তিনকড়ি
তিনকড়ি দাসী (১০ অক্টোবর ১৮৭০ – ১৯১৭) ছিলেন গিরিশ-যুগে বাংলা রঙ্গমঞ্চের এক প্রতিভাময়ী ও খ্যাতনাম্নী অভিনেত্রী।[১] নটী তিনকড়ির অভিনয় সমাদর লাভ করে মূলত তৎকালীন শিক্ষিত, বোদ্ধা তথা এলিট সমাজের। [২]
তিনকড়ি দাসী | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ১৯১৭ |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
নাগরিকত্ব | ভারতীয় |
পেশা | অভিনেত্রী |
পরিচিতির কারণ | লেডি ম্যাকবেথ |
তিনকড়ির জন্ম ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের কলকাতার এক দেহোপজীবিনীর ঘরে। লেখাপড়া তেমন শেখেন নি, কিন্তু থিয়েটারের প্রতি বাল্যাবধি আকর্ষণ ছিল প্রবল। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে স্টার থিয়েটারে গিরিশ ঘোষের বিল্বমঙ্গল নাটকে নির্বাক সখীর ভূমিকায় প্রথম মঞ্চে আসেন। গিরিশচন্দ্র ঘোষ ছিলেন তার শিক্ষক। এরপর বীণা থিয়েটারে মীরাবাঈ নাটকে মীরাবাঈয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে অভিনেত্রী হিসাবে তার প্রথম পরিচিতি তৈরি হয়। সেসময়ে অভিনয় করে কুড়ি টাকা মাহিনা পেতেন। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে খ্যাতির মধ্যগগনে যখন অভিনয় ছাড়েন বিনোদিনী, অল্প সময়ের জন্য যদিও সে স্থান করে নেন কিরণবালা বা প্রমদাসুন্দরী। সুন্দরী, দীর্ঘাঙ্গী, সুগায়িকা তিনকড়িকে প্রাণ ঢেলে তৈরি করে নেন গিরিশ ঘোষই। ক্রমে তিনকড়ি এমারেল্ড থিয়েটার ও সিটি থিয়েটারেও অভিনয় করেন। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনকড়ি গিরিশচন্দ্রের আহ্বানে মিনার্ভা থিয়েটারে আসেন। ইতিমধ্যে তিনি শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ বাংলায় রঙ্গমঞ্চের উপযোগী করে অনুবাদ করেছেন। প্রথমদিকে প্রমদাসুন্দরীকে 'লেডি ম্যাকবেথ' ভূমিকার পাঠ দেওয়া হলেও তিনি সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। এদিকে মহড়াতেই অশিক্ষিত বারাঙ্গনা তিনকড়ি একাগ্রচিত্তে যাবতীয় কলাকৌশল আয়ত্ত করে নিজেকে তৈরি করে নেন। শেষ পর্যন্ত গিরিশ ঘোষ প্রমদাসুন্দরীকে লেডি ম্যাকডাফের ভূমিকায় রেখে তিনকড়িকেই 'লেডি ম্যাকবেথ'-এর ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ দেন।[৩] সাত-আট মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে ছ’নম্বর বিডন স্ট্রিটের মিনার্ভা থিয়েটারে ১৮৯৩ সালের ২৮ জানুয়ারি শনিবার লেডি ম্যাকবেথের ভূমিকায় সেদিন অসাধারণ অভিনয় করে বিখ্যাত হন।[৪] অনেকে তার অভিনয় দেখে, ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অভিনেত্রী মিসেস সারা সিডনসের সঙ্গে তুলনা করেন তার।[৩] এরপর মুকুলমঞ্জুরা নাটকে 'তারা' র ভূমিকায় অভিনয় করে গিরিশচন্দ্রের অভিনন্দন পান - বঙ্গরঙ্গমঞ্চে শ্রীমতী তিনকড়িই এখন সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী। ক্রমে 'জনা', 'করমেতি বাঈ' প্রভৃতি ভূমিকা অভিনয় করে কলকাতার ধনী রসিক মহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেন। দীর্ঘদিন বাংলার রঙ্গমঞ্চের সম্মানিত প্রধান অভিনেত্রী ছিলেন তিনকড়িই। [১]
জীবনের শেষ দিকে বিশ বছর তাঁকে কলকাতার এক ‘বাবু’র রক্ষিতা হতে হয়েছিল। তবে, নিজের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই বাবু তাঁকে যত্নের সঙ্গেই রাখেন। বাবুর আত্মীয়স্বজনরাও তিনকড়িকে বাবুর প্রণয়িনী হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে সেই বাবু তাকে কলকাতার তিনটি বাড়ি দিয়ে যান। তবে তার মধ্যে তৃতীয় বাড়িটি তিনকড়ি দান করে দিয়েছিলেন সেই বাবুর এক পুত্রকে। অন্য দুটি বাড়ি ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে মারা যাওয়ার আগে কলকাতার বড়বাজার হাসপাতালকে উইল করে দিয়ে যান।[১]
২০২৩ খ্রিস্টাব্দের বিশ্ব নাট্য দিবস ও বাংলা রঙ্গমঞ্চের দেড় শত বৎসর পূর্তি উপলক্ষে এক নাট্যোৎসবে দিল্লির বেঙ্গলী অ্যাসোসিয়েশন ঊনবিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় নটী তিনকড়ি দাসীর জীবনী অবলম্বনে লেখা- ‘তিনকড়ি দাসী দ্য লেডি ম্যাকবেথ' মঞ্চস্থ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই যে, গিরিশচন্দ্র ঘোষও তিনকড়িকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন-
“বাংলা রঙ্গালয়ে তোমার যেমন কদর নেই, তেমনি তোমার দোসরও নেই। বাংলার মানুষ তোমাকে চিরটাকাল ‘লেডি ম্যাকবেথ’ হিসেবে চিহ্নিত করবেন।”
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬, পৃষ্ঠা ২৭৩, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
- ↑ ক খ "দিল্লিতে "তিনকড়ি দাসী : দ্য লেডি ম্যাকবেথ" নাটকের সফল মঞ্চায়ন"। ২০২৩-০৪-০৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-১০।
- ↑ ক খ "বিনোদিনীর পরে"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-১০।
- ↑ "লেডি ম্যাকবেথ হন তিনকড়ি দাসী"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-১০।