ডিসমেনোরিয়া

মাসিককালীন ব্যথা

ডিসমেনোরিয়া (ইংরেজি: Dysmenorrhea) হল নারীর মাসিক ঋতুস্রাবের সময় হওয়া যন্ত্রণা যা তার দৈনিক কাজকর্মে বাধা জন্মায়।[১][২]। কিন্তু সাধারণত ঋতুস্রাবের যন্ত্রণাকে ডিসমেনোরিয়া বলা হয়।[৩][৪]

ডিসমেনোরিয়া
বিশেষত্বfamily medicine উইকিউপাত্তে এটি সম্পাদনা করুন
রজচক্রকালে অতিরিক্ত রক্ত ইউটেরাসে জমে থাকা অবস্থা যা ডিসমেনোরিয়ার একটি কারণ

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে চলা সমীক্ষা অনুযায়ী ৫০%-এরও অধিক মহিলার এমন যন্ত্রণা অনুভব হয়৷ ডাক্তারী ভাষায় এই অবস্থাকে বলে ৷ গ্রীক শব্দ "ডিস" মানে হ'ল কষ্টকর, "মেন'" মানে হ'ল মাসিক ও "রিয়া" মানে হ'ল প্রবাহ৷ স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞদের মহিলাদের মধ্যে পাওয়া অসুবিধাসমূহের ভিতর এটি হ'ল প্রধান একটি রোগ৷ ডিসমেনোরিয়া ঋতুস্রাবের কয়েকদিন আগে থেকে হতে পারে বা সাথে হতে পারে এবং সাধারণত ঋতুস্রাব শেষ হওয়ার সাথে সাথে যন্ত্রণাও কমে যায়। কখনও ডিসমেনোরিয়ার সাথে অতিমাত্রায় রক্তস্রাব হয়- এমন অবস্থাকে Menorrhagia বলে।

কোনো অন্য রোগ বা জরায়ুর গঠনের ত্রুটির জন্য হওয়া ডিসমেনোরিয়াক "সেকেন্ডারী ডিসমেনোরিয়া" বলা হয়। অন্য কোনো কারক না থাকলে তাক "প্রাইমারী ডিসমেনোরিয়া" বলা হয়।

লক্ষণ সম্পাদনা

মাসিক ঋতুস্রাব হওয়ার সময় ভুক্তভোগী সকল মহিলাই কম-বেশি পরিমানে তলপেটের যন্ত্রণা অনুভব করে৷ যন্ত্রণা একই জায়গায় থাকতে পারে নতুবা একধার থেকে অন্যধারে হতে পারে৷ যন্ত্রণাটি তলপেট থেকে পিঠের দিকেও যেতে পারে৷ মাসিক আরম্ভ হওয়ার দুই একদিন আগের থেকেই যন্ত্রণা হতে পারে ও মাসিক চলাকালীন দিনগুলিতে যন্ত্রণা অব্যাহত থাকে৷ শতকরা দশ ভাগ মহিলার পেটের যন্ত্রণার ফলে স্কুল,কলেজ বা কাজের ক্ষতি করতে হয়৷ সমীক্ষার এক তথ্য অনুযায়ী প্রতি সাতজন মহিলার ভিতর একজনের পেটের যন্ত্রণা তীব্র হয়৷ আনুষঙ্গিক কিছু লক্ষণ দেখতে পাওয়া যেতে পারে৷ সেইগুলি হ'ল-ওকালি,বমি,মাথার যন্ত্রণা, মাথা ঘোরা,পেটের অসুখ হওয়া বা শৌচ কষা হওয়া, ভাগর লাগা, মানসিক অস্থিরতা হওয়া, তাপ-ধ্বনি-পদার্থের প্রতি অসহিষ্ণুতা বা অতি সংবেদনশীল হওয়া, স্তনযুগলে যন্ত্রণা অনুভব হওয়া ইত্যাদি।

প্রকার সম্পাদনা

ডিসমেনোরিয়া দুই প্রকারের হতে পারে৷ মহিলার স্বাভাবিক জননতন্ত্রে কোনো নির্দিষ্ট কারণ ধরা না পড়লে তা হতে পারে প্রাইমারী ডিসমেনোরিয়া৷ জননতন্ত্রের বিজুতির ফলে যন্ত্রণা হলে সেকেন্ডারি ডিসমেনোরিয়া- যার বিভিন্ন কারণ হতে পারে যেমন এন্ডোমেট্রিয়োসিস, লিয়োমায়মা[৫], এডিনোমাইকোসিস[৬], ইউটেরাইন ফাইব্রয়েড,ওভারিয়ান সিস্ট[৭], গর্ভাশয়ের ভিতর লাগানো গর্ভ নিরোধক সামগ্রী[৮][৯] ইত্যাদি ৷

এন্ডোমেট্রিয়োসিস রোগ সেকেন্ডারি ডিসমেনোরিয়ার একটি মুখ্য কারণ৷ এই রোগে জরায়ুর কোষ (এন্ডোমেট্রিয়াল কোষকলা) শরীরের অন্যান্য স্থানে পাওয়া যায়৷ যার ফলে রোগীর মাসিকের যন্ত্রণা, অনিয়মিত বা বর্দ্ধিত ঋতুস্রাব, সন্তানহীনতা ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়৷ ২৫র থেকে ৩৫বছর বয়সৃ এই রোগ হতে দেখা যায়৷ পেলভিক পরীক্ষা, ভেজাইনাল আলট্রাসনোগ্রাফি ও পেলভিক লেপ্রোস্কপির সহযোগে রোগ শনাক্ত করা যায়৷ হরমোনের দ্বারা চিকিৎসা ছাড়াও কিছু রোগীকে নিরাময়ের জন্য অপারেশন করতে হয়৷

প্রাইমারী ডিসমেনোরিয়া কম বয়সী মহিলাদের ক্ষেত্রে হয়৷ মেয়েদের প্রথম ঋতু্স্রাব আরম্ভ হওয়াকে ডাক্তরী ভাষাতে Menarche বলে। ঋতু্মতী হওয়ার থেকে কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত কিংবা তার সামান্য ওপরের বয়সেও প্রাইমেরী ডিসমেনোরিয়া হতে পারে৷ বয়স বাড়ার সাথে সাথে কিংবা সন্তান প্রসব করার পর মাসিকের যন্ত্রণা ক্রমশ কমে আসে এমনকি আর নাও হতে পারে৷

অন্যদিকে, সেকেন্ডারি ডিসমেনোরিয়া সাধারণতে ৩০র থেকে ৪৫ বছরের মহিলাদের হতে দেখা যায়৷ একটা সময়ে বহু বছর ধরে নিয়মিত ও যন্ত্রণাবিহীন মাসিক হওয়া মহিলার ক্রমে মাসিকে যন্ত্রণা হতে আরম্ভ করে ও ক্রমে যন্ত্রণা বেশি হতে পারে। সাথে আনুসঙ্গিক কয়েকটি লক্ষণ দেখা দিতে পারে৷ সেইগুলি হ'ল- মাসিক অনিয়মিত হওয়া, রক্তস্রাবের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া , মাসিকের মধ্যে কয়েকবার রক্তস্রাব হওয়া, যোনিদ্বার দিয়ে স্রাব নির্গত হওয়া, যৌন ক্রিয়াতে কষ্ট অনুভব করা ইত্যাদি৷

রোগতত্ব সম্পাদনা

জরায়ুর U ভিতরে প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন এফ-২ আলফা rostald নামক রাসায়নিক পদার্থ গুলির ক্রিয়ার ফলে জরায়ুর ভিতরের লাইনিং ছোট হয়ে যায় গর্ভধারণের জন্য ৷ কিন্তু যতক্ষণ সেইটি হয়ে না ওঠে, ডিম্বকোষ গর্ভস্থ না হওয়ার ফলে ততক্ষণ জরায়ুর মাংসপেশীর সংকোচন হয়, জরায়ুতে রক্ত সঞ্চালন কমে যায় এবং মাসিকের রক্তস্রাবের সাথে যন্ত্রণা হতে শুরু করে৷[১০] যদিও প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিনের নিয়মিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই মহিলাদের ঋতুস্রাব হয় - যন্ত্রণা সেইসব মহিলার হয়, যাদের ক্ষেত্রে এই বিধ রাসায়নিক পদার্থ হয় বেশি পরিমাণে নির্গত হয় নতুবা মহিলার প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিনের প্রতি বেশি সংবেদনশীল(sensitive )হয়৷ মস্তিষ্কের পিটুইটরি গ্রন্থির থেকে ভেসোপ্রসিন নামক হরমোন প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিনের উৎপাদনে ক্রিয়া করে৷ অন্য একটা থিওরি অনুযায়ী জরায়ুর রক্তপ্রবাহ হ্রাস পেলে কয়েকটি এমন পদার্থের উৎপত্তি হয় যার ফলে টাইপ-সি যন্ত্রণার কোষসমূহ সক্রিয় হয়ে উঠে৷ এছাড়াও লিউকোট্রিন Leuti নামক অন্য একধরনের রাসায়নিক তত্ত্বের উৎপত্তির জন্যও ডিসমেনোরিয়া হয় বলে ভাবার কারণ আছে৷ বিশেষত সেইসব মহিলার ক্ষেত্রে যাদের প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন বিরোধী Prostagln-inhiodru উপকারী নয় ৷

ডিসমেনোরিয়াকে প্রভাবিত করার কয়েকটি কারক হ'ল: সময়ের আগে অর্থাৎ কম বয়সে ঋতুস্রাব Menarh আরম্ভ হওয়া; মাসিকের পরিমাণ ও দিন বেশি হওয়া; ধূমপান বা মদের সেবন; মেদবহুলতা; পরিবারের এমন রোগ থাকা, জরায়ু যদি বক্র হয়ে থাকে (Retroverted Uteru); যোনিমুখ যদি বেশি সংকীর্ণ (Narrow Cervical) হয়; মানসিক অস্থিরতা; এছাড়া - শারীরিক শ্রম বিমুখতা ইত্যাদি৷

রোগনির্ণয় সম্পাদনা

রোগের শনাক্তকরণ বিশেষ জটিল নয়। প্রাইমারি ডিসমেনোরিয়ার রোগীকে লক্ষণসমূহ দেখে প্রাথমিক পরীক্ষা করিয়েই রোগ শনাক্ত করা যায়। জননতন্ত্রের পরীক্ষা তখনই করার প্রয়োজন হয়,যদি সেকেন্ডারি ডিসমেনোরিয়া বলে সন্দেহ করার কারণ থাকে৷ সেকেন্ডারি ডিসমেনোরিয়ার জন্য বেশ কয়েকটি পরীক্ষার আবশ্যকতা হতে পারে ৷ সেইগুলি হ'ল তেজের টি সি, ডি এল সি, ই এস আর,হিমোগ্লবিন, ভি ডি আর এল; ভেজাইনাল স্রাব পরীক্ষা; প্রসাব পরীক্ষা; হিষ্ট-সালফিংগোগ্রাম এক্সরে; পেটের আলট্রাসাউন্ড; এন্ডোমেট্রিয় বায়প্সি; লেপ্রোস্কপিক পরীক্ষা ইত্যাদি৷ চিকিৎসা - সেকেন্ডারি ডিসমেনোরিয়াকের কারণ শনাক্ত হওয়ার পরে অবস্থা অনুযায়ী যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হয়।

প্রাইমারি ডিসমেনোরিয়ার চিকিৎসা সম্পাদনা

  • প্রয়োজনীয় আশ্বাসনে রোগীর মনের ভিতর থেকে ভীতি দূর করা।
  • আহার - কম চর্বিযুক্ত সুষম নিরামিষ আহার বেশি উপযোগী৷
  • সহায়ক ঔষধ - ভিটামিন-ই, বি-কমপ্লেস্ক, অমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড
  • প্রধান ঔষধ - ষ্টেরইড না থাকা প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন বিরোধী NonAnt InflammatoD NI বেশিরভাগ রোগীর কষ্টের উপশম ঘটায়৷ নেপ্রস্কেন, আইব্রুপ্রফেন,কিটোপ্রফেন,মেফেনেমিক এসিড,ডাইক্লফেনেক ইত্যাদি এই শ্রেণীতে পড়ে। এমন ওষুধসমূহ প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিনের উৎপাদনে বাধা দেয়ার ফলে রোগীর যন্ত্রণার উপশম ঘটে৷ সাধারণত এইরকম যে কোনো একধরনের ওষুধ চিকিৎসক সাধারণত তিনটে মাসিক চক্রের জন্য খেতে বলেন ৷ যন্ত্রণা অনুভব হওয়ার সাথে সাথে ওষুধগুলি আরম্ভ করে মাসিক চলতে থাকা দিনকয়টিতে খেতে হয় ৷ চিকিৎসককে না জানিয়ে নিজে ওষুধ আরম্ভ করতে নেই ৷ কখনো ভুলবশত বা বেশি করে এর সেবন করলে এসিডিটি,গেষ্ট্রাইটিস, হেমাটোমেসিস ইত্যাদি হতে পারে৷

কয়েকটি রোগীকে পেরাসিটামল ও এসপিরিন টেবলেটও উপকৃত করতে দেখা গেছে৷ ওরাল কন্ট্রাসেপ্টিভ পিলে ইষ্ট্রজেন ও প্রজেষ্টরন হরমোন মিলিত থাকার ফলে এটি খএলে ডিম্বকোষ থেকে ডিম্ব প্রস্ফুটিত হয় না। যার ফলে রোগী যন্ত্রণা অনুভব করে না ৷ কয়েকটি ডিসমেনোরিয়ার রোগীকে চিকিৎসকরা এমনভাবেই হরমোন দ্বারা চিকিৎসা করেন। অর্থাৎ ওভুলেশন (Ovulation) রোধ করলে মাসিকের যন্ত্রণা হয় না ৷এন্টিলিউকট্রিন ড্রাগস্ যেমন মন্টলুকাস ইত্যাদির বহুল প্রয়োগ ডিসমেনোরিয়াতে এখনো হয়নি।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Patient Education Pamphlet: Dysmenorrhea ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩০ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে By American Congress of Obstetricians and Gynecologists, retrieved January 2011
  2. TheFreeDictionary > dysmenorrhea Citing:
    • Jonas: Mosby's Dictionary of Complementary and Alternative Medicine. Copyright 2005
  3. TheFreeDictionary > dysmenorrhea Citing:
    • Gale Encyclopedia of Medicine. Copyright 2008
    • Dorland's Medical Dictionary for Health Consumers. Copyright 2007
    • The American Heritage Medical Dictionary Copyright 2007
    • Mosby's Medical Dictionary, 8th edition.
    • McGraw-Hill Concise Dictionary of Modern Medicine. Copyright 2002
  4. eMedicine Specialties > Dysmenorrhea Authors: Andre Holder, Laurel D Edmundson, Mert Erogul. Updated: Dec 31, 2009
  5. Hilário SG, Bozzini N, Borsari R, Baracat EC (২০০৮)। "Action of aromatase inhibitor for treatment of uterine leiomyoma in perimenopausal patients"। Fertil. Steril.91 (1): 240–3। ডিওআই:10.1016/j.fertnstert.2007.11.006পিএমআইডি 18249392 
  6. Nabeshima H, Murakami T, Nishimoto M, Sugawara N, Sato N (২০০৮)। "Successful total laparoscopic cystic adenomyomectomy after unsuccessful open surgery using transtrocar ultrasonographic guiding"। J Minim Invasive Gynecol15 (2): 227–30। ডিওআই:10.1016/j.jmig.2007.10.007পিএমআইডি 18312998 
  7. Hacker, Neville F., J. George Moore, and Joseph C. Gambone. Essentials of Obstetrics and Gynecology, 4th ed. Elsevier Saunders, 2004. আইএসবিএন ০-৭২১৬-০১৭৯-০
  8. Hubacher D; Reyes V; Lillo S; ও অন্যান্য (২০০৬)। "Preventing copper intrauterine device removals due to side effects among first-time users: randomized trial to study the effect of prophylactic ibuprofen"Hum. Reprod.21 (6): 1467–72। ডিওআই:10.1093/humrep/del029পিএমআইডি 16484309  অজানা প্যারামিটার |author-separator= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
  9. Johnson BA (২০০৫)। "Insertion and removal of intrauterine devices"। Am Fam Physician71 (1): 95–102। পিএমআইডি 15663031 
  10. Lethaby A, Augood C, Duckitt K, Farquhar C (২০০৭)। Lethaby, Anne, সম্পাদক। "Nonsteroidal anti-inflammatory drugs for heavy menstrual bleeding"। Cochrane Database Syst Rev (4): CD000400। ডিওআই:10.1002/14651858.CD000400.pub2পিএমআইডি 17943741 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা