কাস্তিও দে গিরিবাইলে

কাস্তিও দে গিরিবাইলে বা গিরিবাইলের দুর্গ (স্পেনীয় - Castillo de Giribaile; উচ্চারণ - কাস্তিও দে খিরিবাইলে) হল দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত একটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। মুসলমান যুগে নির্মিত এই দুর্গটি স্পেনের খায়েন প্রদেশের ভিলচেস পৌর অঞ্চলের অন্তর্গত গুয়াদালেন নামক স্থানে অবস্থিত। সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৫০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই দুর্গটি মালভূমির একেবারে উত্তর সীমা ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছিল, যাতে তার থেকে সহজেই গুয়াদালিমার নদী, পুরনো ও ঐতিহ্যশালী রাস্তা ভিয়া এরাক্লেয়া (হারকিউলিসের রাস্তা) ও ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থিত শহর কাস্তুলোর উপর নজরদারি করা সম্ভব হয়।[১]

কাস্তিও দে গিরিবাইলে দুর্গের ধ্বংসাবশেষ

ইতিহাসসম্পাদনা

পূর্ববর্তী ইতিহাসসম্পাদনা

গিরিবাইলে বা খিরিবাইলে অঞ্চলে মানুষের বসতিস্থাপনের ইতিহাস যথেষ্ট প্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথামার্ধেই এখানে মানুষের বসতি স্থাপিত হয়। এইসময়ের বেশ কিছু খনি এই এলাকায় খুঁজে পাওয়া গেছে। অন্তত ইবেরীয় যুগ পর্যন্ত এই খনিগুলো চালু ছিল এবং তাদের ভিত্তি করে সেইসময় এখানে একটি বেশ বড় ধরনের জনবসতিই গড়ে উঠেছিল। যতদূর সম্ভব এখানে ওরেতানো উপজাতি বসবাস করত। সেইসময়েই কাস্তুলোলেভান্তের মধ্যবর্তী পথে এর অবস্থানের কারণে রণকৌশলগত দিক থেকে এই এলাকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ ও তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে এই কারণে এখানে ওরেতানোদের বসতি যথেষ্ট শক্তিশালী একটি দুর্গের আকার ধারণ করে। এর বিস্তৃতি ছিল প্রায় ১৮ হেক্টরেরও বেশি।[১][২] বর্তমানে এই সুরক্ষিত বসতির একটি প্রাকারের ধ্বংসাবশেষই মাত্র অবশিষ্ট আছে। বর্তমান দুর্গের ধ্বংসাবশেষের দক্ষিণে এই প্রায় ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার উঁচু প্রাকারটি অবস্থিত ছিল। সম্ভবত অন্যদিকগুলিতে কোনও প্রাকারের অস্তিত্ব সে'সময় প্রয়োজন হয়নি। কারণ, যে উঁচু মালভূমিতে এই বসতি স্থাপিত হয়েছিল, প্রাকৃতিক দিক থেকেই তা ছিল যথেষ্ট সুরক্ষিত।

যাইহোক, প্রথম খ্রিস্টপূর্বাব্দের প্রথমার্ধে এই বসতি পরিত্যক্ত হয়। রোমানদের সাথে যুদ্ধে (সেরটোরীয় যুদ্ধ - খ্রিস্টপূর্ব ৮০ - ৭২ অব্দ) এই স্থান সম্পূর্ণ ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয় এবং অবশিষ্টরা নিকটবর্তী কাস্তুলো শহরের দিকে সরে যায়। গিরিবাইলেতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে যে ছাই'এর স্তর আবিষ্কৃত হয়েছে তা এই শহরের পুড়ে যাওয়ারই সাক্ষ্য বহন করে।

প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে আরও বোঝা যায় যে এই অঞ্চলে (বর্তমান দুর্গ সংলগ্ন বিভিন্ন স্থানে) ভিসিগথদেরও বসতি গড়ে উঠেছিল। তবে তাদের বসতিগুলি ছিল ছোট ছোট এবং কৃষিভিত্তিক। বিভিন্ন দানাশস্যের চাষের পাশাপাশি এখানে গবাদি পশুচারণের চিহ্নও খুঁজে পাওয়া গেছে। এখানকার তৎকালীন বাসিন্দাদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে এখনও যদিও আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে, এটুকু বলা যেতে পারে যে মুসলমান যুগে নির্মিত বর্তমান দুর্গটি একটি পূর্ববর্তী দুর্গের ভিতের উপরই তৈরি। সেই পুরনো দুর্গটি ছিল হিসপানো-ভিসিগথদের হাতেই নির্মিত।

স্পেনে মুসলমান বিজয়ের পর পুরনো ইবেরীয় ও রোমান যুগের বসতি ও দুর্গের উপর এই অঞ্চলে আরও একটি দুর্গ গড়ে ওঠে। এইসময় গিরিবাইলের চারিপাশে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন খামারগুলির সুরক্ষার প্রয়োজনেই এই দুর্গের দরকার হয়ে পড়েছিল।[১][২]

বর্তমান দুর্গসম্পাদনা

দ্বাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে খ্রিস্টীয় বাহিনী মাঞ্চা অভিমুখে অগ্রসর হবার আগে এই অঞ্চলে গিরিবাইলেসহ আরও যেসব দুর্গগুলি ছিল, সেগুলির সবক'টিরই সংস্কার করা হয় ও নতুন করে গড়ে তোলা হয়। মূল লক্ষ্য ছিল স্বাভাবিকভাবেই এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে উপত্যকার বিভিন্ন দিকে প্রসারিত বাণিজ্যপথ ও অন্যান্য পার্বত্য পথগুলির সুরক্ষাবিধান করা। এই পর্যায়েই গিরিবাইলেতে দুর্গটিকে নূতন করে মর্টার ব্যবহার করে নির্মাণ করা হয়। দুর্গটি পুনর্নির্মাণের সময় গিরিবাইলে আলমোহাদ খিলাফতের অধীনে ছিল।

১২২৭ খ্রিস্টাব্দে দুর্গটি আবু মোহাম্মদ কাস্তিয়ার রাজা তৃতীয় ফের্নান্দোর হাতে তুলে দেন। ১২৭৪ সালে ধর্মীয় মিলিশিয়া অর্ডার অফ কালাত্রাভা দুর্গটি অধিকার করার পর কাস্তিয়ার রাজা দশম আলফোনসোর নির্দেশে এটির অধিকার বায়েথা পুর কর্তৃপক্ষের হাতে অর্পণ করা হয়। পরে ১২৯২ সালে রাজা চতুর্থ সাঞ্চোর নির্দেশে গুয়াদালিমারগুয়াদালেন নদীর মধ্যবর্তী ভূভাগসহ দুর্গটি তুলে দেওয়া হয় বায়েথার বিচারক দন খিল বাইলে দে কাব্রেরা (Gil Bayle de Cabrera) -র হাতে। এই খিল বাইলে'র নাম থেকেই বর্তমানে স্থানটির নাম খিরিবাইলে বা গিরিবাইলে।[১][২]

বিবরণসম্পাদনা

 
গিরিবাইলে দুর্গের একটি মিনারের অবশেষ

দুর্গটি কোনও সুসম পরিকল্পনার ভিত্তিতে তৈরি হয়নি। বর্তমানে এর অবশেষ হিসেবে দুটি বর্গাকার মিনারের ভগ্নাবশেষ ও দেওয়ালের কিছু অংশ দেখতে পাওয়া যায়। এগুলি নির্মাণের ক্ষেত্রে পাথর জোড়া লাগানোর জন্য মর্টার ব্যবহৃত হয়েছিল। এর মধ্যে একটি মিনার দৈর্ঘ্যে ৭.৪৫ মিটার ও প্রস্থে ৬.২০ মিটার একটি নিরেট বেদীর উপর নির্মিত। এর মধ্যে তিনটি ঘর রয়েছে। এই বেদীর উপরে আরও একটি পুরনো আমলের ইসলামি শৈলীর মিনারের অস্তিত্বের অবশেষও পরিলক্ষিত হয়। এই দুটি মিনারের মধ্যে দূরত্ব ২ মিটারের মতো। যতদূরসম্ভব, দুর্গের ফটকের পাশে প্রহরার উদ্দেশ্যে এই মিনারগুলি তৈরি হয়েছিল। অন্যদিকে দ্বিতীয় যে মিনারটি এখনও কিছুটা অবশিষ্ট অবস্থায় আছে, তারও নির্মাণশৈলী যথেষ্ট জটিল। এক্ষেত্রেও আরও পুরনো কোনও নির্মাণের উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে। এক্ষেত্রেও মিনারটির তলদেশে একটি ইঁট নির্মিত সুসম বেদীর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়; তার উপরে বর্গাকার মিনারটি উঠে গেছে। এর দেওয়ালগুলি পুরু মর্টার নির্মিত। এছাড়া দুর্গটির মধ্যে কামানের গোলা মজুত রাখার জন্য নির্মিত একটি বেসিনের আকৃতির অংশও এখনও অবশিষ্ট আছে।

সংরক্ষণসম্পাদনা

যদিও ১৯৪৯ সালের ২২ এপ্রিল জারি হওয়া ডিক্রিতে (Declaración genérica ; দেক্লারাথিওন খেনেরিকা) এই দুর্গের ভগ্নাবশেষকে সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে এবং ১৬/১৯৮৫ আইনের দ্বারা এই দুর্গ স্পেনের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য (Patrimonio Histórico Español; পাত্রিমোনিও ইস্তোরিকো এস্পানিওল) হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে, বাস্তবে এর সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে তেমন কোনও উদ্যোগ এখনও পর্যন্ত চোখে পড়ে না। কিছুটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থেকেই এই দুর্গের অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ ধীরে ধীরে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে। তবে ১৯৯৩ সালের ২২ জুন এই দুর্গ স্থাপত্য বিভাগে স্পেনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের (Bien de Interés Cultural) মর্যাদাও লাভ করেছে।[৩]

তথ্যসূত্রসম্পাদনা

  1. Valdecantos Dema, Rodrigo. CASTILLOS DE JAÉN: Descubre el pasado de una tierra fronteriza. আইএসবিএন ৯৭৮৮৪৯৫২৪৪০০০.
  2. Olivares Barragán, Francisco. CASTILLOS DE LA PROVINCIA DE JAÉN. C.S.I.C. Jaén, 1992. ISBN 84-87115-10-1
  3. Ministerio de Cultura, Patrimonio Histórico