চেক

হস্তান্তরযোগ্য দলিল যা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়

চেক (ইংরেজি: Cheque), হল এমন একটি হস্তান্তরযোগ্য দলিল যার মাধ্যমে ব্যাংকের আমানতকারি লিখিত ও শর্তহীনভাবে ব্যাংককে চেকের বাহককে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করে থাকে। যিনি চেক লেখেন তিনি আদেষ্টা বা ড্রয়ার হিসাবে পরিচিত[১]। আদেষ্টা বা ড্রয়ার চেকে মুদ্রার পরিমাণ, তারিখ এবং চেকের প্রাপক সহ বিভিন্ন বিবরণ লিখে তাতে স্বাক্ষর করে ব্যাংকে আদেশ দেয়, এক্ষেত্রে ব্যাংককে আদিষ্ট বা ড্রয়ী বলা হয়। ব্যাংক আদেশ দেয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিবৃত অর্থ পরিশোধ করে। আদেষ্টার অবশ্যই আদিষ্ট ব্যাংকে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে।

একটি স্বাক্ষরিত চেক।

বাংলাদেশে বলবৎ ১৮৮১ সালের হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, (A “Cheque” is a bill of exchange drawn on a specified banker and not expressed to be payable otherwise than on demand.)[২] অর্থাৎ চেক হল এক ধরনের বিনিময় বিল যা কোন নির্দিষ্ট ব্যাংকের উপর কাটা হয় এবং যার অর্থ চাহিবামাত্র পরিশোধ্য।

অর্থাৎ চেক হলো এমন একটি হস্তান্তরযোগ্য দলিল যা প্রস্তুতকারক কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয় এবং এর মাধ্যমে আমাতকারী ব্যাংকে রক্ষিত তার আমাতন থেকে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে অথবা তার আদেশে কোন ব্যক্তিকে বা বাহককে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা প্রদানের জন্য ব্যাংকের প্রতি শর্তহীন লিখিত আদেশ প্রদান করে; যার অর্থ চাহিবা মাত্র পরিশোধ্য[৩]

ইতিহাস সম্পাদনা

 
বার্মিংহাম ব্যাংক চেক (১৮০৫)

অতি প্রাচীন কাল থেকে ব্যাংক ব্যবস্থায় চেকের ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রাচীন ভারতে,২৩০০ বছর আগে মৌর্য সাম্রাজ্যের সময় (খ্রিস্টপূর্ব ৩২১ থেকে ১৮৫ অবধি) ‘আদেশ’ নামে একটি বাণিজ্যিক পত্র বা দলিল ব্যবহৃত হত, যার মাধ্যমে তৃতীয় ব্যক্তিকে অর্থ পরিশোধের জন্য কোন ব্যাংকের প্রতি আদেশ বা অনুরোধ করা হত[৪]

প্রাচীন রোমানরা ২১০০ বছর আগে প্রেস্কিরপশন নামে পরিচিত এক ধরনের চেকের ব্যবহার করত।

৩০০ খ্রীষ্ঠাব্দে, পারস্য অঞ্চলের ব্যাংকগুলি ঋণপত্র জারি করতে শুরু করে। এই চিঠিগুলোকে ছক বলা হয়, যার অর্থ "নথিপত্র" বা "চুক্তি"।[৫] আব্বাসীয় খিলাফত এবং অন্যান্য আরব-শাসিত ভূমিতে পরে ছক, চেক হয়ে ওঠে।[৬]

নবম শতাব্দীতে, এক দেশের একজন বণিক অন্য দেশে তার ব্যাংকে টানা একটি সাক নগদ করতে পারত। পারস্যের কবি ফেরদৌসি সাসানিদ রাজবংশের কথা উল্লেখ করার সময় তার বিখ্যাত বই শাহনামেহতে "চেক" শব্দটি বেশ কয়েকবার ব্যবহার করেছেন। ভেনিসে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে সহজতর করার লক্ষে এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ ও স্বর্ণ বহন করা থেকে বণিকদের মুক্তি দিতে এক ধরনের বিল অব এক্সচেঞ্জ এর প্রচলন করেছিলো। পরবর্তীকালে এটির ব্যবহার ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে [৭]

১৫০০ শতকে ডাচ প্রজাতন্ত্রে এক ধরনের অর্থ ব্যবসায়ীর উদ্ভব ঘটে যারা "ক্যাশিয়ার" নামে পরিচিত ছিল। এরা নির্দিষ্ট ফি এর বিনিময়ে মানুষের অর্থ জমা রাখতো। পরবর্তীতে এরা এক ধরনের লিখিত আদেশের প্রচলন করে যেটি নগদ অর্থের মত কাজ করত। পরবর্তীতে এই লিখিত আদেশের প্রচলন ইংল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

 
বার্কলেস ব্যাঙ্ক চেক (১৯২০)

১৭০০ শতকের দিকে ইংল্যান্ড তাদের নিজেদের দেশের মধ্যে অর্থ আদান প্রদানের জন্য বিনিময় বিল ব্যবহার শুরু করে। এই বিনিময় বিলগুলি অঙ্কিত নোট (Drawn Note) নামে পরিচিত ছিল। এগুলি ছিল হাতে লেখা। ১৭১৭ সালে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড এক ধরনের মুদ্রিত চেকের ব্যবহার শুরু করে যা "চেক পেপার" নামে পরিচিত ছিল[৩]

ধারণা করা হয়, সর্বপ্রথম ১৮১১ সালে স্কটল্যান্ডের বাণিজ্যিক ব্যাংক তাদের অ্যাকাউন্টধারীর জন্য প্রিন্ট করা চেকের প্রচলন করে। ওই চেকগুলির উপর ব্যাংক অ্যাকাউন্টধারীর নাম প্রিন্ট করা থাকতো।

১৮৩০ সালে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ৫০, ১০০ এবং ২০০ পাতা বিশিষ্ট চেক বইয়ের প্রচলন করে[৮]

পরবর্তীতে একে একে সকল দেশর ব্যাংকগুলি তাদের অ্যাকাউন্টধারী বা গ্রাহকদের জন্য চেকের ব্যবহার শুরু করে[৯]

 
ওয়েস্টমিনিস্টার ব্যাংক চেক (১৯৫৬)

চেক এর বৈশিষ্ট্য সম্পাদনা

চেক বা Cheque হলো বিশেষভাবে মুদ্রিত এক ধরনের কাগজ যা ব্যাংক কর্তৃক গ্রাহকের হিসাবের বিপরীতে ইস্যু করা হয়ে থাকে[১০]। চেকের বিশেষ কতকগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে[১১]। চেকের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলি নিন্মরুপঃ

  • লিখিতঃ একটি চেক অবশ্যই লিখিত হতে হবে। কোন ফাঁকা চেক অর্থ পরিশোধের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয় না। একটি চেকে অবশ্যই আমানতকারির  স্বাক্ষর, তারিখ, নির্দিষ্ট প্রাপক এবং টাকার পরিমাণ কথায় ও অংকে লেখা থাকতে হবে। অন্যথায় ব্যাংক অর্থ পরিশোধে বাধ্য নয়।
  • শর্তহীনঃ একটি চেক সর্বদাই একটি শর্তহীন আদেশ বহন করে। শর্তারোপ করলে কোন  চেক অর্থ পরিশোধের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয় না।
  • ব্যাংকের উপর আদেশঃ চেকের মাধ্যমে সর্বদা একটি ব্যাংককে আদেশ দেয়া হয়। ব্যাংক ছাড়া অন্য কারো উপর চেকের মাধ্যমে আদেশ দেয়া যায় না।
  • চাহিবামাত্র পরিশোধযোগ্যঃচেক চাহিবামাত্র পরিশোধযোগ্য একটি হস্তান্তরযোগ্য দলিল। তাই ব্যাংকে উপস্থাপনের সাথে সাথে ব্যাংক চেকের টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য।

এছাড়াও ব্যবহার ভেদে চেকের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।

চেকের পক্ষসমূহ সম্পাদনা

একটি চেকের সাধারণত তিনটি পক্ষ থাকে। পক্ষ তিনটি হচ্ছে-

  1. আদেষ্টা, আমানতকারি বা প্রস্তুতকারক (ড্রয়ার)
  2. আদিষ্ট বা ব্যাংক (ড্রয়ী), এবং
  3. প্রাপক (পেয়ী) অর্থাৎ ব্যাংক যাকে টাকা দিবে সেই ব্যক্তি।

চেকের প্রকারভেদ সম্পাদনা

একটি চেকের মেয়াদ থাকে ৬ মাস বা ১৮০ দিন অর্থাৎ চেকে যে তারিখ থাকে তার থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে ব্যাংকে চেক উপস্থাপন করা যায়[১২]। ১৮০ দিনের পরে চেক উপস্থাপন করা হলে তা অর্থ পরিশোধের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয় না। প্রয়োজন ও ব্যবহার ভেদে চেক বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে[১৩]। নিম্নে কয়েক প্রকার চেকের উল্লেখ করা হলঃ

  1. বাহক চেকঃ যখন চেকে "অথবা বাহককে (or Bearer)" লেখা থাকে তাকে বাহক চেক বলে। বাহক চেক যে কোন ব্যক্তি ব্যাংকে উপস্থাপন করলেই ব্যাংক তাকে টাকা দিতে বাধ্য থাকে। তাই এ ধরনের চেকে ঝুঁকি বেশি।
  2. হুকুম চেকঃ যখন চেক "অথবা বাহককে (or Bearer)" কেটে দেয়া হয়  এবং কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা হয় তখন তাকে হুকুম চেক বলে। এ ধরনের চেকের অর্থ শুধু মাত্র চেকে যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা আছে তাকেই অর্থ পরিশোধ করা হয়।
  3. দাগকাটা চেকঃ যখন চেকের উপর দুটি সমান্তরাল দাগ দেয়া হয় এবং "& CO." or "Account Payee" or "Not Negotiable" লেখা থাকে তখন তাকে দাগকাটা চেক বলে। দাগ কাটা চেক আবার দুই ধরনের হয়, যথা-
    • সাধারণ দাগকাটা চেক ও
    • বিশেষভাবে দাগকাটা চেক-যখন সমান্তরাল দুটি রেখার ভিতরে কোন ব্যাংকের নাম লেখা থাকে তখন তাকে বিশেষভাবে দাগকাটা চেক বলে।
  4. এন্টি ডেটেড চেকঃ চেক যেদিন ব্যাংকে উপস্থাপন করা হয় এবং তারিখ যদি তার পূর্বের হয় তখন তাকে এন্টি ডেট চেক বলে।
  5. পোস্ট ডেটেড চেকঃ চেকে ভবিষ্যতের তারিখ থাকলে তখন তাকে পোস্ট ডেটেড চেক বলে। ব্যাংক এ ধরনের চেকের বিপরীতে তারিখ না আসা পর্যন্ত অর্থ পরিশোধ করে না।
  6. স্টেল বা বাসি চেকঃ কোন চেক যখন উল্লেখিত তারিখের ৬ মাস বা ১৮০ দিন  পরে ব্যাংকে উপস্থাপন করা হয় তখন তাকে স্টেল চেক বলে[১৪]। এ ধরনের চেকের বিপরীতে ব্যাংক কখনো টাকা দেয় না।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "CHEQUE | meaning in the Cambridge English Dictionary"dictionary.cambridge.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-১৪ 
  2. "The Negotiable Instruments Act, 1881 | 6. "Cheque""bdlaws.minlaw.gov.bd। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-১৪ 
  3. "History of the Cheque | Cheque & Credit Clearing Company"www.chequeandcredit.co.uk। ২০২০-০৫-০১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-১৪ 
  4. "Reserve Bank of India - Publications"m.rbi.org.in। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-১৪ 
  5. Ilya Yakubovich. (2012). Journal of the American Oriental Society, 132(1), 116. ডিওআই:10.7817/jameroriesoci.132.1.0116
  6. Glubb, John Bagot (১৯৮৮)। A Short History of the Arab Peoples। Dorset Press। পৃষ্ঠা 105আইএসবিএন 978-0-88029-226-9ওসিএলসি 603697876 
  7. "From the archives: the evolution of the cheque | Barclays"home.barclays (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-১৪ 
  8. "Popularity of cheques wanes" (ইংরেজি ভাষায়)। ২০০২-০৭-২৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-১৪ 
  9. Garner, Bryan A. (১৯৯৫)। A Dictionary of Modern Legal Usage (ইংরেজি ভাষায়)। Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-19-507769-8 
  10. Brignall, Miles (২০০৭-১১-৩০)। "Cheque changes leave consumers in the clear"The Guardian (ইংরেজি ভাষায়)। আইএসএসএন 0261-3077। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-১৪ 
  11. "U.C.C. - ARTICLE 4 - BANK DEPOSITS AND COLLECTIONS (2002)"LII / Legal Information Institute (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-১৪ 
  12. "UK Payments Administration - Cheques and Bankers' Drafts Facts and Figures"web.archive.org। ২০১০-০৬-১৩। Archived from the original on ২০১০-০৬-১৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-১৪ 
  13. "Cheque : Meaning, Characteristics of Cheque, Parties to a Cheque"Banking (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২০-০৩-০২। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-১৪ 
  14. "Types of Cheques and Features , Paisabazaar.com"Compare & Apply Loans & Credit Cards in India- Paisabazaar.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৩-১৪