জীববৈচিত্র্য

প্রাকৃতিক ও পরিবেশভূগোলের পাঠ্য বিষয়

জীববৈচিত্র্য হল পৃথিবীর জীবনের জৈবিক বৈচিত্র্য এবং পরিবর্তনশীলতা এবং অধ্যাপক হ্যামিল্টনের মতে, পৃথিবীর মাটি, জল ও বায়ুতে বসবাসকারী সব উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীবদের মধ্যে যে জিনগত, প্রজাতিগত ও পরিবেশগত (বাস্তুতান্ত্রিক) বৈচিত্র্য দেখা যায় তাকেই জীববৈচিত্র্য বলে।[] মার্কিন জীব বিজ্ঞানী ই.এ.নরসে এবং তার সহযোগীদের সূত্ৰ অনুযায়ী জৈব বৈচিত্ৰ্য হল জল, স্থল সকল জায়গায় সকল পরিবেশে থাকা সকল ধরনের জীব এবং উদ্ভিদের বিচিত্ৰতা। পৃথিবীর ১০ বিলিয়ন ভাগের একভাগ অংশতেই ৫০ মিলিয়ন প্ৰজাতির বিভিন্ন জীব-জন্তু এবং উদ্ভিদের বসবাস৷জীববৈচিত্র্যকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় যেমন – (১) ইউনাইটেড নেশন্‌স এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (UNEP) অনুসারে জীববৈচিত্র্য হল কোনো অঞ্চলের অন্তর্গত সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীর জিনগত, প্রজাতিগত ও বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্নতা। (২) সি জে ব্যারো-র (C J Barrow) মতে জীববৈচিত্র্য হল একটি অঞ্চলের অর্থাৎ একটি বাস্তুতন্ত্রের অন্তর্গত বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে বৈচিত্র্য। এমনকি একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির জিনগত বৈচিত্র্যও জীববৈচিত্র্যের অন্তর্গত। অর্থাৎ কোনো একটি অঞ্চলের অন্তর্গত প্রাকৃতিক বাসস্থান বা হ্যাবিট্যাট এবং ওই বাসস্থানে বসবাসকারী সমস্ত প্রাণী, উদ্ভিদ ও অণুজীবের প্রজাতি এবং তাদের জিনগত বৈচিত্র্যের সমাহারকে এককথায় জীববৈচিত্র্য বা বায়োডাইভার্সিটি বলে।

২০০৮ সালের গ্রীষ্মকালে লরঞ্জের কাছে উত্তরাঞ্চলীয় সাসকাচোয়ান মিশ্র জঙ্গলে সংগ্রহ করা ছত্রাকের নমুনা, যা ছত্রাকের প্রজাতির বৈচিত্র্যের একটি উদাহরণ। এই ছবিতে, পাতার লাইকেন এবং মসও রয়েছে।

নামকরণ এবং ব্যুৎপত্তি

সম্পাদনা

১৯৬৮ সালে “বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি” (Biological diversity) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন বন্যপ্রাণী বিজ্ঞানী ও সংরক্ষণবিদ রেমন্ড এফ ডাসমান (Raymond F Dasmann)।

"বায়োডাইভার্সিটি” (Biodiversity) কথাটি সর্বপ্রথম ১৯৮৫ সালে ডাব্লিউ জি রোজেন (W G Rosen) ও পরে ১৯৮৮ সালে ব্যবহার করেন পতঙ্গবিদ ই ও উইলসন (EO Wilson)।



জীববৈচিত্র্যের শ্রেণিবিভাগ

জিনগত বৈচিত্র্য

সম্পাদনা

জিনগত বৈচিত্র্য

) একটি প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির মধ্যে প্রাপ্ত জিনের সব রকমের পার্থক্য। জিনগত তারতম্যকে জেনেটিক ভেরিয়েবিলিটি (Genetic variability) বলা হয়। মিউটেশন (mutation) বা পরিব্যক্তি জিনের প্রবাহ ও জিনগত বৈচিত্র্য ঘটায়। উদাহরণ- Rauwolfia vomitoria উদ্ভিদের রোগ নিরাময়ের জন্য বন্য প্রজাতির রোগ প্রতিরোধী জিনগুলি প্রতিস্থাপন করে “ট্রান্সজেনিক ভ্যারাইটি”-এর উদ্ভিদ তৈরি করা হয়। যেমন- বন্য ধান (Oryza nivara)-র রোগ প্রতিরোধী জিন প্রতিস্তাপন করে ট্রান্সজেনিক ভ্যারাইটির ধান সৃষ্টি করা হয়েছে। এটি চার ধরনের ধানের রোগকে প্রতিহত করে।

প্রজাতিগত বৈচিত্র্য

সম্পাদনা

কোনো বাস্তুতন্ত্রে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীবের উপস্থিতিকে প্রজাতিগত জীববৈচিত্র বা স্পিসিজ ডাইভার্সিটি (Species diversity) বলে। এই বৈচিত্র্য থেকে প্রজাতির সংখ্যা, শ্রেণি, বর্ণ, ছে জানা যায়। নিরক্ষীয় বৃষ্টি অরণ্য বাস্তুতন্ত্রে প্রজাতিগত বৈচিত্র্য বা স্পিসিজ ডাইভার্সিটি সবচেয়ে বেশি। একটি স্থানে অবস্থানকারী বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে যে বৈচিত্র্যতা লক্ষ করা যায় তাকে প্রজাতিগত জীববৈচিত্র্য বলে। এই ধরনের বিভিন্নতা একটা প্ৰজাতির অথবা বিভিন্ন প্ৰজাতির অন্তৰ্গত সদস্য সমূহের মধ্যে দেখা যায়৷ বিজ্ঞানী এড‌ওয়ার্ড উইলসনের (১৯৯২) মতে বিশ্বে ১০ মিলিয়নের থেকে ৫০ মিলিয়ন জীবিত প্ৰজাতি আছে৷ তবে কেবল ১.৫ মিলিয়ন জীবিত প্ৰজাতির এবং ৩,০০,০০০ জীবাষ্ম প্ৰজাতি আবিষ্কার করে নামকরণ করা হয়েছে৷ ইতোমধ্যে বহু প্ৰজাতির প্ৰকৃতির সাথে ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারায় বিলুপ্তি ঘটেছে৷ প্ৰজাতি বৈচিত্ৰতা নিৰ্ণয় করার জন্য দুটা সূচক ব্যবহার করা হয় - শেন'ন উইনার সূচক এবং সিম্পসন সূচক।

বাস্তুতান্ত্রিক জীববৈচিত্র্য

সম্পাদনা

একটি বিরাট অঞ্চল জুড়ে বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের প্রকারভেদকে বাস্তুতান্ত্রিক জীববৈচিত্র্য বা ইকোসিস্টেম ডাইভার্সিটি (Ecosystem diversity) বলে। বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে জিনগত বৈচিত্র্য এবং প্রজাতিগত বৈচিত্রের কারণেও বাস্তুতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য ঘটে। প্রাকৃতিক পরিবেশে ভূমিরূপ, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা এবং শক্তিপ্রবাহ আলাদা হয় বলে বাস্তুতান্ত্রিক জীববৈচিত্র্য ঘটা সম্ভব হয়।

হুইটেকার (Whittaker) [১৯৭২]-এর মত অনুসারে বাস্তুতান্ত্রিক জীববৈচিত্র্য নির্ধারণের তিনটি সূচক আছে। যেমন- (১) আলফা বৈচিত্র্য, (২) বিটা বৈচিত্র্য, (৩) গামা বৈচিত্র্য।

আলফা বৈচিত্র্য

একটি নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক বাসভূমির (habitat) মধ্যে (যেমন বনভূমি) বিভিন্ন প্রজাতি (species)-র গড় জীববৈচিত্র্যকে আলফা বৈচিত্র্য (α-Diversity) বলা হয়।

বিটা বৈচিত্র্য

স্থানীয় জীববৈচিত্র্য (আলফা বৈচিত্র্য) এবং আঞ্চলিক (regional) জীববৈচিত্র্যের অনুপাতকে বিটা বৈচিত্র্য β-Diversity) বলা হয়। এই পদ্ধতিতে এক পরিবেশ থেকে অন্য পরিবেশের প্রজাতির বৈচিত্র্যা সম্পর্কে জানা যায়।

গামা বৈচিত্র্য

যে-কোনো খুব বড়ো ভৌগোলিক অঞ্চলের (যেমন- হিমালয় অঞ্চল) মধ্যে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক বাসভূমির পার্থকের জন্য বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে থাকা জীব প্রজাতির যে সামগ্রিক বৈচিত্র্য তৈরি হয় তাকে গামা বৈচিত্র্য (γ-Diversity) বলা হয়। ভারতের মতো বড়ো দেশের জীববৈচিত্র্য হল গামা বৈচিত্র্য। গামা বৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করে জীববৈচিত্র্য আইন এবং ইকো-ট্যুরিজম (Eco Tourism) গড়ে তোলা হয়।

জীববৈচিত্রের গুরুত্ব

সম্পাদনা

পৃথিবীতে জীববৈচিত্র্য আছে বলে পরিবেশে শক্তি প্রবাহ ঘটে। খাদ্য-খাদক সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রাণী ও কীটপতঙ্গ বেঁচে থাকে। বাস্তুতন্ত্র গতিশীল (dynamic) ও কার্যকর হয়। পরিবেশ রক্ষা ও দুর্যোগ নিবারণের ক্ষেত্রে জীববৈচিত্র্যের কার্যকর প্রভাব আছে যেমন— ম্যানগ্রোভ অরণ্য ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত ও সুনামির প্রভাব থেকে উপকূল অঞ্চলকে অনেকটাই রক্ষা করতে পারে। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ রক্ষা করা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা, আধ্যাত্মিক ও নান্দনিক মূল্যবোধ তৈরি করা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও জীববৈচিত্র্য বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

জীববৈচিত্র্যের অর্থনৈতিক উপযোগিতা আছে। জীববৈচিত্র্য আছে বলে মানুষ খাদ্যের জোগান পায় শিল্পের কাঁচামাল পায়, বিনোদন ও পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে পারে। ওষুধ প্রস্তুত করার জন্য ভেষজ কাঁচামালের জোগান জীববৈচিত্র্যই সুনিশ্চিত করে।

জীববৈচিত্র্য ধ্বংস

সম্পাদনা

জীববৈচিত্র্য নানা কারণে বিনষ্ট হয়, যেমন—

  1. জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য।
  2. ভূমিকম্প, উল্কাপাত, অগ্ন্যুৎপাত, সুনামি, দাবানল, খরা, বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের
  3. অধিক রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের জন্য।
  4. রাস্তা, রেললাইন, ব্রিজ, বাঁধ, জলাধার, খাল নির্মাণ, খনি, অরণ্যনিধন, কৃষিজমির সম্প্রসারণ, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের জন্য।
  5. পরিবেশ দূষণের জন্য।
  6. জীবগোষ্ঠীর প্রাকৃতিক বাসভূমি বা স্বাভাবিক বাসস্থান (habitat) বিনষ্ট হওয়ার জন্য ও অতিরিক্ত শিকার করার জন্য।
  7. বিদেশ বা অন্য কোনো জায়গা থেকে আসা আগন্তুক জীবপ্রজাতির আগ্রাসনের কারণে। উল্লেখ্য যে কচুরিপানা (water hyacinth), ল্যানটানা (lantana), ইউক্যালিপটাস (eucalyptus) প্রভৃতি বিদেশি উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে আগ্রাসী বৈশিষ্ট্য আছে। এরা স্থানীয় উদ্ভিদ প্রজাতিকে নষ্ট করে।

সুরক্ষা ও সংরক্ষণ

সম্পাদনা
রেড ডাটা বুক

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা (International Union for the Conservation Nature. IUCN) বিপন্ন বা লুপ্তপ্রায় জীবপ্রজাতির একটি বিশদ তালিকা প্রকাশ করে। এটি রেড ডাটা বুক (Red Data Book) নামে পরিচিত। ভারতে রেড ডাটা বুক IUCN-এর নিয় অনুযায়ী Zoological Survey of India এবং Botanical Survey of India প্রকাশ করে।

IUCN রেড লিস্ট অনুসারে বর্তমানে প্রায় 1,42,500 টি প্রজাতি বিপন্ন বলা হয়েছে। অবলুপ্তির প্রকার ও গুরুত্বের সাপেক্ষে এদের নয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা -

  1. লুপ্ত (Extinct Ex)
  2. বন্য পরিবেশে লুপ্ত (Extinct in the Wild) [সংকেত EW]
  3. চরম বিপন্ন (Critically Endangered) [সংকেত CR) : যে
  4. বিপন্ন (Endangered) [সংকেত EN]
  5. বিপদাপন্ন (Vulnerable) [সংকেত VUJ]
  6. বিপদের স্বল্প লক্ষণ (Near Threatened) [সংকেত NJ
  7. অনুদ্বিগ্ন প্রজাতি (Least Concern) সংকেত [L.C]
  8. স্বল্প গ্যাত (Data Deficient) [সংকেত DD]
  9. অনির্ধারিত বা অমূল্যায়িত (Not Evaluated) [সংকেত NE]
গ্রিন ডাটা বুক

যে তালিকায় অবিলুপ্তির বিপদ থেকে মুক্ত জীবপ্রজাতিসমূহের উল্লেখ থাকে, তাকে গ্রিন ডাটা বুক (Green Data Books) বলে। ব্ল্যাক ডাটা বুক কাকে বলে ?

ব্ল্যাক ডাটা বুক

যে তালিকায় ক্ষতিকর বা হানিকর জীবপ্রজাতিসমূহের উল্লেখ থাকে, তাকে ব্ল্যাক ডাটা বুক (Black Data Book) বলে।

|

 
সুইস আল্পস (জাতীয় উদ্যান) এ দেবদারু জঙ্গল

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. এইচএসসি জীববিজ্ঞান দ্বিতীয়পত্র | শিরোনাম: জীবের পরিবেশ, বিস্তার ও সংরক্ষণ | লেখক: আবুল হাসান ও অন্যান্য