কাজির দেউড়ি মীর এহিয়া মাদ্রাসা

কাজির দেউড়ি মীর এহিয়া মাদ্রাসা বা মীর এহিয়া মাদ্রাসা আনু. ১৭৫৪ সালের মধ্যে চট্টগ্রামে নির্মিত একটি মাদ্রাসা। এটি চট্টগ্রামের শিক্ষানুরাগী জনসেবক মীর এহিয়ার ও তার পিতা মীর আব্দুর রশিদের প্রচেষ্টা ও অনুদানে প্রতিষ্ঠিত হয়। মাদ্রাসাটি সেইসময়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইসলামি ও সাধারণ শিক্ষার মানোন্নয়নে উল্লেখযোগ্য হারে অবদান রেখেছিলো। মাদ্রাসাটি ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি আরবি ও ফারসি ভাষা শিক্ষা বিস্তারেও ভূমিকা রেখেছিলো।[১] এটি চট্টগ্রামে মোহসিন ফান্ডের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত নিউস্কিম মাদ্রাসা চালু হওয়া পর্যন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতে পেরেছিলো। মাদ্রাসাটির শ্রেষ্ঠ সময় মীর এহিয়ার আমলে বহু ছাত্রসহ প্রায় ১০০০ ছাত্রের বিনামূল্যে থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনার ব্যয় বহন করতো।

কাজির দেউড়ি মীর এহিয়া মাদ্রাসা
মীর এহিয়া মাদ্রাসা
পৃষ্ঠপোষক
  • মীর এহিয়া ফান্ড
  • দেউড়ির কাজি পরিবার
সক্রিয়১৭৫৪ (1754)–১৯৪৭ (1947)
প্রতিষ্ঠাতাগণ
  • মীর এহিয়া
  • মীর আব্দুর রশিদ
অবস্থান,

ইতিহাস সম্পাদনা

১৮ শতকের শেষ ও ১৯ শতকের শুরুর দিকে এটি চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য একটি মাদ্রাসা ছিলো। এটি চট্টগ্রামের সমাজসেবক পরিবার দেউড়ির কাজি পরিবারের প্রত্যক্ষ অবদানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এই পরিবার ১৪১১ সালে ইরাকের বাগদাগ থেকে চট্টগ্রামে আগমন করে শিক্ষাবিস্তারে আত্ননিয়োগ করেন। ফলস্বরূপ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মীর আবদুল গণির পুত্র মীর আবদুর রশিদ ও পৌত্র মীর এহিয়ার জমিদান, ফান্ড গঠন ও সার্বিক প্রচেষ্টার ফলে মাদ্রাসাটির প্রাথমিক প্রচেষ্টা ও কার্যক্রম শুরু হয়েছিলো।[২]

মীর আব্দুর রশিদের সময় সম্পাদনা

মাদ্রাসা গঠনের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে মীর আব্দুল গণি উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করে চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের পূর্বদিকে নিজ জমিতে বসতবাড়ি, দেউড়ি ও একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এরপরে আব্দুল গণির পুত্র মীর আব্দুর রশিদ এই দেউড়িতে একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। এই মাদ্রাসা-মসজিদ পরিচালনার জন্য মোগল সম্রাট আহমদ শাহর বাহাদুর রাজত্বকালের শেষ সময়ে আনু. ১৭৫৪ সালে ৬০ দ্রোণ নিষ্কর জমি অনুদান দেওয়া হয়।[ক]

আহমদ শাহর বাহাদুর জমি দান করার সময় সীলমোহরের ঘোষণায় উল্লেখ করেছিলো:

মীর এহিয়ার সময় সম্পাদনা

সরকার কর্তৃক জমি লাভের কিছুদিন পর মীর আবদুর রশিদ মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর মীর এহিয়া এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি মাদ্রাসাটি সম্প্রসারণ করেন, তার পিতার জমিদারি থেকে প্রাপ্ত অর্ধেক আয় মাদ্রাসার ব্যয়, পণ্ডিতদের গবেষণা বৃত্তি দান ও গরীব শিক্ষার্থীদের লঙ্গরখানায় (বিনামূল্যে খাবার হোস্টেল) ব্যয় করতেন। এই সময়ে মাদ্রাসাটিতে এক হাজার ছাত্র বিনামূল্যে থাকা-খাওয়া ও ফ্রিতে পড়াশোনার সুযোগ পেতেন।

পরবর্তী সময় সম্পাদনা

মীর এহিয়ার তিন কন্যার মধ্যে হানিফা বিবিকে সন্দ্বীপের এক ইসলাম প্রচারকের বংশধর মোহাম্মদ ফজলের সাথে বিয়ে দেন এবং ফজলকে তার জমিদারি ও মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করেন। ফজলের মৃত্যুর পর তার পুত্র মোখলকুর রহমান এবং মোখলকুরের মৃত্যুর পর পুত্র আহমদুর রহমান মীর এহিয়া এস্টেটের মালিকানা লাভ করেন। ততদিনে মীর এস্টেট তার তিন কন্যার মধ্যে ভাগ হয়ে তুলনামূলক ছোট হয়ে যায়। আহমদুর রহমান পরিচালনার সময় চট্টগ্রামের কালেক্টর মি. হার্ডে নবাবের প্রদত্ত সনদ জাল বলে অজুহাত দিয়ে মীর এহিয়া স্টেট বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেন। এ সময় মীর এহিয়া মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন মামলা চলার পরে ১৮৪৪ সালের ২ মে চট্টগ্রামের তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার মি. স্টেনফোর্থ সনদটিকে বৈধ বলে রায় দেন। এবং সম্পত্তির আয় ও মামলা ব্যয় বাবদ ৯১৫৭ টাকা ডিক্রি প্রদান করেন।

তবে মাদ্রাসা পরিচালনার ব্যয় নিয়ে আহমদুর রহমানের বিরোধ সৃষ্টি হয়। নানা ঘটনার পরিক্রমায় আহমদুর রহমান ডিক্রিপ্রাপ্ত টাকা থেকে ৩০০০ টাকা ও মীর এস্টেট সম্পত্তির আয় থেকে ৩০০ টাকা দিতে রাজি হয়। ১৮৭৬ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে এই ৩৩০০ টাকা চিরস্থায়ী দানপত্র করে মীর এহিয়া ফান্ডের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করা হয়। এই ফান্ডের টাকা থেকে স্কুল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও চট্টগ্রামের মুসলমানদের চাপে পরে সরকার মাদ্রাসা নির্মাণে বাধ্য হয়। ১৮১৭ সালের একটি সরকারি আইন মোতাবেক চট্টগ্রামের কালেক্টর এই মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন।

এরপর বহুদিন মাদ্রাসাটি কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলো। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দিকে যখন চট্টগ্রামে মোহসিন ফান্ডের অর্থায়নে নিউস্কিম মাদ্রাসা স্থাপিত হয়, তখন মীর এহিয়া মাদ্রাসাটি চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। তবে এরপরেও মীর এহিয়া ফান্ড সচল ছিলো। এই ফান্ডের অর্থায়নে শামসুল উলামা কামাল উদ্দিনের উদ্যোগে চট্টগ্রাম মাদ্রাসা ও ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্রদের মাসিক ৪ টাকা হারে ৮টি বৃত্তি প্রদান করা হতো।

আরও দেখুন সম্পাদনা

টীকা সম্পাদনা

  1. তৎকালীন বাংলার নবাব শাহমদ জঙ্গ নওয়াজেশ মোহাম্মদের অংকিত সীলমোহরে উল্লেখ আছে, মোগল সম্রাট আহমদ শাহর রাজত্বের ষষ্ঠ বছর ১১ই রবিউস সানি তারিখে এই জমি প্রদান করা হয়েছিলো।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. চৌধুরী, আব্দুল হক (অক্টোবর ২০০৯)। "মীর এহিয়া মাদ্রাসা"মুক্তযুদ্ধ ই আর্কাইভ। বাংলাবাজার, ঢাকা: গতিধারা (সিকদার আবুল বাশার)। পৃষ্ঠা ২২৩–২২৫। আইএসবিএন ৯৮৪৪৬১৪০১১। সংগ্রহের তারিখ ৫ জুলাই ২০২৩ 
  2. "মীরসরাই উপজেলা, চট্টগ্রাম (ভাষা ও সংষ্কৃতি)"mirsharai.chittagong.gov.bd। সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা: উপজেলা শিল্পকলা একাডেমী, মীরসরাই। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৭-০৬