
অ্যাথারস্টোনের বন্ধু, শিল্পী জন মার্টিন, কবিতাটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একই নামের একটি চিত্রকর্ম তৈরি করেছিলেন। ইংরেজ কবি জন মেসফিল্ডের বিখ্যাত, রূপকথার ১৯০৩ সালের কবিতা 'কারগোস'-এর প্রথম লাইনে নিনভেহ উল্লেখ আছে। রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর ১৮৯৭ সালের 'রিসেশনাল' কবিতায় এবং আর্থার ও'শউগনেসির ১৮৭৩ সালের 'ওড' কবিতাতেও নিনভেহর উল্লেখ আছে।
১৯৬২ সালের ইতালীয় পেপলাম ফিল্ম 'ওয়ার গডস অফ ব্যাবিলন' ব্যাবিলনীয়দের নেতৃত্বে বিদ্রোহী বাহিনীর একত্রিত হয়ে লুট এবং নিনভেহ-এর পতনের উপর ভিত্তি করে তৈরি।
'জোনাহ: এ ভেজিটেলস মুভি'-তে, জোনাহ, তার বাইবেলের প্রতিপক্ষের মতোই, ঈশ্বরের দাবির কারণে নিনভেহ ভ্রমণ করতে বাধ্য হয়।
১৯৭৩ সালের চলচ্চিত্র 'দ্য এক্সরসিস্ট'-এ, ফাদার ল্যাঙ্কেস্টার মেরিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসার আগে নিনভেহর কাছে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক খননে ছিলেন এবং রেগান ম্যাকনিলের তাড়ানোর কাজ পরিচালনা করেন।
ওয়ারহ্যামার ৪০,০০০ মহাবিশ্বে, ওলানিয়াস পার্সন জন্মগ্রহণ করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ১৫,০০০ সনে নিনভেহতে, যা তাকে চিরন্তনদের মধ্যে সবচেয়ে পুরানো করে তোলে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Thomas A. Carlson et al., "Nineveh — ܢܝܢܘܐ " in The Syriac Gazetteer last modified June 30, 2014, http://syriaca.org/place/144.
- ↑ Jenson, Philip Peter (২০০৯)। Obadiah, Jonah, Micah: A Theological Commentary। The Library of Hebrew Bible/Old Testament Studies। Bloomsbury Publishing। পৃষ্ঠা 30। আইএসবিএন 978-0-567-44289-5। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১০।
- ↑ Kripke, Saul A. (১৯৮০) [1972], Naming and Necessity, Cambridge, Massachusetts: Harvard University Press, পৃষ্ঠা 67, আইএসবিএন 0-674-59846-6