মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ ভারতে ত্রিপুরার রাজা ছিলেন। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে (১১৭০ ত্রিপুরাব্দে) তিনি সিংহাসন আরোহণ করেন। কৃষ্ণমাণিক্য রাজধানী উদয়পুর থেকে আগরতলায় স্থানান্তর করেন, কুমিল্লায় সতের রত্ন মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাজার আমলে ত্রিপুরার পার্বত্য অংশ ব্রিটিশের করদ রাজ্যে পরিণত হয় এবং ত্রিপুরায় ব্রিটিশ রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। রাজার জমিদারী চাকলা রোশ্‌নাবাদে ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। রামগঙ্গা শর্মা রাজা কৃষ্ণমাণিক্যের রাজত্বকালের ঘটনাবলী নিয়ে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে কৃষ্ণমালা নামে বই রচনা করেন।[১]

কৃষ্ণমাণিক্য
ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা
রাজত্ব১৭৬০
পূর্বসূরিলক্ষ্মণ মাণিক্য
উত্তরসূরিজাহ্নবী দেবী
রাজবংশমাণিক্য রাজবংশ

ইতিহাস সম্পাদনা

ব্রিটিশ ভারতে ত্রিপুরার রাজা ইন্দ্রমাণিক্যের পরলোকগমন ও কৃষ্ণমাণিক্যের শাসনারম্ভের মধ্যে ব্যবধান কাল প্রায় কুড়ি বৎসর। কৃষ্ণমাণিক্য সিংহাসন আরোহণ করেন ১১৭০ ত্রিপুরাব্দের ১লা পৌষ তারিখে। ইতোপূর্বে বিজয়মাণিক্য ও সমসের গাজি উভয়েই ত্রিপুরার অধিপতি ছিলেন। অতঃপর সমসের গাজির পতন হয়। ফলে ত্রিপুরার রাজ্যহারা যুবরাজ কৃষ্ণমণির নির্বাসন শেষ হয়। কৃষ্ণমাণিক্য সদ্গুণান্বিত ছিলেন। তিনি সমসের গাজি কর্তৃক প্রদত্ত ব্রহ্মোত্তর ও অন্য নিষ্কর সম্পত্তিপত্র রহিত না করে মহত্ত্বের পরিচয় দেন।

ব্রিটিশ শাসকের সঙ্গে বিরোধ ও পরাজয় সম্পাদনা

সিংহাসন আরোহণের অল্পকাল পরেই মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্যের সঙ্গে চাকলে রোশনাবাদের রাজস্ব নিয়ে ফৌজদারের বিরোধ শুরু হয়। এ বিরোদ কৃষ্ণমাণিক্যের জন্য বিপদ ডেকে আনে। ফৌজদার মুর্শিদাবাদে নবাবকে কৃষ্ণমাণিক্যের বিরূদ্ধে উস্কে দেন এবং মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্যকে শিক্ষা প্রদানের জন্য সৈন্য প্রার্থনা করেন। মুর্শিদাবাদে নবাবকে বিষয়টি ইংরেজ গভর্নর ভান্সিটার্টের গোচরে আনেন। ইংরেজ গভর্নর ভান্সিটার্ট প্ররোচিত হয়ে কৃষ্ণমাণিক্যের বিরূদ্ধে লড়াইয়ের জন্য চট্টগ্রামের শাসন কর্ত্তাকে নির্দেশ দেন। ১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দে লেফটেনেন্ট মথি সেনাবাহিনী নিয়ে ত্রিপুরায় এসে কৃষ্ণমাণিক্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। ব্রিটিশ সেনাদলের গতিরোধের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণমাণিক্য প্রাচীন কৈলাগড় দুর্গে সাত হাজার সৈন্যসহ যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। তার নিকট প্রয়োজনীয় কামানও ছিল। লেফটেনেন্ট মথি সেনাদলে মাত্র ২০৬ জন সৈন্য ছিল। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক এক সেনাপতি পরাজয় অনিবার্য বলে পাহাড়ে পলায়নে ত্রিপুরার সৈন্যদের প্ররোচিত করেন। ফলে প্রস্তুতি সত্বেও কৃষ্ণমাণিক্য পরাজিত হন ও ব্রিটিশ লিক সাহেব বিজিত ত্রিপুরার রেসিডেণ্ট অধিকর্তা নিযুক্ত হন।

হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার সম্পাদনা

এর কিছুকাল পরে ব্রিটিশ কর্ত্তৃপক্ষ জগৎমাণিক্যের পুত্র বলরামমাণিক্যকে চাকলে রোশনাবাদের অধিপতি করে দেন। এতে কৃষ্ণমাণিক্যের হৃতশক্তি আরও খর্ব্ব হয়ে পড়ে কিন্তু এ ব্যবস্থা দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় নি। বলরামমাণিক্যকে দূর করে কৃষ্ণমাণিক্য আবারও চাকলে রোশনাবাদের অধিকার প্রাপ্ত হলেন। এ জন্য মহারাজাকে কলকাতায় ইংরেজ কর্ত্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাৎ করতে যেতে হয়েছিল। হারিভার সাহেবের সাহায্যে মহারাজা সফলকাম হলেন। এর কিছুকাল মধ্যেই ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী দেশের সর্ব্বময় কর্ত্তৃত্ব লাভ করেন এবং লিক সাহেব (Mr. Ralph Leeke) ত্রিপুরার রেসিডেণ্ট পদে স্থায়ী হন। লিক সাহেব চাকলে রোশনাবাদ শাসন উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের প্রবর্ত্তন করেন। পার্ব্বত্য ত্রিপুরার শাসন মহারাজের হাতে আগের মত থেকে গেল, এই ভাবে সেই সময় থেকে স্বাধীন ত্রিপুরা ও জমিদারী ভিন্ন ভিন্ন ভাবে শাসিত হতে লাগিল। মোগল শাসনের পরিবর্ত্তে ব্রিটিশ শাসন প্রবর্ত্তিত হয়ে গেল।

মৃত্যু সম্পাদনা

সুদীর্ঘ ২৩ বৎসর কাল রাজত্ব ভোগ করে মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য ১৭৮৩ খৃষ্টাব্দে পরলোক গমন করেন।[২]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা