দশাবতার তাস

পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী একটি খেলা

দশাবতার তাস বা ওরক হল পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে তৈরি বহু প্রাচীন একপ্রকার ওরক বা তাস। ভারতের বিভিন্ন স্থানে দশাবতার গণিফা খেলার প্রচলন থাকলেও বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাস সম্পূর্নভাবে স্বতন্ত্র। এই তাসে বিষ্ণুর দশ অবতারের চিত্র পাওয়া যায়।

উৎপত্তি সম্পাদনা

১৫৯২ খ্রিষ্টাব্দে বিষ্ণুপুরের রাজা বীর হাম্বীর জমিদারী লাভ করেন। আকবরের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক থাকায় বিভিন্ন সময় তিনি আকবরের রাজ-দরবারে যান। সেখানে তিনি তাস খেলা দেখলে তিনি স্বরাজ্যে এসে স্বতন্ত্র উপায়ে ঈশ্বর-ভাবালুতা এক নতুন ওরক সৃষ্টির কথা ভাবেন। তারই নির্দেশে বিষ্ণুপুর নিবাসী শিল্পী কার্ত্তিক ফৌজদার দশাবতার ওরক বা তাস তৈরি করেন। মল্লনৃপতিগণ চিত্তবিনোদনের জন্য অবসর সময়ে এই তাস খেলত।[১] তবে ইতিহাসবিদ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, এই খেলাটির উদ্ভব অষ্টম থেকে দশম শতকে। তিনি ১৮৯৫ সালের এসিয়াটিক সোসাইটির জার্নালের এক ছোট্ট নোটে বলেছেন-

...I fully believe that the game was invented about eleven or twelve hundred years before the present date.

প্রচলিত দশাবতার বিশ্বাসে জগন্নাথ বা বুদ্ধের স্থান নবম। কিন্তু দশাবতার তাস অনুযায়ী জগন্নাথ বা বুদ্ধদেবের স্থান পঞ্চম। শাস্ত্রীমশাই বলেন, বাংলায় এমন এক সময়ে দশাবতার তাসের খেলার প্রবর্তন হয়েছিল, যখন বুদ্ধদেব পঞ্চম অবতার রূপে গণ্য ছিল। তাছাড়া তাসে বুদ্ধমুর্তি আদতে মাথা ও হাতসহ দেহকাণ্ডের জগন্নাথ মূর্তি।

নামকরণ সম্পাদনা

দশাবতার তাসে বিষ্ণুর দশ অবতারের ছবি আছে-মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, বলরাম, পরশুরাম, দশরথি-রাম, জগ্ননাথ (বুদ্ধ) এবং কল্কি। এই তাসে দশ অবতারের ছবি থাকায় এর মান দশাবতার ওরক। তাস থেলার মতো হওয়ায় পরবর্তীতে দশাবতার ওরক দশাবতার তাস নামে পরিচিত হয়। এখানে ওরক শব্দের অর্থ পাতা বা পত্র।

তৈরির পদ্ধতি সম্পাদনা

প্রথমে তিনটি সুতির কাপড় তেঁতুলের বীজের আঠা দিয়ে আটকাতে হয়। এরপর এটি ভালোভাবে রৌদ্রে শুকিয়ে নিয়ে খড়িমাটি ও আঠারো মিশ্রণকে নিখুঁতভাবে ওই কাপড়ের দু'পাশে প্রলেপ দিতে হয়। খড়িমাটির প্রলেপ দেওয়া কাপড়টিকে আবার রোদে শুকিয়ে নোড়া দিয়ে ঘসে মসৃণ করতে হয়। পরে কাপড়টিকে চক্রাকারে কেটে নিতে হয়। এরপর শিল্পী নিপুণ হাতে দশ অবতারের চিত্র ও প্রতীক একে দেয়। এই ভাবে দশাবতার তাস তৈরি হয়।[২]

পরিচিতি সম্পাদনা

এক প্রস্ত দশাবতার তাস তৈরিতে মোট ১২০ টি তাস লাগে। প্রতিটি অবতারের জন্য ১২ টি করে তাস থাকে। প্রতিটি অবতারের জন্য নির্ধারিত বারটি তাসের মধ্যে প্রথম তাসটি রাজা ও দ্বিতীয় তাসটি উজির। রাজা তাসটিতে দেউলের মধ্যে অবতারের চিত্রটি আঁকা থাকে। অবতারের দুইপাশে দুটি সহচর দণ্ডায়মান থাকে। উজির তাসটিতে শুধু অবতারের চিত্র অঙ্কিত থাকে এবং অন্যান্য তাসে অন্যান্য অবতারের চিত্র অঙ্কিত থাকে।[৩]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. মনোরঞ্জন চন্দ্র (২০০২)। মল্লভূম বিষ্ণুপুর। কলকাতা। পৃষ্ঠা ২৮৩। 
  2. "দশাবতার তাস, হারিয়ে যেতে বসা বাংলার এক শিল্প"Eenadu English Portal। ২০১৮-০১-২৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০১-২০ 
  3. মল্লভূম বিষ্ণুপুর। কলকাতা। ২০০২। পৃষ্ঠা ২৮৪।  Authors list-এ |প্রথমাংশ1= এর |শেষাংশ1= নেই (সাহায্য)