একটি গ্রিড সেল হল এক ধরনের নিউরন যার একাধিক ফায়ারিং সংকেত একটি পর্যায়ক্রমিক ত্রিভুজাকার বিন্যাসকে সংজ্ঞায়িত করে যা একটি উন্মুক্ত দ্বি-মাত্রিক পরিবেশের সমগ্র উপলব্ধ পৃষ্ঠকে আবৃত করে। মেট্রিক নেভিগেশনের জন্য গ্রিড সেল গুলো মস্তিষ্কের সমন্বয় ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশ গঠন করে বলে মনে করা হয়।[১] এটি একটি প্রাণীকে খোলা জায়গায় নেভিগেট করে, এটি স্থান, দূরত্ব এবং দিক সম্পর্কে তথ্য সঞ্চয় এবং একীভূত করে দ্বিমাত্রিক জায়গায় তার অবস্থান বুঝতে দেয়।

গ্রিড কোষগুলির তাদের অ্যাকশন পটেনশিয়ালের ফায়ারিং ক্ষেত্রের কেন্দ্রগুলিকে সংযুক্ত করলে একটি ত্রিভুজাকার গ্রিড পাওয়া যায়

ইদুর[২], বানর,বাদুড় এবং মানুষ[৩] সহ অনেক প্রাণীর মধ্যে গ্রিড কোষ পাওয়া গেছে। ২০০৫ সালে এডভার্ড মোসার, মে-ব্রিট মোসার গ্রিড সেল আবিষ্কার করেন। ২০১৪ সালে জন ও কেফি সহ তাদের এই অবদানের জন্য তাদেরকে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়েছিল।

পরীক্ষণ সম্পাদনা

 
এন্টোরহিনাল গ্রিড সেল। কালো লাইন গুলো মূলত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চকোলেটের টুকরাকে সংগ্রহ করতে একটি ইঁদুরের গতিপথকে নির্দেশ করে। নীল বিন্দুগুলি সেই স্থানগুলিকে নির্দেশ করে যেখানে একটি এন্টোরহিনাল গ্রিড সেল অ্যাকশন পটেনশিয়াল (স্পাইক) চালনা করে।

মোজার দম্পতি গবেষণা করে বার করেছেন যে, একটি ইঁদুর যখন চকোলেটের টুকরো খোঁজে, তখন তার মগজে পারিপার্শ্বিকের একটা মানচিত্র তৈরি হয়৷ এডভার্ড ও তাঁর স্ত্রী মাই-ব্রিট মোজার বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তা প্রমাণ করতে পেরেছেন৷ এ বিষয়ে মাই-ব্রিট বলেন: ‘‘এই ইঁদুরগুলো যদি না থাকত আর তারা যদি আমাদের সাথে সহযোগিতা না করত, তাহলে আমরা কোনো তথ্য পেতাম না৷ সেই কারণেই ইঁদুরগুলোর সঙ্গে খেলা ও তাদের খুশি রাখাটা এত গুরুত্বপূ্র্ণ৷ ওরা খুশি না হলে, ওরা ভালো না থাকলে, ওরা আমাদের কার্যকরি তথ্য দিতে পারবে না৷[৪] গ্রিড সেলের ক্রিয়াকলাপ সনাক্ত করার জন্য একটি ইলেকট্রোড যা নিউরনের কার্যকলাপ রেকর্ড করতে পারে তা ইদুরের ডরসোমিডিয়াল এন্টোরহিনাল কর্টেক্সে বসানো হয় এবং ইঁদুরটিকে একটি খোলা অঙ্গনে অবাধে চলাফেরা করার সময় নিউরনের কার্যকলাপের রেকর্ডিং সংগ্রহ করা হয়।[৫]

প্রতিবার যখন নিউরনগুলো একটি অ্যাকশন পটেনশিয়াল চালনা করে তখনই পরিপাশ্বের সাপেক্ষে মানচিত্রে ইঁদুরের অবস্থান চিহ্নিত করে ফলাফলের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ফলাফল থকে প্রাপ্ত চিহ্নগুলি সময়ের সাথে একত্রিত হয়ে ছোট গুচ্ছগুলির একটি সেট তৈরি করে, যা্র ফলস্বরূপ সমবাহু ত্রিভুজের মত একটি প্যাটার্ন তৈরি করে। নিয়মিত ত্রিভুজ প্যাটার্ন অন্যান্য ধরনের কোষ থেকে গ্রিড কোষকে আলাদা করে যা স্থানিক ফায়ারিং সংকেতকে ইঙ্গিত করে।[৫]

ইতিহাস সম্পাদনা

আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী এডোয়ার্ড টলম্যান ১৯৪৮ সালে ফিজিওলজিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত তাঁর 'কগনিটিভ ম্যাপ্‌স ইন র‍্যাট্‌স অ্যান্ড ম্যান' শিরোনামের গবেষণাপত্রে প্রাণী কীভাবে পথ চেনে তার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন। তিনি দেখান যে প্রাণিরা স্থান ও ঘটনার সমন্বয় ঘটিয়ে পরিবেশের চিত্র মনে রাখতে পারে। ক্রমঘটমান ঘটনা ও ক্রম-অগ্রসরমান অবস্থানের সমন্বয়ে প্রাণির মগজের মধ্যে ক্রমান্বয়ে একটা সামগ্রিক মানসিক ম্যাপ তৈরি হয়। ওই মানসিক ম্যাপ দেখেই প্রাণিরা পথ চেনে। টলম্যানের তত্ত্ব পথ চেনার প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটা বৈজ্ঞানিক ধারণা দেয় ঠিকই, কিন্তু মগজের ঠিক কোন্‌ জায়গায় এবং ঠিক কী প্রক্রিয়ায় এই মানসিক ম্যাপ তৈরি হয় সে সম্পর্কে কোন ধারণা দেয় না। পরবর্তী বিশ বছর ধরে অনেক বিজ্ঞানীই অনেক রকমের গবেষণা করেছেন এ ব্যাপারে। কিন্তু ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তেমন সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। ১৯৭১ সালে বিজ্ঞানী জন ও'কিফ প্রাণির মস্তিষ্কে প্লেইস সেল বা স্থানিক কোষ আবিষ্কার করে প্রাণির পথ চেনার পদ্ধতি সম্পর্কিত গবেষণায় নতুন পথের সন্ধান দেন।[৬]

জন ও'কিফ এবং প্লেইস সেল

 
John O'Keefe (neuroscientist) 2014 (cropped)

ইঁদুরের হিপোক্যাম্পাস নিয়ে গবেষণা শুরু করেন ও'কিফ। ১৯৭১ সালে, জন ও'কিফ এবং জোনাথন ডস্ট্রোভস্কি ইঁদুরের হিপ্পোক্যাম্পাসে প্লেইস সেলের আবিষ্কারের করেছিলেন।[৭] এই কোষগুলি অ্যাকশন পটেনশিয়ালকে চালনা করে যখন একটি প্রাণী উন্মুক্ত স্থানের একটি নির্দিষ্ট ছোট অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যায়। ইঁদুরের হিপোক্যাম্পাসের পরিবর্তন ঘটিয়ে (আস্তে আস্তে কিছুটা করে কেটে নিয়ে) তিনি ইঁদুরের ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি দেখেন হিপোক্যাম্পাসের ক্ষতি হলে ইঁদুর আর জায়গা চিনতে পারছে না। নতুন জায়গায় গেলে ইঁদুরের যে উত্তেজনা বাড়ে তা হিপোক্যাম্পাসের অনুপস্থিতিতে কমে যায়। অনেক পরীক্ষা করে ও'কিফ দেখেন যে হিপোক্যাম্পাসের কিছু কোষ শুধুমাত্র প্লেইস বা জায়গার পরিবর্তন হলে উত্তেজিত হয়। তিনি এই কোষগুলির নাম দিলেন 'প্লেইস সেল'। প্লেইস সেলগুলো শুধুমাত্র জায়গা পরিবর্তন বা দিক পরিবর্তনের সময় উত্তেজিত হয়। ১৯৭১ সালে তিনি তাঁর ছাত্র জনাথন ডস্ট্রভিস্কির সাথে প্লেইস সেলের ফলাফল প্রকাশ করেন 'ব্রেইন রিসার্চ' জার্নালে। তাঁর পেপার থেকে আমরা জানতে পারি হিপোক্যাম্পাস ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রাণী জায়গা চিনতে পারে না, পথ ভুলে যায়। প্লেইস সেলগুলোর উত্তেজনা জন ও'কিফের আগে আর কেউ পর্যবেক্ষণ করেননি। ও'কিফ আবিষ্কার করলেন যে প্লেইস সেলগুলো শুধুমাত্র পরিচিত পরিবেশে পেলেই উদ্দিপ্ত হচ্ছে, বিভিন্ন প্লেইস সেল মিলে পরিবেশ সম্পর্কে একটা সুনির্দিষ্ট ছক তৈরি হচ্ছে মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসে। তিনি আরো দেখালেন যে হিপোক্যাম্পাসে বিভিন প্লেইস সেলের সমন্বয়ে বিভিন্ন পরিবেশের অসংখ্য মানসিক ম্যাপ সংরক্ষিত থাকতে পারে।[৮]

মে-ব্রিট মোজার ও এডভার্ড মোজার এবং গ্রিড সেল

 
Nobel prize laureates Moser and O'Keefe

মোজার দম্পতি আবিষ্কার করলেন যে হিপোক্যাম্পাসের বাইরে এন্টোরাইনাল কর্টেক্সেও প্লেইস সেলের সিগনাল পাওয়া যায়। তার মানে শুধু মাত্র হিপোক্যাম্পাসের প্লেইস সেলগুলিই যে পরিবেশের স্মৃতি তৈরি করছে তা নয়, এন্টোরাইনাল কর্টেক্সের সেলগুলোর ভূমিকাও আছে সেখানে। তাঁরা দেখলেন ইঁদুরের মগজের এন্টোরাইনাল কর্টেক্স থেকে যে সিগনাল আসছে তা ত্রিভুজের মত প্যাটার্ন তৈরি করছে। বোঝাই যাচ্ছে যে হিপোক্যাম্পাসের প্লেইস সেল ছাড়াও এন্টোরাইনাল কর্টেক্সের এক ধরনের সেলও কাজ করছে যা এই প্যাটার্ন তৈরি করছে। মোজাররা এই সেলের নাম দিলেন গ্রিড সেল। গ্রিড সেল আবিষ্কারের ফলাফল প্রকাশিত হয় ন্যাচার জার্নালে ২০০৫ সালে।[৯]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. http://www.scholarpedia.org/article/Grid_cells#:~:text=A%20grid%20cell%20is%20a,coordinate%20system%20for%20metric%20navigation.
  2. Hafting, Torkel; Fyhn, Marianne; Molden, Sturla; Moser, May-Britt; Moser, Edvard I. (13 আগস্ট, 2005)। "Microstructure of a spatial map in the entorhinal cortex"Nature436 (7052): 801–806। ডিওআই:10.1038/nature03721। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ – www.nature.com-এর মাধ্যমে।  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  3. "Direct recordings of grid-like neuronal activity in human spatial navigation - PMC"। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ 
  4. "মগজের গ্রিড সেল আমাদের জিপিএস – DW – 24.02.2015"dw.com। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ 
  5. "What Grid Cells Convey about Rat Location - PMC"। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ 
  6. দেব, প্রদীপ। "মগজে জিপিএস"। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ 
  7. O'Keefe, J.; Dostrovsky, J. (12 নভেম্বর, 1971)। "The hippocampus as a spatial map. Preliminary evidence from unit activity in the freely-moving rat"Brain Research34 (1): 171–175। ডিওআই:10.1016/0006-8993(71)90358-1। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ – ScienceDirect-এর মাধ্যমে।  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)
  8. "মস্তিষ্কের জিপিএস ব্যবস্থা"SAMAKAL। ৭ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ 
  9. Deb, Pradip। "মগজে জিপিএস"। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জানুয়ারি ২০২৩