গালি বা কথ্যভাষায় গাইল হল এক ধরনের ভাষাভিত্তিক শব্দ, শব্দগুচ্ছ বা বাক্যাংশ যা মূলত কটূক্তি এবং যা অন্য কোনো ব্যক্তির নিন্দাবাদ, অপমান বা অভিসম্পাতের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যখন পরস্পরের মধ্যে গালি বিনিময় হয় তখন একে গালিগালাজ বলে উল্লেখ করা হয়। গালির জন্য সাধারণ শব্দ, অকথ্য শব্দ এবং অশ্লীল শব্দ — এই ত্রিবিধ শব্দাবলী ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

কার্টুনকমিক্সে প্রায়শই গালিকে অন্য চিহ্ন দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে ব্যবহার করা হয় (মর্ট ওয়াকার অঙ্কিত কার্টুন)।

কিছু গালি সাধারণভাবে প্রচলিত; আবার কিছু গালি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে প্রচলিত যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলে। একই ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে সংস্কৃতিভেদে গালির উদ্দেশ্য ও ব্যবহার ভিন্ন হতে পারে। গালি যেমন ব্যক্তিকে হেয় করার জন্য প্রয়োগ করা হয়, তেমনি গোষ্ঠীগত অবমাননার উদ্দেশ্যেও গালি প্রদান করা হয়ে থাকে। মানুষ নয় এমন প্রাণী বা বস্তুকেও গালি দেয়া হয়ে থাকে। গালির তীব্রতা বৃদ্ধির জন্য সাধারণ শব্দের পরিবর্তে অশালীন বা অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা।[১][২][৩]

গালি আর অকথ্যভাষা অভিন্ন নয়। উদ্দেশ্যের দিক থেকে গালি একধরনের সমালোচনা যা নির্দোষ থেকে আক্রমণাত্মক হতে পারে। গালমন্দ করে মানুষ নিজের ক্ষোভ করে অন্য দিকে ঘৃণাপ্রকাশেল সুখ লাভ করে থাকে।

ব্যুৎপত্তি সম্পাদনা

ভাষাবিদ ও অভিধানবিদ বেন জিমার বলেন, "ঐতিহাসিক দিক থেকে গালিকে শনাক্ত করা বেশ কঠিন।"[৪] এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন গালি লেখ্যরূপ পাবার অনেক আগে থেকে কথ্যরূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর মধ্যে ঐ শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হতে পারে এবং নতুন শব্দ প্রবেশ করতে পারে। এর ফলে গোটা প্রক্রিয়াই জটিল হয়ে পড়ে।[৪] অশ্লীল শব্দার্থে এর ইংরেজি "প্রোফ্যানিটি", যা লাতিন প্রোফ্যানাস (profanus) থেকে এসেছে, যার অর্থ "মন্দিরের পূর্বে (বাইরে)"।[৫] এখানে প্রো অর্থ বাইরে আর ফ্যানাম অর্থ মন্দির। প্রোফ্যান বলতে পবিত্রতার অভাব বুঝানো হতো, অন্তত ১৪৫০-এর দিকে। গালি শব্দের অন্যতম (এবং কম নেতিবাচক) ইংরেজি স্ল্যাং শব্দের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় ১৭৫৬ সালের দিকে। তখন এই শব্দের অর্থ ছিল "নিম্ন" বা "অসম্মানীয়" লোকের ব্যবহৃত শব্দ। উনবিংশ শতকের গোড়ার দিক থেকে স্ল্যাং আর তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর লোকের ভাষা হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিল না, যদিও এর অর্থগত দিক থেকে ব্যবহার শিক্ষিত বক্তব্যের আওতার বাইরে ছিল।[৬] এই শব্দের ব্যুৎপত্তি নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। জোনাথন গ্রিন বলেন, স্ল্যাং শব্দের অর্থ স্ক্যান্ডিনেভিয় শব্দ "স্লেঙ্গেনাম" থেকে আসার সম্ভাবনা রয়েছে, যে শব্দটি স্লিং (ছুঁড়ে দেয়া) শব্দেরও স্রষ্টা। তিনি বলেন স্ল্যাং ছুঁড়ে দেয়া ভাষার অংশ, নিজের বক্তব্য তুলে ধরার দ্রুত ও সৎ উপায়।"[৭][৮] গ্রিনের মতে প্রাথমিকভাবে গালি ব্যবহৃত হতো অপরাধীদের মধ্যে, তাদের নিজেদের আলোচনা কর্তৃপক্ষের থেকে আড়াল করার জন্য।[৪] বাংলা গালি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত √গাল্ + ই-তু. আ. থেকে।

মনস্তত্ত্ব ও কারণ সম্পাদনা

হাঁটার পথে হোঁচট খেলে বা ব্যথা পেলে অনেক ক্ষেত্রে সহজাত প্রবৃত্তির মত সহজভাবে অশ্লীল শব্দ বা গালি চলে আসে।[১][৩] কখনো কখনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ব্যবহৃত গালি প্রমাণ করে যে বাকিরা ঐ গোষ্ঠীর বাইরে।[৯][৪] ড. এমা বার্ন তার লেখা সোয়ারিং ইজ গুড ফর ইউ শীর্ষক বইয়ে বলেন, গালি হচ্ছে এমন এক ধরনের ভাষা যা আমরা চমকে গেলে বা স্তম্ভিত হলে বা উৎফুল্ল হলে পরে ব্যবহার করি; অথবা মজা করার জন্য বা কারো প্রতি আক্রমণাত্মক হবার জন্যও ব্যবহার করি। তবে এটা এমন একটা সাংস্কৃতিক ব্যাপার যা কেবল একটি জনগোষ্ঠী, ভাষা, সমাজ, দেশ বা ধর্মের মধ্যেই অর্থপূর্ণ হতে পারে।" অনেক সময়েই বিশেষ সংস্কৃতিতে আপাত নিষিদ্ধ বা ট্যাবু জিনিস থেকে গালি সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে প্রাণীর নাম, শারীরিক সমস্যাও গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এর প্রধান লক্ষ্য মানসিক আঘাত সৃষ্টি করা। কিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ড. রিচার্ড স্টিভেন্সের স্ল্যাং ল্যাবরেটরি নামক গবেষণাকেন্দ্রে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় কিছু ক্ষেত্রে গালি দীর্ঘসময় একই যন্ত্রণা সহ্য করতে সহায়ক হয়। এর কারণ গালির সাথে আবেগের সংযোগ থাকে, আর তার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। গালি দেয়ার সময় হৃদপিণ্ডের গতিও বেড়ে যায়। মানসিক চাপের মধ্যে বা মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার সময় গালি দিলে এমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে, যা পূর্বের ব্যথার অনুভূতিকে কিছুটা লাঘব করে দেয়। এই বিশেষ ক্রিয়ার নাম স্ট্রেস-ইন্ডিউউসড অ্যানালজেসিয়া। সংস্কৃতিভেদে গালি অনেক বৈচিত্র্যময় হয়ে থাকে। কখনো পূর্বাপর প্রজন্মকে নির্দেশ করে গালি দেয়া হয়। ম্যান্ডারিন ভাষার কিছু গালি ১৮ প্রজন্মের আগের পূর্বপুরুষকেও সংযুক্ত করে।[৩]

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত দ্য ইউটিলিটি অ্যান্ড ইউবিকুইটি অব ট্যাবু ওয়ার্ডস শীর্ষক গবেষণাপ্রবন্ধে মনোবিদ টিমোথি জে গালি দেয়াটাকে গাড়ির হর্ন বাজানোর সাথে তুলনা করেন। অন্যের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যও গালির ব্যবহার হতে পারে বলে তিনি মতপ্রকাশ করেন, যেন অন্যের চরিত্রের ভিন্নরূপ আবিষ্কার করা যায়। "রাগ, হতাশা, আনন্দ বা বিস্ময়—এমন আবেগের তীব্রতা বোঝানোর জন্য মানুষ এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করে থাকে" বলেও তিনি জানান।[১০][১]

সাহিত্যে গালির ব্যবহার সম্পাদনা

সাহিত্যে বরাবরই গালির ব্যবহার হয়ে আসছে। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তার লেখায় গালির (স্ল্যাং) ব্যবহার করেছেন।[১১]

ভাষাগত লিঙ্গবৈষম্য সম্পাদনা

ভাষাবিদ ও সমাজতাত্ত্বিকেরা ভাষার মাধ্যমে লিঙ্গবৈষম্যের কথা তুলে ধরেন।[১২][১৩] ডিকশনারি অব আমেরিকান স্ল্যাং তৈরির সময় ১৯৭০-এর দশকে ফ্লেক্সনার দেখেন যে "অধিকাংশ মার্কিন গালি তৈরি ও ব্যবহৃত হচ্ছে পুরুষের দ্বারা।"[১৪] কোনো ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে গালি দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় এই গালির মূল বিষয় নারীকেন্দ্রিক হয়ে থাকে।[১৫][১৬] অর্থাৎ সম্মানহানী করা হয় গালি যাকে দেয়া হচ্ছে তার নিকট কোনো নারী স্বজনের (মা/বোন)।[২] মৌখিকভাবে কাউকে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে অশ্লীল শব্দ হিসেবে গালি ব্যবহৃত হলে অনেক সময়েই তা নারীকে অসম্মানজনকভাবে উপস্থাপন করে। এক্ষেত্রে নারীর যৌনতা, যৌনাঙ্গ বা অঙ্গকেন্দ্রিক শব্দের প্রাচুর্য, যৌন ইঙ্গিত, যৌন দাসত্বের তুলনা, বেশ্যাবৃত্তি ইঙ্গিত করার বিষয়গুলো ভাষায় লক্ষণীয়। অনেক গালির কোনো পুরুষবাচক শব্দও নেই। সেক্ষেত্রে ভাষা ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে গালিকে কল্পনা করায় নারীর প্রতি অবমাননার ধারা বৃদ্ধি পায় বলে মনে করা হয়।[১৭][২][১৮] বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইড পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে ৮৮ শতাংশ নারী "পথচারী কর্তৃক আপত্তিকর মন্তব্যের শিকার হন।"[১৮][১৫] নির্যাতনের ক্ষেত্রে বা উত্যক্ত করার সময়ে গালি একটি সাধারণ অস্ত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন ভাষার মাধ্যমে হেয় করার ফলে নারী তার সামাজিক অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত থাকে, আত্মবিশ্বাসের অভাব বোধ করে এবং বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণে অনিচ্ছা দেখা দেয়।[১৮]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. অর্ণব সান্যাল (২ ডিসেম্বর ২০২০)। "আমরা এত গালি দিই কেন"দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ 
  2. গওহার নঈম ওয়ারা (১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১)। "গালিগালাজের শব্দ চয়নের মনস্তত্ত্ব"দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  3. আনন্দ জাগাতিয়া ও ক্যাথি এডওয়ার্ডস (৬ মে ২০২১)। "গালি দিয়ে আমরা এত সুখ পাই কেন?"বিবিসি বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ 
  4. ক্যাথি স্টেইনমেইটজ (১২ ডিসেম্বর ২০১৮)। "Why Slang Is More Revealing Than You May Realize"টাইম। সংগ্রহের তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ 
  5. "PROFANE | Definition of PROFANE by Oxford Dictionary on Lexico.com also meaning of PROFANE"Lexico Dictionaries | English (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২১-০৯-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৯-১৩ 
  6. "Slang"Oxford English Dictionary। Oxford University Press। সংগ্রহের তারিখ ৪ মার্চ ২০১০ 
  7. "Slang"Online Etymological Dictionary। সংগ্রহের তারিখ ৪ মার্চ ২০১০ 
  8. "A Brief History of slang"Films on Demand। Films Media Group। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জানুয়ারি ২০১৫ 
  9. McArthur, Tom। "Exploring languages and cultures: The purpose of slang"ওপেনলার্ন। সংগ্রহের তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ 
  10. Jay, Timothy (১ মার্চ ২০০৯)। "The Utility and Ubiquity of Taboo Words"Perspectives on Psychological Science (ইংরেজি ভাষায়)। 4 (2): 153–161। আইএসএসএন 1745-6916ডিওআই:10.1111/j.1745-6924.2009.01115.x 
  11. শিরলি ডেন্ট (২ ডিসেম্বর ২০০৯)। "Slang does not make literature 'relevant'"দ্য গার্ডিয়ান। সংগ্রহের তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ 
  12. Grossman, Aryn L.; Tucker, Joan S. (১৯৯৭-০৭-০১)। "Gender Differences and Sexism in the Knowledge and Use of Slang"Sex Roles (ইংরেজি ভাষায়)। 37 (1): 101–110। আইএসএসএন 1573-2762ডিওআই:10.1023/A:1025644921272 
  13. de Klerk, Vivian (১৯৯০-০৫-০১)। "Slang: A male domain?"Sex Roles (ইংরেজি ভাষায়)। 22 (9): 589–606। আইএসএসএন 1573-2762ডিওআই:10.1007/BF00288237 
  14. Wentworth, Harold; Flexner, Stuart Berg (১৯৭৪)। Dictionary of American Slang (ইংরেজি ভাষায়)। Crowell। 
  15. নিশাত সুলতানা (১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১)। "শব্দে আর জব্দ না হোক নারী"দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ 
  16. সুমি রেক্সোনা (৫ নভেম্বর ২০২০)। "যৌন সহিংসতায় 'গালি'র ভূমিকা"বাংলা ট্রিবিউন। সংগ্রহের তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  17. নিশাত সুলতানা (২৪ এপ্রিল ২০২১)। "গালির মধ্যেও লুকিয়ে আছে ক্ষমতার রাজনীতি"দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  18. "নারী নির্যাতনের ভিন্ন ধরন, গালি ও তিরস্কারমূলক শব্দ যেভাবে তাদের জব্দ করে"বিবিসি বাংলা। ৬ মার্চ ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১