জিঞ্জিরা গণহত্যা একটি পরিকল্পিত সামরিক গণহত্যা যা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক কালে সংঘটিত করে। ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল শুক্রবার ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত, বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জ উপজেলার জিঞ্জিরা,কালিন্দি ও শুভাড্যা এই তিন ইউনিয়নব্যপী এই গণহত্যাটি সংঘটিত হয়।[]

হত্যাকাণ্ডের বিবরণ

সম্পাদনা

মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক কালে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট এর পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যার পর ঢাকা নগরীর বেঁচে যাওয়া মানুষজন পালানোর স্থান ও প্রথম নিরাপদ আশ্রয়স্থল রূপে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে অবস্থিত জিঞ্জিরার দিকে যাত্রা করে। জিঞ্জিরা ও এর আশেপাশের অঞ্চলগুলো ছিল তখন প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল। তাই সেগুলো আগে থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক চিহ্নিত ছিল। যখন ঢাকা থেকে পালিয়ে সবাই সেখানে একত্রিত হতে থাকে, তখন পাকিস্তানি বাহিনী সেখানে গণহত্যা চালানোর প্রস্তুতি নেয়।[] তারা ১ এপ্রিল মধ্যরাতের পর থেকে অর্থাৎ ২ এপ্রিল ভোর থেকে জিঞ্জিরায় সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে এবং কেরানীগঞ্জকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে।[]

অপারেশন সার্চলাইট পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জাহানজেন আরবাব জিঞ্জিরায় অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বশিরকে। পাকিস্তানরা ঐদিন গভীর রাতেই বুড়িগঙ্গার অন্য পাড়ের মিটফোর্ড হাসপাতাল অধিকার করে এবং চিকিৎসালয় সংলগ্ন পরীবিবির মসজিদের ছাদ থেকে আনুমানিক ৫টায় ফ্লেয়ার ছুড়ে গণহত্যা আরম্ভ করার জন্য সংকেত প্রদান করে।[] ভোরের আগেই গানবোট দিয়ে সেনা নামানো হয় জিঞ্জিরা, কালিন্দী ও শুভাঢ্যা ইউনিয়নে।এরপর প্রথমেই হানাদার সেনারা  জিঞ্জিরা ও বড়িশুর বাজার গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। শুরু হয় ইতিহাসের এক ভয়াল হত্যাযজ্ঞ। এ বিষয়ে ডেইলি স্টার পত্রিকায় ২ এপ্রিল ২০২৩ সংখ্যায় প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকারে কিছু চাক্ষুষ বর্ণণা উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রায় আনুমানিক ভোর সাড়ে ৫ টা থেকে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে একটানা নয় ঘণ্টা চালিয়ে যায় এবং দুপুর ২.৩০ এ হত্যাযজ্ঞ শেষ করে। তারা ঘরবাড়িতে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। মান্দাইল ডাকের সড়কের সামনের পুকুরের পাড়ে পাকিস্তানি বাহিনী ষাট জন লোককে একসাথে একই সারিতে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে।[] এ গণহত্যায় আনুমানিক সহস্র বা তার চেয়ে অধিক সংখ্যক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।[][]

পাকিস্তানি প্রচারযন্ত্রের মিথ্যা সংবাদ প্রচার

সম্পাদনা

জিঞ্জিরা গণহত্যার পরের দিন, অর্থাৎ ৩ এপ্রিল ১৯৭১ পাকিস্তানি প্রচারযন্ত্র জিঞ্জিরা গণহত্যাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য এবং দেশের অন্যান্য মানুষ ও বহির্বিশ্বকে বিভ্রান্ত করার জন্য হত্যার সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে মিথ্যা খবর প্রচার করে। ৩ এপ্রিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সমর্থিত পত্রিকা মর্নিং নিউজের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল এমন,"Action against miscreants at Jinjira" অর্থাৎ "জিঞ্জিরায় দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ"।[]

আর তৎকালীন পিটিভি (পাকিস্তান টেলিভিশন) ঐ দিন ২ এপ্রিল রাতে সংবাদ প্রচার করে, " বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতিকারীদের কঠোর হাতে নির্মূল করা হয়েছে"।[]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. নির্মলেন্দু গুণ (২০০৮)। আত্মকথা ১৯৭১। বাংলা প্রকাশ(পৃ ১৪৭)। isbn 984-300-000-500-9
  2. আত্মকথা ১৯৭১,নির্মলেন্দু গুণ,বাংলা প্রকাশ,২০০৮(পৃ ১৪৭-১৪৯)
  3. স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র,অষ্টম খন্ড(পৃ৩৭৬-৩৭৮)
  4. আত্মকথা ১৯৭১, নির্মলেন্দু গুণ, বাংলা প্রকাশ, ২০০৮ (পৃ ১৭৬-১৭৭)
  5. নির্মলেন্দু গুণ(২০০৮)।আত্মকথা ১৯৭১। বাংলা প্রকাশ(পৃ ১৭৩)। isbn 984-300-000-500-9
  6. দৈনিক বাংলা, ১৩ নভেম্বর ১৯৭২
  7. জাহানারা ইমাম। একাত্তরের দিনগুলি। সন্ধানী প্রকাশনী। আইএসবিএন 984-480-000-5 
  8. নির্মলেন্দু গুণ(২০০৮)।আত্মকথা ১৯৭১। বাংলা প্রকাশ(পৃ ১৮২)। isbn 984-300-000-500-9