গ্রীককেন্দ্রিকতা
গ্রীককেন্দ্রিকতা বলতে গ্রীক জাতি এবং গ্রীক সভ্যতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিশ্বদর্শনকে বোঝায়। এই বিশ্বদর্শন অনুমান করে নেয় যে গ্রীকরা বিশ্ব ইতিহাসে ছিল অনন্য এক জাতি এবং গ্রীক সভ্যতাটি মূলত অন্য কোনো সভ্যতার সহায়তা ছাড়াই উদ্ভূত হয়েছে।[১] এই জাতীয় অনুমানকে অবশ্য সাম্প্রতিককালে প্রায়শই প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।[১]
ব্যাখ্যা সম্পাদনা
হাতুন আল-ফাসির মতে, গ্রীককেন্দ্রিকতা হলো ‘ইতিহাসের এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি যা গ্রীক বিশ্বকে সভ্য মহাবিশ্বের কেন্দ্রে স্থাপন করে’।[২] ওয়ের্নার জিগার বর্তমান ইউরোপীয় সংস্কৃতির অগ্রগতিতে গ্রীক প্রভাবের চিত্রায়নে ‘গ্রীককেন্দ্রিকতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।[৩] তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে ইউরোপীয় ইতিহাস সর্বদাই গ্রিসকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া উচিত। কারণ তার মতে, গ্রীসের সাথে পশ্চিমা বিশ্ব ‘শারীরিক ও বৌদ্ধিকভাবে’ অঙ্গীভূত। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ ও অনুপ্রেরণার জন্য ইউরোপের সর্বদাই গ্রীসের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত বলেও তিনি মনে করতেন। যেহেতু তার মতে একমাত্র ‘গ্রীককেন্দ্রিক জগতই’ প্রকৃত ‘আদর্শ’ ধারণ করে এবং যেহেতু ইউরোপের ‘জাগতিক ও আধ্যাত্মিক’ যাত্রা গ্রীসেই শুরু হয়।[৪] নাসোস ভায়েনাসের মতে, গ্রীককেন্দ্রিকতাকে একটি ‘প্রত্যয় হিসেবে দেখা যেতে পারে যা গ্রীক উপাদানটির স্বতন্ত্রতা এবং এর বাইরের সমস্ত কিছুর উপর এর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করার পাশাপাশি সাধারণত এটিকে উচ্চতম মানের স্তরে নিয়ে যায়’।[৫] ভায়েনাস যুক্তি দিয়েছিলেন যে এটি বরং এক ধরনের ঐতিহ্যবাদ যা একটি ‘নিরব গ্রীক ঐতিহ্য’ আবিষ্কারের কথা বলে।[৬]
হেইনরিক ফন স্টাডেন গ্রীককেন্দ্রিকতাকে এক ধরনের ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক সুবিধা’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন যে সুবিধাটি বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদরা প্রায়শই গ্রীক জগত থেকে উঠে আসা বিজ্ঞানকে অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতায় আবির্ভূত ও বিকশিত বিজ্ঞানের উপর প্রদান করেন। তিনি ইউরোপকেন্দ্রিক ঐতিহাসিকদের বিজ্ঞানের এমন এক সংস্করণ গ্রহণ করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন যা গ্রীকদের ‘বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির’ উদ্ভাবনে কৃতিত্ব প্রদান করতে পারে।[৭][৮] এনরিক ডাসেলের মতানুসারে, গ্রীককেন্দ্রিকতার ধারণাটি এই দাবি করে যে গ্রীসই হল পশ্চিমা বিশ্বের সংস্কৃতির উৎস এবং গ্রীক সভ্যতা 'মিশরীয় সভ্যতা এবং ইহুদীদের নিকট কোনোভাবেই ঋণী নয়’।যদিও তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, গ্রীস মধ্যপ্রাচ্যের একটি ‘নির্ভরশীল’ এবং ‘প্রান্তিক পশ্চিমাংশ’ ব্যতীত আর কিছুই ছিল না।[৯]
প্রভাব সম্পাদনা
লিদউইজডে দে জং মনে করেন যে, গ্রীককেন্দ্রিকতা ইউরোপীয় ইতিহাস এবং প্রত্নতাত্ত্বিকতায় গভীরভাবে মিশে আছে।[১০] পিটার গ্রিন যুক্তি দিয়েছেন যে, এটি গ্রীক এবং তরুণ ম্যাসেডোনিয়ার সংস্পর্শে আসা ‘যে কোনও সভ্যতার সমস্ত অর্জনকে বিকৃত ও হ্রাস করেছে’।[১১] হ্যান লেমারস এর মতে, জর্জ ট্র্যাপেজুনটিয়াসের মতো গ্রীককেন্দ্রিকতার সমর্থনকারীরা মানব সভ্যতার ‘সকল ধরনের অগ্রগতি ও বিনাশের’ জন্য গ্রীকদের কৃতিত্ব দিয়েছেন।[১২] এনরিক ডাসেলের মত অনুযায়ী আধুনিক ইউরোপকেন্দ্রিকতার জন্ম এই গ্রীককেন্দ্রিকতা থেকে।[১৩][১৪] মার্কাস উইঙ্কলারও বর্ণবাদ এবং উপনিবেশবাদের মূল কারণ হিসেবে ইউরোপকেন্দ্রিক বিশ্বদর্শনকে দায়ী করেছেন যা মূলত প্রাচীন গ্রীককেন্দ্রিকতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।[১৫] কাং জং ইন এবং ইওম কোয়ানইওং গ্রীককেন্দ্রিকতাকে ‘পাশ্চাত্যকেন্দ্রিকতার’ প্রত্নতাত্ত্বিক রূপ বলে চিহ্নিত করেছেন যা গ্রীক সভ্যতাকে তার ‘বৌদ্ধিক উৎস’ হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং এ ধারণাকে সর্বজনীন হিসেবে উপস্থাপন করেছে।[১৬] একইভাবে, সাবেলো গাতসেনি যুক্তি দিয়েছেন যে, গ্রীককেন্দ্রিকতা ভিন্ন সভ্যতায় লালিত মূল্যবোধকে নিঃশেষ করে 'অন্যান্য দেশের উপর ইউরোপ-উত্তর আমেরিকাকেন্দ্রিক মূল্যবোধ চাপিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া হিসাবে’ ‘পাশ্চাত্যায়নের’ পথ প্রশস্ত করেছে।[১৩]
আরও দেখুন সম্পাদনা
তথ্যসূত্র সম্পাদনা
- ↑ ক খ Rollinger, Robert (২০০৮)। "The Eastern Mediterranean and Beyond: the Relations between the World of the 'Greek' and 'Non-Greek' Civilizations"। Kinzl, Konrad H.। A Companion to the Classical Greek World। Wiley-Blackwell। পৃষ্ঠা 197। আইএসবিএন 9781444334128।
- ↑ al-Fassi, Hatoon (২০০৭)। Women in pre-Islamic Arabia: Nabataea। Archaeopress। পৃষ্ঠা 3। আইএসবিএন 9781407300955।
- ↑ Borody, W. A. (১০–১৫ আগস্ট ১৯৯৮)। "Classical Greek Philosophical Paideia in Light of the Postmodern Occidentalism of Jacques Derrida"। The Paideia Archive: Twentieth World Congress of Philosophy। The Paideia Archive: Twentieth World Congress of Philosophy। পৃষ্ঠা 7–13। আইএসবিএন 9781634350518। ডিওআই:10.5840/wcp20-paideia199820361। সংগ্রহের তারিখ ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯।
- ↑ Werner, Jaeger (১৯৪৫)। Paideia: The Ideals of Greek Culture: Volume I: Archaic Greece: The Mind of Athens। Oxford University Press। পৃষ্ঠা xv, xvii। আইএসবিএন 9780195004250।
- ↑ Vayenas, Nasos (১৯৯৭)। "Hellenocentrism and the Literary Generation of the Thirties"। Tziovas, Dimitris। Greek Modernism and Beyond: Essays in Honor of Peter Bien। Rowman & Littlefield। পৃষ্ঠা 45। আইএসবিএন 9780847685776।
- ↑ Kourdis, Evangelos (২০১৬)। "The Velopoulos-Liakopoulos Phenomenon. Α Semiotic View of the Explosion of Greek Conspiracy Theories and Urban Legends in the Economic Crisis"। Lexia. Rivista di Semiotica (23–24): 233।
- ↑ von Staden, Heinrich (১৯৯২)। "Affinities and Elisions: Helen and Hellenocentrism"। ISIS। 83 (4): 578–595। জেস্টোর 234259। ডিওআই:10.1086/356290।
- ↑ Beasley, Caitlin। "hellenocentrism"। Quillets and Quackery (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১২-২৭।
- ↑ Dussel, Enrique (২০০৭)। Ethics of Liberation: In the Age of Globalization and Exclusion। Duke University Press। পৃষ্ঠা 260। আইএসবিএন 9780822352129।
- ↑ De Jong, Lidewijde। Becoming a Roman province: an analysis of funerary practices in Roman Syria in the context of empire (Ph.D.)। Stanford University। পৃষ্ঠা 22। সংগ্রহের তারিখ ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯।
- ↑ Green, Peter (২০১৩)। "Against Hellenocentrism"। London Review of Books। 35 (15): 41–42। আইএসএসএন 0260-9592।
- ↑ Lamers, Han (২০১৫)। Greece Reinvented: Transformations of Byzantine Hellenism in Renaissance Italy। Brill। পৃষ্ঠা 165। আইএসবিএন 9789004303799।
- ↑ ক খ Ndlovu-Gatsheni, Sabelo J. (২০১৬)। The Decolonial Mandela: Peace, Justice and the Politics of Life। Berghahn Books। পৃষ্ঠা 38। আইএসবিএন 9781785331190।
- ↑ Ndlovu-Gatsheni, Sabelo J. (২০১৮)। "Racism and Blackism on a World Scale"। Rutazibwa, Olivia U.; Shilliam, Robbie। Routledge Handbook of Postcolonial Politics। Routledge। পৃষ্ঠা 75। আইএসবিএন 9781317369394।
- ↑ Sammons, Jeffrey L. (২০১১)। "Von Iphigenie zu Medea. Semantik und Dramaturgie des Barbarischen bei Goethe und Grillparzer (review)"। Goethe Yearbook। 18 (1): 306–307। আইএসএসএন 1940-9087। ডিওআই:10.1353/gyr.2011.0485।
- ↑ Jung In, Kang; Kwanyong, Eom (২০০৩)। "Comparative Analysis of Eastern and Western Tyranny: Focusing on Aristotle and Mencius"। Korea Journal। 43 (4): 117। ২৪ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ মার্চ ২০২০।