কৃষি রসায়ন

ফলিত রসায়নের কৃষি উপ-শাখা

কৃষি রসায়ন রসায়নশাস্ত্রের একটি শাখা যেখানে শস্য উৎপাদন, সুরক্ষা ও ব্যবহারের সাথে সংশ্লিষ্ট রাসায়নিক গঠন, বিক্রিয়া ও পরিবর্তনগুলি অধ্যয়ন করা হয়, বিশেষ করে মৃত্তিকার স্বাস্থ্য ও উর্বরতা, উদ্ভিদের পুষ্টি ও শস্য সুরক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট রাসায়নিক প্রক্রিয়া ও আন্তঃক্রিয়াগুলি অনুধাবনের উপর জোর দেওয়া হয়।[১] এটি একটি আন্তঃশাস্ত্রীয় বিজ্ঞান যেখানে রসায়নশাস্ত্রের বেশ কিছু শাখা, বিশেষ করে জৈব রসায়ন ও প্রাণরসায়নের নীতি ও পদ্ধতিগুলিকে কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পরিবেশ বিজ্ঞানে প্রয়োগ করা হয়। এতে পুষ্টি উপাদানে ব্যবস্থাপনা, কীটপতঙ্গনাশকের রসায়ন, রাসায়নিক সার ও অন্যান্য পরিবেশগত নিয়ামক কীভাবে শস্যের বৃদ্ধি, ফলন ও পরিবেশগত দীর্ঘস্থায়িত্বের উপর প্রভাব ফেলে, তার উপরে গবেষণা করা হয়। অধিকন্তু, কাঁচামাল থেকে খাদ্য ও পানীয় প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবেশ নজরদারি ও সমস্যা নিরসন, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও পরিবেশের স্বাস্থ্য, ইত্যাদি বিষয়ও এই শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি ট্রাক্টরের মাধ্যমে কৃষিক্ষেতে রাসায়নিক কীটনাশক ছেটানো হচ্ছে। কীটনাশকগুলিকে কৃষি রসায়নের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়।

কৃষি রসায়ন খাদ্য নিরাপত্তা, টেকসই পরিবেশ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। পুষ্টি উপাদান ব্যবস্থাপনার কাম্যতকরণ, কীটনাশকের ব্যবহার ন্যূনতমকরণ, মৃত্তিকার উর্বরতা বৃদ্ধি, ইত্যাদির মাধ্যমে কৃষি রসায়নবিদেরা পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ন্যূনতম রেখে কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখেন। বর্তমানে মৃত্তিকার গুণমান হ্রাস, পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি, কীটনাশক প্রতিরোধ ক্ষমতা, পরিবেশ দূষণ, ইত্যাদি কৃষি রসায়নের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। সূক্ষ্ম কৃষি, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা ও টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনাতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও পন্থা এসব সমস্যা সমাধানে সহায়ক হতে পারে।

কৃষি রসায়নে সাম্প্রতিক অগ্রগতির মধ্যে আছে সূক্ষ্ম কৃষি প্রযুক্তি, জীব-ভিত্তিক সার ও পরিবেশবান্ধব কীটপতঙ্গনাশক নির্মাণ ও উন্নয়ন। ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানোপ্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তির মতো উদীয়মান প্রযুক্তিগুলি প্রয়োগ করে কৃষির জটিল সমস্যাগুলির সমাধান করার দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া পুনরুজ্জীবনমূলক কৃষি চর্চার মাধ্যমে মৃত্তিকা স্বাস্থ্যের উন্নতিসাধন, জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সহনশীলতা অর্জনের মতো ব্যাপারগুলির উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।

কৃষি রসায়নের ব্যবহারিক প্রয়োগের মধ্যে আছে মৃত্তিক পরীক্ষণ, রাসায়নিক সার সূত্রায়ন, শস্য সুরক্ষা কৌশল নির্ণয় এবং পরিবেশ নজরদারি। কৃষি রসায়নবিদেরা কৃষক, কৃষিবিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে বিজ্ঞান-ভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনশীলতা ও দীর্ঘস্থায়িত্ব বাস্তবায়নের কাজ করে থাকেন। তারা কৃষিবিজ্ঞান, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, উদ্ভিদ জীববিজ্ঞান ও শারীরবৃত্ত ও খাদ্য বিজ্ঞানসহ আরও বিভিন্ন শাস্ত্রের সাথে একত্রে কাজ করেন, যাতে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে কৃষিক্ষেত্রের বিভিন্ন বহুমুখী সমস্যা সমাধান করা যায়।

কৃষি রসায়নের ইতিহাসের মূল ব্যক্তিত্বের মধ্যে আছেন ইউস্টুস ফন লিবিগ, যিনি আধুনিক মৃত্তিকা বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন; নরম্যান বরলাউগ, যিনি শস্য সুপ্রজনন ও কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণার মাধ্যমে বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদনে বিপ্লব সাধন করেন। কৃত্রিম রাসায়নিক সার উদ্ভাবন, কীটনাশক রসায়নের সূচনা ও শস্যের উন্নতিসাধনে জৈবপ্রযুক্তির অগ্রগতি, ইত্যাদি কৃষি রসায়নের কিছু মাইলফলক।

কৃষি রসায়নবিদেরা উচ্চশিক্ষায়তনিক গবেষণা ক্ষেত্র, সরকারি কৃষি সংস্থা, উপদেষ্টামূলক কাজ ও কৃষি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলিতে কাজ করেন। এছাড়া তারা মৃত্তিক ও উদ্ভিদ বিজ্ঞান, পরিবেশ সংরক্ষণ, শস্য সুরক্ষা, টেকসই কৃষির বিকাশ, ইত্যাদি ক্ষেত্রেও পেশাদারি কাজ করতে পারেন এবং এভাবে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করে বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে খাদ্য সরবরাহের বৈশ্বিক প্রচেষ্টাতে অবদান রাখতে পারেন।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Scope, Journal of Agricultural Chemistry"