কাইদু-কুবলাই যুদ্ধ

কাইদু-কুবলাই যুদ্ধ চাগাতাই খানাতের খান কাইদু এবং ইউয়ান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা কুবলাই খান ও কুবলাইয়ের উত্তরসূরি তিমুর খানের মধ্যে সংঘটিত হয়। ১২৬৮ থেকে ১৩০১ সাল পর্যন্ত কয়েক দশক এই সংঘাত চলেছিল। মঙ্গোল গৃহযুদ্ধের পর এই যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় এবং ফলশ্রুতিতে সাম্রাজ্যে ভাঙ্গন ধরে। ১২৯৪ সালে কুবলাই খানের মৃত্যুর সময় নাগাদ মঙ্গোল সাম্রাজ্য চারটি পৃথক খানাতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এগুলি হল: উত্তরপশ্চিমের গোল্ডেন হোর্ড‌, মধ্যভাগের চাগাতাই খানাত, দক্ষিণপশ্চিমের ইলখানাত এবং পূর্বে চীনের ইউয়ান রাজবংশ[১] তিমুর খান পরবর্তীতে পশ্চিমের খানাতসমূহের সাথে শান্তি স্থাপন করলেও ১৩০৪ সালে কাইদুর মৃত্যুর পর চারটি খানাত পৃথকভাবে নিজেদের পরিচালিত করেছে।

কাইদু-কুবলাই যুদ্ধ
মূল যুদ্ধ: মঙ্গোল সাম্রাজ্যের বিভাজন
তারিখ১২৬৮-১৩০১
অবস্থান
ফলাফল অমীমাংসিত
মঙ্গোল সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন
বিবাদমান পক্ষ

চাগাতাই খানাত

গোল্ডেন হোর্ড‌ (১২৮৪ সাল পর্যন্ত কাইদুর মিত্র)

ইউয়ান রাজবংশ

ইলখানাত (কুবলাইয়ের মিত্র)
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
কাইদু
বারাক
দুওয়া
মেনগু-তিমুর
কুবলাই খান
তিমুর খান
আবাগা

ইতিহাস সম্পাদনা

 
মঙ্গোল সাম্রাজ্যের বিভাজন, আনুমানিক ১৩০০ সাল। সবুজ দ্বারা ইউয়ান রাজবংশ, হলুদ দ্বারা গোল্ডেন হোর্ড‌, ধূসর দ্বারা চাগাতাই খানাত এবং বেগুনি দ্বারা ইলখানাত নির্দেশ করা হয়েছে।

মঙ্গোল গৃহযুদ্ধের পর কুবলাই খান কাইদুকে নিজ দরবারে আসার নির্দেশ দেন। কিন্তু কাইদু তা অমান্য করেন। কাইদুর কারণে কুবলাই খানের পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। ১২৬৬ সালে কুবলাই খান চাগাতাই খানাতের মসনদে বসার জন্য গিয়াসউদ্দিন বারাককে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু এরপর তিনি কুবলাই খানকে খাগান হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। প্রথমে গোল্ডের হোর্ডে‌র থেকে তুর্কিস্তানে ইউয়ান বাহিনীকে সামরিক সহায়তা করার ওয়াদা করা হয়েছিল। কাইদু ও বারাক লড়াই করার পর কাইদু বুখারা অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন। কাইদু বারাককে কুবলাই খানের মিত্র ইলখানাতে হামলার জন্য রাজি করান। ১২৬৭ সালের দিকে ইউয়ান রাজবংশ ও ইলখানাতের বিরুদ্ধে গোল্ডেন হোর্ডে‌র মেনগু-তিমুরের সাথে কাইদু ও বারাকের সন্ধি হয়। পরবর্তীতে ১২৭০ সালের ২২ জুলাই হেরাতে একটি যুদ্ধে বারাক ইলখান আবাকার কাছে পরাজিত হন। কাইদুর সাথে সাক্ষাতের জন্য সফরকালে বারাক মারা যান। কাইদু নিজের দুর্বল অবস্থার কারণে বারাকের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। এদিকে চাগাতাই খানাতের শাহজাদা মুবারক শাহ কাইদুর আনুগত্য মেনে নেন। বারাকের ছেলেরা কাইদুর সাথে লড়াই করে পরাজিত হন। অনেক চাগাতাই শাহজাদা ইলখানাতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। চাগাতাইদের শাসনের জন্য কাইদুর প্রাথমিক প্রচেষ্টাসমূহ বেশ বাধার মুখোমুখি হয়েছিল। নেগুবাইসহ কয়েকজন শাহজাদাও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। নেগুবাইকে কাইদু ইতিপূর্বে চাগাতাইয়ের খান নিযুক্ত করেছিলেন। দুওয়াকে খান নিযুক্ত করার পর পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়েছিল। রাশিয়া ভিত্তিক গোল্ডেন হোর্ড‌ও কাইদুর মিত্রে পরিণত হয়।

১২৭৫ সালে কাইদু উরুমকি হামলা করে আত্মসমর্পণ দাবি করেন। কুবলাই খান তাকে বিতাড়নের জন্য সেনা সহায়তা প্রেরণ করেন। কুবলাইয়ের ছেলে নোমুখান ও সেনাপতিরা কাইদুর হামলা প্রতিরোধের জন্য ১২৬৬-৭৬ পর্যন্ত আলমালিক অধিকার করে রেখেছিল। ১২৭৭ সালে মংকে খানের ছেলে শিরেগির নেতৃত্বে কয়েকজন চেঙ্গিস বংশীয় শাহজাদা বিদ্রোহ করে কুবলাই খানের দুই ছেলে ও সেনাপতি আনতোংকে বন্দী করে। বিদ্রোহীরা কাইদুর হাতে আনতংকে এবং মেনগু-তিমুরের হাতে কুবলাইয়ের সন্তানদের সমর্পণ করে। কুবলাই খানের প্রেরিত সেনারা শিরেগির বাহিনীকে আলতাই পর্বতমালার পশ্চিমে বিতাড়িত করে এবং মঙ্গোলিয়া ও শিনজিয়াঙে ইউয়ান আধিপত্য মজবুত করে। তবে কাইদু আলমালিকের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হন।[২] পরবর্তীতে মেনগু-তিমুরের মৃত্যুর পর গোল্ডেন হোর্ড‌ কাইদুর প্রতি তাদের সমর্থন নিয়েছিল। ১২৮৪ সালে গোল্ডেন হোর্ডে‌র তিনজন শাসক নোকাই, তোদেমংকে ও কোনিচি কুবলাই খানের সাথে শান্তি স্থাপন করেন।[৩] এছাড়াও নোকাই ও তোদেমংকে ইলখান আহমেদ তেগুদারের সাথেও শান্তি স্থাপন করেছিলেন।[৪] জোচির পরিবারের কাছ থেকে সামরিক সহায়তার জন্য কাইদু তার নিজ প্রার্থী কোবেককে গোল্ডেন হোর্ডে‌র একাংশের ক্ষমতার জন্য ১২৯০ দশকের শুরু থেকে সমর্থন দিচ্ছিলেন। গোল্ডেন হোর্ডে‌র সাথে কাইদুর বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট কোবেকের কয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছিল।

১২৯৩ সালে কুবলাই খানের একজন কিপচাক সেনাপতি তুতুগ কাইদুর মিত্র বারিয়ান তুমেন দখল করে নেন। পরের বছর কুবলাই খান মারা যান এবং তার ছেলে তিমুর খান তার উত্তরসূরি হন। ১২৯৮ থেকে দুওয়া ইউয়ানদের উপর নিজের হামলা বৃদ্ধি করতে থাকেন। একটি আচমকা হামলায় তিনি মঙ্গোলিয়ায় একটি ইউয়ান সেনা ঘাঁটি আক্রমণ করে তিমুরের জামাতা কোরগুজকে বন্দী করেন।[৫] তবে দুওয়া ইউয়ান বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। দুই পক্ষ বন্দী বিনিময়ের ব্যাপারে একমত হলেও দুওয়া ও কাইদু কোরগুজকে হত্যা করেছিলেন। মঙ্গোলিয়ার ইউয়ান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন করার উদ্দেশ্যে তিমুর কুলুগ খানকে নিযুক্ত করেন। এরপর আলতাই পর্বতমালার দক্ষিণে ইউয়ান বাহিনীর হাতে কাইদু পরাজিত হন। তবে ১৩০০ সালে কাইদুর হাতে কুলুগ খান পরাজিত হন। পরের বছর কারাকোরামে হামলার জন্য কাইদু ও দুওয়া একটি বড় বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। ইউয়ান বাহিনী এতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু কোনো পক্ষই চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে পারেনি। দুওয়া যুদ্ধে আহত হন এবং কাইদু শীঘ্রই মারা যান।

এই সময় পর্যন্ত কুবলাই খান ও তার উত্তরসূরি তিমুর খানের বিরুদ্ধে কাইদু নিরবচ্ছিন্নভাবে ৩০ বছরের বেশি সময় লড়াই করে গেছেন। ১৩০৪ সালে ইউয়ান সম্রাটের সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়ার মাধ্যমে শান্তি স্থাপনের মাধ্যমে হলেও কাইদু-কুবলাই যুদ্ধের ফলে মঙ্গোল সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন আরো প্রকট হয়।

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. The Cambridge History of China: Alien Regimes and Border States. p. 413.
  2. Atwood, Christopher Pratt (২০০৪)। "Qubilai Khan"। Encyclopedia of Mongolia and the Mongol Empire। Facts on File। পৃষ্ঠা 459। 
  3. Thomas Allsen, 1985. The Princes of the Left Hand: an introduction to the history of the Ulus of Orda in the thirteenth and early fourteenth centuries. Archivum Eurasiae Medii Aevi, 5, 5–40.
  4. Judith Pfeifer – “Aḥmad Tegüder’s Second Letter to Qalā’ūn (682/1283).’ In History and Historiography of Post-Mongol Central Asia and the Middle East, edited by Judith Pfeiffer & Sholeh A. Quinn, 167–202. Wiesbaden: Harrassowitz, 2006.
  5. The Cambridge History of China: "Alien regimes and border states, 907–1368", p.502