দ্বি-উপাদান তত্ত্ব

হার্জবার্গের স্বাস্থ্য-প্রেষনা তত্ত্ব বা দ্বি-উপাদান তত্ত্ব অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রের কিছু নির্দিষ্ট বিষয়াদি কাজের সন্তুষ্টির সাথে জড়িত । অন্যদিকে, সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু উপাদান জড়িত থাকে কাজের অসন্তোষের সাথে । হার্জবার্গের মতে, এসব উপাদান কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে প্রভাব বিস্তার করে[১]

আলোচনার বিযয় হার্জবার্গের দ্বি-উপাদান তত্ত্ব – যা প্রেষণা এর অর্ন্তভুক্ত, প্রেষণা সম্পর্কিত যে সকল তথ্য ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে হার্জবার্গের দ্বি- উপাদান তত্ত্ব তার মধ্যে অন্যতম । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধ্যাপক প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ফ্রেডারিক হার্জবার্গ পিট্সবার্গের ১১টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ২০০ জন প্রকৌশলী ও হিসাবরক্ষকের ওপর গবেষণা চালিয়ে প্রেষণার উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ তত্ত্বের উদ্ভাবন করেন।

হার্জবার্গের দ্বি-উপাদান তত্ত্ব

সম্পাদনা

তিনি মনে করতেন কোনো ব্যক্তির সাথে তার কাজের সম্পর্ক বা সে তার কাজের প্রতি কেমন মনোভাব পোষণ করে-তার ওপর ব্যক্তির কাজের সফলতা বিশেষভাবে নির্ভরশীল । এরূপ সম্পর্ক বা মনোভাব জানার জন্য তিনি তাঁর গবেষণায় প্রশ্ন রাখেন, “What do people want from their jobs.” তিনি তাদের কাছ থেকে বিস্তারিতভাবে জানতে চান, ‘কখন ও কোন অবস্থায় তাদের কাজে তারা সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্টিবোধ করে এবং কখন ও কী কারণে তাদের কাজকে খারাপ লাগে।”

হার্জবার্গের দ্বি-উপাদান তত্ত্ব

সম্পাদনা

প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে হার্জবার্গ দেখতে পান যে, প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী ও কর্মীদের দেয় সুযোগ-সুবিধা এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কতিপয় উপাদানের উপস্থিতি কর্মীদেরকে সন্তুষ্ট করে আবার কিছু উপাদানের উপস্থিতি না থাকলে তারা অসন্তুষ্ট হয় । এরূপ কর্মসন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির সাথে জড়িত উপাদানগুলোকে তিনি দু’ভাগে ভাগ করেন; (১) সন্তুষ্টিদানকারী বা প্রেষণামূলক উপাদানসমূহ (Motivational factors or satisfiers) ও (২) রক্ষণাবেক্ষণমূলক বা অসন্তুষ্ট সৃষ্টিকারী উপাদানসমূহ (Maintenance or hygiene factors) । নিম্নে উভয় ধরনের উপাদান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :

১. প্রেষণামূলক বা সন্তুষ্টি সৃষ্টিকারী উপাদানসমূহ (Motivational factors or satisfiers) :

প্রতিষ্ঠানে যে সকল উপাদানের উপস্থিতি কর্মীদেরকে প্রণোদিত করে তাকে প্রেষণামূলক উপাদান বলে । এরূপ উপাদানের অনুপস্থিতিতে কর্মীরা কাজে প্রেষিত হয় না ফলে তারা গতানুগতিক নিয়মে কাজ সম্পাদনে সচেষ্ট থাকে । হার্জবার্গ নিম্নোক্ত বিষয়াদিকে এরূপ উপাদান হিসেবে শনাক্ত করেছেন :

ক) সাফল্যার্জন (Achievement);

খ) স্বীকৃতি (Recognition);

গ) সৃষ্টিধর্মী ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ কাজের মধ্য দিয়ে অগ্রগতি অর্জন (Advancement, through creative and challenging work);

ঘ) কাজ (The work itself);

ঙ) ব্যক্তিক উন্নয়নের সম্ভাবনা (The possibilities of personal growth); এবং

চ) দায়িত্ব (Responsibility) ।

হার্জবার্গ বলেছেন, উপরোক্ত উপাদানসমূহ কাজের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। তাই এ সকল উপাদানের উপস্থিতি কর্মীদেরকে কাজের সাথে অধিক হারে সম্পৃক্ত হতে ও মনোযোগ সহকারে কার্যসম্পাদনে উদ্বুদ্ধ করে । এরূপ সম্পৃক্ততার বিষয় বিবেচনা করেই এগুলোকে Intrinsic factors নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে । হার্জবাগ মনে করেন এরূপ উপাদানের অনুপস্থিতিতে কর্মীরা উৎসাহ ভরে কাজ করতে প্রেষিত হয় না বটে তবে কর্মীরা এজন্য খুব অসন্তষ্ট হয় না বা তার জন্য কোনোরূপ আন্দোলনে প্রলুদ্ধ হয় না ।

২. রক্ষণাবেক্ষণমূলক বা অসন্তুষ্টি সৃষ্টিকারী উপাদানসমূহ (Maintenance or hygiene factors) :

যে সকল উপাদানের অনুপস্থিতি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি করে তাকে রক্ষণাবেক্ষণমূলক বা হাইজিন উপাদান বলে । ‘হাইজিন’ শব্দটি চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে নেয়া C. B. Memoria বলেছেন, “It refers to factors that help maintain, but not necessarily imporove, health. ” 17 অর্থাৎ এগুলো সেই ধরনের উপাদান যা স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য প্রয়োজন কিন্তু স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটায় না। হার্জবার্গ নিম্নোক্ত উপাদানসমূহকে এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন :

ক) কোম্পানি নীতি ও প্রশাসন (Company policy and administration);

খ) কারিগরি মানসম্মত তত্ত্বাবধান (Technical supervision);

গ) তত্ত্বাবধায়কের সাথে কর্মীদের আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক (Interpersonal relations with supervisor);

ঘ) সহকর্মীদের সাথে সম্পর্ক (Interpersonal relations with peers);

ঙ) অধস্তনদের সাথে নির্বাহীর সম্পর্ক (Interpersonal relations with subordinates);

চ) বেতন (Salary);

ছ) চাকরির নিরাপত্তা (Job security);

জ) ব্যক্তিগত জীবন (Personal life):

ঝ) কর্ম পরিবেশ (Work condition); ও

ঞ) পদমর্যাদা (Status)।

হার্জবার্গ মনে করতেন, প্রতিষ্ঠানে রক্ষণাবেক্ষণমূলক উপাদানের উপস্থিতি অবশ্যই কাম্যমানের থাকবে বলে কর্মীরা প্রত্যাশা করে । তাই যখন তা থাকে না তখন কর্মীরা খুবই অসন্তুষ্ট হয় এবং প্রয়োজনে তারা আন্দোলন বা সংগ্রাম করে তা অর্জনের চেষ্টা করে । এগুলো পাওয়া যেহেতু কর্মীরা অধিকার মনে করে তাই এ সকল বিষয়ের উপস্থিতি-কর্মীদের কার্যক্ষেত্রে প্রণোদিত করার বা উৎসাহ সৃষ্টির কারণ হয় না ।

মূল বিষয়াদি

সম্পাদনা

আব্রাহাম মাসলোর প্রেষনা তত্ত্ব দ্বারা অনুপ্রানিত হার্জবার্গের মতে, ব্যক্তি পর্যায়ে কাজের সন্তুষ্টি নিশ্চিন্ত করার জন্যে নিন্মস্তরের চাহিদা (যেমন; বেতন) খুব ভালোভাবে পূরণ করাটা কার্যকরী নয় ।[২] বরং, হার্জবার্গ মনে করেন, প্রাপ্য বেতন ও অন্যান্য সুবিধাসমূহ একজনকে কাজের প্রতি ধরে রাখতে পারলেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তার প্রেষনা বৃদ্ধি এবং তার দ্বারা উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এসব অকার্যকর । কেননা কর্মচারীগণ উচ্চস্তরের চাহিদা (কাজের গুরুত্ব, কর্মক্ষেত্রে পরিচিতি, দায়িত্ব ও কাজের ধরন) থেকেই প্রেষনা পেয়ে থাকেন বলে হার্জবার্গ মনে করেন।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Herzberg, Frederick; Mausner, Bernard; Snyderman, Barbara B. (১৯৫৯)। The Motivation to Work (2nd সংস্করণ)। New York: John Wiley। আইএসবিএন 0471373893 
  2. Herzberg, Frederick (১৯৬৬)। Work and the Nature of Man। Cleveland: World Publishing। ওসিএলসি 243610