তেনেরিফে বিমানবন্দর বিপর্যয়

তেনেরিফে বিমানবন্দর বিপর্যয় সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ২৭শে মার্চ। ঐ দিন বিকাল ৫টা ৬ মিনিট ৫৬ সেকেন্ডে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল সংলগ্ন স্পেনের তেনেরিফে দ্বীপের লোস রোদেওস বিমানবন্দরে (বর্তমানে তেনেরিফে উত্তর বিমানবন্দর নামে পরিচিত) দুইটি বোয়িং ৭৪৭ উড়োজাহাজ রানওয়েতে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে এবং এতে ৫৮৩ জন বিমান যাত্রী নিহত হন। এই দুর্ঘটনা আজ পর্যন্ত বিমানচালনার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়।

তেনেরিফে বিপর্যয়ের সরলীকৃত চিত্র; লাল তারকা সংঘর্ষস্থল নির্দেশ করছে।
আমস্টারডামের ভেস্টগার্ডে সমাধিস্থলে তেনেরিফে দুর্ঘটনার স্মারক সৌধ

ঘটনার বিবরণ সম্পাদনা

ঐদিন গ্রান কানারিয়া দ্বীপের গান্দো বিমানবন্দরে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। ফলে বিমানবন্দরটি সাথে সাথে বন্ধ করে দেয়া হয়। যে সব ফ্লাইটগুলো সেখানে আসার কথা ছিল সেগুলোকে ঘুরিয়ে দেয়া হয় নিকটবর্তী তেনেরিফে দ্বীপের লোস রোদেওস বিমানবন্দরে। লোস রোদেওস একটি ছোট বিমানবন্দর। সাধারণত আঞ্চলিক ছোট ছোট ফ্লাইট পরিচালনা করা হয় এই বিমানবন্দর থেকে। দিনটি ছিল রবিবার। ফ্লাইট সংখ্যা ছিল কম, তাই বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারের লোকজনও ছিল স্বাভাবিকের চাইতে কম, মাত্র ২ জন। গান্দো বিমানবন্দরের ফ্লাইটগুলো যখন এই ছোট বিমানবন্দরে অবতরণ করতে থাকে, তখন বিমানবন্দরে প্রায় ট্রাফিক জ্যাম লেগে যাবার মত অবস্থার সৃষ্টি হয়।

বিকেলের দিকে সকল ফ্লাইটের জন্য গান্দো বিমানবন্দর খুলে দেয়া হয়। লোস রোদেওস বিমানবন্দরের বিমানগুলো একে একে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকে। এ সময় এখানে ছিল রয়াল ডাচ এয়ারলাইনসের কেএলএম-এর একটি বোয়িং ৭৪৭ এবং প্যান অ্যাম-এর আরেকটি বোয়িং ৭৪৭। কেএলএম বিমানে ২৩৪ জন যাত্রী ছিল যার ভেতর ৫৩টি শিশু ছিল। অপরদিকে প্যান এম বিমানে ৩৮০ যাত্রী ও ১১ জন ক্রু ছিল।

কেএলএম-এর ক্যাপ্টেন জেকভ বানজান্টন এদিন বিশেষ তাড়াহুড়া করছিলেন। কারণ তার অনুমোদিত উড্ডয়ন-ঘণ্টা শেষ হতে আর বেশি বাকি ছিল না। এই উড্ডয়ন-ঘণ্টা উপেক্ষা করে যদি তিনি বিমান চালান, তবে তার লাইসেন্স বাতিলের মত ঘটনা ঘটতে পারে। আর তিনি যদি ফ্লাইট পরিচালনা না করেন, তবে রয়েল ডাচ এয়ারলাইনসকে মোটা অঙ্কের মাসুল গুনতে হবে, রাত্রে যাত্রী ও ক্রুদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ও নতুন একদল ক্রুকে সেখানে পাঠাতে গিয়ে। সময় বাঁচাতে গিয়ে বানজান্টন লোস রোদেওস থেকেই আমস্টারডাম যাবার তেল নিয়ে নিলেন, যার পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৫ টন। কিন্তু এয়ারলাইন্সের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত তেল নেয়া নীতিবিরুদ্ধ, কারণ এতে বিমান অপ্রয়োজনীয় রকম ভারী হয়ে যায়। অবতরণের সময় বিমান ভেঙে পর্যন্ত যেতে পারে। এই তেল নিতে গিয়ে বানজান্টন প্যান এম-এর পথরোধ করে রাখেন প্রায় ৪০ মিনিটের মত। আর ঠিক এই সময় নিকটবর্তী পাহাড় থেকে নেমে আসে ঘন কুয়াশা।

ঘন কুয়াশার মধ্যেই যাত্রা করে বোয়িং দুইটি। কন্ট্রোল টাওয়ারের নির্দেশ ছিল এরকম "কেএলএমের পিছনে প্যান এম যাবে। মূল রানওয়েতে ওঠার পর প্যান অ্যাম সি৩ গেট দিয়ে বামে ঘুরে যাবে আর কেএলএম রানওয়ের শেষ মাথায় গিয়ে ১৮০ ডিগ্রি টার্ন নিয়ে (ইউ টার্ন) সোজা উড্ডয়নের জন্য দৌড় শুরু করবে"। কিন্তু এরই মধ্যে ঘন কুয়াশা আরো অন্ধকার করে দেয় চারিদিক। দৃষ্টিসীমা নেমে আসে মাত্র ৫০০ মিটারে। বিমান উড্ডয়নের জন্য কমপক্ষে ৭০০ মিটার দৃষ্টিসীমা থাকতে হয়। ফলে প্যান অ্যামের পাইলট সি৩ গেট দেখতে না পেয়ে কিছুটা ইতস্ততঃ করতে থাকেন। এদিকে কেএলএমের পাইলট ১৮০ ডিগ্রি ঘুরেই ইঞ্জিনের থ্রাট্‌ল(নিয়ন্ত্রক) চাপ দেন। এতে ইঞ্জিন উড্ডয়ন গতিসীমায় পৌঁছানোর জন্য বিপুল গতিতে ঘুরতে শুরু করে। সে সময় কো-পাইলট বলে ওঠেন "আমরা এখনও এটিসি ক্লিয়ারেন্স নেই নি"। এটিসি ক্লিয়ারেন্স হলো বিমান আকাশে উড্ডায়নের পর ন্যাভিগেশনের জন্য ব্যাহহৃত বিশেষ ধরনের ক্লিয়ারেন্স। এটিসি ক্লিয়ারেন্স আর রানওয়ে ক্লিয়ারেন্স এক নয়। অসহিষ্ণু হয়ে বানজান্টন বলেন "ঠিক আছে, ক্লিয়ারেন্স নিয়ে নাও"। কো-পাইলট কন্ট্রোল টাওয়ারকে আস্পষ্ট ভাবে বলেন "উই আর নাউ ...টেকিং অফ"। এই শব্দের দু'রকমের অর্থ হতে পারে। যদি "উই আর অ্যাট টেকঅফ" হয় তার অর্থ আমরা টেকঅফের জন্য প্রস্তুত। যদি "উই আর নাউ টেকিং অফ" হয় তাহলে আমরা টেকঅফ করতে যাচ্ছি। বুঝতে না পারার ফলে কন্ট্রোল টাওয়ার প্রাথমিক ভাবে বলে "ok" -এটা বলার অর্থ তাকে রানওয়ে ক্লিয়ারেন্স দেয়া নয়। কিন্তু এটা শুনেই কেএলএমের ক্যাপ্টেন বলে ওঠেন "উই আর গোয়িং -আমারা যাত্রা শুরু করছি"। সাথে সাথে কন্ট্রোল টাওয়ার বলে "ষ্ট্যান্ড বাই ফর টেকঅফ -টেকঅফের জন্য অপেক্ষা করুন" এ সময় প্যান অ্যামের ক্যাপ্টেন জলদি জানান দেন তারা রানওয়েতেই রয়ে গেছেন। একমুখী বেতার ব্যবস্থার কারণে এই বেতার বার্তাগুলো পরিষ্কার শোনা যায়নি। কারণ প্যান অ্যাম ও কন্ট্রোল টাওয়ার একই সাথে কেএলএমকে সতর্ক করতে গিয়েছিল।

ক্যাপ্টেন বানজান্টন একরোখা সিদ্ধান্তে রানওয়ে দিয়ে বিমান চালনা করতে থাকেন। শেষ মুহূর্তে প্যান অ্যাম বিমানটি তার নজরে আসে। আর প্যান অ্যামও প্রানপণে চেষ্টা করে রানওয়ে থেকে সরে যেতে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। বানজান্টন প্যান অ্যাম দেখামাত্র টেকঅফ/ওড়ার প্রচেষ্টা চালান। তাতে তিনি অনেকখানি সফলও হন। কিন্তু অতিরিক্ত জ্বালানি থাকার কারণে বিমানটি ভারি হয়ে যায়, তার ফলে বিমানটি উড়তে প্রত্যাশিত সময়ের চাইতে বেশি সময় লেগে যায়। ফলে কেএলএমের লেজের অংশ প্যান অ্যামের উপর আছড়ে পড়ে। এই দুর্ঘটনায় কেএলএমের সকল যাত্রী এবং প্যান এমের ৮০ ভাগ যাত্রীই নিহত হন।

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা